
(১)
রাতের মায়া চাদরে ঢেকে আছে ফুলপুর নামের গ্রামটি। এই গ্রামেরই ছোট্ট একটা কুটিরে এই গভীর রাতেও জেগে আছে একটি প্রাণ। নিষ্পলক চেয়ে আছে আকাশের নিষ্প্রভ চাঁদটির দিকে। ঝলসানো রুটির মত চাঁদটারও বুঝি তার মতই অভিমান হয়েছে৷ বাইরে সেই কখন থেকে একই সুরে ঝিঁঝিঁ পোকা ডেকে চলেছে৷ বাড়ির দক্ষিণ দিকের শিমুল গাছটায় বসে হুতুম পেঁচাটাও কেমন করে ডেকেই চলেছে৷ থামার নাম গন্ধ নেই৷ বাড়ির সবাই বোধয় ঘুমিয়ে গেছে৷ এবার তবে উঠা যাক৷ গায়ের নকশি কাঁথাটা সরিয়ে উঠলো অরু৷ দিদি বেঘোরে ঘুমাচ্ছে৷ দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়ালো অরু৷ আধভাঙা নড়বড়ে দরজাটার খিল খুলার আগে পিছনে একবার ফিরে তাকালো সে৷ নাহ চিন্তা নেই৷ দিদি এখন আর উঠবেনা। আলতো করে খিলটা টেনে দরজা খুলে বাইরে বের হলো অরু। আজ এত রাতে বাইরে বের হয়েও তার ভয় করছেনা৷ অন্যদিন হলে দিদিকে টেনে তুলে তারপর বের হতো।
পা টিপে টিপে অরু সদর্পে এগিয়ে চললো মা-বাবার ঘরের দিকে। দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে সে। কিসের একটা দ্বিধা কিংবা ভয়ের জন্য দরজাটা সে খুলতে পারছেনা। কিন্তু আজ তো তার ভয় পেলে চলবেনা৷ ভয়কে জয় করতেই হবে৷ কাঠের দরজাটার ফাঁক দিয়ে খিলটা খুলা যাবে৷ সে আস্তে আস্তে নিঃশব্দে খুলার চেষ্টা করতে থাকে। হুট করেই শিমুল গাছটায় পেঁচার ডানা ঝাপটানিতে সে ভয় পেয়ে যায়৷ পিছিয়ে এসে মাটিতে বসে পড়ে। কিছুক্ষণ সে বসে থাকে এভাবেই৷ নাহ যে করেই হোক আমাকে কাজটা হাসিল করতেই হবে৷ যে করেই হোক। এ আমার প্রতিজ্ঞা।
মনকে শক্ত করে উঠে দাঁড়ালো অরু। এবার সে খিলটা খুলতে সক্ষম হলো। আলতো পায়ে ঘরে ঢুকে সোজা চলে গেল ঘরের উত্তর কোণে। একটা টিনের ট্রাংক রাখা আছে সেখানে৷ অরু খুব সতর্কতার সাথে ট্রাংকটা খুললো। খুলে তার মায়ের লাল বেনারসি শাড়িটা নিলো। পাশেই রাখা মায়ের বালা জোড়াটা। দিদির পুঁতির মালাটা সে সকালেই নিয়ে রেখেছিলো। ট্রাংকটা বন্ধ করে সে এবার গেলো টেবিলে রাখা একটা বাক্সের কাছে। সেখান থেকে মায়ের আলতা আর সিঁদুর কৌটোটাও নিলো।কিন্তু সে লাল টিপ কোথায় পাবে? বাড়িতে রো লাল টিপ নেই। যাক আলতা দিয়ে বানানো যাবে তো। জিনিস গুলো হাতে পেয়ে অরু বেজায় খুশি৷ দিগ্বিজয়ের হাসির রেখা তার আস্যতে।
জিনিস গুলো নিয়ে খুব সাবধানে ঘরে চলে আসে।
(২)
অরু সবার আগে হাতে পায়ে আলতা পড়েছে৷ আলতা শুকানোর জন্য অনবরত মুখ দিয়ে ফুঁ দিচ্ছে সে৷ আর মিটিমিটি হাসছে। এবার সে শাড়ি পড়বে৷ কিন্তু শাড়ি পড়তে গিয়েই বাধে বিপত্তি৷ জড়ির কাজের শাড়িটা জড়াতে গিয়ে পিঠে লাগতেই আঁতকে উঠে অরু৷ চ্যালা কাঠের আঘাতে দগদগে আঘাতের যন্ত্রণা যেনো দ্বিগুণ বেড়ে যায়৷ রক্ত ঝড়াও শুরু হয়।
সকালের কথা মনে পড়ে গেলো অরুর৷ রোজকার মত আজকেও তার বাবা মাঠ থেকে ফিরেছিলো। তখন সে তার নিজের ঘরে ছিলো। দিদির ভাঙা মেকাপ বক্সটা দিয়ে সে আনমনে সাজছিলো। পড়নে তার দিদির আদ্ধেক ছিড়ে যাওয়া জামাটা। বাবা হুট করেই ঘরে ঢুকে যায়৷ অরুকে এসব করতে দেখে মাথায় রক্ত চড়ে যায়৷ যে ছেলের জন্মের খুশিতে হালের সবচাইতে বড় গরুটা বেচে পাড়ার লোকদের নেমন্তন্ন করে খাইয়েছিল, যে ছেলের জন্মের খুশিতে মা কালীকে জোড়া পাঠা উৎসর্গ করেছিল, যে ছেলের জন্মে আশার প্রদীপ জ্বলেছিলো তার মনে এই বুঝি আমার দুঃখ ঘুচাবার দূত এসেছে সে ছেলের কিনা মেয়েদের মত স্বভাব চরিত্র৷ সারাদিন পাড়ায় পাড়ায় মেয়েদের নেচেকুদে বেড়ায়৷ সাজগোজ করে৷ প্রথম প্রথম যখন করতো তখন ভেবেছে নেহাতই মজার ছলে করে। কিন্তু দিনকে দিন এসব অকাজ বেড়েই চলেছে৷ এর একটা বিহিত করা দরকার।
অরুকে জিজ্ঞেস করে সে,
-কি করতাছস তুই এইহানে বইয়া?
-বাবা আমি মাইয়া সাজেতেসি৷ দেহো আমারে কি বালা দেহা যায়।
অরু কিছু বুঝে উঠার আগেই রামলাল বাবু ছেলের কপোলে সজোরে একটা থাপ্পড় মারে৷ অরু হতভম্ব হয়ে যায়৷ নিজের দোষটা বুঝতে পারেনা। কেননা এসব করার জন্য তার বাবা তাকে কখনোই কিছু বলেনি৷ তবে আজ কি হলো বাবার। বাবা তো আগে গাল টেনে বলতো ছোট্ট পরীর মত লাগছে৷ তার বাবা লিপস্টিক অব্দি ঠিক করে দিত। জীবনের প্রথমবার তার বাবা তাকে মেরেছে৷ অরু চিৎকার দেয়না৷ কেমন ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে দাঁড়িয়ে থাকে৷ অরুর বাবার চেঁচামেচি শুরু করে৷ অশ্রাব্য ভাষায় গাল দিতে থাকে। শুনে অরুর মা আর দিদিও চলে আসে৷
(৩)
-কি হইসে বাবা৷ তুমি আইজকা আমারে মারতেসো ক্যান?
-কথা কইবিনা তুই বান্দির পুত৷ তোরে জন্ম দিয়া কি আমি পাপ করসি? তুই ক আমারে। তোর লাইগা মাঠে ঘাটে আমার কথা হুনতে হয়৷ আইজকা গফুর মিয়া কয় আমি নাকি হিজরা জন্ম দিসি৷ আমি নাকি হিজরার বাপ। তুই মাইয়া মাইনষের মত ক্যান চলোস? এইসব হিজরামি করতে তোর শরম করেনা? গ্রামের সব লোক তোরে হিজরা হিজরা বইলা অপমান করে৷ তাও তুই এইসব করস ক্যান?
রাগে ক্ষোভে রামলাল বাবু অরুকে সজোরে ঝাঁকুনি দিয়ে মাটিতে ফেলে দেয়৷ শাল কাঠের চ্যালাটা দিয়ে পিঠের উপর অনবরত মারতে থাকে৷ অরুর গগন বিদারক চিৎকার কারোর কানে পৌঁছায় না৷ মা আর দিদি অসহায় দাঁড়িয়ে থাকে৷ মা আঁচলে মুখ ঢেকে অশ্রুসজল চোখে ছেলের মুখপানে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে৷ দিদি বাবাকে আটকাতে এসেছিলো৷ এক ঝটকায় তাকে ফেলে দেয় রামলাল বাবু। এলোপাথাড়ি পিটিয়ে অবশেষে গামছাটা নিয়ে বের হয়ে যায়।
অরু সারাদিন উঠানে পড়ে থাকে। রামলাল বাবুর হুংকার কেউ যদি ওকে সাহায্য করে তবে তার জায়গা হবেনা এই বাড়িতে৷ তারপর অরু নিজে নিজেই কোনোরকমে উঠে নিজের ঘরে যায়।
(৪)
শাড়ি পড়া শেষ অরুর৷ পিঠে জ্বলছে। জ্বলুক। এই আঘাত তো একদিন শুকাবেই। কিন্তু হৃদয়ের আঘাত? সে কি শুকাবে? আজীবন সেখানে দগদগে ঘা হয়ে থাকবে৷
অরু এবার মায়ের বালা জোড়াটা দুই হাতে পড়ে নেয়৷ পায়ের মলটাও পড়ে নেয়৷ এটা ওর কাছেই ছিলো। আকাশ’দা মেলায় গিয়ে কিনে দিয়েছিলো মলটা। হ্যাঁ আকাশ’দা৷ অরুর সত্যিকারের কাছের একজন মানুষ যে কিনা অরুকে খুব ভালোই বুঝত। অরুর থেকেও বেশি হয়তো। অরুর সব’চে ভালো সময় গুলো এই আকাশ’দার সাথেই কাটানো। বিকেল বেলায় সাইকেলে চড়া, ডিঙিতে চড়া, কাশবেন লুকোচুরি খেলা, বৃষ্টিতে ভিজে কদম ফুল পেড়ে আনা আরো কত্ত কি! সবই আজ বিস্মৃতির অতলে চলে গেছে। মলটা পড়ে অরু পুঁতির মালাটা পড়লো। তারপর মাটির দেয়ালে গেঁথে দেওয়া ভাঙা আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়ালো সে। চোখের নিচে একটু কাজল এঁকে দিলো। এবার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ জিনিসটা বাকি৷ সিঁদুর পড়া৷ খুব ইচ্ছে ছিলো আকাশ’দার হাতে সিঁদুর পড়বে৷ আচ্ছা আকাশ’দা যেদিন পল্লবী বৌদিকে সিঁদুর পড়িয়েছিলো সেদিন কি অরুর সেই ছোট্ট বায়নাটার কথা মনে পড়েছিল একবারো? ”এই আকাশ’দা তুমি আমারে একদিন সিঁদুর পড়াইয়া দিবা?”
আকাশ’দা অট্টহাসিতে ভেঙে পড়েছিল সেদিন৷ কিছু বলেনি। তবে হাসির কারণে অরু কিন্তু খুব অভিমান করেছিল সেদিন। আর অরুর অভিমান আকাশ’দা কিভাবে ভাঙিয়েছিল জানেন? ললাটে চুমু খেয়ে।
আচ্ছা আকাশ’দা কি সেদিন শুনতে পেরেছিল ষোড়শী এক কিশোরের মনে বয়ে যাওয়া সেই ঝড়ের শব্দ? তিক্ততা আর বিষাদের ছায়া কি সে দেখতে পেয়েছিল? দেখতে পেয়েছিল কি অরুর চোখের এক ফোঁটা অশ্রুবিন্দুর?
(৫)
অরু এবার শেষ কাজটা সম্পন্ন করার প্রস্তুতি নিচ্ছে। লাল টিপ বানানোর জন্য সে এক ফোঁটা আলতা আর একটুখানি সিঁদুর নিল। তারপর সেটা টিপের মত করে কপালে পড়ে নিল। এবার সে মাথায় ঘোমটা টা দিয়ে মাটির দেয়ালে গেঁথে দেওয়া ভাঙা আয়নাটার দিকে তাকালো। নিভুনিভু প্রদীপটা ডান হাতে তুলে ধরলো। অপরুপ লাগছে তাকে। একেবারে দেবীর মত। খুব স্বপ্ন ছিলো এরকম দেবীর মত সেজে একবার হলেও সে নিজেকে দেখবে, দেখাবে সবাইকে৷ মায়ের কাছে কত্ত বায়না ধরেছে সে যেন এভাবে বেনারসি পড়িয়ে সাজিয়ে দেয়৷ দিদিকেও বলেছিলো। অতঃপর আজ এই শরৎ নিশিতে তার স্বপ্ন পূরণ হয়েছে। প্রথমবারের মত নিজের অন্তরের নারী স্বত্তাকে বাহ্যিক ভাবে ফুটিয়ে তুলেছে সে৷ শিরা উপশিরা আর রক্তের প্রতিটা কণায় মিশে গেছে যে স্বত্তা যা কোনোদিন সে অস্বীকার করতে পারেনি তারই বহিঃপ্রকাশে আজ সে বেজায় খুশি৷ মুক্ত পাখির মত স্বাধীন আজ সে। অরুর চোখে জল ছলছল করছে৷ আনন্দের জল এটা৷
এবার অরু কবাট খুলে আস্তে আস্তে আবার বাইরে এলো। তারপর মলে মৃদু ঝংকার তুলে গুটি গুটি পায়ে দেবীর মত করে এগিয়ে চললো বাড়ির দক্ষিণ দিকের মেঠো পথটা ধরে…………..!!
গফুর মিয়া আর তার ১১ বছর বয়সী ছেলে ভোর রাতে উঠে ঢুলতে ঢুলতে খেতে সেচ দিতে যাচ্ছিলো। তারপর রাস্তার ধারে পলাশ গাছটায় কিছু একটা দেখতে বিকট চিৎকার মেরে অজ্ঞান হয়ে যায়৷ সকাল বেলা পুরো ফুলপুর গ্রামে রটে গেলো অরু হিজরাটা মরেছে৷ অনেকেই দেখতে এলো বেনারসি পরিহিত দেবী সাজের অরুকে৷ একটা রশিতে সবচেয়ে নিচের ডালটায় ঝুলছে অরুর লাশ। সকালে মৃদু সূর্যের আলোর প্রতিফলনে দূর থেকে দেখে মনে হয় যেন এই শরৎেও পলাশ গাছটায় কিছু পলাশ সদ্য পুষ্পিত হয়েছে।
গ্রামের মোড়ল খবরটা শুনে দুঃখ করে বললো, “আহারে বেচারা। এত অল্প বয়সেই মইরা গেছে।” ঠোঁটের কোণে কিন্তু ঠিকই বিজয়ের হাসি।
লেখকঃ শাফিন রাজ
প্রকাশেঃ সাতরঙা গল্প