
লেখক- উইংলেস বার্ড
খোলা জানালা দিয়ে তাকিয়ে আছি দূরে। অলস দুপুর। অট্টালিকার নগর যেখানে শেষ, সেখানে নীল আকাশে একটা পাখির অবয়ব। হয়ত উড়ে উড়ে কেঁদে বেড়াচ্ছে। ধানসিঁড়ি নদী তীরের সেই সোনালী ডানার চিলের মত। চোখের কোণে পানি আসার আগেই ফোনটা বেজে উঠল। রিসিভ করে তিন সেকেন্ড মত কথা হল। মূলত আমি শুনলাম খালি। তারপর উঠে গিয়ে দরজা খুলে দিলাম। সিঁড়িতে পায়ের শব্দ পাওয়া যাচ্ছে, সতর্কভাবে পা ফেলছে কেউ। আমি কান পেতে আছি। পনেরো বছর আগের পরিচিত পায়ের শব্দটা শুনব বলে। মুহিত তখন স্কুল শেষ করেই একরকম উড়তে উড়তে আমার বাসায় হাজির হত। একই স্কুলে আমরা তখন ক্লাস টেনে পড়ি। আমি মর্নিং শিফটে আর ও ডে শিফটে। চারটায় স্কুল শেষ করেই আমাদের বাসার সিঁড়িতে ধপধপ আওয়াজ তুলে ব্যতিব্যস্ততার সাথে ও তিন তলায় উঠে আসতো। বারান্দায় গিয়ে আন্টিকে চিৎকার করে ডেকে ব্যাগটা আর শার্টটা পাচার করে দিতো ওদের বারান্দায়। তারপর আমরা টিভিতে ভিডিও গেমস খেলতে বসতাম। কন্ট্রা, ডাবল প্লেয়ার। আজ এই এতবছর পরে আমি আগের মতই দরজায় দাঁড়িয়ে, সেই একই মানুষ উঠে আসছে। কিন্তু সেই পরিচিত চঞ্চল পায়ের আওয়াজ আজ নেই। এখন এই শব্দ খুব ধীর, শালীন এবং সতর্ক।
মুহিত সামনে এসে দাঁড়ালো। আমি দেখলাম সে মিটিমিটি হাসছে। তার সবকিছু বদলে গেছে, মায়াকাড়া কালো চোখ আর নিঃশব্দ হাসিটা ব্যাতিত। আরো লম্বা হয়েছে। পরিষ্কার করে শেভ করা মুখটা দেখে বয়স বোঝার উপায় নেই। একটা মেটালিকার ছবি সম্বলিত ঢোলা টি-শার্ট গায়ে দেয়া তার দিকে ভাল করে খেয়াল করতেই দেখলাম তাকে একদম সেই পুরনো দিনের মতই লাগছে। আমি হাত বাড়িয়ে দিতেই ও একদম ঝাপিয়ে পড়ল বুকে। আমি শেষবার মুহিতকে আলিঙ্গন করার সুযোগ পাই নি। তার বাবার হঠাৎ বদলী হওয়াতে তাদের শহর ছাড়তে হয়েছিল। এক রাতে দেখি মুহিতের মা বাবা সবকিছু গোছাচ্ছে আর মুহিত বারান্দায় বসে কাঁদছে। আমি তাকে বলেছিলাম আমরা যোগাযোগ রাখবো। সে কাঁদতে কাঁদতে বলেছিলো আমি ওকে ভুলে যাবো। আমিও কেঁদেছিলাম। বারান্দার গ্রিল আর দুই বাসার মাঝের একহাত ফাঁকা জায়গাটা তখন কষ্টটা আরো বাড়িয়ে দিচ্ছিল। আমি হাত বাড়িয়ে ওর হাত ধরে ছিলাম। অনেক রাত পর্যন্ত। তারপরদিন সকালে ম্যাজিকের মত দেখি মুহিতরা কেউ নেই। সিঁড়ির গোড়াতেই কয়েক মিনিট দুজনকে শক্ত করে আলিঙ্গন করে ধরেছিলাম। বুঝতে পেরে দুজনই কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে লজ্জা পেয়ে ছাড়িয়ে নিলাম নিজেদের। মুহিতকে ভেতরে আসতে বললাম।
আমার ঘর দেখে সে কিছু আন্দাজ করে বলল, ‘‘ভাবী কই!’’
আমি বললাম, ‘‘বিয়ে করি নি তো।’’
মুহিত কিছুটা অবাক হল যেন। প্রসঙ্গ বদলে জানতে চাইলো, ‘‘এখনো ভিডিও গেমস খেলো?’’
আমি স্মৃতিকাতর হয়ে উত্তর দিলাম, ‘‘হুম। এটাই তো আমাদের স্মৃতিকে জিইয়ে রেখেছে।’’
মুহিত আমাকে অবাক করে দিয়ে জানতে চাইলো, ‘‘শুধু ভিডিও গেমস! সেইদিন সন্ধ্যায় আমাদের ভিতরে ঘটে যাওয়া প্রথম চুমুটা?’’
আমার বুকটা ধক করে উঠল। এতগুলো বছর পরে মুহিত আমার বাসায় আসলো কৈশরের রহস্য উদঘাটন করতে! যে চুমুটা আমার হৃদয়ে খুব গোপণে যত্ন করে রাখা আছে, সেটাও যে একদিন চুমুর মালিকের কাছে কৈফিয়ত হিসেবে ফেরত দিতে হবে তা তো বুঝি নি। আমি বোকার মত বললাম, ‘‘তুমি বিয়ে করো নি?’’ মুহূর্তেই ভুল হয়ে গেছে ভঙ্গীতে জানতে চাইলাম,‘‘আমার নাম্বার কিভাবে ম্যানেজ করলে?’’
মুহিত প্রশ্ন দুইটি হাসতে হাসতে এড়িয়ে গিয়ে নাটকীয়ভাবে বলল,‘‘হৃদয়ের জট খুলতে এসেছি।’’ নিমিষেই ভাবাবেগ পরিবর্তন হয়ে গেল, রুদ্ধ কণ্ঠে সে বলল,‘‘ এই শহর ছেড়ে যাওয়ার পর থেকে একটা দিন নেই যেদিন তোমায় ভুলে থেকেছি। তোমার আমার নির্বাসিত সময় হৃদয়ে জমতে জমতে ঘন কালো জট তৈরী হয়েছে। আটকে পড়েছি আমি, মুক্তি চাই।’’ ঘরে আসার পর থেকে মুহিতের দিকে আমি আংশিকভাবে তাকিয়েছি কয়েকবার। মাত্র মুখ তুলে চাইলাম। সে ঋজু ভঙ্গিতে আমার দিকে ফেরারী আসামীর মত চেয়ে। আত্মসমর্পণ করতে চায় ও। ও চায় আমি ওকে দণ্ডিত করি এতদিন ঘরে না ফেরার অপরাধে।