
১
ছেলেটাকে প্রথম দেখলাম বারান্দায়।
কোয়ারেন্টাইন মিম আর নেটফ্লিক্স সিরিজ নিয়ে বন্ধুদের সাথে যখন ঝগড়া লেগে যায় যায় অবস্থা, ফোনটার চার্জ তখনই সুন্দরমতো ১%-এ নেমে আসলো। আমি হাফ ছেড়ে ফোনটা চার্জে দিয়ে পেছনের বারান্দায় এসে দাঁড়ালাম।
বিকালের আকাশটা আজ নীল, অন্যান্য দিনের তুলনায় একটু বেশিই। বাসা থেকে বের হতে পারব না জেনেই হয়ত প্রকৃতির এই নিষ্ঠুর হাতছানি। মোড়ায় বসে গ্রিলে মাথা ঠেকালাম। মা মুরগির মাংস দিয়ে কি যেন একটা রান্না করছে। রান্নাঘর থেকে খুব সুন্দর ঘ্রাণ পাওয়া যাচ্ছে।
তখনি দেখলাম উনাকে।
আমাদের মাঝে দূরত্বটা খুব বেশি না, বিশ ফুট হবে। উল্টা পাশের বিল্ডিংটার তৃতীয় তলায় আমার মতই বারান্দায় এসে দাঁড়িয়েছে ছেলেটা।
নড়েচড়ে বসলাম। ওই বাসায় কোনদিন আমার বয়সি কারো দেখা মিলেনি। ল্যাপটপটা কিনার আগে প্রায়ই এসে এখানে বসতাম। কখনো কাউকে দেখিনি।
ছাই রঙের টি-শার্ট, গোল চশমা আর এলোমেলো চুলে চোখ আটকে গেল। পরের বিশ মিনিট কিভাবে চলে গেল বলতে পারলাম না। ছেলেটা উঠে যখন ঘরের ভিতরে চলে গেল, বুঝতে পারলাম, আমারো ঘরে ফেরার সময় হয়েছে।
২
সময়টা মনে গেঁথে গেল।
বিকাল ৫টা। এক মিনিটও নড়চড় নেই।
একদিন, দুইদিন, তিনদিন।
পাঁচদিন, সাতদিন।
উনার দৃষ্টি রাস্তার দিকে, মন খারাপ করা।
আমার দৃষ্টি উনার দিকে।
মন্ত্রমুগ্ধ।
ছাই গেঞ্জি, নীল গেঞ্জি, হলুদ গেঞ্জি, আরও দুয়েক রঙ পরে আবার ছাই রঙে ফেরত আসেন উনি, কিন্তু উনার দৃষ্টি আর আমার দিকে ফিরে না।
আজব। একটা জলজ্যান্ত মানুষ চোখে পড়া কি এতটাই অসম্ভব?
ছোটবোন আমার সাথে বারান্দায় আসে, আমার ছটফটানি দেখে আর মুচকি হাসে।
অষ্টম দিনে মাথায় বিভিন্ন রকমের কুবুদ্ধি খেলতে লাগলো। কি করা যায়?
চিৎকার করব? নাহ, পাগল ভাববে।
জোরে ডাকব? নাহ, ডাকার কোন কারণ নেই। আর নামই তো জানিনা। কি ডাকব?
কথা বলব?
নাহ, থাক।
খোঁচা খোঁচা দাড়িতে ছেলেটাকে সেই মানাতো। তাই দশম দিনে যখন দেখলাম সেই দাড়ি সে ফেলে দিয়েছে, আমার দুঃখের আর কুলকিনারা থাকলো না।
মনে হল চেঁচিয়ে বলি, এই ছেলে! দাড়ি কাটলে কেন?
ধুর। উল্টাপাল্টা কিছু করার আগে দৌড়ে ঘরে চলে আসলাম।
মা বাবা কেউ বুঝলেন না আমার ছোট বোন কেন আমার দিকে তাকালেই শুধু হাসে। বুঝলাম শুধু আমি।
৩
রোগটার নাম মায়োপিয়া। চোখের ব্যারাম। আক্রান্ত মানুষ দূরের জিনিশ দেখে না। চশমা পরলে আবার দেখা যায়। কিন্তু ও তো চশমা ঠিকই পরে।
তাহলে তাকায় না কেন এদিকে?
মনের ভিতর প্রচণ্ড অভিমান নিয়ে পরের দিন বারান্দায় গেলাম। ছেলেটার হাতে টিভির রিমোট কন্ট্রোলারের মত কি যেন একটা।
তাকালই না।
রাগে দুঃখে ওয়ারড্রোব ঘেটে ছোট মামির দেয়া কটকটা টিয়া রঙের পাঞ্জাবি বের করলাম। মামি আমার এসব ব্যাপারে একটু কাঁচা, তাই জন্মদিনে এই বিদঘুটে রঙের জামাটা দেওয়ার পর সেইযে ড্রয়ারে রেখেছিলাম আর বের করিনি।
পাঞ্জাবিটা পরে নির্ধারিত সময়ের এক ঘন্টা আগেই এসে বারান্দায় বসে হাঁ করে রোদ খেতে থাকলাম। বিকালের আলোয় আমার গা থেকে যেন রেডিয়াম ঠিকরে বের হচ্ছে।
এখন হয়ত খেয়াল করবে!
মা সংসার খরচ হিসাব ফেলে দৌড় দিয়ে আসল।
“কি হয়েছে তোর?”
“কিছু না মা,” আমি ঠান্ডা গলায় বললাম, “আজকে মামির কথা অনেক মনে পড়ছে। অনেক বেশি।“
৪
বারোতম দিনে একটা অস্বাভাবিক ঘটনা ঘটল।
নিচতলার আংকেলকে লকডাউনের মধ্যে বাইরে পেয়ে পুলিশ আচ্ছামত মারলো। বারান্দাগুলো মানুষে টইটম্বুর। সবাই নিচের তামাশা দেখতে ব্যস্ত।
এরমধ্যে ছেলেটা প্রথমবারের মত আমার দিকে তাকালো। আমিও ওর দিকে তাকালাম।
ছেলেটা অসহায় একটা হাসি দিল। আমিও হাসলাম। এরপরে খেয়াল করলাম আমার হাত পা কাঁপছে।
আরেকটা দুর্ঘটনা হওয়ার আগে ঘরে চলে আসলাম।
পরেরদিন বারান্দায় যাওয়ার পর ছেলেটা নিজে থেকে তাকালো। মনে হল কানের কাছে কেউ ড্রাম বাজাচ্ছে।
একটু গলা চড়িয়ে বললাম, “এখানে নতুন?”
কপাল কুঁচকে তাকাল সে, তারপর কানের কাছে হাত নিয়ে ইশারা করল, শুনতে পারছে না।
লম্বা একটা শ্বাস নিয়ে দৌড়ে ঘরে গেলাম। একটা খাতা আর মার্কার নিয়ে আসলাম। বড় বড় অক্ষরে লিখলাম, “নতুন এসেছ?”
ছেলেটাকে দেখাতেই তার ঠোঁটের কোনে একচিলতে হাসি ফুটল। ঘরে গেল, কাগজ আর কলম নিয়ে আসল।
“মামার বাসা। আটকে গেছি।“
কাঁপা কাঁপা হাতে আবার লিখলাম, “কিসে পড়?”
“ইন্টার দিবো এইবার। তুমি?”
“ফার্স্ট ইয়ার,” ছোট করে লিখলাম।
ছেলেটা কিছু বলল না। শুধু হাসল। আমি বাকিটা পরের দিনের জন্য রেখে দিলাম। সব আজকেই বলে ফেললে বাকি লকডাউন করব কি?
৫
“Whatsapp আছে?” তেরতম দিনে জিজ্ঞেস করেই ফেললাম। খেয়াল হল, অচেনা এক ছেলের কাছে নাম্বার চেয়ে ফেলেছি। নিজের সাহসের তারিফ নিজেই করলাম মনে মনে।
ছেলেটা মাথা নাড়ল। ক্ষণিকের জন্য মনটা খারাপ হয়ে গেল। মানা করে দিল?
“ফোন নষ্ট,” লিখে তুলে ধরল সে। আরেক হাতে সেই রিমোট কন্ট্রোলার। প্রাগৈতিহাসিক যুগের নোকিয়া বাটন ফোন – চিনতে পারলাম অবশেষে।
দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। কপালে সম্ভবত কাগজ কলমই আছে।
“কবে যে বের হব!” আবার লিখল সে, “ভালো লাগে না।“
“আমারও,” লিখে তুলে ধরলাম, কিন্তু বলতে পারলাম না যে আমার আসলে পুরো ব্যাপারটাই অসম্ভব ভালো লাগছে।
৬.
গল্পটা সুন্দর ছিল।
প্রত্যেকদিন বিকাল ৫টায় আমরা বারান্দায় আসতাম। সাথে কাগজ আর কলম।
আমার রুম আজব আজব লেখাসহ কাগজ ভরে গেল। মা ঘর পরিষ্কার করতে এসে একটা কাগজে লেখা পেলেন, “গোলাপি।“
“এ কি?” একটু অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল মা।
“কিছুনা,” আমি কাগজটা কেড়ে নিয়ে ব্যাগে ভরলাম, “বাংলা বানান প্র্যাকটিস করি।“
“তো এত বড় করে লেখার কি দরকার?” মা পাল্টা প্রশ্ন করে বসল, “কতগুলা কাগজ নষ্ট!”
আমি কিছু বলতে পারলাম না। ছোট বোনটা মুখ টিপে হেসেই গেল।
“দোস্ত, প্রেমে পরসিশ নাকি?” বেষ্ট ফ্রেন্ড সাদী ষোলতম দিনে ভিডিওকলে সব বন্ধুদের সামনেই জিজ্ঞেস করে বসল।
“মানে?”
“বিকাল ৫টায় কই চলে যাস?”
বলতে যেয়েও বলি না। বিকালের ওই আধা ঘন্টা সময়টুকু নাহয় শুধু আমারই থাকলো?
কিন্তু আমাকে অবাক করে দিয়ে আঠারতম দিন থেকে ছেলেটা বারান্দায় আসা বন্ধ করে দিল।
৭
মামার বাসায় এসে আটকে গেছে, সেটা জানতাম। চলে যাবে, সেটাও জানতাম। কিন্তু এভাবে না বলে চলে যাবে কখনও দুঃস্বপ্নেও ভাবিনি।
পরে ভাবলাম, আমাকে বলেই বা যাবে কেন। আমি কে?
পরের দুইদিন বারান্দায় অযথাই বসে থাকলাম। জানতাম আসবে না। তাও বিকাল হতেই যেয়ে অপেক্ষা করতে লাগলাম।
আমার খাতা কলম টেবিলে পড়ে থাকল। পুরান কথোপকথন বের করে করে পড়া শুরু করলাম।
নেটফ্লিক্সে আর মন বসাতে পারলাম না। বন্ধুদের ভিডিওকল রিসিভ করা কমিয়ে দিলাম। পছন্দের মুরগির ঝোল তিতা লাগা শুরু করল। রাতে কাঁদতে যেয়েও কান্না আসলো না। কয়েকদিনের পরিচয়, এমন আর কি। কিছুদিন গেলে এমনিতেই ভুলে যাব।
খাওয়া-দাওয়ার চূড়ান্ত অনিয়মের পর শেষমেশ একবেলা মা যখন কপালে হাত দিয়ে জ্বর মাপতে নিল, তখন কথাটা মাথায় আসলো।
ওর খারাপ কিছু হয়নি তো?
৮
একুশতম দিনে মন খারাপ করা মেঘলা বিকালে এক চিলতে রোদের মত তার চেহারা দেখা গেল। আমি বসা থেকে লাফ দিয়ে উঠলাম।
আকাশী রঙের একটা টিশার্ট গায়ে, চুল আরও এলোমেলো, চোখের নিচে এক পরত কালি।
“কোথায় ছিলে?” আমি লিখে তুলে ধরলাম।
মৃদু হাসি, “জ্বর ছিল।“
বুকের ভিতর কি যেন বাড়ি খেল একটা। কিছু লিখতে চেয়েও পারলাম না।
“???”
আবার হাসল। মাথা নিচু করে লিখল, “সর্দি জ্বর। আমি মরে যাচ্ছি না।“
চেহারায় বিরক্তি ভাব দেখেও শুধু হেসেই গেল। রাগ সপ্তমে উঠলো আমার।
“জ্বর হলে মনে হয় বারান্দায় আসা যায়না?” লিখলাম আমি।
“কেন, খুব মিস করছিলে?” লিখে আমার দিকে ধরল সে।
কলমটা রেখে ঘরে একটা দৌড় দিয়ে চলে আসলাম। মানুষের উদ্ভট প্রশ্নের উত্তর দেয়ার কোনই দরকার নাই। কিন্তু মুখের হাসিটা পরের একটা ঘন্টা আর সরাতে পারলাম না।
৯
পরের দিন সে হাই হ্যালো সব বাদ দিয়ে কাগজে একটা নাম্বার লিখে দিল। আমি চুপ করে নাম্বারটা ফোনে টাইপ করে কল দিলাম।
“হ্যালো! কেমন আছ?” জিজ্ঞেস করলাম।
ভরাট কন্ঠে উত্তর এলো, “কেমন দেখা যাচ্ছে?”
আমি হাসলাম।
“কালকে থেকে ওরা সব খুলে দিচ্ছে, শুনেছ?”
আমি মাথা নাড়লাম, “কালকে বের হয়ে প্রথমে কি করবে?”
“চুল কাটব।“
“আর?”
“ফ্রেন্ডদের সাথে দেখা করব।“
“আর?”
“বাবুল মামার দোকানে চা খাব।“
“আর?”
“আর কি? বাসায় যাব। আম্মাকে দেখিনা অনেকদিন।“
আমি আর কিছু বললাম না। শুধু পরেরদিনের অপেক্ষায় থাকলাম।
১০
“নিচে নামো।“
এতটুকুই শোনার দরকার ছিল। লাল গেঞ্জিটা গায়ে চাপিয়ে চুলটা একটু ঠিক করে দৌড় লাগালাম।
প্রথম দিনের সেই ছাই রঙের টিশার্ট গায়ে, গোল চশমা চোখে। কালো প্যান্টের পকেটে হাত পুরে চুপ করে একটা গাছের গায়ে হেলান দিয়ে দাঁড়ানো অবস্থায় পেলাম। দূর থেকে যতটা সুন্দর লাগতো তারথেকে কাছে আরও বেশি সুন্দর। কথা বলতে যেয়ে খেয়াল হল, নামটাই জিজ্ঞেস করা হয়নি এতদিন।
“অনয়,“ একটু হাসল সে।
“তীর্থ,” আমিও হাসলাম।
“বাসায় যাচ্ছি, ফোন ঠিক করে কল দিব।“
আমি কিছু না বলে দাঁড়িয়ে থাকলাম।
“কিছু বলবে?” অনয় জিজ্ঞেস করল।
“হুম। দাড়ি কেটে ফেলেছিলে কেন?”
ফিরতি হাসিটা দেখে বুঝলাম ভালো বিপদে পড়েছি। ছেলে অনেক জ্বালাবে। আর মাঝে মাঝে কিছু জ্বালানোতেও যেন সুখ। যেমন সুখে ভাসছি এখন। আর এরকম করে ভাসতে চাই সারাটাজীবন।
লেখকঃ Todd Chavez
প্রকাশেঃ সাতরঙা গল্প