কামিং আউট

লেখকঃ অরণ্য রাত্রি

আমরা কামিং আউট শব্দটি প্রায় শুনে থাকি। এবং সম্প্রতি এই শব্দটির ব্যবহার বেড়ে গিয়েছে। কামিং আউট হল একটা বিশেষ প্রক্রিয়া, যার মাধ্যমে একজন মানুষ তার নিজের সেক্সুয়াল অরিয়েন্টেশন এবং আইডেন্টিটি বুঝে , মেনে নেয় এবং মূল্যায়ন করে। এর মাধ্যমে সে তার সেক্সুয়াল অরিয়েন্টেশন এবং আইডেন্টিটিকে আরও অনুসন্ধান করে এবং অন্যের সাথে শেয়ার করে। লক্ষণীয়, এক্ষেত্রে আমি LGBTQ সম্প্রদায়ের কথা বলছি। সহজ কথায় বলতে গেলে নিজের সেক্সুয়াল অরিয়েন্টেশন এবং আইডেন্টিটি যা এত দিন অপ্রকাশিত ছিল তা প্রকাশ করা বা জানানোই হল কামিং আউট।

এটা হতে পারে হঠাৎ করে প্রকাশ করা বা ধীরে ধীরে প্রকাশ করা। একটা মানুষের জীবনে  কাম আউট যে একবার হবে এমন কোন কথা নেই। তা বিভিন্ন মানুষের কাছে , বিভিন্ন সময় বিভিন্ন ভাবে হতে পারে। কামিং আউট কারো কারো কাছে খুব দুরূহ ব্যাপার এবং সাহসের প্রয়োজন হয়। কারণ, একজন মানুষের কাছে কাম আউট করার পর সেই মানুষটি কি প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করবে তা বলা মুশকিল। একটা ব্যাপার মাথায় রাখতে হবে, নিজের সেক্সুয়াল অরিয়েন্টেশন সম্পর্কে নিশ্চিত হবার পর, মেনে নেয়ার পর এবং তা মুল্যায়ন করতে শেখার পরই কাম আউট করা উচিৎ।

আমি সরাসরি ২-৩ জনের কাম আউট করার কথা শুনেছি। একজনের কাছে শুনেছি তার বাবা,মা  জানে যে সে সমকামী। সে নিজেই বলেছে। মানে কাম আউট করেছে। তার বাবা মা তখন তাকে বলেছে এসব নিয়ে চিন্তা না করে পড়াশোনায় মন দিতে। এবং পরবর্তীতে এই ব্যাপারে তাকে কোন প্রশ্ন করা হয় নি। বা ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাওয়ার কথাও বলা হয় নি। এমন কি তার সমকামী বন্ধুদেরকেও তার মা আপ্যায়ন করেছেন। কিন্তু একবার লুত(আ.) এর কাহিনী লেখা একটি প্রবন্ধ তাকে পড়তে দেয়া হয়। এর থেকে ছেলেটা অনুধাবন করে, যেহেতু তার বাবা মা অনেক ধার্মিক, বন্ধুত্ব পর্যন্ত‌ই তার সীমাবদ্ধতা। এর বেশি কোন কিছু শুনলে তার বাবা মা তা মেনে নিবেন না।তাহলে এটাকে কি মেনে নেয়া বলে? নাকি শুধু নীরবে জেনে যাওয়া ? আরেকজন পাশের দেশ ভারতের পশ্চিমবঙ্গের। সেখানকার এক তরুণ ছেলের কথা। বেশ কয়েক বছর আগের কথা । সে যখন কাম আউট করলো তখন তার উপর চললো নির্যাতন। শারীরিক এবং মানসিক। সে ওখানে, মানে কলকাতায় একটি ভাল বিষয়ে পড়ার সুযোগ পেয়েছিল। কিন্তু তার বাবা মা তাকে এই পথ থেকে সরিয়ে আনার জন্য পাঠিয়ে দেয় বাংলাদেশে মেডিকেলে পড়তে। তাদের ধারণা ছিলো, বাংলাদেশে নিশ্চয়‌ই কলকাতার মত সমকামী বন্ধু বান্ধব যোগাড় করা সম্ভব নয়। এখন পড়াশোনা শেষ করে সে তার দেশে ফিরে গিয়েছে। জানি না এখন সে কেমন আছে। 

আরেকজনের কথা জানি, যার মায়ের কাছে সে কাম আউট করেছে এবং তার মা সব মেনে নিয়েছে এবং তার মা তার ব্যক্তিগত জীবনে কোন রকম হস্তক্ষেপ করেন না।

এই তিনটি ঘটনা ছাড়াও অনেক ঘটনা শুনেছি যেগুলো প্রায় একরকম ।যেমন বাসায় বন্দি করে রাখা । বাসা থেকে বের হতে না দেয়া । শারীরিক এবং মানসিক ভাবে অত্যাচার। একঘরে করে ফেলা। কিন্তু কোন কোন ক্ষেত্রে পরবর্তীতে এক সময় পরিবারের সদস্যরা  সে যেমন, তাকে সেভাবেই মেনে নেয়। আবার কারো কারো ক্ষেত্রে একদমই মেনে নেয় না। এমন কি বাসা থেকে বের করে দেয়। কেউ কেউ ডাক্তার এর কাছে  নিয়ে যায়। কিন্তু সমকামিতা কোন রোগ নয়। তবু দীর্ঘ দিন যাবত চিকিৎসা চলতে থাকে। এক সময় পরিণত বয়সে পৌঁছালে বাধ্য হয়ে হয়তো পরিবারের চাপে বিয়ে করে ফেলতে হয়।কেউ কেউ বিদ্রোহ করে নিজেই বের হয়ে যায় বাসা থেকে।

আবার কারো কারো পরিবারে হয়তো কোন প্রশ্ন না করেই তাকে মেনে নেয়। কিন্তু তার সংখ্যা আমার জানা মতে খুব বেশি নয়। 

এ হলো আমাদের দেশের প্রেক্ষাপট। মনে রাখতে হবে আমাদের দেশের বেশির ভাগ মানুষ রক্ষণশীল। তাদের কাছে সমকামিতা খুব স্পর্শকাতর একটি ব্যাপার। ধর্ম , সমাজ এর কারণে বেশিরভাগ মানুষ সমকামিতাকে ভালো চোখে দেখে না। আবার তারা জানেও না যে, সমকামিতা কোন রোগ নয়। কিংবা  তারা জানে না যে, ইচ্ছা করেই মানুষ সমকামী হয় না বা উভকামী হয় না বা ট্রান্সসেক্সুয়াল হয় না। এটা প্রাকৃতিক। তাই আমাদের দেশে কাম আউট করা পশ্চিমা দেশের তুলনায় দুরূহ। তার উপর ৩৭৭ ধারা তো রয়েছেই। 

কাম আউট কেন করবো? 

আমি আগেই বলেছি বাংলাদেশে কাম আউট করাটা কঠিন ব্যাপার। তারপরও কারো কারো কাম আউট করার দরকার পরে। নিজের আপনজনদের কাছে সব সময় অভিনয় করে যাওয়ার যে কষ্ট আর নিজের সেক্সুয়াল অরিয়েন্টেশন এবং আইডেন্টিটি লুকিয়ে রাখার যে পীড়ন  আর চাপ তা কমানোর জন্য কাম আউট করা লাগতে পারে। অনেক সময় এই অভিনয় আর করতে ইচ্ছা করে না এবং নিজের আইডেন্টিটি কাউকে না কাউকে খুলে বলতে ইচ্ছা করে। নিজের আপনজনদের কাছ থেকে নিজেকে লুকিয়ে রাখতে রাখতে এক সময় মানুষ এক দম বন্ধ করা পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়। মনে হয় যেন একটু প্রাণ ভরে শ্বাস নেই। এজন্য তখন তার একই সেক্সুয়াল অরিয়েন্টেশন বা আইডেন্টিটির মানুষের সাথে মেলামেশা করা কিংবা এমন কমিউনিটি তে সম্পৃক্ত হওয়ার দরকার হয়ে পরে। 

এখন কাম-আউট করার পর একজন মানুষ যে সকল প্রতিকূল পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে পারে:

১। হোমোফবিয়া: এর মানে হল সমকামী মানুষদের অপছন্দ করা এবং তাদের প্রতি বিদ্বেষ প্রকাশ করা। অর্থাৎ কেউ হয়তো কাম আউট করার পর বিষমকামী মানুষের ঘৃণা , বিদ্বেষ এর শিকার হতে পারে। 

২। নিরাপত্তা: কাম আউট হবার পর অনেকেই আপনজনদের দ্বারাই মানসিক এবং শারীরিক ভাবে অত্যাচারিত হয়। আর স্কুল, কলেজ, কর্মস্থলে কাম আউট করলে সমাজের  অনেক মানুষ হুমকি দিতে পারে। এমনকি ক্ষতি করতে পারে। 

৩। অনেকেরই তার প্রতি নেতিবাচক ধারণা জন্মাতে পারে। 

৪। অনেকেই হয়তো ব্যাপার টা গুরুত্ব সহকারে নিবে না।

৫। আগে তাকে যেভাবে আন্তরিক ভাবে গ্রহণ করতো, অনেকেই হয়তো সেইভাবে আর গ্রহণ না করতে পারে।

৬। অনেকেই এই ব্যাপার নিয়ে আর আলোচনা করতে আগ্রহী হবে না, বরং এড়িয়ে যাবে।

৭। স্কুলে কাম আউট করলে অনেকেই বুলিং এর শিকার হতে পারে। 

কাম আউট করার আগে কিছু উপদেশ: 

• এখন আমাদের দেশে কিছু LGBT প্লাটফর্ম রয়েছে। কামআউট করার আগে সেই প্লাটফর্মগুলো তে যোগাযোগ করা এবং সম্পৃক্ত হওয়া দরকার। কারণ সেখানে অনেকেই কাম আউট করার ব্যাপারে নিজের অভিজ্ঞতা শেয়ার করতে পারবে। এবং পরামর্শ দিতে পারবে। 

• নিজের ভিতরে আত্মবিশ্বাস জন্মাতে হবে। ভয় কে জয় করতে হবে। নিজের সিদ্ধান্তে অটল থাকতে হবে যে আমি কাম আউট করবো।

• কার সাথে কাম আউট করা ঠিক, সেটা ভাবতে হবে। সে যথেষ্ট সমর্থন দিতে পারবে কিনা সেটা একটা চিন্তার ব্যাপার। কোন সময় এবং কোথায় কাম  আউট করাটা উপযুক্ত হবে তা ভেবে বের করতে হবে। মনে রাখতে হবে ঠাণ্ডা মাথায় যে কোন কাজ করলেই তার ফলাফল ভালো হয়। 

• কাম আউট করার পর নানা প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হবে। সেই প্রশ্ন গুলোর যথাযথ উত্তর দেয়ার জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে। 

• কি  ভাবে জানানো হবে সেটা আগে ঠিক করতে হবে।হতে পারে তা চিঠি, ইমেইল কিংবা সরাসরি কথা বলা। এবং সরাসরি কথা বলে জানাতে গেলে আগেই কথা গুলো গুছিয়ে নিতে হবে। বলার সময় স্থির এবং শান্ত থাকতে হবে। তর্কে জড়ানো যাবে না।

• কাম আউট পরবর্তী প্রতিক্রিয়ার জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে। এটা কখনো ধরে নেয়া উচিৎ না যে প্রথম প্রতিক্রিয়াই আশাব্যঞ্জক হবে।  মানুষকে চিন্তা করার সময় দিতে হবে । পরবর্তীতে হয়তো সে বা তারা ব্যাপার টা মেনে নিবে। পরিবারের মানুষের ক্ষেত্রে তা বিশেষ ভাবে প্রযোজ্য। 

• বন্ধু বান্ধব দের কাছে  বা পরিবারের বাইরের কারো কাছে কাম আউট করার সময় নিরাপদ কোন জায়গায় কাম আউট করা উচিৎ। 

• আমার মতে বাংলাদেশে পরিবারের কাছে কাম আউট করার আগে একটা নির্দিষ্ট বয়সে পৌঁছে তারপর কাম আউট করা উচিৎ। সেই সাথে নিজেকে স্বাবলম্বী হতে হবে। যাতে পরিবারে প্রতিকূল পরিস্থিতি সৃষ্টি হলে আলাদা থাকতে পারে। কিন্তু যারা মনে করে তার পরিবার  সহজেই ব্যাপারটা মেনে নিবে তাদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। এই ব্যাপারে ভিন্ন মত থাকবে এটাই স্বাভাবিক । যাদের ভিন্ন মত রয়েছে তাদের আলোচনার আহ্বান জানাই। 

পরিশেষে বলবো, সেক্সুয়াল অরিয়েন্টেশন বা আইডেন্টিটি একটি মানুষের সব কিছু নয়। এটা একটা মানুষের জীবনের অবশ্যই একটি গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। কিন্তু এছাড়া মানুষের জীবনে আরও অনেক কিছু আছে। তাই শুধু মাত্র সেক্সুয়াল অরিয়েন্টেশন আর আইডেন্টিটি দিয়ে একটি মানুষ কে বিচার করা উচিৎ নয়। মানুষের জীবনে আরও রয়েছে শখ, বন্ধু, পরিবার, লক্ষ্য, শিক্ষা, বিবেক, বিশ্বাস এবং আরও অনেক কিছু। এই সব কিছু মিলিয়েই একজন হয়ে উঠে পরিপূর্ণ মানুষ।

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.