
ক্লিনিকের বেডে তিথি শুয়ে আছে। তার তলপেটে এখনও ব্যথা করছে। যন্ত্রণায় সে দাঁতে দাঁত চেপে আছে।
ক্লিনিকটা তিথির পরিচিত। এর আগেও সে এখানে অনেকবার এসেছে।
ক্লিনিকটা সুন্দর। বেডের পাশের ফুলদানিতে এক গুচ্ছ গোলাপ ফুল রাখা। পুরো ক্লিনিক জুড়ে বাচ্চাদের হাসিমুখের ছবি ঝোলানো। ছবিগুলোর নিচে লেখা- দুটি সন্তানের বেশি নয়, একটি হলেই ভালো হয়।
অন্য কোনো সময় হলে তিথি আগ্রহ নিয়ে বাচ্চাগুলোর ছবির দিকে তাকিয়ে ভাবতো, “ইশ! এমন একটা দেবশিশু যদি আমার থাকতো!” কিন্তু, এই মুহূর্তে এসব সৌন্দর্য তিথিকে স্পর্শ করছে না।
তার অসম্ভব টেনশন হচ্ছে। সে একমনে দোআ ইউনুস পড়ছে। কয়বার পড়া হলো এটা সে গুনে রাখছে। মনে মনে সে এক সপ্তাহ রোজা রাখার মানত করে ফেলল।
তিথির পাশে তিথির শ্বাশুড়ি আনোয়ারা বসে আছেন। আনোয়ারার হাতে তসবি। তিনি একমনে তসবি জপছেন। মাঝে মাঝে তিনি তিথির মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন।
এমন সময়ে ইমরান রুমে ঢুকল। ইমরানের মুখ শুকনো। মলিন মুখে সে তিথিকে বলল, “বাচ্চাটা এবারও নষ্ট হয়ে গেছে। রিপোর্টে তাই এসেছে।”
ইমরানের কথা শুনে আনোয়ারা গম্ভীর হয়ে গেলেন। এসময় আনোয়ারা বিষদৃষ্টিতে তিথির দিকে একবার তাকালেন। তিথির দিকে তাকিয়ে তিনি দেখেন তিথি কেঁদে ফেলেছে।
তবে, তিথির কান্না তার মন দ্রবীভূত করল না। তার চোখমুখ আরো শক্ত হয়ে গেলো। তিনি উঠে চলে গেলেন।
ইমরান তিথির দিকে তাকিয়ে বলল, “তিথির জরায়ুতে সমস্যা ধরা পড়েছে। জরায়ুর ক্ষত না কী যেন। এজন্যই ওর অ্যাবরশন হয়ে যাচ্ছে।”
*
সিয়াম আর জাহিদ ধানমন্ডির রাস্তা দিয়ে হাঁটছে। সিয়ামের মুখ হাসি হাসি। সিয়াম জিজ্ঞেস করল, “আচ্ছা তোমার সঙ্গে আমার প্রথম দেখা কীভাবে হয়েছিল সেটা মনে আছে?
জাহিদ সিয়ামের দিকে তাকিয়ে বলল, “হ্যাঁ, খুব ভালো মতই মনে আছে। তোমার তখন যা অবস্থা ছিল!”
সিয়াম বলল, “হ্যাঁ। অনেক হ্যান্ডসাম ছিলাম তখন তাই না? হিহিহি!”
জাহিদ হাসতে হাসতে বলল, “হ্যান্ডসাম না ছাই। তুমি ওইদিন যেই শার্ট আর প্যান্ট পরেছিলে তা এখনও চোখে ভাসে।”
সিয়াম হাসিমুখে জিজ্ঞেস করল, “কী পরেছিলাম বলো তো! আমার মনে পড়ছে না।”
– ঢলঢলে একটা জিন্সের প্যান্ট। আর খয়েরি রঙের শার্ট। চোখে ছিল মোটা ফ্রেমের চশমা। এক কথায় আঁতেল আঁতেল লাগছিল তোমাকে।
– দাঁড়াও দাঁড়াও। তুমি মনে হয় খুউব সেজেগুজে ছিলে সেদিন? এত বড় বড় চুল ছিল তখন তোমার মাথায়। তোমাকে দেখে মনে হচ্ছিল জংলী কেউ প্রথম বনের বাইরে বেড়াতে এসেছে।
– ও আচ্ছা। তো, এখনো কি আমাকে জংলী বলেই মনে হয়?
– না। এখন তো তুমি ভদ্রলোক হয়ে গেছো। অফিসের ফর্মাল ড্রেসে তোমাকে যখনই দেখি- বড়সড় ক্রাশ খাই।
– আচ্ছা, তোমাকে প্রপোজ করার দিনের কথা মনে আছে? আমি কিন্তু সেদিন সেজেগুজে এসেছিলাম। প্রপোজ করার পর তুমি বাংলা সিনেমার মতো কেঁদে ফেলেছিলে।
সিয়াম বলল, “মনে আছে। এখনও মাঝে মাঝেই আমার এসব মনে পড়ে।”
সিয়ামের কথা শুনে জাহিদ হাসল। সিয়াম পরম নির্ভরতায় জাহিদের হাত ধরল।
গল্প করতে করতে তারা দুজন এগিয়ে গেল। কিছুক্ষণ পর দেখা গেল সিয়াম আর জাহিদ- দুজনে একটা চায়ের দোকানে বসে হাসিমুখে চা খাচ্ছে।
*
তিথি এই মুহূর্তে তাদের বসার ঘরে চোখমুখ শক্ত করে বসে আছে। তিথির পাশের ঘরে তার শ্বাশুড়ি আনোয়ারা ক্রমাগত চেঁচিয়ে কথা বলছেন। আনোয়ারা বলছেন, “এ কেমন মেয়েছেলে রে বাবা! স্বামীকে বাচ্চা কাচ্চার মুখ দেখাতে পারে না। এর আগেও চারবার একই দশা হয়েছে। বাচ্চা পেটে আসে, কিন্তু বাচ্চা রাখতে পারে না। নির্ঘাত এই মেয়ের কোনো দোষ টোষ আছে। এরকম একটা মেয়েকে যে আমার ছেলেটা কীভাবে বিয়ে করল বুঝতে পারছি না। অলক্ষ্মী মেয়ে একটা।”
তখন ইমরান মা’কে থামিয়ে দিয়ে বলল, “এসব কী বলছ মা? তিথি পাশের ঘরেই আছে। এসব শুনলে ও কী মনে করবে বলো তো?”
আনোয়ারা খেঁকিয়ে উঠে বললেন, “তোর বউকে কি আমি ভয় পাই? যা তোর বউকে ডেকে নিয়ে আয়। বড় আসছে বউয়ের পক্ষ নিয়ে কথা বলতে। যা তুই তোর বউয়ের আঁচলের তলায় গিয়ে বসে থাক। শোন, আমি তোকে একটা কথা বলি। তুই আরেকটা বিয়ে কর।”
এসব চিৎকার তিথির অসহ্য লাগছে। তার নিজের উপরেও রাগ লাগছে। সৃষ্টিকর্তা কেন তাকে মা হওয়ার পূর্ণতা থেকে বঞ্চিত রাখলেন এটা জানতে তার বড় ইচ্ছা করছে। কিন্তু জানার উপায় নেই।
তিথি আবিস্কার করলো তার মাথা ব্যথা করছে।
সেদিন বিকালে তিথি তার ঘরের জিনিসপত্র পরিষ্কার করছিলো। চিরুনিটা ড্রেসিং টেবিলের উপর সে রাখবে এমন সময় ইমরান রুমে ঢুকল। মুখস্থ বলার মতো ইমরান গড়গড় করে তাকে নিতান্তই অপছন্দের কিছু কথা বলতে শুরু করল। তিথি খেয়াল করল তার গলার কাছে কিছু একটা দলা পেকে আছে।
ইমরান বলছে, “শোনো! আমি তো তোমাকে ডিভোর্স দিচ্ছি না। এতো চিন্তা করছ কেন? তোমাকে শুধু আমার বিয়ের পর বাসা বদলে ফেলতে হবে। মোহাম্মদপুরের দিকে আমার চেনা এক কাজিন আছে। সে সব ব্যবস্থা করে রাখবে।”
কথা শুনতে শুনতে তিথি তার বাম হাতে থাকা চিরুনি নাড়াচাড়া করতে লাগল।
ইমরান বলেই যাচ্ছে, “আমার নিজের কি ইচ্ছা আছে আরেকটা বিয়ে করার বলো? মা-ই তো এসব করছে। জানই তো মা’র নাতি-নাতনির কত শখ। বিয়েটা কিন্তু সেজন্যই করছি। তোমার জরায়ুর ওই সমস্যাটা না থাকলে তো আমাকে আবার বিয়ে করতে হতো না। তুমি প্লিজ আপসেট হয়ো না।”
তিথির ইচ্ছা করলো বলতে, “মা বলল বলেই বিয়ে করতে হবে? তুমি কি বাচ্চা ছেলে?” কিন্তু, তার কেন জানি না মনে হলো সমস্ত দোষ তার নিজের। তাই সে কিছু বলতে পারল না।
ইমরান আরো বলছে, “শোনো তিথি! বিয়ের পরও তোমার জন্য আমার টান কিন্তু কমবে না। তুমি তখনও আমার কাছে অতি প্রিয় একজন মানুষ হয়ে থাকবে। আর মাসের শুরুতে টাকাপয়সা সব দিয়ে রাখব। টাকাপয়সা নিয়ে চিন্তা করবে না। এই দেখো! কাঁদছে আবার। তুমি এত ন্যাকা কান্না করো না মাঝে মাঝে!”
*
সায়েন্স ল্যাব মোড়ের কাছে সিয়াম দাঁড়িয়ে আছে। আশেপাশের ফার্নিচারের দোকানের আয়নায় সে নিজেকে দেখলো। চুল ঠিক করলো কয়েকবার।
তার হাতে ছয়টা লাল গোলাপ। একটা গোলাপের পাপড়ির মধ্যে সে ছোট্ট একটা চিরকুট ভাজ করে ঢুকিয়ে রেখেছে। গোলাপ দেয়ার পর জাহিদ যদি চিরকুটটা কোনোভাবে উদ্ধার করতে পারে তাহলে সে দেখবে চিরকুটে লেখা-
“ছয়টা গোলাপ আমাদের ছয় বছরের রিলেশন উৎযাপন করার জন্য। এবং এখনও আমি তোমাকে ভালোবাসি, ভালোবাসি এবং ভালোবাসি।”
কিছুক্ষণ পর জাহিদ এসে হাজির হলো। সিয়ামকে দেখে জাহিদ হাসল।
সিয়াম এগিয়ে গেলো। জাহিদের হাতে ফুল দিয়ে বলল, “এই নাও। এগুলো তোমার জন্য। আর শোনো, এখান থেকে সোজা রেস্টুরেন্টে যাবো। আজকে আমি তোমাকে খাওয়াবো। বিরিয়ানি খাবে তো?”
জাহিদ কিছু বলল না। ইতস্তত করতে করতে অন্যদিকে তাকালো। সিয়াম বলল, “কী হলো? সব ঠিক আছে?”
জাহিদ সিয়ামের দিকে তাকালো। বলল, “সিয়াম, কাল আমাকে বাড়ি যেতে হবে।”
– হ্যাঁ তো যাবে! এভাবে বলার কি আছে?
– সিয়াম! ২৭ তারিখে আমার বিয়ে।
– দাঁড়াও। বিয়ে মানে? এসব কবে হলো?
– বাবা অনেকদিন ধরেই মেয়ে খুঁজছিলেন। এইতো গত বৃহস্পতিবার পাকা কথা দিয়ে এসেছেন।
– তাহলে আমাদের কী হবে? আজকে তো আমাদের রিলেশনের ছয় বছর হবে।
– আজ আমরা ব্রেকআপ করব। তবে চিন্তা করো না। তোমার সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ রাখব। ভালো বন্ধু হয়ে তো থাকতেই পারি তাই না?
– বুঝতে পারছি না। আমার সব এলোমেলো লাগছে।
– একটু বোঝার চেষ্টা করো। আমার বয়স এখন ২৯। আর তোমার ২৬। এখন আর ছেলেমানুষী করার সময় নেই। লাইফে সিরিয়াস একটা ডিসিশন তো নিতেই হত।
– মানে রিলেশনটা তোমার কাছে ছেলেমানুষী ছিল?
– না তা না। আর এভাবে থাকতে ভালো লাগে না সিয়াম! একটা কোথাও থিতু হতে ইচ্ছা করে ইদানীং। ছয় বছরের রিলেশনটা আর সহ্য হচ্ছে না। লুকিয়ে বাঁচতে ভালো লাগে না আর। আর তাছাড়াও বাড়িতে মা-বাবা দু’জনেই অসুস্থ। তাদের দেখাশোনা করার জন্য হলেও তো একজন মানুষ দরকার।
– আমাকে নিয়ে কি তোমার কোনো সমস্যা হচ্ছে? কেন জানি না আমার মাথা এখনও ঝিম ধরে আছে।
– তুমি খুবই ভালো একটা ছেলে। তারপরেও৷
– তুমি বিয়ে করে ফেললে আমি কী করব?
– তুমিও একটা বিয়ে করে ফেলো। লাল টুকটুকে একটা বৌ আনবে ঘরে।
এসময় সিয়াম কড়া গলায় বলল, “জাহিদ! তুমি খুব ভালো মত জানো আমার পক্ষে একটা মেয়েকে বিয়ে করা অসম্ভব।”
– তাহলে কী করতে বলছ? তোমাকে বিয়ে করব?
সিয়াম কিছু বলতে পারল না।
জাহিদ বলল, “একটা সময় আমিও ভাবতাম বিয়ে টিয়ে না করেই বাঁচব। এখন আর তা মনে হয় না। একটা ছোট্ট ঘটনা শোনো। কয়েকদিন আগে আমি নিউমার্কেটের দিকটায় হাঁটছিলাম। এমন সময় দেখি একটা পিচ্চি ছেলে- তিন-চার বছর বয়স হবে। সে তার বাবার হাত ধরে গুটিগুটি পায়ে হেঁটে বেড়াচ্ছে। পিচ্চিটা এমন সুন্দর! চেরী ফলের মতো ঠোঁট। মাঝে মাঝে সে খিলখিল করে হাসছে আর তার বাবার দিকে তাকিয়ে পরিষ্কার গলায় বলছে, আব্বু আব্বু! খেলনা গাড়ি কিনে দাও না! তার কথা এমন আদুরে যে ইচ্ছা করছিল একবার হলেও তাকে কোলে নেই। তখন বুঝলে, হঠাৎ মনে হলো আমার “আব্বু” ডাক শোনার গোপন একটা বাসনা আছে। আমার নিজের ছেলে সেই বাসনা পূরণ করবে।”
– ও আচ্ছা।
– হ্যাঁ। আর তাছাড়াও এভাবে ছন্নছাড়ার মতো বেঁচে থাকা যায় না। রিলেশনে তো ব্রেকআপ হয়-ই। আমরাও করব। কাঁদতে শুরু করলে কেন আবার? প্লিজ কান্না বন্ধ করো। রাস্তার সবাই আমাদের দিকে তাকাচ্ছে।
– তুমি না বলেছিলে সবসময় সঙ্গে থাকবে?
– “সবসময় সঙ্গে থাকবো”- কথাটার চেয়ে মিথ্যা আর কোনো কথা পৃথিবীতে নেই। আরেক ধরণের মিথ্যা আমরা রিলেশনে যাওয়ার আগে বলি । আমরা বলি “তোমাকে ছাড়া আমি বাঁচতে পারব না”। কারো জন্য আসলে আমাদের বেঁচে থাকা থেমে যায় না। আমরা বেঁচে থাকি। ভালো মতই বেঁচে থাকি। তাই, এই মিথ্যে গুলো যে বিশ্বাস করবে তার মত গাধা এই পৃথিবীতে নেই।
– আমি কিন্তু মন থেকে বলেছিলাম যে আমরা একসাথে থাকবো।
– আমিও বলেছিলাম। তারপরেও আর পারছি না সিয়াম! আমাকে ক্ষমা করো।
সিয়াম চুপ করে রইল।
*
২৭ তারিখে জাহিদের বিয়ে হয়ে গেলো।
“কবুল” বলার আগে জাহিদের চোখের সামনে একবার সিয়ামের মুখ ভেসে উঠল। সিয়ামের মুখ কল্পনায় সামনে রেখেই জাহিদ বলল, “কবুল”।
এই বিয়ে করা নিয়ে বাড়িতে যে কত ঝামেলা হয়েছে তা সিয়ামকে জাহিদ কখনই জানায় নি। জাহিদ বাড়িতে সাফ জানিয়ে দিয়েছিল সে বিয়ে করবে না। মাসের পর মাস জাহিদ বাড়ির কারো সাথে যোগাযোগ রাখে নি। পরে বাধ্য হয়ে তাকে বিয়েটা করতে হয়েছে। কেন জানি না সিয়ামকে জাহিদের এসব কিছুই জানাতে ইচ্ছা করে নি।
নব বিবাহিত স্ত্রীকে নিয়ে ফুল দিয়ে সাজানো মাইক্রোবাসে ওঠার পর জাহিদের চোখ চট করে ভিজে এলো। জাহিদ প্রাণপণ চেষ্টা করতে লাগল চোখে পানি না আনতে। চোখে পানি আনার মতো বিশ্রী একটা দৃশ্য যেন কেউ না দেখতে পায়, সেজন্য সে জানালা দিয়ে বাইরে তাকালো।
এদিকে, একই দিনে বিয়ে হচ্ছে ইমরানের। তবে, ইমরান আগ্রহ নিয়ে বিয়ের প্রতিটা নিয়ম মেনে চলছে। গায়ে হলুদ, ডিজে পার্টি কোনো কিছুই সে বাদ রাখে নি।
হবু বউকেও ইমরানের অসম্ভব পছন্দ হয়েছে। শান্ত, গোলগাল মুখ মেয়েটার। তিথির মতো অস্থির না। শান্তশিষ্ট মেয়েরা মা হিসেবে দারুণ হয় এই আবিস্কার ইমরানের নিজের।
তিথি মেয়েটাকে ইমরান সেদিন আর মনে করতে চাইল না। মেয়েটার কথা মনে হলেই ইদানীং তার গা জ্বলে ওঠে। আপদ বিদায় হলেই সে বাঁচে।
“কবুল” বলার অংশটা শেষ করতে ইমরানের এক সেকেন্ডও লাগল না।
*
তিথি এখনো ইমরানের বাসাতেই আছে। তবে সে এই মুহূর্তে তার ট্রলিব্যাগে কাপড়চোপড় গোছাচ্ছে। ইমরান নতুন বউ নিয়ে আসার আগেই সে বাড়ি ছেড়ে চলে যাবে। চলে যাওয়ার জন্য অবশ্য তাকে কেউ জোরাজুরি করে নি। আবার থেকে যাওয়ার জন্যেও কেউ কিছু বলে নি। তাই, তিথি স্বেচ্ছায় বাড়ি ছাড়ছে।
ব্যাগ গোছাতে গোছাতেই তিথি দেখল ফিরোজা রঙের শাড়িটার ভাজ এখনও খোলা হয় নি। এই শাড়িটা ইমরান তাকে জন্মদিনে উপহার দিয়েছিল। উপহার দেয়ার সময় মানুষটার সে কতো আবদার! সেই আবদার এখন কোথায়?
আচ্ছা বিয়ের আগে মানুষটার সঙ্গে ধানমন্ডি লেকের পাশে বসে গল্প করার সেই সময়টা কি আর কখনো ফিরে পাওয়া যাবে না? কিংবা, বিয়ের পরে দু’জন বারান্দায় বসে কফি খাওয়ার সময়গুলো কি আর আগের মত আসবে না?
মানুষ কি এতো দ্রুত বদলায়?
আচ্ছা, বাচ্চা নেয়ার বিষয়টা কি খুব জরুরি? অনেকেই তো সারাজীবন নিঃসন্তান থেকে যায়। জাহিদ কি এভাবে থাকতে পারবে না? তারা কি একটা বাচ্চা দত্তক নিতে পারে না?
তিথি দীর্ঘশ্বাস ফেলল। তার ক্লান্ত লাগছে। সে একবার হাই তুলল। ব্যাগ গোছানো শেষ হওয়ার পর সে বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়ল। বেরুনোর সময় তাকে কেউ আটকালো না। এই বাড়িতে তার উপস্থিতি এখন অপ্রয়োজনীয়। সে চলে গেলেই সবাই মুক্তি পাবে।
তিথি মনে মনে ঠিক করলো বাসা থেকে সোজা বাসস্ট্যান্ডে যাবে। বাসস্ট্যান্ট থেকে সিলেটের গাড়ি ধরে সোজা সিলেট।
কিন্তু সে ঠিকমতো পা ফেলতে পারছে না। তার হাঁটার ভঙ্গি এলোমেলো। তিথির মনে হলো তার মাথাটা ঘুরছে। সে মাটিতে বসে পড়লো। পরের কিছু সময় তিথিকে নিজের চোখ মুছতে দেখা গেল।
*
সেই একই রাতে সিয়াম বাড়ির ছাদে চলে এলো। তার হাতে মগভর্তি গরম চা।
সিয়াম মোবাইলে সময় দেখল। রাত এগারোটা বেজে গেছে। এতক্ষণে নিশ্চয়ই জাহিদের বিয়ে টিয়ে হয়ে গেছে। সিয়াম ঠিক করলো সে আর জাহিদের কথা ভাববে না। অনেক কষ্ট লাগলেও না।
অনেকটা সময় সিয়াম একভাবে ছাদে দাঁড়িয়ে রইলো। তার দৃষ্টি আকাশের দিকে। আকাশে আজ চাঁদ উঠেছে। তারা তেমন একটা নেই। ঢাকার দূষণ মনে হয় বেড়ে যাচ্ছে। দূষণের জন্য তারা ঢাকা পড়ছে।
সিয়ামের আবার জাহিদের কথা মনে পড়ছে। সে নিজের চিন্তাকে আর বাঁধা দিলো না।
এ ধরণের সম্পর্কের মূল গন্তব্য আসলে কোথায়? খুব সম্ভব গন্তব্য নেই। প্রেম করে বেড়াও, কিন্তু এর বেশিদূর যেও না। আবার সেই প্রেম/রিলেশন করা নিয়েও কত কথা পেটের ভিতর চেপে রাখতে হয়। কত অপরাধবোধ থাকে পেছনে!
কিছু কিছু ক্ষেত্রে ব্রেকআপ এত দ্রুত হয় যে রিলেশনে যেতেই ভয় করে।
তারপরেও সিয়াম রিলেশনে গিয়েছিল। কিন্তু সে জানত না এই ধরণের সম্পর্কের গন্তব্য অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ব্রেকআপ। কী যে আশ্চর্য লাগছে এখন সিয়ামের!
তাহলে কি ব্রেকআপ অবশ্যম্ভাবী জেনেই রিলেশনে যেতে হবে?
সেই রাতে কেন জানি না মেয়েদের মা হওয়ার ক্ষমতার ওপর সিয়ামের তীব্র ঈর্ষা হতে লাগলো।
আবার কিছুক্ষণ পরেই এরকম হাস্যকর চিন্তা আসায় সে শব্দ করে হেসে ফেলল। হাসির পরপরই কান্না! সিয়াম নিঃশব্দে কাঁদার চেষ্টা করতে লাগল। পারল না। জাহিদের মুখ সে কল্পনা থেকে মুছে ফেলতে চাইল। কিন্তু, এতদিনের চেনা মানুষটাকে কি এক মুহূর্তে ভোলা সম্ভব?
*
জাহিদ নতুন বউ নিয়ে বাড়ি এসে পৌঁছেছে। তাদের বাড়িতে জোরেশোরে গানবাজনা হচ্ছে। জাহিদকে দেখা গেলো তাদের বসার ঘরে। গম্ভীর মুখে সে বসে আছে।
এসময় জাহিদের বড় বোনের বাচ্চা মেয়েটা এসে তার হাত ধরলো। মেয়েটা পুরো শব্দ বলতে পারে না। সে ভেঙে ভেঙে জাহিদকে বলল, “মামা, তুমি আজকে পাঞ্জাবি পরেছো কেন?”
জাহিদ হাসল। আদুরে গলায় জাহিদ বলল, “আজ আমার বিয়ে তো এজন্য। আমাকে সুন্দর লাগছে না?”
মেয়েটা মাথা নাড়ালো। তার কাছে জাহিদকে সুন্দর লাগছে।
এরও অনেক পরে জাহিদকে একমনে বাড়ির বারান্দায় বসে থাকতে দেখা গেলো। তার চারদিকে বন্ধুরা বসে আছে। বন্ধুরা নানান রকম গল্প করে হাসাহাসি করছে। জাহিদ কিছুতেই মন দিতে পারছে না।
তার মন পড়ে আছে বহুদূরে।
*
অন্যদিকে, সিলেটের বাসে উঠে তিথি জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে ক্রমাগত চোখ মুছতে লাগল।
*
পৃথিবীর ভিন্ন ভিন্ন জায়গায় বাস করা চারজন মানুষ একই দিনে তাদের প্রিয়জনের থেকে আলাদা হয়ে গেলো। সেই বিচ্ছেদের পেছনে থাকা অনেকগুলো কারণের মধ্যে জরায়ু নামক একটা অঙ্গ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করলো।
লেখকঃ ফাহিম হাসান
প্রকাশেঃ সাতরঙা গল্প