রায়হান ভাইয়ের নাচ, হোম কোয়ারেন্টাইন এবং অন্যান্য

লেখকঃ তু

“উফ্! আর পারছি না, বাড়িতে বদ্ধ লাগছে!” অনেক বিরক্তির সুরেই বলে বসলেন চলচ্চিত্র জগতের এক নামকরা তারকা, যিনি স্ত্রী, কন্যা নিয়ে অনেক দিন ধরেই ঢাকায় বসবাস করছেন |কিন্তু করোনার কারণে বাড়িতে অলস বসে থাকা যেন সহ্যের সীমা ছাড়িয়ে চলেছে | ওদিকে বদনবই এর লাইভ তারকা খ্যাত “রায়হান ভাই” নামক জনৈক ভদ্রলোকের রাতভর উদ্দাম নাচ দর্শনে, কিছু তরুণ-তরুণী ব্যতিব্যস্ত আর তারই একাংশ সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত এই তারকার রূপ-গুনের আলোচনায় ব্যস্ত |

ওদিকে কিছু মানুষ সারাদিন নিত্য নতুন রান্নার আয়োজন করে মাইডেতে আপলোড করেই চলেছে | কেউ কেউ ঝাঁটা হাতে ছবি নিয়ে, কেউবা গত বছরের বালি, ব্যাংককের স্মৃতিচারণ করেই  দিন অতিবাহিত করছে | সবার দিনানিপঞ্জির ব্যতিক্রমটা থাকলেও একটা জায়গা তে কিন্তু সবার বেশ মিল; কেউই ঘরের মধ্যে এই বন্দি জীবন আর কাটাতে রাজি নয় | স্বামীরা সংসারের সবাইকে নিয়ে বেড়াতে যাবে, বাচ্চা-কাচ্চারা স্কুলে যাবে, গৃহিণীরা রান্না সেরে পাশের বাসার ভাবীর সাথে একটু হাঁটতে বেরোবে আর তরুণ-তরুণীরা যে যার মতো এখানে ওখানে কাজে-অকাজে ছুটে বেড়াবে | এই যেন সবার মনের দাবি |

বিকেলের রোদ আসতে শুরু করেছে, চারিদিকে একটা গুমোট ভাব |করোনার এই অলস দিনগুলি যখন অন্যদের জীবনে হঠাৎ এক ছন্দপতন তৈরী করলো, ঠিক তখনি  পাশের বাসার “নীলাভ” কে ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গেলো | তার জীবনের কোন ছন্দপতন ঘটেনি বরং করোনার আজকের দিনগুলির মতোই ছিল তার গত ৩ বছরের দিনপঞ্জি | ভার্সিটির ১ বছরের সিনিয়র এক বড় ভাই, অনিন্দ এর সাথে বায়োলজি ১০১ ক্লাসে পরিচয় | সেই পরিচয় ধীরে ধীরে প্রণয়ে গড়ায় | নিজের আবেগের সবটুকু দিয়েই সেই প্রণয় ধরে রাখার প্রয়াসে বাড়িতে কোনো একদিন বলে দিল, “আমি সমকামী আর অনিন্দকে ছাড়া আমি বাঁচবো না”| নীলাভের মা, বাবা, ভাই, বোন,আত্মীয়, স্বজন,পাড়া প্রতিবেশী সবাই “ছি ছি” করে উঠলো| কয়েকদিন বাদেই বাড়ির দারোয়ান এক কুটিল হাসি দিয়ে তাকানো শুরু করলো আর কাজের বুয়া  নীলাভের ঘর পরিষ্কার করতে আশা বন্ধ করে দিল |

বাড়িতে হুকুম জারি হলো, আজ থেকে নীলাভের পড়াশোনা বন্ধ, বাসার বাইরে যাওয়া বন্ধ, সারাদিন ধর্ম পালন আর বাড়ির কাজে সহায়তাই আপাতত তার কাজ | সমাজের সকলের মতে, ছেলেটি বিপথগামী, ব্যভিচারের শিকার আর শয়তানের সহযোগী যা কিনা তার পুরো পরিবারকে বিপদে ফেলেছে | ঠিক করোনা ভাইরাস যেমন একজন থেকে আর একজনকে সংক্রমণ করে চলেছে, নীলাভও সবাইকে এই বিপদে সংক্রমণ করে ফেলেছে | অভিমত পাড়ার জনসাধারণের |”বাড়িতে থাকাই তার এই বিপদ থেকে রক্ষা পাওয়ার এক মাত্র পথ” সমাধান দিয়ে গেলেন এলাকার কিছু সুধীজন | পরিবারও সেই সমাধান মেনে নিল|  একদিন, দুইদিন, তিনদিন, পনেরো দিন, এক মাস…এভাবে চলে গেলো তিন তিনটি বছর | সমকামী হওয়ার অপরাধে আর পরিবারের সবার ভালোর স্বার্থে তাকে যেভাবে দিনের পর দিন ঘরবন্দি থাকতে হলো, তা এখন নীলাভের সয়ে গিয়েছে | কিন্তু গত কয়েকদিনে তারমতো বাড়ির সবাই গৃহবন্দী | এলাকার সুধীজন থেকে শুরু করে, কাজের বুয়া, দারোয়ান, সবজিওয়ালা সবাই | সবাই আজ গৃহবন্দী | এসব দেখে ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে তার মাথায় আজ কয়েকটা প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে | আজকের গৃহবন্দী সমাজকি তার মতোই সমকামী? নাকি এই সমাজ সমকামিতার থেকেও আরো বড় কোনো সংক্রামক ব্যাধি নিয়ে চিন্তিত?

সমকামী হওয়ার অপরাধে তাকে যেভাবে গত তিন বছর গৃহবন্দী থাকতে হলো, সেই যন্ত্রনার মাত্রা কি এখন তার পরিবার বা সেই সমাধান দিয়ে যাওয়া সমাজ বুঝতে পারবে? একজন সমকামীকে তার ইচ্ছা, আবেগ, অনুভূতিগুলোকে করোনারুপি এই সমাজের সংক্রমণ থেকে দূরে রাখতে,দিনের পর দিন সেই অনুভূতিগুলোকে একঘরে করে রাখার যে তিক্ত অনুভূতি, তা কি এই সমাজ কখনো উপলব্ধি করবে? আজকের দিনের মতো কখনো কি সবাই এই বদ্ধ সমাজের শেষ চাইবে যেখানে হাজারো নীলাভ তাদের ভালোবাসার জন্য হোম কোরানটিনে যাবে না, যে সমাজে সমকামিতাকে করোনার সাথে তুলনা করা হবে না? অথবা সমকামিতা কোনো ভয়ানক সংক্রামক ব্যাধি হিসেবে পরিগণিত হবে না?  
নীলাভ ভাবতে থাকে… সূর্য অস্তাচলের দিকে অনেকটাই ঢলে পড়েছে | আর একটা রাত আসছে… আর একটা গৃহবন্দী দিনের অপেক্ষা…

There is one comment

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.