
লেখকঃ অরণ্য রাত্রি
এক
– খানকি মাগি। একদম মাইরা ফালামু
– ভাই দেখছেন কি? চড় মারেন একটা। হালা সমকামী করে। নাউজুবিল্লাহ
চড় মারল একজন রবিনের গালে। রবিন কে মোটামুটি নগ্ন করে চেয়ারে বেঁধে রাখা হয়েছে।আশে পাশে প্রায় ৬-৭ জন যুবক জটলা করে দাঁড়িয়ে আছে। সবাই খুব ক্ষিপ্ত। পারলে রবিন কে মেরেই ফেলে। রবিনের একটাই দোষ। সে সমকামী। রবিন কে আটকে রাখা হয়েছে একটা ক্লাব ঘরে।একজন চিৎকার করে উঠলো
– এই হালার পুতেরা কি দেখস ? নাপিত ডেকে আন । মাগির ভুরু আর চুল চাইছা দিমু
– ভাল কইসেন ভাই। হা হা
রবিন কাকুতি মিনতি করে উঠলো
– ভাই প্লিজ ছেড়ে দেন আমাকে
– আহা ছাইড়া দিমু তো …খালি তোর বাব মা রে বল ১০০০০ টাকা বিকাশ করতে। তাইলেই ছাইড়া দিমু।
– বাবা জানলে আমার ভয়ানক বিপদে পরে যাব। ভাই রা প্লিজ ছেড়ে দেন।
আরেকজন রবিনের নিতম্ব বরাবর একটা লাথি দিয়ে বলল
– সমকামী করার সময় মনে ছিল না এই কথা! ১০০০০ টাকা এর কমে ছাড়বো না। যেখান থেকে পারিস যোগাড় কর।
– ভাই আমি এত টাকা কই পাবো। প্লিজ ভাই আমারে ছেড়ে দেন।
ইতিমধ্যে নাপিত চলে এসেছে। নাপিত রবিনের মাথা ন্যাড়া করে ভুরু ছেঁচে দিল।রবিন অনেক বাঁধা দিল কিন্তু কোন লাভ হল না।
দুই
ঘটনার সূত্রপাত গ্রাইন্ডার থেকে। গ্রাইন্ডার এখনকার সমকামী যুবক দের খুব প্রিয় একটা মোবাইল এপ। এখানে বিভিন্ন সমকামী যুবক রা একে অপরের সাথে চ্যাট এবং ছবি বিনিময় করতে পারে। রবিন ও এক বন্ধুর পরামর্শে গ্রাইন্ডারে প্রোফাইল খুলে। সেখানেই পরিচয় হয় শাফির সাথে। শাফি খুব ফ্যাশন সচেতন , হ্যান্ডসাম যুবক। রবিন তো শাফির ছবি দেখে মুগ্ধ। শাফি কে রবিন তার ছবি পাঠাল। রবিন দেখতে খারাপ নয়। শাফিও রবিনের ছবি দেখে পছন্দ করলো। তারপর তাদের দুইজনের মধ্যে প্রতিদিন চ্যাট হতে লাগলো। এর পরে ফোনে কথা। এক পর্যায় শাফি তাকে প্রপোজ করলো। রবিন তো এক কথায় রাজি। কিন্তু তখনো তাদের মাঝে দেখা হয় নি। শাফি ই রবিন কে দেখা করার কথা বলল। ঠিক হল শুক্রবার সন্ধ্যায় মিরপুরে রবিন আর শাফি দেখা করবে। রবিনের ইচ্ছা ছিল কোন শপিং মলে দেখা করার। কিন্তু শাফি বলল মিরপুর তার জন্য সুবিধা হয়। রবিন অবশ্য মিরপুর এলাকাটা ভাল মত চিনে না। কিন্তু এখনকার যুগে গুগল ম্যাপের বদউলতে এটা কোন ব্যাপার ই না।
শুক্রবার রবিন বিকেল থেকেই খুব উত্তেজিত। সন্ধ্যায় তার স্বপ্ন পুরুষের সাথে দেখা হবে। সন্ধ্যার আগে পরিপাটি কাপড় চোপড় পরে রবিন বাড়ি থেকে বের হল। মিরপুরে সে একটু আগেই পৌঁছে গেল। রবিন , শাফি কে ফোন দিল
– হ্যালো আমি পৌঁছে গিয়েছি
– আমি আসছি । একটু অপেক্ষা কর।
রবিনের জায়গা টা ভাল লাগছিল না। চারপাশের দোকান পাট। কোন রেস্টুরেন্ট ও নেই। বসবে কোথায় তারা। কোন একটা রেস্টুরেন্ট এ বসলে ভাল হত। যাই হোক শাফি আসলে অন্য কোথাও যাওয়া যাবে ভাবলও রবিন। মাগরিবের আযান দিচ্ছে। পশ্চিম আকাশ লাল হয়ে গিয়েছে। চারিদিক অন্ধকার হয়ে যাচ্ছে। অথচ শাফির আসার নাম নেই। আরও ১০ মিনিট পর রবিন শাফি কে দেখতে পেল। তাকে দেখে হাসি মুখে এগিয়ে আসছে। শাফি দেখতে আসলেই সুন্দর । একদম মডেল দের মত। শাফি রবিন কে বলল
– অনেকক্ষণ দাড় করিয়ে রেখেছি না?
– আরে না । কোন ব্যাপার না। কিন্তু এইখানে কই বসবো ?
– ধারে কাছে একটা ক্লাব ঘর আছে। এই সময় কেউ থাকে না। চল ওখানে যেয়ে বসি। পাশেই গরম গরম সিঙ্গারা বিক্রি করে। গরম গরম সিঙ্গারার সাথে তোমার সাথে গরম গরম গল্প করবো ।
রবিনের কেন জানি প্রস্তাব টা ভাল লাগছিল না। ক্লাব ঘরে কেন ? যে কোন একটা রেস্টরেন্টে বসলেই তো ভাল। তারপর ও শাফির প্রস্তাবে দ্বিমত পোষণ করলো না রবিন।
ক্লাব ঘর টা কাছেই। ইটের ঘর। উপরে টিনের ছাউনি।বাইরে থেকে দেখা যাচ্ছে ভিতরে হলুদ আলো টিম টিম করে জ্বলছে। এরপর ইতিহাস। রবিন ক্লাব ঘরে ঢুকতেই শাফি ক্লাব ঘরের দরজা বন্ধ করে দিল। ভিতরে আরও ৬-৭ জন মানুষ বসে আছে। তারপর যা হবার তাই হল। রবিন কে মারধোর করে নগ্ন করে চেয়ারের সাথে বাঁধলও ওরা। আসলে ব্যাপার টা হল এটা ছিল রবিনের জন্য একটা ফাঁদ। শাফি মোটেও সমকামী নয়। সে আসলে গ্রাইন্ডারে চ্যাট করে এরকম সমকামী যুবক দের প্রলুব্ধ করে এরকম ভাবে ক্লাব ঘরে নিয়ে আসে। আর তার আরও ৬-৭ জন বন্ধু আগে থেকেই সেখানে উপস্থিত থাকে। পরে তারা ভিক্টিম কে বেঁধে মোবাইল তো নেয় ই। তারপরও মোটা অঙ্কের মুক্তিপন চায়। আর বাংলাদেশে সমকামিতা নিষিদ্ধ। তাই পুলিশের সাহায্য নিতে পারে না ভিক্টিমের বাবা মা। তার উপর লোক লজ্জার ভয় তো আছেই। রবিনের সাথেও আজকে এই ঘটনাই ঘটেছে।
তিন
– তুই তোর বাপ মা রে ফোন দিবি নাকি পুলিশে দিব তোকে ? জানিস তো বাংলাদেশে সমকামিতা শাস্তি যোগ্য অপরাধ। পুলিশে দিলে কিন্তু তোর বাপ মায়ের অবস্থা আরও টাইট হয়ে যাবে।
– প্লিজ ভাই রা এমন করেন না। আমাকে ছেড়ে দেন।
– এ দেখই একি গান গাইছে ভাঙ্গা রেকর্ডের মত। তোরে ছেড়ে দেয়ার জন্য কি এত কষ্ট করে এই নাটক সাজিয়েছি
একজন এসে কষে চড় মারলও রবিনের গালে। সবচেয়ে মজা পাচ্ছে মনে হয় শাফি। সে মিটি মিটি হাসছে। রবিন ভাবছে এই রূপের মোহে বিভ্রান্ত হয়ে একেই সে ভালবেসেছে। কষ্টে রবিনের চোখে পানি এসে গেল।
– এই মাইয়া মানুষের মত কাঁদবি না।
একজন এসে থুথু ছিটালো রবিনের গায়ে।
– মুসল্মানের পোলা হইয়া এই কাজ ক্যাম্নে করিস। লুত নবীর কাহিনী কি জানস না?
আরেক জন হেসে বলল
– মাইয়া মানুষ দেখলে খাঁড়ায় না। পোলা গো ধন দেখলে খাঁড়া হয়া যায় । তাই না? ছিঃ পোলা হইয়া পোলা গো সাথে করস।
এইবার এক ছেলে একটা বেল্ট নিয়ে আসলো
– শোন অনেক টাল্টি বাল্টি হইসে। আমাগো বাড়ি যাওন লাগবো। তুই যতক্ষণ ফোন না দিবি তোর বাপ মা রে ততক্ষণ বেল্ট দিয়ে পিটামু তোরে
এই বলে বেল্ট দিয়ে জোরে রবিনের নিতম্বে আঘাত করলো ছেলে টা। এইবার রবিন খুব ভয় পেয়ে গেলো। ভয়ের চোটে মুখ দিয়ে কথা বের হচ্ছে না রবিনের।
চার
রবিনের বাবা আসাদ সাহেব খুব চিন্তায় পরে গিয়েছেন। রাত ১১ টা বাজে। এখনো ছেলে ঘরে ফিরে নাই। কে জানি রবিনের মোবাইল থেকে ফোন করে বলেছে তার ছেলে রবিন সমকামী। ১০০০০ টাকা না দিলে রবিন কে পুলিশে দিবে তারা। আসাদ সাহেব ভেবে পাচ্ছেন না কি করবেন। ১০০০০ টাকা দেয়া ব্যাপার না। কিন্তু রবিন কে ছাড়বে তো তারা। তার এটা ভেবে কষ্ট হচ্ছে তার ছেলে সমকামী। জীবনে কখনো কোন কারণ ছাড়া তিনি নামায কাজা করেন না। সেই তার ছেলে সমকামী। তার মরে যেতে ইচ্ছা করছে। যাই হোক তিনি মন কে শক্ত করলেন । বিকাশে টাকাটা দিয়ে দেয়াই ভাল। কারণ পুলিশের কাছে গেলে ব্যাপার টা জানা জানি হয়ে যাবে। লোক লজ্জায় পরে যাবেন তিনি। হয়তো মসজিদ যাওয়ার সময় কিংবা বাজার করতে যাওয়ার সময় মানুষ তাকে দেখে হাসতে হাসতে বলবে
– ওই দ্যাখ সমকামীর বাপ যায়।
ব্যাপার টা ভেবে তিনি শিউড়ে উঠলেন।আবার ফোন বাজছে। নিশ্চয় ওরা ফোন করছেন
– আঙ্কেল কি ভাবলেন ? টাকা দিবেন নাকি আপনার ছেলে কে পুলিশে দেব ?
– না না বাবা রা আমি এখুনি টাকা বিকাশ করছি
– কম টাকায় আমরা ছেড়ে দিলাম। কিন্তু এখন থেকে ছেলে কে চোখে চোখে রাখবেন।
– হ্যাঁ বাবা রা।
পাঁচ
একটু আগে ছাড়া পেয়েছে রবিন। বাড়ি যাচ্ছে সে। মাথা চুল চেঁছে দিয়েছে ওরা। ভুরুও নেই। লজ্জায় মাটিতে মিশে যেতে ইচ্ছা করছে রবিনের। কিভাবে সে বাবার সামনে মুখ দেখাবে সে। বাবা তাকে অতান্ত আদর করে। তিন ভাই বোনের মাঝে সেই সবচেয়ে আদরের। অথচ সে বাবা কে এত কষ্ট দিল । ১২ টা নাগাদ বাড়ি পৌঁছে গেল রবিন। দরজা খুলল আসাদ সাহেব। তিনি সন্তান কে দেখে শুধু একটা কথাই বললেন
– ছিঃ। এই জন্য তোকে জন্ম দিয়েছি!
ছয়
রবিন নিজের ঘরে বাতি নিভিয়ে বসে আছে। পাশের ঘর থেকে আসাদ সাহেবের কান্নার শব্দ শোনা যাচ্ছে
– হে আল্লাহ আমাকে উঠিয়ে নিয়ে যাও। এই দেখার জন্য বেঁচে আছি? আমার সন্তান সমকামী এটা জানার আগে আমার মৃত্যু হল না কেন!
রবিনের চোখ পানি তে ভিজে যাচ্ছে। সে তো ইচ্ছা করে সমকামী হয় নি। কেউ ইচ্ছা করে সমকামী হয় না। পৃথিবীর শতকরা ১০ ভাগ লোক সমকামী। তারা চেষ্টা করলেও পরিবর্তিত হতে পারে না। সমাজ বিজ্ঞানীরা এটাই বলে থাকেন। রবিন অনেক চেষ্টা করেছিল নিজেকে পরিবর্তন করার। সে শুধু স্ট্রেট পর্ণ দেখেছে নিজেকে পরিবর্তন করার জন্য।কিন্তু মেয়ে দের নগ্ন শরীর কক্ষনো তাকে আকৃষ্ট করতো না। বরং ছেলে দের শরীরের দিকেই তার চোখ চলে যেত। আসাদ সাহেবের কণ্ঠ শোনা যাচ্ছে
– এই ছেলে কে আমি ত্যাজ্য পুত্র করবো
রবিনের চোখ বেয়ে শুধু অশ্রু।
সাত
ভোর হয়ে এসেছে।ফজরের আযান শোনা যাচ্ছে। আসাদ সাহেব এখনো ঘুমান নাই। তার চোখে শুধু অশ্রু। তিনি ভাবছেন অনেক হল এখন ছেলে কে বুঝিয়ে বলতে হবে। এই পথ থেকে ছেলে কে সরিয়ে আনতে হবে,। ছেলে টাও নিশ্চয় কষ্ট পাচ্ছে। অতি আদরের ছেলে তার। তিনি ঘর থেকে বের হয়ে রবিনের ঘরের দিকে গেলেন। কিন্তু রবিনের ঘরে কেউ নেই।
আট
ভোর বেলা রবিনের খুব প্রিয় সময়। এই সময় নীরব থাকে। শুধু পাখির কলরব শোনা যায়। কেমন একটা স্নিগ্ধ পরিবেশ,। রবিন ছাদে দাঁড়িয়ে আছে। তার খুব কষ্ট হচ্ছে। আজকে তার যে অপমান হল তার জন্য কি সে দায়ী। এত গুলো মানুষ তাকে শুধু শুধু মারলো , অপমান করলো, ন্যাড়া করে দিল। কিন্তু সবচেয়ে খারাপ লাগছে বাবার কথা ভেবে। বাবার কথা গুলো তার একদম ভিতরে আঘাত করেছে। এসব কথা শোনার থেকে বাবা যদি তাকে চড় মারতো তাও হাজার গুন ভাল ছিল। যে বাবা তাকে ভাত হাতে তুলে খাইয়ে দে, মায়ের মৃত্যুর পর মায়ের অভাব বুঝতে দেয় নি সেই বাবা তাকে তাজ্য পুত্র করতে চাইছে। যে দোষের জন্য বাবা তাকে তাজ্য পুত্র করতে চাইছে তার তো কোন সমাধান নেই। সে চাইলেও তো কক্ষনো স্ট্রেট হতে পারবে না। এ তার আজন্ম পাপ। কেন সৃষ্টিকর্তা তাকে এইভাবে সৃষ্টি করেছেন। আজ তার খুব মা কে ডাকতে ইচ্ছা করছে। মা বেঁচে থাকলে কি মা তাকে তাজ্য পুত্র করতে চাইতেন? নিশ্চয় না। মায়ের বুকে মাথা রেখে রবিনের খুব কাঁদতে ইচ্ছা করছে।
পরিশিষ্ট
খুব ভোরে রবিনের লাশ পাওয়া গেল রাস্তার উপর। তিন তলা থেকে লাফ দিয়ে আত্মহত্যা করেছে রবিন। সৃষ্টিকর্তা , বাবা , প্রকৃতির উপর অভিমান করেই আত্মহত্যা করেছে সে। নাকি তার পাপের প্রায়শ্চিত্ত করলো সে। সমকামী হবার আজন্ম পাপ। যে পাপের কোন ক্ষমা নেই সমাজ, সংসার এমন কি সৃষ্টিকর্তার কাছেও।