
“আপনার প্রথম প্রেম নিয়ে জানতে চাই। ভক্তরা জানতে চায়, তাদের প্রিয় অভিনেতার এই ফরেভার সিঙ্গেল থাকার কারণ। আজ কিন্তু বলতেই হবে আপনার গল্পটা!”
এই মুহূর্তে দুই বাংলার সবচে জনপ্রিয় নায়ক রিজভান মির্জা কে একটু নার্ভাস দেখাচ্ছে। সত্য বলার জন্য এই লোকটির সুখ্যাতি আছে, মুখে কিছুই আটকায় না দেখে তিনি একইসাথে নন্দিত-নিন্দিত। এই কারণেই তিনি এসব টিভি শো’তে আসেন না, কখন কি বলে ফেলেন কে জানে?
“রিজভান ভাই,লজ্জা পাচ্ছেন কী?লজ্জার কিছু নেই, আপনার মতো সুপারস্টারের প্রথম প্রেম যিনি, আজ আপনাকে দেখে নিশ্চয়ই তিনি কপাল চাপড়াচ্ছেন! নাম-ধাম বলার দরকার নেই, কেবল গল্পটাই শুনতে চাই আমরা।”
রিজভান মির্জা হুট করে ফ্ল্যাশব্যাকে চলে গেলেন। প্রথম প্রেম বড় জটিল একটা সমীকরণ, যার হিসাব তিনি কখনোই মেলাতে পারেননি। অদ্ভুত সেইসব কলেজের দিনগুলো, অদ্ভুতুড়ে সেই কলেজ হোস্টেলের কাহিনী। বলতে শুরু করলেন তিনি।
“আম্মু সরকারি চাকুরে- তাই স্কুলজীবনে গোটা আটেক স্কুলে পড়েছি, প্রতিবারই সেই বয়’জ স্কুল- সম্ভবত এই কারণেই স্কুলে থাকতে প্রেমঘটিত কোন ব্যাপার আমার সাথে ঘটেনি। এসএসসি দিয়ে যখন একটা ক্যান্টনমেন্ট কলেজে ভর্তি হই, ছেলে-মেয়ে একসাথে আমার সেই প্রথম ক্লাস করা। আমরা থাকতাম কলেজেরই হোস্টেলে, আমি, হামিম,তন্ময়, সাদিক- আরো অনেকেই।”
দর্শক মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনে যাচ্ছে, সাথে উপস্থাপকও। রিজভান নামের এই মানুষটির বাচনভঙ্গীর মধ্যে কেমন একটা জাদু আছে, বারবার কথা শুনতে ইচ্ছে করে। থামলে ভালো লাগে না।
“আমি আবার যাকে বলে, মাম্মা’স বয় ছিলাম। অফিস থেকে ফিরে আম্মু ভাত খাইয়ে দেবে দেখে স্কুল থেকে ফিরে বিকেল চারটা পর্যন্ত বসে থাকতাম। এইরকম একটা নাদুসনুদুস ছেলে কলেজ হোস্টেলের মতো শক্ত জায়গায় পড়ে যাকে বলে হালুয়া টাইট হয়ে গেল। ছোট্ট একটা খাট, লো-কমোড ওয়াশরুম, সেটা আবার রুম থেকে আধ।কিলো দূরে, অদ্ভুত গ্রাম্য অ্যাক্সেন্টে কথা বলা রুমমেট, শহুরে আমি মোটামুটি তটস্থ হয়ে গেলাম এক সপ্তাহ পার হতে না হতেই। খাবারের কথা বাদই দিলাম, মাছ পছন্দ করি না দেখে বাসায় মাছ রান্নাই হতো না, আর এখানে প্রতিদিন একবেলা ছোট্ট এক টুকরো ধরিয়ে দিতো- না খেলে নেই!”
উপস্থাপক একটু নড়েচড়ে উঠলেন। প্রোগ্রামের সময় বেশি না, রগরগে প্রেমের গল্প না বলে এসব কী হোস্টেলের গল্প বলা শুরু করলো এই লোক? রিজভান অবশ্য থেমে থাকেন না,বলে যান।
“এই ভয়াবহ হোস্টেলজীবনে দুদন্ড শান্তি দিয়েছিলো তুলি। আমার ক্লাসমেট। আমার প্রথম প্রেম। আমি ওকে ডাকতাম তুলতুল। এই জেনারেশন নতুন একটা শব্দ খুব বলে না, হোলসাম? তুলি মেয়েটা ছিলো এইরকম হোলসাম একজন। দেখলেই মনটা ভালো হয়ে যেত। প্রথম যেদিন ও ‘হ্যাঁ’ বলেছিলো, মনে হচ্ছিলো পুরো পৃথিবীটা আমার। ওর সাথে আমি পুকুরপাড়ে বসে গল্প করতাম, কোন কোনদিন কলেজের পাশের বড় বাইপাস রোডটায়। একদিন এক স্যার দেখে ফেললেন, তখন আমাদের সে কি ভোঁ-দৌড়….”
উপস্থাপকের চোখ চকচক করছে। ফাইনালি, ভালো কনটেন্ট আসছে, সুপারস্টারের স্ক্যান্ডাল মানেই টিআরপি হাই, তার শো হিট। উত্তেজনা সামলে তিনি বলেন, “কিন্তু রিজভান ভাই, সবকিছু শেষ হয়ে গেলো কীভাবে?”
একবার ঢোক গিললেন তিনি। গল্পের শেষটা তার জন্য বড়ই বেদনাদায়ক। বলতে ভালো লাগে না। তুলি ওঁর ছেলেবন্ধুর নাম। তার সবচে কাছের বন্ধু। তার প্রেম। তার একসময়ের রুমমেট। না, বিষয়টা খুব স্বাভাবিকভাবে হয়নি। হোস্টেলে আসার তৃতীয় রাতে একটা ঘটনা ঘটে তার সাথে। রাত তখন তিনটারও বেশি, গভীর ঘুমে মগ্ন তিনি- হুট করে গায়ের চাদরটা সরিয়ে দেয় কেউ একজন। আধো ঘুম-আধো জাগরণে রিজভান টের পায় কেউ একজন এক হাতে তার মুখ চেপে ধরে আরেক হাতে বক্সারটা খুলে ফেলছে। একটা তীক্ষ্ণ ব্যথার অনুভূতি- তারপর সব অন্ধকার।
এই বিষয়টা একদিন নয়, প্রায় প্রতিদিনই হতে থাকে। প্রথম এক দু’দিন অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলো ষোল বছরের রিজভান- এরপর সয়ে গেলো কীভাবে কীভাবে।
স্টকহোম সিনড্রোম বলে একটা বিষয় থাকে, কিশোর রিজভানের সাথে সম্ভবত এরকম কিছুই হতে থাকে, ওই ঘটনার ঠিক দশদিন বাদে সে আবিষ্কার করে, ব্যাপারটা তার মন্দ লাগছে না। সত্যি বলতে, কোন কোন রাতে এই অতিথি না আসলে সে বেশ মিস করতে শুরু করে তাকে! একদিন-দুদিন-তিনদিন- একসময় সেই অতিথি, তুলিকে(আসল নাম তন্ময়) চিনে ফেলে রিজভান- প্রেম জন্মে।
সমস্যা হচ্ছে যে আশেপাশের প্রেম-ভালোবাসা শাশ্বত বলা মানুষগুলোই ওদের এই বিষয়টাকে ঘেন্না করে। সমলিঙ্গ তাদের কাছে ঘিনঘিনে, কদর্য, কুৎসিত।
যা হবার তাই হয়, একদিন রুমে ধরা পড়ে যায় তারা। সরকারি চাকুরে মায়ের প্রিয়পাত্র হোস্টেল সুপার বাঁচিয়ে দেয় তাকে, তুলিকে দেয়া হয় টিসি। সেই শেষ, আর কখনো তুলিকে খুঁজে পাননি তিনি।
মিডিয়ার সামনে এসব কি আর বলা যায়? লিবারেল মিডিয়ার চে’ হোমোফোবিক আর কিছু নেই, আজীবন ঠোঁটকাটা রিজভানকেও তাই সতর্ক হয়ে উঠতে দেখা যায়। তিনি বলেন,
“সবকিছু কখনোই শেষ হতো না, কিন্তু তুলিরা সবাই অ্যামেরিকা চলে যায়। আর ফেরেনি দেশে। কম চেষ্টা করিনি কনট্যাক্ট করার, কিন্তু খুঁজে পাইনি। হয়তো ও সুখেই আছে, হয়তো বিয়ে-থা করেছে, কে জানে। তবে যেখানেই থাকুক,রিজভান মির্জার ভালোবাসা রইবে তার জন্য-আজীবন!”
তুমুল করতালিতে স্টেজ ছাড়েন তিনি। সত্যিটা কখনোই কেউ জানতে পারবে না, সত্যিটা বলতেও পারবেন না তিনি- সুপারস্টারেরা কখনো ওসব বলে নাকি? সত্য দুরকম হয়, প্রিয় সত্য আর অপ্রিয় সত্য- তার জীবনে এই মুহূর্তে এই অপ্রিয় কদর্য সত্যটির দরকার নেই।
মোবাইল ফোনে তার আর তন্ময়ের একমাত্র ছবি দেখতে দেখতে চোখের কোনে হালকা পানি এলো হালের সুপারস্টার রিজভানের। ভাবলেন, “আচ্ছা, প্রেমও কী কখনো কুৎসিত হতে পারে?”
লেখকঃ ধৃতিমান রায়
প্রকাশেঃ সাতরঙা গল্প