আরেকটি প্রেমের গল্প

লেখক -উইংলেস বার্ড

‘‘ঋণী আমাকে খুবই ভালবাসে, আমি ওর সাথে আর প্রতারণা করতে পারব না।’’ ওয়াসরুমে যেতে যেতে একটা দীর্ঘ অর্ধনগ্ন অবয়ব কান্না মিশ্রিত কণ্ঠে বলে গেল। সাদা বিছানায় একটা অনগ্ন দেহ উপুর হয়ে পড়ে আছে, মুখ ফেরানো বাইরের জানালার দিকে, জুতাটাও খোলে নি । পিছনে ওয়াসরুমের আলোটা ঘরটাকে সামান্য সময় আলোকিত করে দিয়ে নিমিষেই সমস্ত আলো নিয়ে দরজার আড়ালে আবার ঢেকে গেল। ঘরটায় আপাতত ছায়াঢাকা অন্ধকার। ঘোলা জানালার কাঁচ ভেদ করে পর্দার পাশ কাটিয়ে ঝাপসা লাল-নীল আলো যতটুকু আসছে তা অদূরবর্তী রাস্তা থেকে। রাস্তারও আলো আছে, তাইতো পথিকেরা চলাচল করতে পারে। শুয়ে শুয়েই ভাবে সে। শুধু তার কোন আলো নেই, কেউ হাঁটে না তার পথে। ঝাপসা চোখে সে তার পথে কোন মানুষ দেখে না। অঝোরে কেঁদে কেঁদে অস্পষ্ট করে তোলে চারপাশ। পিছনে ওয়াসরুমে কল ছাড়ার আওয়াজ পাওয়া গেলো। দীর্ঘ অবয়বটা মুখ ঢেকে বসে পড়ল বালতির পাশে পা মুড়িয়ে।

সারারাত যে জায়গাটা নিস্তব্ধ ও নিঃসঙ্গ, সকাল হতে হতেই সে জায়গা জনারণ্যে জমাট বাঁধা। ব্যস্ত মানুষের দলে যোগ দিতে তাই খালেদও রেডি হয়। অফিস যাবে সে। এই সময়টায় ঋণী টেবিলে নাস্তা দিয়ে খালেদের জন্য টিফিনবক্সে লাঞ্চ ভরে। আর থেকে থেকে আড়চোখে খালেদের দিকে তাকায়। খালেদ গোসল করে বাইরে আসে, ঋণী চোখ বন্ধ করে আফটার শেভের গন্ধ নেয়, পছন্দের শার্টটা খাটে রাখে ঋণী তবুও খালেদ আলমারি খুলে অন্য শার্ট পড়ে, বিনা বাক্য ব্যয়ে নাস্তা সেরে খালেদ লাঞ্চবক্স হাতে নিয়ে গটগট করে বেরিয়ে পরে। ঋণী প্রতিদিন চিন্তা করে বলবে কিছু, কিন্তু শেষ পর্যন্ত কিছুই বলা হয় না। কথাগুলো খালেদের অবহেলার কাছে পরাজিত হয়। বিয়ের প্রায় এক বছর পরেও একই শূণ্যতা, একই হাহাকার। প্রতি রাতের মতই নিস্তব্ধ ও নিঃসঙ্গ।

সাদা রংয়ের একটা স্নিগ্ধ ব্যাপার থাকে। খালেদের বিয়ের আগে বিছানার চাদরটা নীল ছিল। প্রায় বছরখানেক আগে একদিন গ্রাম থেকে খালেদ ফোন করে। জানায় তার বিয়ে হয়ে গেছে বাবার বন্ধুর মেয়ের সাথে। মা মরা মেয়েটির বাবা হঠাৎ মারা যাওয়ায় খালেদের বাবা বন্ধুর মেয়েকে পুত্রবধূ হিসেবে ঘরে তোলে। তার কিছুদিন বাদে খালেদ ঋণীকে নিয়ে ফিরে আসে শহরে, কোথাও একটা ঘর ভাড়া নেয়। বিছানার নীল চাদরটা চেয়ে নিয়ে যায় খালেদ, সাথে নিয়ে যায় প্রতারক তকমা। তারপর থেকে বিছানায় সাদা চাদর বিছানো। অবসরে বিছানার মালিক সেখানে ঋণীর ছবি রাখে, পাশে তার নিজের ছবি। প্রায় একবছর ধরে দুজনের ভিতর বিস্তর পার্থক্যটা সে চোখের সামনে দেখতে দেখতে ভাবে সমাজে ঋণী সাদা রংয়ের মত, কি মোলায়েম, স্নিগ্ধ, চোখের আরাম!  আর সে কেবল অন্ধকার, ধূসর, আলোবর্জিত! দুই দিন আগে খালেদ শেষবারের মত তাকে চুমু খেয়ে গেলো ওয়াসরুম থেকে বের হয়ে। দুজন দুজনকে অনেকক্ষণ জড়িয়ে ধরেছিল সাদা বিছানায়। কেউ কাউকে কোন কিছু না বলে দীর্ঘক্ষণ নিঃশব্দে কেঁদেছিল শুধু। ঘরে ফেরার আগে খালেদ বাচ্চাদের মত ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে বলে গিয়েছিল,‘‘আমি প্রতারক নই। তোমাকে যেভাবে ভালোবেসেছি সেরকম করে কাউকে কোনদিন ভালবাসতে পারব না। আমরা কোনদিনই এই সম্পর্কের কোন নাম দিতে পারব না। ঋনী আমার সমাজগৃহীত সঙ্গীনি। তার ভালবাসা অবহেলা করা আমার পক্ষে সহজ। কিন্তু আমার সত্যিটা না জানিয়ে তাকে শুধুই অবহেলা জানানো আমার জন্য খুব কঠিন। আমি প্রতারক নই, বিশ্বাস করো শোভন। অন্তত তুমি তো জানো আমি প্রেমিক।’

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.