
লিখেছেনঃ তারাশঙ্কর
প্রতিদিনের মত আজও ছোট দাদুর ডাকেই ঘুম ভাঙল। উফফ…এই ছুটির দিনটাতেও রেহাই নেই, ভোরবেলাতেই ঘুমটা নষ্ট। অবশ্য আমাকে ডাকছেন না উনি, ডাকছেন আমার দাদুকে, পার্কে হাঁটতে যাবার জন্য। এই দুই বুড়োর বন্ধুত্তের জ্বালায় আর বাঁচি না! কেন বাপু, আমার মনে হয় কোন বুজুম ফ্রেন্ড নাই! কই, ওরা তো আমার ঘুম ভাঙ্গাতে আসে না কোনদিন! একটা দিন মিস নাই এই ভোরবেলার একসাথে শরীরচর্চা, মাঝে মাঝে আমিও যাই। কিন্তু দাদুর সাথে এক রুমেই থাকি বলে ঘুমটা আমার নষ্ট হয় প্রতিদিনই।
নিজামুদ্দিন হক, আমার দাদু। অবসরপ্রাপ্ত সরকারী কর্মকর্তা।সফল একটা কর্মজীবন শেষে গত ৮ বছর ধরে অবসর জীবন যাপন করছেন। আমরা সবাই একসাথেই থাকি- দাদু, আমার বাবা-মা, আমি, বড় বোন। দাদি নেই, চলে গেছেন ৫ বছর হল।এরপর বাবা-মা আমাকে জোর করেই দাদুর ঘরে পাঠিয়েছেন, বয়স্ক মানুষ রাতে একা থাকলে কখন কি হয় সেই ভয়ে। আমরা দু’জনে দুটো বেডে ঘুমাই, প্রাইভেসি কিছুটা নষ্ট হলেও কয়েকদিন পর আমি আর আপত্তি করিনি। একে তো দাদুর রুমটা ভীষণ সুন্দর- বাগানের দিকে, বিশাল বড় বড় জানালা, বারান্দা আছে, সেখানে নানা রকম লতাপাতা- আর তাছাড়া দাদু আমার খুব ভালো বন্ধুও। আমরা সব কথাই শেয়ার করি, প্রচুর মজা করি- এই ৭০ বছর বয়সেও দাদুর মনটা তরুণদের মতই আছে।আর ওনার শরীরটাও দারুন ফিট। মা তো মাঝে মাঝে দুষ্টুমি করে বলেন, আমরা যখন বুড়ো হয়ে যাবো তখন বাবা আর মনির চাচা কে আমাদের চাইতেও ইয়াং লাগবে।
মা’র মনির চাচা, মানে মনির দাদু হচ্ছেন আমার দাদু’র জানে জিগার দোস্ত। ছোট বেলা থেকে এটা দেখেই বড় হয়েছি। দুই পরিবারের মধ্যেও দারুন বোঝাপড়া। মনির দাদু ডাক্তার, দাদুর চাইতে বয়সে কিছুটা ছোটই হবেন। কিভাবে তাদের বন্ধুত্তের শুরু আমি জানি না। দাদির কাছে শুনেছিলাম উনি বিয়ের সময় থেকেই এমন দেখে অভ্যস্ত। সেটা এতটাই গভীর যে কখনো কখনো তাদের পরিবারের স্বার্থের চাইতেও বন্ধুত্বটাই বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। দুজনের যোগাযোগ সারাক্ষণই হয়, আগেও হত, দাদুর রিটায়ারমেন্টের পর সেটা আরও বেড়েছে। বাসায় কোন ঘটনা ঘটলেই বন্ধুকে ফোন করে জানানো চাই-ই। মজার ব্যাপার হচ্ছে, আমার সবচে’ ঘনিষ্ঠ বন্ধু রাফিন হচ্ছে মনির দাদু’র বড় নাতি। আমরাও এমন করি, আমাদের দাদুরাও এমন করে- ব্যাপারটা অনেক মজা লাগে আমাদের। রাফিন মাঝে মাঝে বলে, আমাদের বন্ধুত্বটাও যেন দাদুদের মত বুড়ো হয়। আমি বলি, না। আমাদের বন্ধুত্ব যেন বুড়ো বয়সেও দাদুদের মতই তরুণ থাকে।
আমার দাদু-দাদির সংসার এর বয়স ছিল প্রায় ৩৫ বছর। দাদি ভীষণ হাসিখুসি একটা মানুষ ছিলেন। ওনাদের কোনদিন ঝগড়া করতে কেউ দেখে নি। দাদির কোন চাওয়া দাদু কোনদিন নাকি অপূর্ণ রাখেননি। একদিন বিকেল বেলায় মা দাদির মাথায় তেল দিয়ে দিচ্ছিলেন, আমি পাশেই বসে ছিলাম। কথায় কথায় মা দাদিকে বললেন, আম্মা, আব্বার সাথে আপনি কি অনেক সুখী? দাদি কিছু বলতে গিয়ে থেমে গেলেন, একটু পর বললেন, তোমার আব্বা আমাকে যেমন আদর আর সম্মানে রেখেছে এটা খুব কম মেয়ের ভাগ্যেই জোটে। কিন্তু কেন জানি মাঝে মাঝে মনে হয় মানুষটাকে আমি পুরো চিনতে পারি নি। আমাকে এতো কিছু দিল, কিন্তু আমার কাছে কোনদিন কিছু চাইল না। আমার থেকে কখনো কিছু নিল না। যদি দুঃখ বল, বা অপূর্ণতা- তাহলে এটাই আছে; না হলে আমি অনেক সুখী। কথাটা আমার মাথায় গেঁথে গিয়েছিল চিরদিনের জন্য।
একদিন মনির দাদু সকাল বেলা এলেন না। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে দাদু নিজেই বের হলেন। ফিরলেন প্রায় ২ ঘণ্টা পর শুকনো মুখে। আমি তখন স্কুলের জন্য বের হচ্ছি। জিজ্ঞেস করলাম, তোমাকে এমন দেখাচ্ছে কেন? ‘তোর মনির দাদুর শরীরটা অনেক খারাপ, জ্বরে বেহুঁশ হয়ে আছে। রাত থেকে জ্বর, ওরা আমাকে একটা খবরও দেয়নি।’ দাদুকে ভীষণ বিরক্ত দেখাচ্ছে, আমি আর কথা বাড়ালাম না। ‘টেনশন কোরো না’ বলে বেরিয়ে আসলাম। বিকেলে ফিরে শুনলাম মনির দাদুকে হসপিটালে নিতে হয়েছে, দাদুও ওখানে। ফ্রেশ হয়ে খেয়ে রাফিন কে ফোন দিলাম। ওর কাছ থেকে ঠিকানা নিয়ে হসপিটালের উদ্দেশ্যে রওনা হলাম।
পরের কয়েকটা দিন যেন এই দুই পরিবারের উপর দিয়ে ঝড়ের মত গেল। মনির দাদুর অবস্থা আরও খারাপ হল, একবার তো আইসিইউ তেও নিতে হল। নানারকম পরীক্ষা শেষে ডাক্তার সিদ্ধান্তে পৌঁছালেন, দাদুর পেরিঅ্যাম্পুলারি কারসিনোমা, মানে পিত্তনালির ক্যান্সার হয়েছে। আর সেটা পেটে কিছুটা ছড়িয়েও পড়েছে। অপারেশন করা যেতে পারে, কিন্তু তাতে খুব একটা লাভ নেই মনে হচ্ছে। এই ভয়াবহ দুঃসংবাদ আমাদের সাজানো জগত টাকে এলোমেলো করে দিল। এতদিনে নিজের মধ্যে বুঝতে পারলাম, মনির দাদু আমার অজান্তেই আমার নিজেরও কত আপন ছিলেন। রাফিন তো একেবারেই ভেঙ্গে পড়েছে। কিন্তু অবাক হলাম দাদুকে দেখে। তাঁকে অনেকটাই স্বাভাবিক দেখাচ্ছে। সব কিছুর ম্যানেজমেন্ট উনিই করছেন। আমার কেন জানি ব্যাপারটা খুব একটা পছন্দ হল না। ওনাদের বন্ধুত্ব আমার কাছে আদর্শ ছিল। আমি আরেকটু আবেগময় প্রতিক্রিয়া আশা করেছিলাম হয়ত।
ডাক্তাররা অপারেশন এর ব্যাপারে আমাদের সিদ্ধান্ত জানতে চাচ্ছিলেন। সিদ্ধান্ত নেবার ভার দাদুর উপর ছেড়ে দেয়া হল, দুই পরিবারের বড় বড় ডিসিশন গুলো উনিই দেন বেশিরভাগ সময়। বিকেলে জানাবেন বলে বাসায় চলে গেলেন। আমি মা’র সাথে থেকে গেলাম। বিকেল প্রায় হয়ে এলেও দাদু আসছিলেন না, ফোন ও রিসিভ করছিলেন না। মা আমাকে বাসায় পাঠালেন। কাজের লোক দরজা খুলে দিল, জিজ্ঞেস করলাম, দাদু কই? ‘সকালে আইসা ঘরে ঢুকছে, একবারও বাইর হয় নাই, দুপুরে খায়ও নাই।’ আমি আস্তে করে দরজা ঠেলে ঘরে ঢুকলাম, দাদুকে দেখে বুকের মধ্যে একটা ধাক্কা খেলাম। কেমন একটা চোখ করে জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছে, নীল আকাশের সমস্ত শুন্যতা যেন ওই দুই চোখে আশ্রয় খুঁজছে; পাশ থেকে আজ অনেকদিন পর ওনাকে ভালো করে খেয়াল করলাম- কী পরিবর্তন টাই না হয়েছে এই কয়দিনে! আস্তে করে দু’বার ডাকলাম, শুনতে পেলেন না মনে হল; কাছে গিয়ে কাঁধের উপর আলতো করে হাত রাখলাম, চমকে উঠে ঘুরে দাঁড়ালেন, ওনার চোখে পানি। আমার বুকের ভিতর কেমন জানি একটা ধাক্কা লাগলো, আমাকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে উঠলেন- আমি একদম একা হয়ে যাবো রে দাদু, আমি এই ভয়টাই করে এসেছিলাম সারাজীবন, আমি ওর জন্য কিছুই করতে পারলাম না…আমার শার্টের বুক ভিজতে লাগলো, একটা অচেনা কষ্ট গলার কাছে কেমন জানি দলা পাকাতে লাগলো…আমি দাদুকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলাম।
অপারেশন করেও মনির দাদুকে বাঁচানো গেল না। দাদুর চোখের পানি হয়ত ওইদিনই ফুরিয়ে গিয়েছিল, তাঁকে এক ফোঁটাও কাঁদতে দেখলাম না। সারাদিন ঘর থেকে বের হলেন না, শেষ দেখাটাও দেখলেন না। দাদি মারা যাবার পরও তাঁকে এতটা ভাঙতে আমি দেখি নি, পারলৌকিক কাজগুলোও নিজে দাঁড়িয়ে থেকে করিয়েছিলেন। আমি খুব কাছাকাছি থাকার চেষ্টা করলাম, দাদু কোন কথাই বলেন না। খেতে দিলে খান, নামাজের সময় নামাজ পড়েন… প্রাণের চিহ্ন খুঁজে পাওয়াটাই দায় হয়ে পড়ল ওনার মাঝে। অবশেষে, মনির দাদুর ৫ দিনের মাথায়, দাদুও আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন ঘুমের মাঝেই।
সকাল বেলাতেই দাদুর উকিল বাসায় এলেন। আমাকে খুঁজে বের করে বড় একটা খাম ধরিয়ে দিলেন, ‘তোমার দাদু তোমার জন্য এটা রেখে গেছেন।’ আমি আমার রুমে যেয়ে খামটা খুললাম, ভেতরে দুটো চিঠি আর বাবার নামে আরেকটা প্যাকেট। প্যাকেট সরিয়ে প্রথম চিঠিটা পড়লাম, দুটো চিঠিই সপ্তাখানেক আগে লেখা। তিনবার পড়তে হল প্রথমটা, স্তব্ধ হয়ে কিছুক্ষন বসে রইলাম। দ্বিতীয় টা একটা অনুরোধ পত্র- ‘আমার কবরটা প্লীজ তুই মনিরের পাশে দিস। এই শেষ দায়িত্বটা তোকে দিয়ে গেলাম।’
প্রথম চিঠিটা আলমারিতে তুলে বন্ধ করে বাকি চিঠি আর প্যাকেটসহ দরজার দিকে এগুলাম। দাদির কবরের পাশে খোঁড়া নতুন কবরটা বন্ধ করে মনির দাদুর পাশে নতুন আরেকটা খোঁড়ার ব্যবস্থা করতে হবে।