
অরিত্র কে নিয়ে আর পারা যায় না, বাচ্চাটা যে কি ভীষণ দুষ্টু হয়েছে! কেন যে ইদের ছুটিতে এই শহরেই আসতে হয় ওর বাবার! ফারিয়া বেশ চিন্তিত, ফারিয়া,অরিত্রর মা।
অরিত্রকে নিয়ে শপিং এ এসেছে, কিন্তু বদমাশ ছেলেটা যে কই গেল! হারিয়ে গেল না তো আবার! চিন্তিত ফারিয়া এদিক সেদিক খুঁজতেই দেখতে পেল মাঝবয়সী এক লোকের হাত ধরে আছে অরিত্র। দৌড়ে ছুটে গেল ফারিয়া।
-এই ছেলে, কতবার বলেছি এভাবে লুকোচুরি করবে না! তার উপর অচেনা শহর! যদি কিছু হয়ে যেত?
অরিত্র কিছু বলার আগেই লোকটি বলে উঠলো, কিছু হয়নি, হতে পারতো, এতটুকু ছেলে, একা একা রাস্তা পার হচ্ছিল!
ফারিয়া-কি বলে যে আপনায় ধন্যবাদ দিব! আপনার নাম টা?
-আমি আয়ান। এ শহরেই থাকি। একটি স্কুলে বাংলার শিক্ষকতা করি।
-আমি ফারিয়া, বাচ্চাটি আমার, ওর নাম অরিত্র। ওর বাবা আকাশ এ শহরেরই ছেলে। বছর দশেক হলো, দেশের বাইরে থাকা হয়। ইদের ছুটিতে এসেছি। চৌধুরী বাড়িতে আছি আমরা। সময় করে একদিন আসবেন, ওর বাবা সহ জম্পেস আড্ডা দেয়া যাবে, বাংলার শিক্ষক বলেই বলছি, আমরা দুজনে অসম্ভব সাহিত্যপ্রেমী!
-জ্বী অবশ্যই। একদিন সময় জরে যাওয়া যাবে। সাহিত্য নিয়ে আলাপ তো! অগ্রাহ্য করতে পারি না! আজ তবে এগোই!
এগুতে এগুতে আয়ানের খটকা লাগলো! “আকাশ! চৌধুরী বাড়িতে থাকে!বাচ্চার নামটাও ততক্ষণে মাথায় যেনো দুয়ে দুয়ে চার মিলিয়ে দিল! “অরিত্র” আহ অরিত্র! আমাদের অরিত্র!
হাঁটতে হাঁটতে হুট করেই যেন থেমে গেল আয়ানের পৃথিবী। প্রায় ১২ বছরই তো হলো! কেন সে এই স্মৃতি থেকে বেরোতে পারেনা?কেন বার বার ঐ দিনগুলো ঝড় তুলে উড়িয়ে দেয় তার মন কে!
আকাশ ও আয়ান! স্কুল জীবন থেকেই যারা গাঁটছড়া বেধেছিল, একজন আরেকজন কে ছাড়া কিচ্ছুটি বুঝতো না। এ নিয়ে বন্ধুরা কম পচায় নি তাদের! তারাও কম যায় না! হেসেই উড়িয়ে দিত সব পচানি। গায়ে মাখতো না। এই হরিহর আত্মা ভালো করেই জানতো এসব গায়ে মাখালে তাদেরই বরং জীবনকে উপভোগ করা হবে না।
সেই দিনটির কথা আয়ানের খুব মনে পড়ছে। একবার কি যেন তুচ্ছ বিষয় নিয়ে তাদের মাঝে বেশ ঝগড়া হয়েছিল, আকাশ সেবার বেশ বাজে ব্যবহারই করেছিল আয়ানের সাথে। ভুল বুঝতে পেরে আকাশ বরং দমে না গিয়ে একের পর এক চেষ্টা করছিল। একবার তো ১০০টা লাল গোলাপ দিয়ে লিখেই ফেললো, “ফিরে আসবি নাকি ফিরে যাবো?” গোলাপ আর আকাশ দুটোই আয়ানের ভালোবাসা, দ্বিতীয়টি বরং হাজারগুণ বেশি, তাই সেবার তারা মান অভিমান ভেঙে কাছে ফিরলো, অথচ কেউ কখনো কাউকে বলছে না তারা ভালোবাসে!
এমনও কি হয়! ভাবতে থাকে আয়ান!
নাহ এবার আকাশকে কিছু একটা বলতেই হবে। কিন্তু কিভাবে বলবে? সে যদি ক্ষেপে যায়? যদি আর কখনো কথা না বলে!
আয়ান সাহস করে আকাশকে বলেই ফেললো, “আমি যেভাবে ভাবি, তুইও কি তা ভাবিস?”
আকাশ: মানে? কি বলতে চাইছিস তুই?
-বলতে তো চাই অনেক কিছু, কিন্তু…
-বলতে চাস, “ভালোবাসিস?” এইতো?
যেন দৈববাণীতে আকাশ আগেই বুঝতে পেরেছিল!সৃষ্টিকর্তা দুজনের মনে এত মিল দিয়েছিল কিভাবে ভাবতে থাকে আকাশ!
সেই যে সেদিন তারা একে অপরকে জড়িয়ে ধরলো, হাতে হাত রেখে পথচলা শুরু হল কেউ কি ভেবেছিল তাদের জীবনেও ঝড় আসবে?
যেকোনো সম্পর্ক যেন ঠিক ততদিন ভালো থাকে যতদিন সেখানে কোনো কমিটমেন্ট, চাওয়া-পাওয়ার হিসাব এসে দাঁড়ায় না। তাদেরও তেমনই হলো। জীবনের একটা পর্যায়ে এসে আকাশকে বিয়ে করার চাপ দেয়া শুরু হলো পরিবার থেকে।
আয়ান ভেবেছিল, “চাপ দিলেই বা কি সে তো আমাকে ছাড়া ভাবতেই পারেনা! ভবিষ্যৎ সাজাবে আমাকে ছাড়া! এটা অসম্ভব “
সেই আকাশই কাপুরুষের মত বিয়ে করে, দুদিন পরেই দেশের বাইরে চলে গেল! আকাশের বিয়েতে আয়ান এসেছিল। গায়ে হলুদ মাখিয়ে দিয়েছে।আর ভেবেছে এর চেয়ে বরং যদি নিজের শরীরে বিষ দিতে পারতো কতই না ভাল হতো! যে শরীরে আজ সে হলুদ লাগালো,যেখানে এতদিন তার অধিকার ছিল আজ থেকে সেটা অন্য কারো!
যাইহোক এসব ভাবতে ভাবতে আর অরিত্রর কথা চিন্তা করতে করতে আয়ান বাড়িতে গেল।
পরের দিন ফারিয়ার দেয়া ঠিকানায় আকাশ চলে এলো! উদ্দেশ্য এত বছর পর যদি মানুষটাকে একনজর দেখা যায়! ফেসবুকে তাকে অনেক খুজেছে কিন্তু পায়নি!
ফারিয়া: আয়ান সাহেব! এসেছেন ভালোই করেছেন।আজ হাতে তেমন কাজও নেই। চলেন বারান্দাটায় বসি। অরিত্রর বাবা আসবে একটু পর। বসে বসে প্রায় ঘন্টা খানেক হয়ে যায়। আকাশ কেন আসছে না! ছটফট করছে আয়ান। নাহ এমন করে আর ভাল্লাগে না। জিজ্ঞেস করেই বসে,” আচ্ছা, আকাশ সাহেব কোথায়?”
ফারিয়া এবার খানিকটা গুরু গম্ভীর হয়ে বললো, “আপনার আকাশ ২ বছর আগে রোড এক্সিডেন্টে মারা গিয়েছে”
-কিহ! আর আমার আকাশ মানে কি?
-দেখো আয়ান, আকাশ আমাকে সব বলেছিল। তোমার ছবিও দেখিয়েছিল। আকাশ সত্যিই আর নেই। আমায় ক্ষমা করো, আমি ওকে বাঁচাতে পারিনি!
আয়ান কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে বসে আছে।
ফারিয়া আরও বলতে থাকলো, ওই যে দেখো অরিত্র! ছেলেটা আমাদের হলেও নামটা কিন্তু তোমারই দেয়া! আমি জানি আমি ওকে যতটা ভালবাসি, আকাশের সন্তান হিসাবে তুমিও তাকে ততটাই ভালবাসো! কারণ ওর মধ্যেই তো আছে আকাশ! এশহরে আমি এসেছিলাম তোমাকে খুজে বের করতে, সেখানে অরিত্রই কাকতালীয় ভাবে তোমায় খুঁজে পেল! চলো আয়ান জীবনটা নতুন করে শুরু করি! আয়ান এটা আকাশেরই আবদার ছিল, ওর শেষ ইচ্ছা বলতে পারো!
আয়ান ভাবছে, অনেকক্ষণ ভাবছে। “তোমাতে সঁপেছি আমার প্রাণ! এই প্রাণ তো আকাশেই সঁপেছিলাম!আজ নাহয় ওর সন্তানের জন্যই সঁপে দেই নিজেকে!” আকাশের ঔরসজাত সন্তানকেই তো বড় করতে হবে, এটাই তো তার জীবনের চাওয়া ছিল! প্রকৃতি আসলেই যেন কাউকে খালি হাতে ফেরায় না!
লেখকঃ ধূসর পান্ডুলিপি
প্রকাশেঃ সাতরঙা গল্প