
লেখকঃ অরিত্র হোসেন
সকাল কখন হয়, আর রাত কখন হয় টেরই পাইনা। ঘড়ি দেখতে ইচ্ছে করে না। দেখে কি লাভ? ঘণ্টার পর ঘণ্টা চলে যাচ্ছে। পৃথিবী থমকে গিয়েছে। মানুষের জীবনে অনিশ্চয়তার মেঘ দৌড়চ্ছে। খাঁচার ভিতর মানুষ নিজেকে কি বন্দী রাখতে কি চায়?
বন্দী হিসেবে থাকা আমার জন্য নতুন কিছু না। দাবি করছি না কখনও ‘জেল’ এ ছিলাম, তবে নানা সামাজিক পরিস্থিতি, এমনকি নিজের জান বাঁচাতে জোর করেই বন্দী জীবনযাপন করতে হয়েছে এবং এখনও হচ্ছে।
ভিন্ন সময়, ভিন্ন পরিস্থিতি। এই জান বাঁচানোর রাজনীতি খুব অদ্ভুত। কখনও মানুষ, কখনও ভাইরাস। নিস্তার নেই কারোর কাছ থেকেই।
হঠাৎ করেই পরিস্থিতি বদলে যায়। সবকিছু ছেড়ে ছুঁড়ে, সবকিছু থেকে নিজেকে সরিয়ে আনতে হয়। নিজের অস্তিত্বকে সিন্দুকে বন্দী করে রাখতে হয়।
এই বন্দী থাকার ইতিহাস যদিও নতুন কিছু নয়, তবে বিভীষিকাময় দিনকালের পুনরাবৃত্তি মোটেও মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী নয়।
মার্চের মাঝখানে তড়িঘড়ি করে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ হয়ে গেল। আমি নিজেকে অনিচ্ছার সত্ত্বেও বন্দী ঘোষণা করলাম। তবে স্বেচ্ছায় বন্দী, আর অনিচ্ছায় বন্দী হবার মধ্যে পার্থক্য আছে। ভেবেছিলাম হয়তো এক সপ্তাহর মতো এই বন্দী জীবনযাপন কাটাতে হবে। না! গড়াতে গড়াতে এপ্রিল মাস চলে এসেছে। গতকাল শেষ রাতে যখন টের পেলাম, আমি নিজের অন্ধকার ঘরকে এক নজর দেখে নিলাম। এই চার বছর আগে আমাকে বন্দী থাকতে হয়েছে, এই ঘরটিতে। কবে যে বের হতে পারবো, আদৌ বাঁচবো কিনা, পরিচিতদের দেখতে পারবো কিনা, নিজের জীবনের চাকা আবার সচল হবে কিনা জানতাম না। জানতাম না বেঁচে থাকবো কিনা। প্রতি মুহূর্ত কাটত ‘এই কেউ এলো’ এমন আতঙ্কে।’ পরিবারের জন্য মায়া হতো, অন্তত তাদেরকে মুক্তি নিজেকে উৎসর্গ করতেও চেষ্টা করা হয়। সাহসে কুলায়নি, পিছপা হতে বাধ্য হয়েছিলাম। তবে সেসময় অনুধাবন করেছি আমারও মতো অনেকেই সে অবস্থার শিকার। তাদের মধ্যে অবশ্য কিছু মানুষ নিস্তার পেয়ে গেলো। দিব্যি ঘুরে বেড়াতে লাগলো। নিজেদেরকে মুক্ত করতে পেরেছিল। সমাজের রাজনীতির খেলায় কেউ থাকে বন্দী, কেউ হয় মুক্ত।
পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা লিখেও বুঝানো যাবে না সেই অসহ্যকর অনুভূতি।
আমার সঙ্গে আমার ঘরের সম্পর্ক ভয়ানক অদ্ভুত। ফ্ল্যাটের কাজ শেষ হতেই নিজের ঘর গুছাতে লাগলাম। ছোটবেলার স্বপ্ন অবশেষে সত্য হল! কত দিন কেটেছে এই ভেবে ‘আচ্ছা বাইরে খেতে হবে না, টাকা বাঁচাতে হবে। আচ্ছা, কাপড় লাগবে না। আচ্ছা, একটু কষ্ট করেই চলি। আমার আশেপাশের মানুষ খাচ্ছে, ঘুরছে, কিনছে তাতে কি? সব ধৈর্যের প্রতিদান একসময় পাবই।’ যে বাড়ির জন্য ছোটবেলা থেকে নানা ধরণের চড়াই-উতরাই পার করে এসেছি – ২০১৬ সালের পরে সেই নিজের ঘর, বাড়ির প্রতি এক বিতৃষ্ণা চলে এসেছে। বাড়ির এই জায়গায় জন্মের পর থেকেই আছি, তবে এক হত্যাকাণ্ড আর নিজের জান অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার সংগ্রামে লড়তে লড়তে শক্তি হারিয়ে ফেললাম। নতুনভাবে সবকিছু শুরু করবার পণ করেও, সেই ঘর এখন আমার কাছে মানসিক অশান্তির এক বিশাল মাধ্যম। চার মাস বিদেশ থেকে আসার পর ঘরে ঢুকতেই পুরানো সব স্মৃতি একদম জাপটে ধরল। মনে হচ্ছিল, এই বুঝি এক দীর্ঘ ঘোর কেটে গেল মাত্র। মানুষের ভয়ে ২০১৬ সালে, আর ভাইরাসের ভয়ে ২০২০ সালে বন্দী, তবুও অদৃশ্যভাবে আমি আজীবন বন্দী এই সমাজ, এই রাষ্ট্র এবং এই রাজনীতির কাছে। সবকিছু ধীরে ধীরে ভেঙে পড়ছে। জোড়া লাগবে না, নতুন করে তৈরি করার প্রশ্নই উঠে না।
বন্দী জীবন কখনও ছেড়ে যায় না আমায়। বার বার ফিরে আসে। হাঁসফাঁস লাগে। পুরনো মানসিক আঘাতে বার বার আহত হচ্ছি।মাঝে মধ্যে মনে হয়, মানসিকভাবে নিহত হয়তো হয়েই আছি। এখন পালা সেই সত্যকে স্বীকার করে নেওয়া।
এই বন্দীর কোন মুক্তি নেই।