
লিখেছেনঃ অরণ্য রাত্রি
বিয়ের কথা বললেই আমার চোখের সামনে ভাসে একটি খুব সুন্দর করে সাজানো মঞ্চে একজন শেরওয়ানী আর পাগড়ী পরে বর বসে আছে আর তার সাথে আছে লাল বেনারসি শাড়ি পরে সারা অঙ্গ জুড়ে গহনা দিয়ে সাজানো কনে। বাজছে বিসমিল্লাহ খানের সানাই আর খাবারের সুগন্ধ তো আছেই। আচ্ছা একটূ অন্য রকম ভাবে চিন্তা করা যায় না? যদি মঞ্চে বরের সাথে কনে না থেকে শেরওয়ানী পাগড়ী পরা আরেকজন বর থাকে? কিংবা বিয়ের মণ্ডপে লাল শাড়ি পরা গহনা দিয়ে সজ্জিত কনের জন্য আরেকজন কনে অপেক্ষা করে তাহলে?
আমি সমকামী বিয়ের কথা প্রথম জানতে পারি ডঃ মুহাম্মদ জাফর ইকবালের আমেরিকা নামক একটি আত্মজীবনী মূলক বই থেকে । তখন আমার বয়স কতই বা হবে? মাত্র ক্লাস সিক্সে পড়ি। সেখানে লেখা ছিল আলি নামের একজন বাঙালী যুবক আরেকজন পুরুষ কে বিয়ে করে চারিদিকে আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। আমি পড়ে খুব অবাক হয়েছিলাম। একজন পুরুষের সাথে আরেকজন পুরুষের কিভাবে বিয়ে হতে পারে? তখনও সেক্স কি তাই ভাল মত বুঝতাম না। আর সমকামিতা বুঝা তো আরও পরের কথা
এই ক্ষেত্রে চুপিচুপি বলে নেই এক সময় আমারও খুব সাধ ছিল আমার স্বপ্নের মানুষের সাথে আংটি বদল করার। আর আমাদের কমিউনিটিতে অনেকেরই নিশ্চয় বর বা কনে সাজার একটা গোপন ইচ্ছা রয়েছে। আমাদের দেশে যে কেউ কখনো বিয়ে করার চেষ্টা করে নাই তা বলবো না। কিন্তু এই দেশে সমকামী বিয়ের নাই কোন সামাজিক স্বীকৃতি না আইনগত স্বীকৃতি। শুধু মাত্র কমিউনিটির কয়েকজন মানুষের উপস্তিতিতে মালা বদল বা আংটি বদল। অনেক্ টা যেন পুতুলের বিয়ে দেয়ার মত। অবশ্য কেউ যদি তা করে মনে প্রশান্তি পায় তাতে তো কোন দোষ নেই।
সমকামী বিয়ে আসলে কি জানার আগে আমাদের জানতে হবে বিয়ে আসলে কি? বিয়ে এমন একটি প্রতিষ্ঠান যার মাধ্যমে দু’জন মানুষের মধ্যে ঘনিষ্ঠ ও যৌন সম্পর্ক সামাজিক স্বীকৃতি লাভ করে।এই সংজ্ঞা উইকিপিডিয়া থেকে নেয়া। সুতরাং সমকামী বিয়ে হল ২ জন একই লিঙ্গের মানুষের মাঝে বিয়ে।
অনেক সমাজ বিজ্ঞানীরাউ বিভিন্ন সময় বিয়ের বিভিন্ন সংজ্ঞা দিয়েছেন।কিন্তু তার বেশির ভাগ সংজ্ঞায় সন্তান জন্ম দান প্রসঙ্গ উল্লেখ থাকায় সেই সংজ্ঞা গুলো আমি এখানে উল্লেখ করলাম না। কারন আমার মতে সন্তান জন্মদান বিয়ের এক মাত্র উদ্দেশ্য হতে পারে না। কারন বিষমকামী বিয়ে গুলো তে সব দম্পতিই কি সন্তান জন্ম দানে সক্ষম থাকে? কিংবা অনেকে কি এমন বয়সে বিয়ে করে না যখন সন্তান জন্ম দান আর সম্ভব নয়? তাহলে এই বিয়ে গুলো কি সমাজ স্বীকৃতি দেয়ু না? নাকি এই বিয়ে গুলোর আইনত কোন ভিত্তি নেই?
আমেরিকায় একটা জরিপে দেখা যায় ১৯৭০ থেকে ১৯৯২ সাল পর্যন্ত বিবাহিত কাপলদের প্রায় ৩০ ভাগেরই কোন সন্তান নেই। আমেরিকার সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল এন্ড প্রিভেনশনের সূত্র অনুযায়ী শতকরা ৬ ভাগ ১৫- ৪৪ বছরের বিবাহিত নারী রা সন্তান জন্ম দানে অক্ষম। ২০১০ সালে আমেরিকায় পিউ রিসার্চ সেন্টার একটা জরিপ করেছিল। তাতে শতকরা ৫০ ভাগের বেশি বিবাহিত এবং অবিবাহিত উভয় পক্ষের মানুষ বিয়ের কারণ হিসেবে সন্তান জন্ম দানের চেয়ে ভালবাসা, প্রতিশ্রুতি এবং সাহচর্য কে বেশি গুরুত্বপূর্ণ মনে করেছেন।
আজকাল বাচ্চা দত্তক নেয়ার প্রয়োজন পরে না। স্পার্ম ডোনেশন এবং সারোগেট মাদারের মাধ্যমে বাচ্চা নেয়া এখন খুব সহজ ব্যাপার হয়ে পরেছে।
আমাদের দের দেশে তো সমকামী হওয়াটাই পাপ। সেখানে সমকামী বিয়ে তো দুরের কথা। কিন্তু আমাদেরও তো ইচ্ছা করে নিজের জীবন সঙ্গী কে সবার সামনে প্রকাশ করি। তাকে পারিবারিক অনুষ্ঠান গুলো তে নিয়ে যাই নিজের জীবন সঙ্গী হিসেবে। কিন্তু তা তো সম্ভব না।এদিকে আমাদের পাশের দেশ ভারতে ৩৭৭ ধারা তুলে দেয়া হয়েছে। কিন্তু সমকামী বিয়ে এখনো স্বীকৃতি পায় নি।
১৯৮৯ সালে ডেনমার্কে সর্বপ্রথম সমকামী সম্পর্ক আইনগত স্বীকৃতি পায়। রেজিস্টার্ড পার্টনারশিপ প্রতিষ্ঠা করা হয় যেখানে একটি বিবাহিত বিষমকামী দম্পতি যেসকল সুযোগ সুবিধা পায় তার বেশির ভাগ সুযোগ সুবিধা সেখানে দেয়া হয়েছিল। কিন্তু বাচ্চা দত্তক নেয়ার অধিকার দেয়া হয় নি। নেদারল্যান্ড এ সর্ব প্রথম সমকামী বিয়ে আইনগত স্বীকৃতি লাভ করে। সাল টা ছিল ২০০১। ২০০১ সালের ১ এপ্রিল অ্যামস্টারডাম এর মেয়র জব কহেন এর উপস্থিতি তে ৪ টি সমকামী কাপলের অফিসিয়ালি নিবন্ধন করার মাধ্যমে বিয়ের অনুষ্ঠান করা হয়। এবং এই কাপল দের কে বাচ্চা দত্তক নেয়ার অধিকারও দেয়া হয়। এরপর থেকে ইউরোপ থেকে শুরু করে অন্যান্য মহাদেশের বিভিন্ন দেশ গুলো তে সমকামী বিয়ের আইনগত এবং সামাজিক স্বীকৃতি দেয়া হয়। ২০১৫ সালে আয়ারল্যান্ড সর্বপ্রথম গণভোটের মাধ্যমে সমকামী বিয়ে কে সামাজিক এবং আইনগত স্বীকৃতি দেয়।
আমেরিকা তে ১৯৭০ সালেই সমকামী বিবাহের আন্দোলনের শিকড় বপন করা হয়। এরপর নব্বই এর দশকে এসে এই আন্দোলন কিছুটা প্রেরণা পায়। কিন্তু আন্দোলন মূলত অগ্রসর হয় ২০০০ সালের পর। ২০০৩ সালে ম্যাসাচুসেটস স্টেটে সমকামী বিয়ে সর্বপ্রথম আইনগত স্বীকৃতি লাভ করে। এবং ২০১৫ সালে আমেরিকার ৫০ টি স্টেটের সব গুলো স্টেটে সমকামী বিয়ে স্বীকৃতি পায়। আমার মনে আছে সেই সময় ফেসবুকের প্রোফাইল পিকচার রংধ্নুর রঙে রাঙিয়ে আমেরিকার সমকামী মানুষ দের সাথে একাত্মতা প্রকাশ করেছিল অনেকেই।
এশিয়ার মাঝে সর্ব প্রথম তাইওয়ান ২০১৯ সালে সমকামী বিয়ে আইনত অনুমোদন করে।
কোন মুসলিম প্রধান দেশেই এখনো সমকামী বিয়ে স্বীকৃতি পায় নি
এখন পর্যন্ত পৃথিবীর ৩০ টি দেশে সমকামী বিয়ে আইনত অনুমোদিত
কিছু তথ্য
বিয়ের মাধ্যমে একজন ব্যক্তি মনোসামাজিক এবং স্বাস্থ্যগত সুবিধা পেয়ে থাকে। কারণ বিয়ে বিষমকামী এবং সমকামী উভয় দম্পতি কে আর্থিক, নৈতিক এবং সামাজিক অবলম্বন দেয়। আমেরিকায় ২০০৯ সালে একটি গবেষনায় দেখা যায় ১৫০০ সমকামী ,উভকামী এবং ট্রান্সসেক্সুয়াল মানুষ যারা যে সকল স্টেটে তখনো সমকামী বিয়ে আইনত অনুমোদিত নি সেখানে বাস করতো তারা অন্যদের তুলনায় বেশি সামাজিক চাপ এবং মানসিক সমস্যায় ভুগছিল ।এবংএই সমস্যা গুলোর জন্য পূর্বের কোন মানসিক স্বাস্থ্য সম্পর্কিত ইস্যু দায়ী ছিল না।
এমন কোন বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই যা দাবী করতে পারে যে সমকামী , উভকামী এবং ট্রান্সজেন্ডার মানুষ বিয়ে করার জন্য উপযুক্ত নয় এবং তারা একজন সুস্থ স্বাভাবিক ভাবে বাচ্চা প্রতিপালন করতে পারে না। বরং ২০১৪ সালের মেলবর্ন ইউনিভার্সিটির একটি গবেষণায় দেখা যায় সমকামী দম্পতি দ্বারা পালিত বাচ্চা রা সাধারণ জনগনের চেয়ে সাস্থ্য এবং পারিবারিক সংলগ্নতার ক্ষেত্রে ৬ শতাংশ বেশি স্কোর করেছে। আরেকটি গবেষণায় ২০১০ সালে দেখা যায় যে লেসবিয়ান মা দের দ্বারা পালিত বাচ্চা বিষমকামী দম্পতি দের দ্বারা পালিত বাচ্চা দের চেয়ে সামাজিক এবং শিক্ষাগত কর্মদক্ষতায় এগিয়ে এবং তাদের সামাজিক সমস্যাউ কম থাকে। এই গবেষণা গুলোর কথা বাদ দিলেও এক কথায় বলা যায় যে বিষমকামী দম্পতি দের থেকে সমকামী দম্পতি রা বাচ্চা পালনে কোন অংশে পিছিয়ে নেই।
বিয়ের পর সব দম্পতি রাষ্ট্র কর্তৃক কিছু সুবিধা পেয়ে থাকে। তাই যে সকল দেশে সমকামী বিয়ে আইন গত ভাবে অনুমোদিত সে সকল দেশে সমকামী দম্পতি রা রাষ্ট্র কর্তৃক কিছু সুবিধা পায়। যেমন সাস্থ্য বিমা, স্পাউসের অসুস্থতার কারণে ছুটি নেয়া, স্পাউসের পেনশান গ্রহন করা, সম্পত্তির ভাগ পাওয়া , ইমিগ্রেশনের সুযোগ সুবিধা ইত্যাদি।
সমকামী বিয়ের মাধ্যমে সমকামী দের উপর যে বৈষম্য করা হয় তা বন্ধ করা যাবে। কারণ রাষ্ট্র তাদের মেনে নিয়েছে সেখানে অন্য কোথাও তাদের প্রতি বৈষম্য মূলক আচরণ করার সুযোগ থাকতে পারে না। আর বৈষম্য করলে তারা আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে পারবে। সমকামী দের হুমকি , নির্যাতন ও অনেক কমে আসবে। কিন্তু হঠাত করে একদম সমকামী বিয়ে পর্যন্ত চলে যাওয়ার পক্ষপাতি আমি না। ধাপে ধাপে তা করতে হবে।যেমন আমাদের দেশে ৩৭৭ ধারার মত ভয়ানক এক আইন ই এখনো রয়ে গিয়েছে। তাই বোধ হয় জাতিসংঘ সমকামী দের উপর উৎপীড়ন , জুলুম এবং বৈষম্যর বিরুদ্ধে প্রচারণা চালাচ্ছে। সমকামী বিয়ের উপর নয়।
সমকামী বিয়ে অনুমোদিত হবে কি হবে না তা বিশ্বের বেশিরভাগ দেশেই নির্ভর করে সেই দেশের বেশির ভাগ মানুষের ধর্ম বিশ্বাস , প্রথা এবং আইনের উপর। তাই কোন কোন দেশে সমকামিতা অপরাধ। আর কোন কোন দেশে সমকামী বিয়ে পালন করা হয় মহাসমারোহে। তবে যাই হোক না কেন ভালবাসার থেকে বিশাল আর কিছু হতে পারে না। কোন কাপল যদি একে অপর কে অসম্ভব ভালবাসে তাহলে বিয়ের সুযোগ না থাকলেও একদিন না একদিন তারা সুখী হবেই এটা আমার বিশ্বাস। যদিও তাদের পথ অনেক বন্ধুর হবে। অনেক প্রতিবন্ধকতা তাদের পেরোতে হবে। অনেকেই হয়তো মানসিক ভাবে প্রচণ্ড চাপের সম্মুখীন হতে পারে । আবার কখনো বৈষম্যের শিকার হতে পারে। হুমকি , নির্যাতন সহ্য করতে হতে পারে। তবুও বলবো সাহস হারানো যাবে।
আমার স্বপ্ন একদিন আমার মতই একজন পুরুষ তার স্বপ্নের পুরুষ কে পরিবারের সবার সামনে নিজের জীবন সঙ্গী কে আংটি পরিয়ে দিচ্ছে। হ্যাঁ বাংলাদেশের কথাই বলছি। হয়তো ব্যাক গ্রাউন্ডে বাজবে কোন বাংলা বিয়ের গান। কিংবা সানাই এর সুর। আমি হয়তো আমার জীবনে এই দৃশ্য দেখে যেতে পারবো না। কিন্তু এমন দিন একদিন অবশ্যই আসবে।
প্রথম প্রকাশঃ সমপ্রেম