সমকামিতাঃ সত্য নাকি কল্পনা?

লেখকঃ সুধাংশু

আমাদের বাঙালী সমাজ ব্যবস্থায় একটা শিশুর বেড়ে ওঠার একটা বড় অংশে তাকে দুষ্টুমির ছলে হোক কিংবা হেয়ালি করে, বড়রা দু’একবার বলেই থাকে, “ওকে তো ওর দাদীর সাথে বিয়ে দিব।“ কিংবা বাবার বন্ধুর মেয়েকে দেখিয়ে দুষ্টুমির ছলে বাবা বলে, “বড় হলে কিন্তু তোমাদের বিয়ে দেব”!

কিন্তু বিশ্বাস করুন আমি কখনো এই ধারণাটার সাথে আমার জীবনের কোনো সম্পর্ক খুঁজে পাইনি। যেখানে সমাজ, শিশু বয়সে আমার মাথার ভেতরে অনবরত ধুকিয়ে যাচ্ছে যে, “ যখন পুরুষ হয়ে জন্মেছো; মেয়ে তো তখন বিয়ে করতেই হবে!”, ঠিক তখনই আমি সদ্য যৌবনপ্রাপ্ত পাশের বাসার ছেলেটিকে দেখে ভেবেছি, “ওকে কেনো বিয়ে করা যাবে না?”। কিন্তু আমার শিশু মস্তিষ্ক তখন ধরে নিয়েছিল যে, এগুলোর অস্তিত্ব শুধুই আমার মাথার মধ্যে। কিন্তু বেশি দিন লাগলো না বাস্তব কোনটা বুঝতে।

আমার বেড়ে ওঠা আর পাঁচটা রক্ষণশীল পরিবারের ছেলেদের মতো স্বাভাবিক ছিল না। সমাজে ছেলে হবার বদৌলতে কোথায় আমি ইচ্ছে স্বাধীন মতো বেরোতে ও মানুষের সাথে মিশতে পারবো, তা কখনই ছিল না। নাচতে ভালবাসতাম ছোটবেলায়। ছেলে “হিজরা” হয়ে যাচ্ছে ভেবে বাবা গান শিখতে পাঠালো। তাতেও আপত্তি ছিল না। আমার মেয়ে বন্ধু বেশি ছিল। কিন্তু তখনও বালক আমি বুঝতাম না, কেন আমার সমবয়সী ছেলেরা আমাকে নিয়ে হাসি-তামাশা করছে এজন্য। মেয়েদের সাথে কি বন্ধুত্ব করতে নেই?

যাক গে! এসব কমবেশি সব সমকামী পুরুষ ছেলেবেলায় সহ্য করে আসে। আমার বয়স এখন ২১ বছর। আমি আমার জীবনে অনেক সমকামীর সাথে পরিচিত হয়েছি এবং তাদের জীবনকে কাছ থেকে জানারও চেষ্টা করেছি। আশ্চর্যজনক ভাবে, বাংলাদেশের সমকামীদের একটি খুব কমন বিষয় হলো শিশু কিংবা বাল্যকালে পরিবারের সদস্য বা পরিবারের কাছের কারোর দ্বারা যৌন নীপিড়নের শিকার হওয়া।  আমার চারপাশের অধিকাংশ সমকামী জীবনের কোনো না কোনো পর্যায়ে এমন যৌন নীপিড়নের শিকার হয়েছে, বিশেষ করে যখন তারা বুঝতোই না যৌনতা কি! লিঙ্গ কি! আমিও এই যৌন নীপিড়নের শিকার। কিন্তু আমার ব্যাপারটা বেশ আলাদা। আজ পর্যন্ত যাদের কাছেই শুনেছি তারা যৌন নীপিড়নের শিকার, তারা কেউ স্বাভাবিক ভাবে তাদের এ অভিজ্ঞতার কথা বলতে পারে নাই; ভেঙ্গে পড়েছে। অনেকে জীবনের বড় একটা সময় এই ট্রমা পেয়ে মানসিক ভাবে দূর্বল ও ডিপ্রেসড হয়ে কাটিয়েছে। কিন্তু আমি না কখনও এই বিষয়টা নিয়ে ডিপ্রেশন অনুভব করিনি। হ্যাঁ, আমি অবশ্যই আমার সাথে হয়ে যাওয়া ব্যাপারটাকে স্বাভাবিক বা সুস্থ কিছু মনে করছি না, কিন্তু আমি বড় রকমের আঘাতের বদলে গভীর দ্বীধায় পড়ে গিয়েছিলাম।

ফিরে যাই আমার শৈশবে, যেখানে নারীকে সঙ্গী হিসেবে পাওয়ার ধারণা হজম করতে আমার কষ্ট হচ্ছিল। বারংবার আমার মন পুরুষের দিকে ঢলে পড়ছিল, কিন্তু আমি বুঝে উঠতে পারছিলাম না, এইটা কি আদৌ সম্ভব নাকি আমার নিছক কল্পনা!

আমার সমকামীতা শুধু মাত্র “কল্পনা” থেকে বাস্তবের “ধারণা”-তে রূপ নিলো, ২০১০ সালে, যখন আমি আমার বয়স ১০ বছর। আমার চাচাতো ভাই এসেছিলো ঘুরতে। আর ঠিক তখনই সে সুযোগের সদ্ব্যবহার করেছিল আর আমি ফাঁকা বাসায় তার দ্বারা যৌন নীপিড়নের শিকার হই। কিন্তু, আমি অদ্ভুত ভাবে জিনিস গুলোকে আমার শরীরের জন্য স্বাভাবিক মনে করেছিলাম। মনে হচ্ছিল, “এইটা তো আমার মাথার মধ্যে হয়, কিন্তু এখন কি বাস্তবে হচ্ছে নাকি আমি ঘোরের মধ্যে আছি?” 

আমার দীর্ঘ ৪/৫ বছর লেগেছিল, আসলে বুঝতে যে, সে আমার সাথে কি করেছিল এবং সেটা যে ভুল করেছিল। কিন্তু, সে যেটা করেছিল,তাতে আমার শিশু মন দ্বীধায় পড়ে গিয়েছিল। তখনই আমি বুঝতে শুরু করেছিলাম যে, সমাজের বাঁধা ধরা নিয়ম আমার জন্য নয়। আমি সমকামী, সমপ্রেমী! আজ দীর্ঘ ১০ বছর পার হয়ে গেছে, ঐ ঘটনার। কিন্তু আমি আজো তাকে ক্ষমা করতে পারিনি, হয়তো কোনো দিন পারবও না! হয়তো আমার শুরুটা আরো রঙিন ও সুন্দর হতে পারতো। হয়তো আমি সুস্থ একটা ঘটনার মধ্য দিয়ে ব্যাপার গুলো বুঝতে পারতাম। কিন্তু, সে ছিল আমার দ্বীধাগ্রস্থ শিশু থেকে সমকামী হয়ে ওঠার প্রথম সিঁড়ি!

সব কথার শেষ কথা হিসেবে একটি বার্তা সকলকে পৌছে দিতে চাই। আপনাদের পরিবারের শিশুদের দেখে রাখুন। আর যেনো কোন শিশু যৌন নীপিড়নের শিকার না হয়।

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.