
লেখক- সূর্যদীপ্ত নাগ
আজ থেকে প্রায় বছর পনেরো-ষোল আগে বাবার মন রাখতে ডাবলুবিসিএস পরীক্ষায় বসার প্রস্তুতি নিয়েছিলাম। সেজন্য একটা সংস্থায় সমাজতত্ত্ব এবং অর্থনীতি নিয়ে পড়েওছিলাম কিছুটা। অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ লাইনে যাবার বিন্দুমাত্র ইচ্ছা ছিল না বলে পরীক্ষাটা মন দিয়ে দিই নি ঠিকই, কিন্তু সেই পড়াশোনা বেশ কাজে এসেছে আমার। তা যাইহোক, একদিন অর্থনীতির ক্লাসে ভারতবর্ষের ব্যকওয়ার্ডনেসের কারণ বোঝাতে গিয়ে স্যার এমন একটা পয়েন্ট বলেছিলেন যা আজীবন আমায় কাজে এসেছে নিজের অবিবাহীত থাকার চয়েজকে ডিফেন্ড করার জন্য।
তিনি বলেছিলেন, আমরা পিছিয়ে আছি কারণ আমরা জীবনযাপনের ক্ষেত্রে সমাজের ছকে বাঁধা নিয়মের বাইরে গিয়ে ভাবতেই পারি না। এখানে ইচ্ছা এবং আর্থিক সামর্থ্য থাকুক বা না থাকুক, একটা বয়সের পর বিয়ে করা এবং সন্তানের জন্ম দেওয়া লোকজনের ধারণা অনুযায়ী কার্যত বাধ্যতামূলক। এইসব সন্তানের মধ্যে সুপ্ত থাকা সম্ভাবনাগুলোকে বার করে আনার জন্য যে দায়িত্ববোধ বা আর্থিক ক্ষমতা বাবা-মায়ের থাকা প্রয়োজন, সেটা এইসব বাবা-মায়ের থাকে না বলে এরা ভবিষ্যতের নাগরিক হিসেবে মোটেই দেশের জন্য মানবসম্পদ হয়ে ওঠে না, বরং হয় দেশের অর্থনীতির ওপর চেপে বসে থাকা বোঝা। এই আনপ্রোডাকটিভ মূল্যহীন জনতার চাপে দেশের অর্থনীতির কার্যত নাভিশ্বাস বেরিয়ে যায়। তাছাড়া, মাথাপিছু প্রাপ্য লিমিটেড ন্যাচারাল রিসোর্সগুলিতেও স্বাভাবিকভাবেই টান পড়তে থাকে এই পরিকল্পনাবিহীন সংখ্যাবৃদ্ধির কারণে। তাই, যতদিন না পর্যন্ত সমাজের একটা বড় অংশ এই জাতীয় ছকে বাঁধা ট্র্যাডিশনাল চিন্তাভাবনা তথা জীবনযাপনের বাইরে বেরিয়ে আসতে পারছে, ততদিন আমাদের দেশের প্রগ্রেস হওয়া কঠিন।
এই কথাগুলো বাকি ছাত্রছাত্রীরা কতটা খেয়াল করেছিল জানি না, কিন্তু এটা আমার জীবনের মোর ঘুরিয়ে দেয়। ছোটবেলা থেকে যে যে জিনিসগুলোকে আমাদের জন্য ভাল এবং গ্রহণযোগ্য বলে আমাদের শেখানো হয়েছে এতোকাল, সেগুলোর সবকটা যে আদৌ মঙ্গলজনক নয় সেটা হঠাৎ বুঝতে পেরে যাই একমুহূর্তে। শুধুমাত্র বিয়ে বা সন্তানধারণ করার ক্ষেত্রেই নয়, আরো অনেক অনেক ক্ষেত্রেও।
এমনিতে, বিয়ে করে সংসার করার সখ আমার কোনোকালেই ছিল না, কিন্তু এই কথাগুলো নিয়ে ভাবতে ভাবতেই আমি স্পষ্টভাবে লক্ষ করতে শুরু করি যে কিভাবে ছকে বাঁধা ভাবনা আমাদের দেশের অগ্রগতির পথ রোধ করছে, এবং আমাদের নিজেদেরও ব্যক্তিজীবনে সুখি হওয়ার পথে বাধা সৃষ্টি করছে। তখন থেকেই ভাবতে শুরু করি বিভিন্ন অল্টারনেটিভ লাইফস্টাইল সম্পর্কে। কিন্তু, আমাদের চারপাশের মানুষগুলির বেশিরভাগই যেহেতু চিন্তাভাবনার দিক থেকে অত্যন্ত লিমিটেড, তাই এক্ষেত্রে তাদের সাথে ক্ল্যাশ হতেও শুরু করে তখন থেকেই।
নিজের বাবামায়ের কথা আলাদা। কারণ তাঁদের স্বাভাবিকভাবেই দুশ্চিন্তা থাকে সন্তানের ভাল থাকা বা না থাকা নিয়ে, এবং তাঁরাও হামেশাই আর পাঁচটা লোকের মতোই ছকের বাইরে গিয়ে ভাবতে পারেন না। কিন্তু, তাঁদের ক্ষেত্রে যেহেতু কনসার্নটা যথেষ্ট রিয়াল, তাই তাঁদের নিজের অন্যরকম লাইফস্টাইলের ব্যপারে বোঝানোর ক্ষেত্রে সেই বিষয়গুলো অবশ্যই মাথায় রাখতে হয়। আবার একই সাথে এটাও মাথায় রাখতে হয় যে, জীবনটা কিন্তু বাবা-মায়ের নয়, নিজেরই, এবং, যতই চাপে পড়ে নিক না কেন, মাথায় রিভলভার ঠেকিয়ে কিছু করতে বাধ্য না করলে একজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের সিদ্ধান্তগুলোর নৈতিক দায়ীত্বও তারই। সুতরাং, নিজের জীবনের ব্যপারে যেকোনও বড় সিদ্ধান্ত সব সময় নিজেকেই নিতে হয়। মা-বাবার থেকে চাপ এলে তাঁদের খুব স্পষ্ট করে বুঝিয়ে দিতে হয় নিজের ভবিষ্যত পরিকল্পনাগুলোর ব্যপারে। এবং, নিজস্ব ভাল থাকার ধারণাগুলোর বিষয়েও।
এবার আসি যে চাপগুলো আসে আমাদের দূর সম্পর্কের আত্মীয়, পাড়ার কাকিমা বা অফিস কলিগ জাতীয় লোকজনের থেকে, সে ব্যপারে। আমার মনে হয় এগুলো হ্যান্ডল করার ক্ষেত্রে আমরা অকারণ ডিফেন্সিভ থাকি। সেটা আদৌ কতটা ভাল এবং এফেক্টিভ, সন্দেহ আছে সে বিষয়ে। আমি তো বরং লোকজনেই উল্টে চাপ দিতে থাকি। মানে, প্রতি মুহূর্তে তাদের বুঝিয়ে দিই যে –
১) প্রত্যেককে বিয়েথা করে একটা নির্দিষ্ট ছকে বাঁধা জীবন যাপন করতে হবে – এই জাতীয় চিন্তাভাবনা সমাজ তথা রাষ্ট্রের উন্নতির পক্ষে কতটা প্রতিবন্ধক।
২) বর্তমান ভারতের জনসংখ্যার অন্তত চল্লিশ শতাংশকে আবশ্যিকভাবে দেশের উন্নতির জন্য অবিবাহিত থাকতে বাধ্য করা উচিত, বা অতদূর না হলেও, সোশ্যাল ইন্সেন্টিভের মাধ্যমে লোকজনকে এই ধরনের চিন্তা করতে উদ্বুদ্ধ করা উচিত।
৩) সন্তান পালনের চাপ থাকে না বলে অর্থনৈতিকভাবে অবিবাহীত জীবন অনেক বেশি স্টেবল এবং সুখকর।
৪) বিবাহীত লোকেরা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই নিজেদের নৈতিক দায়ীত্ব পালন করতে পারেন না – অর্থাৎ, ছেলেমেয়েদের ঠিকঠাক মানুষ করতে পারেন না। বর্তমান সমাজের দিকে তাকালেই সেটা বোঝা যায়। কিন্তু, যেসব মানুষ বিয়ে করেন না, তাঁরা আর যাই হোক অন্তত দেশের জঞ্জাল বৃদ্ধি করেন না।
এসব জ্বালাময়ী ভাষণ দেওয়ার উপকারীতা কি? প্রথমতঃ বলা তো যায় না, এর ফলে কিছু লোকের হয়তো চৈতন্য হলেও হতে পারে। অন্তত এর থেকে বিয়ে করতে অনিচ্ছুক আর একজন মানুষ কিছু যুক্তি পেয়ে যেতে পারেন লড়বার। দ্বিতীয়তঃ এসবের ফলে মাথায় গোবর পোরা লোকজন নিঃসন্দেহেই আপনাকে পাগল বলে ভাবতে থাকে, এবং সাধারণত লোকে পাগলকে ভয় পায় বলে, অকারণে আপনাকে ঘাঁটানোর থেকে বিরত থাকে।
তা, সেটাই বা কম কি?