বরাবর, পৃথিবী

বরাবর,
পৃথিবী
৩০ এপ্রিল, ২০১৬

আমাদের জীবনে মাঝে মাঝে এমন কিছু ঘটনা ঘটে, যা ঘটার পর কোন কিছুই আর আগের মতো থাকে না। দুদিন আগেও আমি জীবন কে যেভাবে দেখতাম তা আর আগের মতো নেই। সব বদলে গেছে। চোখের পলকে।

এই সপ্তাহে আমার দুজন বন্ধু মারা গিয়েছে। আসলে মারা গিয়েছে না বলে বলা ভালো মেরে ফেলা হয়েছে। মৃত্যু ব্যাপারটা খুব কঠিন। কারো স্বাভাবিক মৃত্যু মেনে নিতেই আমাদের ভয়ানক কষ্ট হয়। আমার বন্ধুদের খুন করা হয়েছে পৈশাচিক তম উপায়ে। তাদের জবাই করে হত্যা করা হয়েছে। স্বাভাবিকভাবেই আমি ভালো নেই। আমার বন্ধুদের হত্যা করার কারণটি কিন্তু খুব সামান্য। আমার বন্ধুদের একমাত্র দোষ তারা LGBT অধিকার নিয়ে কথা বলতো। তারা ব্যাপারটা লুকোচুরির মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখেনি।তারা সরাসরি বলা ভালো প্রত্যক্ষ ভাবে এই অধিকার আদায়ের লড়াইয়ে যুক্ত ছিল।

আমার এই দু’জন বন্ধুর সাথে আমার পরিচয় LGBT অ্যাক্টিভিটি নিয়ে কাজ করার সময়। আমি এই অ্যাক্টিভিজম এ জড়িয়েছিলাম LGBT নিয়ে মানুষের ধারণা কে বদলে দেয়ার তুমুল আকাঙ্ক্ষা থেকে। কারণ আমি মনেপ্রাণে বিশ্বাস করি সচেতনতা বৃদ্ধির মাধ্যমেই এর গ্রহণযোগ্যতা তৈরি করা সম্ভব। বলে রাখা ভালো, আমি নিজেও একজন সমপ্রেমী। আমি নিজে একজন নারী। প্রতিটি নারীর মতো আমিও ছোট্ট সুন্দর একটা সংসারের স্বপ্ন দেখি। পৃথিবীতে আমিও একটা প্রাণকে বড় করে তুলতে চাই। একটি শিশুকে বড় করে তুলতে চাই। তবে তা আরেকজন নারীর সাথে।

জুলহাজ ভাই একজন চমৎকার মানুষ ছিলেন। কনফিডেন্ট, ধীর স্থির, সাহসী এই মানুষটিকে আমার নিখুঁত মনে হতো। বিভিন্ন ইভেন্টে উনার আন্ডারে আমি কাজ করেছি। আর তনয়ের কথা কি বলবো? Full of talent একটা ছেলে। থিয়েটার করতো তনয়। আমি মুগ্ধ হয়ে সবসময় ওর কাজ দেখেছি। এমন অনেকসময় গিয়েছে পুরো ইভেন্টে আমি একাই মেয়ে। অনেক জন সমপ্রেমী পুরুষের থাকাটা একটা মেয়ের জন্য অবশ্যই নিরাপদ। কিন্তু বিব্রত যে লাগতো না তা নয়। তনয়ের জন্য এ ব্যাপারটি আমি কখনোই অনুভব করিনি। আমি হয়তো একা এক কোণে স্মার্ট-ফোন গুঁতচ্ছি তনয় তখন আমাকে সংগ দিচ্ছে। এই ফিল্ডে খুব কম সংখ্যক মেয়ে থাকার অ্যাডভান্টেজ হিসেবেই বলেন আর আমি ব্যক্তিগত জীবনে একটু কিউট টাইপ দেখেই বলেন এই দুজন মানুষের অনেক আদর আমি পেয়েছি।

জুলহাজ ভার আর তনয়ের ঘটনা নিয়ে নিউজ ফিডে যখন ঝড় উঠছিল তখন আমার পৃথিবী থমকে গেছে। আমার দেখা দুজন শ্রেষ্ঠ মানুষের শোকে কাতর হবো নাকি নিজেকে বাঁচাবো আমি ঠিক বুঝতে পারছিলাম না। কাঁদতে কাঁদতে অনলাইনে খোঁজ নিলাম কোথায় পকেট নাইফ পাওয়া যায়। রাস্তায় বের হলে এক অজানা আতঙ্ক আমাকে চেপে ধরে। এই বুঝি কেউ চাপাতি নিয়ে আমার দিকে এগিয়ে আসছে! দলবেঁধে কেউ আমার দিকে এগিয়ে আসলে আমার বুক কেঁপে উঠে। হৃৎপিণ্ড রেসের ঘোড়ার মত ছুটতে শুরু করে। নিজের বাসাতেও আতঙ্কে থাকি। আমার ছোট্ট একটা ভাতিজি আছে। ও হয়তো ডেক্সটার হয়ে যাবে, আমার মা কি সহ্য করতে পারবে আমার এহেন মৃত্যু? জীবনের সবচেয়ে বড় আয়রনির সামনে দাঁড়িয়ে আছি। আমার বাবা মা সত্যিটা জানলে হার্ট ফেইল করে ফেলতে পারে। তথাকথিত লোকে কি বলবে এর যন্ত্রণায়। মেয়ে বিয়ে দেয়া এই সমাজে ফরজ। তারপর মেয়ে মানসিকভাবে কতটুকু বেঁচে আছে তার খোঁজ যদিও সমাজ কখনোই করবেনা।

LGBT নিয়ে যারা কাজ করতো তাদের অনেকেই ফেসবুক প্রোফাইল বন্ধ করে, ফোন নম্বর বাসা বদলে ফেলে বেঁচে থাকার যুদ্ধে নাম লিখিয়েছে। এখন যা পরিস্থিতি মাথা তো কাটা পড়তেই থাকবে। আমি ঠিক জানিনা কবে আমরা এর থেকে বের হতে পারবো।
আমাদের দেশের মানুষ গুলো খুব বিচিত্র। এদেরকে আমি ঠিক বুঝতে পারিনা। নিজে রাতে পর্ণ দেখে হাতের সুব্যবস্থা করতে ব্যস্ত মানুষ গুলো দিনের বেলায় সেলিব্রেটিদের বুকের মাপ খোঁজায় ব্যস্ত। সমপ্রেমী কাউকে মেরে ফেললে তাদের বাহবা দেয়ার ধরন দেখে ভাষা হারিয়ে ফেলি। দুনিয়াতে যেন শুধু তাদেরই বেঁচে থাকার অধিকার আছে।
যাইহোক, এই ঘটনা ঘটার পর আমার কাছের যে কয়টি মানুষ আছে তারা সবাই আমাকে বলেছে দেশ ছেড়ে চলে যেতে। আমি ছোটবেলা থেকে অনেক বড় বড় স্বপ্ন দেখেছি কিন্তু নিজের দেশ ছেড়ে চলে যাবার স্বপ্ন কক্ষনো দেখিনি, কক্ষনো না। আমি ছোটবেলা থেকেই ভালো ছাত্রী ছিলাম, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাশ করেছি, ছাত্রাবস্থা থেকেই সামাজিক নানা কাজে যুক্ত ছিলাম। এখন ভালো চাকরী করছি। আমি সবসময় দেশের জন্য কিছু করতে চেয়েছি। সুবিধা বঞ্চিতদের সাথে কাজ করবো, দেশের ইকোনমিতে কন্ট্রিবিউট করবো অনেক আশা ছিল আমার। কিন্তু আমি কেমন করে এ দেশে থাকবো যেখানে আমার বেঁচে থাকার নূন্যতম গ্যারান্টিটুকু নাই? আমি কেমন করে থাকবো এদেশে যেখানে আমি জানি আমি মরে যাবার পর হোমপেইজ, চায়ের কাপ সবখানে সোল্লাসে ঝড় উঠবে বেশ হয়েছে মরে গিয়ে দেশটাকে সাফ হয়েছে!! এ কেমন মাতৃভূমি? যার বুকে আমার জন্য এতোটুকু জায়গা নাই

আমার খুব ইচ্ছে করছিলো আপনাদের বলি আমার জন্য দোয়া করবেন, কিন্তু তার থেকে বেশি ইম্পরট্যান্ট আসলে এই দেশটার জন্য দোয়া করা। এখানে আমি ভালো নেই। আমরা ভালো নেই।

ইতি,
বাটারটওস

প্রথম প্রকাশ ধী ব্লগ, একটি বয়েজ অফ বাংলাদেশ-এর উদ্যোগ। কপিরাইটঃ বয়েজ অফ বাংলাদেশ। অনুমতি ছাড়া পুনঃপ্রকাশ করা যাবে না।

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.