
রিদয়ের কবরে মাটি দেওয়ার সময় ইনজাম আপন মনে বলছে, নাও রিদয় তোমাকে আজ আমি মুক্ত করে দিলাম। সারাজীবন ভর তুমি যে শান্তি খুজে পাও নি তা আজ আমি তোমায় উপহার দিলাম। আজ আমি যা করেছি তা হয়তো কোনো প্রেমিক করে নি। হ্যা আমি নিজ হাতে তোমাকে মেরে ফেলেছি
গতকাল রাতে ইনজাম রিদয়ের গলা টিপে হত্যা করে।যে রিদয় ছিল তার জীবন কেন তাকে নিজ হাতে মেরে ফেললো ইনজাম।
.
.
রিদয় আর ইনজাম ছিল দুই প্রেমিক যারা স্রোতের বিপরীতে গিয়ে একে অপরকে ভালোবেসেছে।সমাজ তাদের মর্যাদা দেয় নি কিন্তু তারা সমাজ কে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে তারা চেয়েছিলো তাদের ভালোবাসা কে পূর্নতা দিতে কিন্তু বিধাতা হয়তো অন্যকিছু ভেবে রেখেছিলো, তাই হয়তো তাদের চোখে এক রাশ স্বপ্ন দিয়েও সাথে সাথে তা ভেঙ্গে চুরমার করে দিয়েছে।
.
.
রিদয় আর ইনজাম ছিল ক্লাসমেট। ইনজাম অন্য একটি স্কুল থেকে বদলি হয়ে এই স্কুলে ভর্তি হয় সে সুবাদে ইনজাম আর রিদয় প্রায় প্রতিদিনই একে অপরের দেখা পেতো। রিদয় ছিল খুব চাপা স্বভাবের আর ইনজাম তার বিপরীত।ইনজাম এর সবকিছু তেই রিদয়ের থেকে ভালো অভিজ্ঞতা। কিন্তু রিদয় ছিল একটু বোকাসোকা মানে রিদয় কে কেউ যদি চড় মেরেও যায় তবুও সে জিজ্ঞেস করবে না কেনো তাকে চড় মারা হয়েছে আর দাড়িয়ে কাদঁতে শুরু করবে।
.
.
সময় টা ছিল নবম শ্রেনির প্রথম দিকে রিদয় যখন স্কুলে আসতো তখন ইনজাম লক্ষ্য করতো যে রিদয় কেমন যেনো খুড়িয়ে খুড়িয়ে হাটে আর ক্লাসে ঘুমায় অনেক। ইনজাম এইটা দেখে প্রায় সময়ই রিদয় কে টিজ করতো। তো একদিন ইনজাম রিদয় কে টিজ করতে শুরু করে হঠাৎ রিদয় চিতকার দিয়ে ইনজাম কে বলে, “প্রতিদিন যদি তোমার সাথে আমার মতো নির্যাতন হতো তাহলে তুমি বুঝতে কি কষ্ট হয়,কি যন্ত্রনা,তোমার আপন কেউ যদি তোমার সাথে এটা করতো তাহলে তুমি বুঝতে যে কি ব্যাথা, কি কষ্ট”। রিদয় এটা বলে সাথে সাথে কাদঁতে কাদঁতে চলে গেলো। সবকিছু যেনো ইনজাম এর মাথার উপর দিয়ে গেলো। ইনজাম কিছুই বুঝলো না যে রিদয় কি বলে গেলো তাকে।শুধু এইটুকু বুঝতে পারলো রিদয় অনেক কষ্টে আছে।আর তাকে যে করেই হোক রিদয়ের কষ্টের কারন যানতে হবে।
.
.
এর পর থেকে ইনজাম রিদয়ের সাথে ভাব করার চেষ্টা করতে থাকে তাকে। ইনজাম রিদয় এর পাশের সিট বসে সবসময় ওর পাশে থাকে। একদিন ইনজাম রিদয় কে জিজ্ঞেস করে তোমার বাসায় কে কে আছে। তখন রিদয় সেই প্রশ্ন টা এড়িয়ে যায়। অপর দিন যখন ইনজাম আবার একই প্রশ্ন করে তখন রিদয় আর এড়িয়ে যেতে পারে নি। তখন রিদয় বলে ” আমার বাবা-মা কেউ বেচে নাই।আমি আমার আপুর কাছে মানুষ হচ্ছি।আর আমার আপুর সংসারে আপু,আপুর দুই ছেলে, আপুর শাশুড়ী আর……..।” এটা বলতে গিয়ে। রিদয় কেমন যেনো ভয় পেয়ে যায় আর চুপ হয়ে যায়।তখন ইনজাম বলে আর তোমার দুলাভাই তাই না? তখন রিদয় বলে শুধু মাথা নেড়ে সম্মতি জানায়। তখন রিদয় বলে, বাদ দাও আমার কথা তোমার পরিবার এ কে আছে? তখন ইনজাম বলে, “আমার পরিবার এ আব্বু,আম্মি,বড় দুই ভাই আর আমি “। এভাবেই চলতে থাকে সময়।
.
.
ইদানীং ইনজাম খেয়াল করছে যে রিদয়ের ক্লাসে ঘুমানোর অভ্যাস টা অনেক বেড়ে গেছে আর সে ঠিক মতো বেঞ্চ এ বসতেও পারে না।
ইনজাম বুঝতে পারলো যে কিছু একটা সমস্যা আছে। তো ইনজাম একটা রিস্ক নিলো। সে একদিন রিদয়ের পাশে বসে কাদঁতে শুরু করে।রিদয় একটু অবাক হলো কারন যে ইনজামের মুখ থেকে হাসি সরে না সে আজ কাদঁছে।তাই সে জিজ্ঞেস করলো ” কি হয়েছে ইনজাম? কাদঁছো কেনো। “তখন ইনজাম রিদয় কে বললো। ” যানো আমার অনেক কষ্ট, আমার ভাইয়া আমাকে রাতে ঘুমাতে দেয় না। তার যৌনাঙ্গ দিয়ে ব্যাথা দেয়।যানো অনেক ব্যাথা হয়।তুমি বুঝবে না যে কতটা কষ্ট হয়।” ইনজাম খেয়াল করলো রিদয় একদম চুপ হয়ে গেছে সে কি যেনো ভেবে আতঁকে উঠতেসে বার বার। তখন ইনজাম রিদয় কে একটা ঝাকি দিয়ে বললো তুমি বুঝো? কতটা ব্যাথা হয়? তখন রিদয় কাদঁতে কাদঁতে বললো “হ্যা আমি বুঝি।আমি জানি কতটা কষ্ট হয় আমি জানি কতটা যন্ত্রনা সহ্য করতে হয়। আমি ছোট বেলা থেকে সহ্য করে আসছি এই যন্ত্রনা।তুমি আমাকে টিজ করতা না? যে আমি কেন ঘুমাই কেন খোড়ায় খোড়ায় হাটি? যানো প্রতিরাতে আমার সাথে এমন করে,আমি অনেকবার আপু কে বলেছি কিন্ত আপু তার সংসার বাঁচানোর জন্য চুপ করে আছে।আর আমি কান্নাকাটি করলে আমাকে অনেক মারে। সে তার পিঠের উপর থেকে জামা টা সড়িয়ে বললো এই দেখো অনেক মেরেছে।”
ইনজাম এই কথা শুনে আর থাকতে পারলো না সাথে সাথে জড়িয়ে ধরলো রিদয় কে।ইনজাম মনের অজান্তেই রিদয় কে ভালোবেসে ফেলেছে এটা ছিল তার বহিঃপ্রকাশ। তখন ইনজাম রিদয় কে বললো”তুমি ওইখানে পরে আছো কেনো? “রিদয় বললো,কোথায় যাবো আমি? আমার ত এই দুনিয়ায় আর কেউ নেই।
তখন ইনজাম রিদয়ের হাতটা শক্ত করে ধরে বলে কে বলেছে কেউ নেই? আমি আছি ত। সেখান থেকে শুরু হয় তাদের নতুন করে পথ চলা। তারা একসাথে এসএসসি পরীক্ষা দেয়।কিন্তু ততদিনে রিদয়ের উপর নির্যাতনের পরিমাণ এতটুকুও কমে নি তারপর এসএসসি পাশ করার পর রিদয় তার বোনের বাড়ি ছেড়ে দেয়।ইনজাম রিদয় কে একটা রুম ভাড়া করে দেয় থাকার জন্য। কিন্তু ইনজাম রিদয়ের সাথে থাকে না। কারন ইনজামের ইচ্ছে সে রিদয়ের জন্য একটা ফ্ল্যাট কিনবে তারপর একসাথে থাকবে।
.
.
আজ অনেকগুলো বছর কেটে গেছে এরই মধ্যে ইনজামের বাবা-মা মারা গেছে আর ভায়েরা বিদেশে বসবাস করছে বহুবার ইনজাম কে বলেছে তাদের সাথে যেতে কিন্তু সে যায়নি।কারন তার বেচে থাকার যে কারন সে টা ত এইদেশেই আছে। কিন্তু এরই মাঝে রিদয়ের ক্যান্সার ধরা দিয়েছে যা এখন অনেকটা কন্ট্রোল এ আছে। তবুও রিদয় অনেক কষ্টে থাকে প্রায় সময় ই।
তো অই দিন টি ছিল 15 জুলাই।যেদিন তারা তাদের জমানো টাকা দিয়ে কেনা ফ্ল্যাটে উঠবে। আর সেই দিন টা ছিল রিদয়ের জন্মদিন। তাই ইনজাম খুব সকালেই রিদয়কে কিছু না বলে নতুন ফ্ল্যাটে চলে যায় আর সাজাতে শুরু করে। সাজানো শেষ হলে সে রিদয় কে সারপ্রাইজ দিবে তাই ফোন দেয়। আর চিতকার করে বলে ” রিদয় কোথায় তুমি আমাকে মেরে ফেললো। নতুন ফ্ল্যাটে আমাকে মেরে ফেললো “। এটা শোনার সাথে সাথে রিদয় তারাহুরো করে বের হতে গিয়ে সিড়ি থেকে পড়ে মারাত্মক ভাবে আহত হয়। ইনজামের কাছে কল আসে যে রিদয় কে গুরুতর অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।
ইনজাম পাগোলের মতো ছুটে চলে যায় হাসপাতালে আর দেখে রিদয়ের অপারেশন চলতেসে। ডাক্তার অপারেশন থিয়েটার থেকে বের হয়ে বলে রিদয়ের জ্ঞ্যান আসতে সময় লাগবে কিন্তু ব্রেন এ চোট লাগার ফলে সে আর কোনোদিন কোমা থেকে বের হতে পারবেন না।
.
.
তারপর 3 দিন পর রিদয়ের জ্ঞ্যান আসে।সে রিদয়কে নিয়ে তার ফ্লাটে চলে আসে।সেই ফ্ল্যাট যেখানে তারা একসাথে থাকার প্ল্যানিং করেছিলো অনেক স্বপ্ন দেখেছিলো। কিন্তু রিদয় শুধু চেয়ে থাকে কিছু বলে না। শুধু চোখ দিয়ে পানি ঝরে।
.
.
ইনজামের মনে হচ্ছিলো রিদয় যেনো ওকে কিছু বলতে চাচ্ছে। সে যেনো মুক্তি চাচ্ছে। সে শান্তি চাচ্ছে, যা সে সারাজীবন এ পায় নি।ছোটবেলার নির্যাতন , ক্যান্সারের সাথে ফাইট সব যুদ্ধ জিতে গিয়েও আজ সে পরাজিত।
তখন ইনজাম রিদয়ের গলা টিপে ধরে রিদয় ছটফট করতে করতে মারা যায়। তখন ইনজাম হাসতে থাকে আর বলে। নাও আমি তোমায় মুক্তি দিলাম।
.
.
কবরস্থান থেকে ফিরে এসে ইনজাম এসে বিছানায় শুয়ে পরে আর বলে আমিও আসতেসি তোমার কাছে রিদয় তোমার গলা টেপার আগে আমিও যে হেমলক বিষ পান করেছি। হয়তো বিষটা ধীরে ধীরে আমাকে মারবে কিন্তু কেউ আমাকে তোমার কাছে আসতে আটকাতে পারবে না। তুমি একদিন বলেছিলে তুমি যেনো আমার আগে মরতে পারো তোমার কোনো স্বপ্ন ত পুরন করতে পারি নি এই স্বপ্ন টা পুরন করলাম। আসছি আমি প্রিয়।
এভাবে ইনজাম ঢলে পরলো মৃত্যুর কোলে।
.
.
.
কিছু কিছু মানুষের জীবন থাকে দুঃখ বেদনায় ভরা।সুখ নামের সোনার হরিণ সবসময় তাদের অধরা থেকে যায়। যদি জন্মান্তর বলতে কিছু থাকে হয়তো সেই জন্মে রিদয় আর ইনজাম তাদের স্বপ্ন গুলো তারা পুরন করবে।
লেখকঃ নূর হোসেন তানভীর
প্রকাশেঃ সাতরঙা গল্প