
ঠোটকাটাকে সাক্ষাত্কার দেয়ার সময় বের করার জন্য ধন্যবাদ. শুরতেই রূপবান নিয়ে প্রশ্ন করতে চাই. আপনাদের উদ্যোগ ও একত্রিত হওয়ার প্রেক্ষাপট সম্পর্কে একটু বলুন
ধন্যবাদ আপনাকেও। ভালোবাসার স্বাধীনতা ও অধিকার বিষয়ে জনসচেতনতা বৃদ্ধির মাধ্যমে প্রেম, যৌনতা ও লিঙ্গ বৈচিত্র্যের সার্বজনীন স্বীকৃতি, গ্রহণযোগ্যতা, ও সমধিকার আদায়ের লক্ষ্যে কাজ করছে রূপবান।
রূপবান নামে কাজ শুরু করার বহু আগেই এর সাথে সংশ্লিষ্ট অনেকে এই বিষয়ে জনসচেতনতামূলক নানা কাজের সাথে জড়িত ছিল, তবে ২০১১-তে প্রথমবারের মত প্রেম ও লিঙ্গ বৈচিত্র্য বিষয়ক একটি প্রকাশনার তাগিদ অনুভব ও তারই বাস্তবায়ন কল্পে ২০১৩-এর জানুয়ারিতে রূপবান নামে একটি ম্যাগাজিন প্রকাশের কাজ হাতে নেয়া হয় (তখন একে মজা করে Roopbaan – the fagazine বলা হত)। প্রায় এক বছর লেগে যায় রূপবানের আত্মপ্রকাশে; কিন্তু ইতমধ্যে নানা ধরনের জনসচেতনতামূলক অনুষ্ঠান আয়োজনের মাধ্যমে রূপবান বাংলাদেশি সমপ্রেমিদের একটি প্ল্যাটফর্মে পরিণত হতে থাকে, যা বেগবান হয় ২০১৪-এর জানুয়ারিতে রূপবান ম্যাগাজিন প্রকাশ ও এপ্রিলে ( পহেলা বৈশাখে) রংধনু যাত্রার পর।
রূপবান স্বীকার করে পৃথিবীর আর দশটি দেশের মত বাংলাদেশেও উল্লেখযোগ্যসংখ্যক (৫-১০%) সমপ্রেমী জনগোষ্ঠী রয়েছে; একই সাথে রয়েছে লিঙ্গ রুপান্তরকামি ও হিজড়া জনগোষ্ঠী। রূপবান বিশ্বাস করে প্রেম, যৌনতা, লিঙ্গ তথা মানব বৈচিত্র্যকে বৃহত্তর সংলাপ এবং জনসচেতনতামূলক কার্যক্রমের মাধ্যমে এই বিষয়ে সামাজিক নেতিবাচক মনোভাব, আক্রমণাত্মক দৃষ্টিভঙ্গি ও আইনি-সামাজিক বাধাবিপত্তি অতিক্রম করা সম্ভব। রাষ্ট্রীয়, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বাধার কারণে কোন ব্যক্তি তার ভালোবাসার অধিকার থেকে বঞ্চিত হবে রূপবান তা মানতে রাজি নয়। তবে আমরা জানি বাংলাদেশে এই বিষয়গুলো অত্যন্ত সংবেদনশীল । এই সংবেদনশীলতার বিষয়টি মাথায় রেখেই রূপবান সাজায় তার কার্যক্রম ও প্রচারনা।
আমরা সম্পূর্ণ সেচ্ছাসেবাভিত্তিক, অরাজনৈতিক, অলাভজনক একটি মঞ্চ। আমাদের মূলমন্ত্র ভালবাসার অধিকার একটি মানবাধিকার।
আপনাদের পহেলা বৈশাখের রংধনু যাত্রার অভিজ্ঞতা একটু বলুন।
আমরা যে খুব organized/formal তা কিন্তু না। যারা অনেক দিন ধরে এক সাথে কাজ করছি, তারা মিলে একত্রিত হয়ে, “চল, এইটা করি, ওইটা বানাই”, এই হল আমাদের হাল। রংধনু যাত্রার শুরুটাও সেভাবে। প্রত্যেক নববর্ষেই তো আমরা শাহাবাগে যাই, মঙ্গল শোভাযাত্রায় সবার সাথে হাঁটি, এইবার কেননা আমরা বিচ্ছিন্নভাবে না হেঁটে এক সাথে হাঁটি; শোভাযাত্রার শেষ ভাগে ভেসে উঠুক একটা রংধনু; যে জানে সে একবার দেখলেই বুঝবে, আর বাদবাকিদের কাছে এ শুধুই রঙ নিয়ে খেলা। ফেসবুকে আয়োজন করে সবাইকে বলা হল রংধনু রঙের যে কোন একটি বেছে নিয়ে সে পোশাকে পহেলা বৈশাখে হাজির হতে। ২০১৪-এর পহেলা বৈশাখে কি নিদারুণ উত্তেজনা, অজানা আশংকা, বাঁধভাঙ্গা আনন্দে প্রায় ১০০জনের অংশগ্রহণে অনুষ্ঠিত হল রংধনু যাত্রা। রূপবানের আয়োজনে হলেও আমরা বরাবর বলে এসেছি বৈশাখের প্রথম দিনে বৈচিত্র্য ও বন্ধুত্ব উৎযাপন ছাড়া আর কোন উদ্দেশ্য নেই এই রংধনু যাত্রার। তার পরও এক অনলাইন নিউজ পোর্টাল (priyo.com) একে বানিয়ে দিল দেশের প্রথম ‘Gay Pride’, আর ব্যাস যায় কই, হামলে পড়ল সবাই দেশ, জাতি ও ধর্ম উদ্ধার কল্পে। ২০১৫-তে তাই ভাবা হয়েছিল কেউই আসবেনা বুঝি । আগের অনেকে আসেনি, কিন্তু নতুন এসেছে অনেকে, এবারের যাত্রা ছিল আগের বারের চেয়েও বেশি জাঁকজমকপূর্ণ।
বিপত্তি বাধল এই যাত্রায় হিজড়াদের অংশগ্রহণ নিয়ে। বাঙ্গালীর সার্বজনীন উৎসবে নারী-পুরুষের পাশাপাশি হিজড়ারাও অংশ নেবে, এটাই স্বাভাবিক, কিন্তু না, হিজড়াদেরকে পুলিশ অত্র এলাকায় ঢুকতেই দেয়না বলতে গেলে, তারা নাকি public nuisance করে। (অথচ পুরুষবেশে যখন যৌননিপীড়করা প্রবেশ করে ও ঘুরে বেড়ায় পুলিশ তাদের কিছুই করতে পারেনা। ) অন্য দিকে, যাত্রায় অংশগ্রহণকারীদের অনেকেই আপত্তি জানাল হিজড়ারা কেন আমাদের সাথে হাঁটবে, লোকে তখন আমাদের হিজড়া বলবে। আমরা বুঝে নিলাম, প্রেমের সমতা বা ভালোবাসার অধিকার চাই আমরা ঠিকই, কিন্তু রূপবানরাও সেই প্রথাগত লিঙ্গ কাঠামোয় বন্দী। হিজড়া বা রুপান্তরকামিদের সাথে আমরা এক কাতারে দাঁড়াতে চাইনা । সেইসাথে এইখানে সামাজিক-অর্থনৈতিক শ্রেণী বিভাজনের বিষয়টাও আছে।
আধুনিক ইতিহাসের একটা বড় সময়কাল ধরে সমকামিতাকে মানসিক রোগ হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে। ১৯৯০ সালের মে মাসের ১৭ তারিখ World Health Organization এই দৃষ্টিভঙ্গির অবসান ঘটানোর প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগ নেয় এবং সমকামিতাকে মানসিক রোগ হিসেবে আর বিবেচনা না করার সিদ্ধান্ত নেয়, সেই থেকে এই দিনটি বিশ্বব্যাপী আন্তর্জাতিক homophobia এবং transphobia বিরোধী দিবস হিসেবে পালিত হয়, বাংলাদেশে কি সমকামিতাকে এখনো মনোরোগ হিসেবে দেখা হয়?
তা তো বটেই। তবে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ বাংলাদেশে এই বিষয়টি মানসিক বিকৃতি বা বেআইনি কাজের চেয়েও ‘মহাপাপ’ হিসেবে বেশি পরিগণিত হয়। সাধারণ জনগণ ‘সমকাম মহাপাপ’ এই ধারনা নিয়েই এর প্রতি তাদের ঘৃণা- বিদ্বেষ ব্যক্ত করে; সুতরাং আপনি যতই WHO-এর বরাত দিয়ে এই ধরনের যৌনপ্রবৃত্তিকে স্বাভাবিক, প্রাকৃতিক বলেন না কেন; বা ‘অনেক দেশে সমকাম আর অপরাধ নয়’ যুক্তি দেন না কেন; তারা ঘুরে ফিরে আপনাকে কোরআনে বর্ণিত লুত জাতির ধ্বংস হয়ে যাওয়া কাহিনী শুনিয়ে আপনাকে চুপ করিয়ে দেবে।
“সমকামভীতির (homophobia) বিরুদ্ধে বাংলাদেশ” নামে আপনাদের মতনই একটি ফেইসবুক গ্রুপ বলেছেন, “সমকামভীতি বাংলাদেশে বৈষম্যমূলক আইন, ঋণাত্মক সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি, সংবাদমাধ্যমে ভুলভাবে উপস্থাপন, স্বাস্থ্যসেবা এবং বিচারব্যবস্থায় প্রবেশে বাধা এবং কর্মক্ষেত্রে নিয়োগে বৈষম্য ইত্যাদি রূপে বিদ্যমান।” এই বক্তব্যের সাথে কি আপনারা একমত? খুব যান্ত্রিক শোনাতে পারে, কিন্তু বাংলাদেশের সমকামভীতির প্রধান কারনটা কি বলে মনে হয় আপনার?
বিষয়টি জটিল। বলা হয়, বিশ্বের যেকোনো দেশে/সমাজে ৫-১০% জনগোষ্ঠী প্রথাগত যৌন প্রবৃত্তি বা লিঙ্গ পরিচয়ের যে কাঠামো তার থেকে ভিন্ন জীবনযাপনে অভস্ত্য, এর মধ্যে সমকামি, উভকামি, অযৌন, আবার লিঙ্গ রুপান্তরকামি ছাড়াও না না ধরনের মানুষ রয়েছে। বাংলাদেশে আমরা যদি নিম্নে ৫%ও ধরি তাহলেও ৮০ লক্ষাধিক, বা প্রতি ২০ জনে ১ জন, ব্যক্তির উপস্থিতি কাম্য; কিন্তু আমরা কি তা দেখি আমাদের চারপাশে তাকালে? কাউকে জিজ্ঞাসা করলে সে তার পরিচিত কয়জন ‘রূপবান’কে চেনেন বলতে পারবেন? অনেকের কাছে হিজড়া জনগোষ্ঠী এই ধরনের জীবনযাত্রার একমাত্র রেফেরেন্স। হিজড়ারাই সুদীর্ঘকাল ধরে এই উপমহাদেশে ভিন্ন লিঙ্গ পরিচয় ও যৌনতা এবং তৎসংশ্লিষ্ট জীবন যাপনের ধারক/বাহক হিসেবে টিকে রয়েছে। তাদের প্রতি রাষ্ট্র ও সমাজের যে বৈষম্যমূলক আচরণ, তা অনুধাবনযোগ্য। জন্মের পর জীবনের প্রতিটি পদে তারা সম্মুখীন হন বৈষম্যের, এমনকি মৃত্যুর পরও। অথচ দেশে সম্প্রতি এক শুমারিতে ১০০০০-এর মত হিজড়া গণনা করা হয়েছে, যা কিনা মূল জনসংখ্যার কোন উল্লেখযোগ্য প্রতিফলনই নয়। তাহলে বাকিরা কোথায়? বাংলাদেশের যৌন ও লিঙ্গ বৈচিত্র্যময় জনগোষ্ঠী মূলত অদৃশ্য। বাংলাদেশীদের মধ্যে বিদ্যমান সমকামভীতির কারণেই এই বিশাল জনগোষ্ঠী অদৃশ্য ও অশ্রূত। আর তাই অদৃশ্য এই জনগোষ্ঠী যে বৈষম্যের স্বীকার হয়, তাও নির্ণয় অযোগ্য। একজন সমপ্রেমী ব্যক্তিকে যখন তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে বিপরীত লিঙ্গের সাথে বিবাহে বাধ্য করা হয়, তা মানবাধিকার লঙ্ঘন হিসেবে গন্য করা হয় কি? আবার আপনার বোন যদি কোন মেয়েকে ভালবেসে জীবনসঙ্গী হিসেবে গ্রহণ করতে চায়, কিন্তু আপনার সমকামভীতির কারনে তা কখনোই প্রকাশ করতে না পারে, তবে কি একে বৈষম্য বলবেন আপনি? আমাদের মতে বাংলাদেশি সমপ্রেমিদের মূল বৈষম্য দিনের পর দিন তারা যা নয় তার অভিনয় করে যাওয়া, প্রেম-ভালোবাসার মতো অপূর্ব সুন্দর অনুভূতিকে প্রকাশ করতে না পারা বা সেই অনুভূতি উদ্ভূত সম্পর্কের সামাজিক স্বীকৃতি না পাওয়া।
আদর্শগত অবস্থান থেকে দেখলে, দুজন প্রাপ্ত বয়স্ক ব্যক্তির পারস্পরিক সম্মতির ভিত্তিতে স্থাপিত যৌন সম্পর্ক যখন একটি দেশের আইনে অপরাধ হিসেবে গণ্য, তা অবশ্যই একটি বৈষম্যমূলক আইন।
মুদ্রার অপর পিঠে রয়েছে বাংলাদেশের সমকামী ও উভকামীদের সুবিধাগত অবস্থান। বাংলাদেশে সমকামী জনগোষ্ঠীর অস্তিত্বের ব্যপারে সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের অজ্ঞতার কারনে সমকামীদের মধ্যে এক ধরনের যথেচ্ছাচারী যৌন প্রবণতা দেখা যায়। সমপ্রেমের সমাজ ও রাষ্ট্র স্বীকৃত/ প্রাতিষ্ঠানিক রূপ না থাকায়, ঠিক যে কারনে ধর্ম ও নৈতিকতা সমকামকে নিরুৎসাহিত করে, সেই যৌন অজাচার চলছে লোকচক্ষুর অন্তরালে। ফলে তারা নিজেদের নানা ধরনের স্বাস্থ্য ঝুঁকির মুখে ঠেলে দিচ্ছে। একই সাথে সমকামিদের একটি বৃহৎঅংশ এই সুবিধাগত অবস্থান হারাবার ভয়েই হোক, আর আত্মগ্লানি থেকেই হোক, তুমুল বিরোধিতা করছে ভালবাসার স্বাধীনতা ও অধিকার আদায়ের আন্দোলনের।
ভীতির মূলকারণ অজ্ঞতা, বাদ বাকি সব কারণ ওই অজ্ঞতা প্রসূত।
এখানে একটু interrupt করি। আরেকভাবে বলা যায় এই অজ্ঞতা বা সমাজের চোখের এই ঠুলি বিষমকামী সম্পর্কের উদযাপন ও সাভাবিকিকরণ (celebration and normalization of heterosexual relationship)-এর সাথে সম্পর্কিত নয় কি? ধর্মীয় মূল্যবোধ, আইনের পাশাপাশি মূলধারার অর্থনৈতিক-সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডে যেভাবে বিষমকামী প্রেম-বিয়ের উদযাপন এবং একে ঘিরে যে বানিজ্য, সেটা বিজ্ঞাপন চিত্রেই হোক বা প্যাকেজ নাটকেই হোক — তা চিন্তা চেতনায় প্রেম-ভালবাসার বৈচিত্র ভাবনার, কল্পনার সম্ভাবনাকে নষ্ট করে ইংরেজিতে একটা কথা শুনেছি, heterosexual monogamy is a capitalist dream. প্রেম-ভালোবাসাকে এ দেশের ধর্ম, আইনের পাশপাশি অর্থনীতি, সংস্কৃতিও ছকে বাঁধতে চায়, শাসন করে – এটা আমাদের মনে হয়। এই বিষয়ে আপনারা কি ভেবেছেন?
অজ্ঞতা শুধু একা বিষমকামী সমাজের না, সবারই । সমপ্রেমি পুরুষ হিসেবে আমি হয়ত আমার যৌন প্রবৃত্তির ভিন্নতা অনুধাবন করে এটি স্বাভাবিক দাবি করছি, কিন্তু আমার আর বাদবাকি সব ধ্যানধারনাই সেই hetero-normativity নিয়ন্ত্রিত। পুরুষতান্ত্রিক সমাজে পুরুষের আধিপত্য ও সুবিধাগত অবস্থানে আমি কোন সমস্যা দেখছি না। নারী ও পুরুষের বাইরে অন্য কোন লিঙ্গ পরিচয় আমার চোখেও ‘কেমন যেন’ ঠেকছে, ‘মেয়েলি’ ছেলেগুলো বিছানায় ভালো হতে পারে কিন্তু ওদের সাথে সমাজে ওঠ-বস করা যায়না। বিয়েকে আমি সম্পর্কের অনিবার্য পরিণতি হিসেবে মেনে নিয়েছি। কেউ কেউ একাই থাকতে চায়, তা মানতেই পারিনা। অযৌন হওয়া মানে তার চিকিৎসা দরকার। গালি দেই উভকামিদের, ‘এরা অবিশ্বস্ত’, ভুল করেও তাদের উভপ্রেমি বলছিনা। হিজড়ারাও মানুষ, ঠিকাছে, কিন্তু আমরা, ওরা না।
আশা করি আপনার উত্তর পেয়েছেন।
আবার আইনের কোথায় ফিরে আসি। বৈষম্যমূলক আইনের ক্ষেত্রে আপনারা বোধহয় বাংলাদেশ পেনাল কোডের ৩৭৭ নং ধারাটির কথা বলছেন, যেটি সমকামী সঙ্গমকে একটি যাবজ্জীবন কারাগার প্রদানের মত অপরাধ হিসেবে চিহ্নিত করেছে। এই আইনটি সন্দেহাতীতভাবে বিষমকামী (hererosexual) সম্পর্ক ব্যতিত অন্য যে কোনো প্রেম ভালবাসার সম্পর্ককে criminalizeকরে। এটিকে ঘিরে দুটো প্রশ্ন করতে চাই। আমাদের প্রথম প্রশ্নটি হলো এই আইনটি বাংলাদেশে কি হারে প্রয়োগ করতে দেখা যায়? এই আইনটির প্রয়োগ সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে চাই। যেমন ধরুন, এই বছরের মার্চ মাসে লেবাননে একই ধরনের আইন প্রয়োগ করে একটা মামলায় ঐতিহাসিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ রায় দেয়া হয়, যেখানে একজন উভলিঙ্গীয় নারীর (transwomen) বিরুদ্ধে একজন পুরুষের সাথে যৌন সম্পর্ক স্থাপনের অপরাধের অভিযোগ আনা হয়। এই মামলার রায়ে বিচারকরা বলেন, “লিঙ্গীয় পরিচয় শুধু আইনি কাগজপত্র দিয়ে নির্ধারিত হতে পারে না, একজন মানুষের বেড়ে ওঠা , লিঙ্গ পরিচয় সম্পর্কে ব্যক্তির নিজের ধারনাকে এখানে আমলে আনতে হবে।” এই রায়টিকে ঘিরেই আমাদের দ্বিতীয় প্রশ্ন, একটা মুসলিম প্রধান রাষ্ট্রে এই ধরনের একটা রায় আমাদের দেশের আন্দোলনে কিভাবে প্রভাব ফেলবে?
পেনাল কোড ৩৭৭ একটি ঘুমন্ত দানব। বাংলাদেশ দন্ড বিধির ৩৭৭ ধারা অনুযায়ী যে ব্যক্তি স্বেচ্ছাকৃতভাবে কোন পুরুষ,নারী বা জন্তুর সহিত,প্রাকৃতিক নিয়মের বিরুদ্ধে যৌন সহবাস করে সেই ব্যক্তি যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে বা যেকোন বর্ণনার কারাদণ্ডে–যার মেয়াদ দশ বছর পর্যন্ত হতে পারে-দন্ডিত হবে এবং তদুপরি অর্থদণ্ডেও দণ্ডনীয় হবে। এই ধারায় অস্বাভাবিক অপরাধের শাস্তির বিধান করা হয়েছে এবং তা অবশ্য প্রাকৃতিক নিয়মের বিরুদ্ধ ভাবে হতে হবে। যদিও প্রাকৃতিক নিয়ম বিরুদ্ধ যৌন সহবাসের সর্বজনীন স্বীকৃত সংজ্ঞা এখনো নির্ণীত হয়নি। বাংলাদেশ ছাড়াও প্রাক্তন ব্রিটিশ ঔপনিবেশ সকল দেশেই, যেমন ভারত, পাকিস্তান, এই ধারা আছে (বা ছিল)। তবে এখন পর্যন্ত বাংলাদেশে এর তেমন কোন প্রয়োগ বা প্রভাব দেখা যায়নি। সম্প্রতি কুষ্টিয়া জেলার ভেড়ামারা উপজেলায় জনৈক দিপুকে (২২) পুলিশ ৩৭৭ দন্ডবিধিতে গ্রেফতার করেছে ওই গ্রামেরই অপর এক কিশোরকে (১১) বলাৎকার করার অভিযোগে; এমনটা শোনা গেছে। এর আগে আলোচনায় আসা সনজিদা – প্রীতি, যাদের পুলিশ ঢাকা থেকে গ্রেফতার করে, এদের মধ্যে প্রীতির বাবা সনজিদার নামে কিডন্যাপিং মামলা ঠুকে দেন, যা আজ অবদি চলছে। । যদিও তারা দু’জন নিজেদের বিবাহত বলে দাবি করে, দু’জন নারী সমপ্রেমির ক্ষেত্রে ধারা ৩৭৭-এর প্রয়োগের বিষয়টি কারোই মাথাই আসেনি।
ধারা ৩৭৭ প্রাকৃতিক নিয়মের বিরুদ্ধে যৌন সহবাসের আওতায় শুধু সমলিঙ্গ ব্যক্তিদের সম্ভাব্য সকল যৌনাচারকেই বেআইনি (অন্ততঃ ভারতীয় মামলা মকদ্দমার দস্তাবেজ থেকে তাই প্রতীয়মান) ধার্য করে তাই নয়, নারী-পুরুষেও যদি পায়ুকাম তথা প্রাকৃতিক নিয়মের বিরুদ্ধে যৌন সহবাস করে তবে তা এর আওতায় পরে। সুতরাং বিষমকামিরাও এর আওতাভুক্ত।
আপাততঃ তাই এই দানব ঘুমিয়ে থাকতে থাকতে আমরা লিঙ্গ ও প্রেম বৈচিত্র্য বিষয়ে সর্বাত্মক জনসচেতনতা ও সমর্থন আদায়ের কাজে হাত দিয়েছি। সরকার, বিচারবিভাগ, আইন প্রণয়ন ও প্রয়োগকারী, সংবাদ ও সংস্কৃতিকর্মী, ধর্মীয় ও রাজনৈতিক নেতা, পেশা ও বুদ্ধিজীবী, সাধারণ মানুষের সবার, প্রত্যেকের সমান প্রয়োজন লিঙ্গ, যৌনতা, প্রেম এসবকিছুর বৈচিত্র্য বিষয়ে সম্যক ধারনা লাভ করা। ভীতির মূলকারণ অজ্ঞতা; আর তাই শুধুমাত্র সময়োপযোগী ও সম্যক ধ্যানধারনাই পারবে এক সময় ধারা ৩৭৭ বিলোপ করার পক্ষে আন্দোলনের সহায়ক সামাজিক পরিবেশ সৃষ্টি করতে।
আপনি শুধু হিজড়াদের বিষয়টাই চিন্তা করুন, তাহলে এই বিষয়ে আমাদের নীতিপ্রনয়নকারিদের জ্ঞানের দৈন্য বুঝতে পারবেন। হিজড়াদেরকে ‘তৃতীয়’ লিঙ্গ স্বীকৃতি দেয়া হল, আমরা অবশেষে হিজড়াদের দিন বদলাবে ভেবে খুশি হলাম, কিন্তু সম্প্রতি হিজড়া কোটায় চাকুরীপ্রার্থী ১২ জনকে মেডিকেল পরিক্ষায় পুরুষ বলে সাব্যস্ত করা হয়েছে, কারণ তাদের প্রত্যেকের পুংলিঙ্গ আছে। সরকার বা তার কর্মকর্তাদের এই ধারনাই নেই যে হিজরাদের মধ্যে খুব সামান্য শতাংশই উভলিঙ্গ (Intersex), তাদের মধ্যে রয়েছে রুপান্তরকামি(Transgender)রাও যারা শারীরিক বা জন্মগত পুংলিঙ্গধারী হলেও তাদের মননে তারা নারী সত্তাই বহন করেন ও সমাজে নারী পরিচয়েই পরিচিত হতে চান।
যেকথা একটু আগেও বলা হয়েছে, যে এখন পর্যন্ত হিজড়া জনগোষ্ঠীই বাংলাদেশে যৌন ও লিঙ্গ ভিন্নতার ধারক/বাহক, আর তাই লোকের কাছে সমকামী মানেই হিজড়া। ধারনার স্বচ্ছতা প্রয়োজন এইখানেই যে, বেশির ভাগ সমকামীই আপনার সন্তান, ভাইবোন, বন্ধু- সহকর্মী, প্রতিবেশী হয়ে দিনের পর দিন কাটাচ্ছে, একই ঘরে, পাড়ায়, সমাজে, দেশে। আপনাদের অজ্ঞতা-প্রসুত ভীতি ও সেই ভীতির ভিত্তিতে গড়ে ওঠা সমাজ, সংস্কার, আইনের যাঁতাকলে পরে তারা দিনাতিপাত করছে। অথচ আপনারা তাদের অস্তিত্ব সম্পর্কে অজ্ঞ। আপনি যে রায়ের কথা বললেন, তা অবশ্যই সে অজ্ঞতা দুর করতে একটি রেফেরেন্স হিসেবে কাজ করবে। আমেরিকার বিবাহ সমতা আইন পাশ ও ফেসবুকে প্রোফাইল ফটোতে রংধনু ফিল্টার দেয়া নিয়ে গত কয়েক সপ্তাহে বাংলাদেশে এই বিষয় নিয়ে যে পরিমাণ তর্ক-বিতর্ক হয়েছে, তার একশভাগের একভাগও হয়নি গত ৪৪ বছরেও; বিষয়টি অবশ্যই ভালো।
নিপীড়নমূলক আইনের পাশাপাশি প্রাতিষ্ঠানিক সমকামভীতিকে মোকাবেলা করার জন্য গত এক দশকে নতুন নতুন আইন পাশ হয়েছে। তারমধ্যে gay marriage act গুরুত্বপূর্ণ। যুক্তরাষ্ট্রে সেই হার্ভে মিল্কের দিন আর নেই। মাত্র কিছুদিন আগে সেখানে এই আইনটি পাশ হয়েছে। এর আগে নেদেরলান্দ্স (২০০১), বেলজিয়াম (২০০৩), কানাডা (২০০৫), সাউথ আফ্রিকা (২০০৬), নরওয়ে (২০০৯), পর্তুগাল আর আর্জেন্টিনা (২০১০), ব্রাজিল আর উরুগুয়ে (২০১৩) সমকামীদের বিবাহের অধিকার নিশ্চিত করা হয়। এক অর্থে বলা যায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে সমকামী ভালবাসার আইনগত অধিকার নিশ্চিত করতে যুক্তরাষ্ট্রে আন্দোলনকারীদের অনেক পথ পাড়ি দিতে হয়েছে। আপনাদের ফেইসবুক পেজে আপনারা ভালবাসার স্বাধীনতার কথা লিখেছেন। এই স্বাধীনতার স্বপ্নটা সম্পর্কে একটু বলুন। এই স্বপ্ন বাস্তবায়নের, এ স্বাধীনতা অর্জনের পথ কি?
প্রথমেই স্বীকার করে নিচ্ছি, ‘ভালোবাসার স্বাধীনতা’ বা অধিকার, এই শব্দগুলো রূপবানের একান্তই নিজস্ব কৌশলগত শব্দাস্ত্র। যে দেশে মানুষ এখনো যৌন স্বাধীনতাকে যৌন স্বেচ্ছাচার মনে করে সেখানে মানুষের যৌন প্রবৃত্তি ও তার বহুবিধ রূপ নিয়ে কথা বলতে গেলে প্রেম-ভালবাসার পথ দিয়েই আগাতে হয়। ঠিক একই কারণে আমরা সমপ্রেম বা নিজেদের ‘রূপবান’ বলে পরিচয় দিতে স্বচ্ছন্দবোধ করি । সমকাম শব্দটার সাথে যে যৌন বা কামগন্ধ জড়িয়ে আছে, এবং সেই সাথে পাপ, অপরাধ, পশ্চিমা সংস্কৃতির যে লেবাস, তা ছাড়িয়ে সাধারণ মানুষের মনে এই বিষয়ে সমর্থন জোগাড় করা দুষ্কর বলে আমরা মনে করি। দু’জন প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তি সম্মতির ভিত্তিতে তাদের ব্যাক্তিগত সময় ও পরিসরে যদি একে অপরকে যৌন আনন্দ দেয়; তা অপরাধ হতে পারেনা। অপরাধ হল ধর্ষণ, যৌন নির্যাতন, নিপীড়ন, শিশুকাম; অপরাধ হল কারো লিঙ্গ বা যৌন পরিচয়ের ভিত্তিতে কাউকে নিগৃহীত করা, অধিকার বঞ্চিত করা। কিন্তু সে আলাপে যেতে হলে, আগে আমাদের মানুষের কাছে বিষয়টি নিয়ে যেতে হবে, কথা বলতে হবে এবং সে কথা বলার ভাষা হতে হবে সহজপাচ্য, ‘ভালবাসার স্বাধীনতা’কে তাই তেতো ওষুধের মিষ্টি আবরণ বলতে পারেন। এই স্বাধীনতা অর্জনের পথ নিঃসন্দেহে দুর্গম কিন্তু অসম্ভব নয়। আমেরিকা বা ইউরোপের দেশগুলোতেও বছরের পর বছর লেগে গেছে প্রেম ও লিঙ্গ সমতার আন্দোলনে সফলতা পেতে, বাংলাদেশে সে হিসেবে এই যাত্রা মাত্র শুরু । আমরা বিশ্বাস করি বৃহত্তর সামাজিক সংলাপ এবং জনসচেতনতামূলক কার্যক্রমের মাধ্যমে এ বিষয়ে নেতিবাচক মনোভাব, আক্রমণাত্মক দৃষ্টিভঙ্গি ও আইনি-সামাজিক বাধাবিপত্তি অতিক্রম করা সম্ভব। আমাদের প্রকাশনা, ফেসবুক বা টুইটার পেজ আমাদের ‘ভাষা’ বয়ে নিয়ে যায় সবার কাছে; আমাদের নিয়মিত আয়োজনগুলো সবার কাছে ‘ভাস্বর’ করছে আমাদের অস্তিত্ব; একই সাথে সুযোগ করে দিচ্ছে এই অশ্রুত, অদৃশ্য জনগোষ্ঠীকে নিজ ‘ভাবনা’ প্রকাশে; দেশীয় সংস্কৃতি ও সংস্কারকে মাথায় রেখে তৈরি আমাদের প্রচারণা তৈরি করছে আমাদের ‘ভাবমূর্তি’, এবং এই পথ ধরেই এক সময় অর্জিত হবে ‘ভালবাসা’র সমতা।
ভালবাসার স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠিত হোক, রূপবানকে ধন্যবাদ।।