
২৫ তারিখ সকাল বেলা।
উঠোনে বসে শীতের রোদ পোহাচ্ছি। দরজায় ঠক ঠক আওয়াজ। দরজায় খুলতেই দেখি ব্যাগ হাতে রাতুল আর শ্রাবণ দাড়িয়ে। ওদের হাতের ব্যাগ দেখে মনে পড়লো আজ বান্দরবান যাবার কথা।
‘তোরা এখানে? বাস ক’টায়?’
‘বাস ১২টায়।’
‘তাহলে ১১টা বাজে এখানে কি করিস?’
‘তোকে নিতে আসছি।’ রাতুলের সোজাসাপটা জবাব।
‘আমি যাব না, সেটা আগে বলছি।’
‘এত কথা না বলে ব্যাগ গুছা পাঁচ মিনিটের মধ্যে।’
‘টাকা নাই।’
এবার শ্রাবণের কঠোর কণ্ঠের জবাব, ‘ঢং কম কর। টাকা আমরা দিব। বেশি কথা বললে লাথি মেরে বান্দরবান পাঠায়ে দিব।’
আমি তবু চুপচাপ দাড়িয়ে রইলাম।
আমার বন্ধুমহল ছোট। ছোট পরিবার সুখী পরিবার। তাতে অত জটিলতা, অত সীমারেখা নেই। বলা যায় নিরামিষ। মাধ্যমিক পরীক্ষা শেষ। নিরামিষ হয়ে আর কতদিন। আমিষের জোগান দিতে তাই বান্দরবান ঘুরতে যাবার পরিকল্পনা হল। পরিকল্পনা রাতুলের, উৎসাহ শ্রাবণের। শ্রাবণের দুলাভাই বান্দরবানের সহকারী জেলা প্রশাসক। থাকা-খাওয়া এমনকি ঘোরাফেরার ব্যবস্থাও তিনি করবেন। তাই ৬০০ টাকার বাজেট করা হল। হাস্যকর বাজেট কিন্তু ভ্রমণে ওটাও পুরো খরচ হয়নি। তবে সে আরেক কাহিনী। বাঙ্গালীর উৎসাহ শুরুতে সবসময় এভারেস্টের চুড়োয় থাকে। ১০ জনের তালিকা তৈরি হয়ে গেল তাই। তবে এভারেস্ট থেকে ঢিবির গোড়ায় নামতেও সময় লাগে না। দুদিনের মাথায় তাই তালিকা ৫ জনে নেমে এলো। ছোট পরিবার সুখী পরিবার। গাই গুই করতে করতে আরো দুজন বাদ, আমি তার মধ্যে। কারণ দর্শালাম অর্থসঙ্কট। বন্ধুরা নাছোড়বান্দা, প্রয়োজনে তাদের অর্থায়নে আমার ভ্রমণ হবে। কিন্তু আমিও একগুঁয়ে। তার চেয়েও বড় কথা আসল কারণ তো অর্থসঙ্কট নয়, অন্য কিছু, যা মুখ ফুটে ওদের বলবার উপায় ছিল না।
বন্ধুত্ব নগ্ন হয়। তার সীমারেখার বাইরেও তাই আরেকটা সীমারেখা থাকে। কিংবা বারবার সীমারেখাগুলো মিশিয়ে দিতে হয় বন্ধুত্ব টিকিয়ে রাখবার জন্য। নগ্নতা অশ্লীল কিনা সে বিতর্ক বাদ রইলো, সময়ভেদে তা যে দৃষ্টিকটু সেটা সত্যি। তবে তাকে দৃষ্টিসহনীয় করতে শৈল্পিক ভাবে উপস্থাপন করা যায় কিংবা ঈষৎ আভরণে। যত যাই হোক না কেন, নিজের নগ্ন রূপ হঠাৎ কারো নজরে পড়ে গেলে তা উভয়পক্ষের জন্যই অসস্তিকর। কিন্তু বন্ধুত্বের নগ্নতা?
বন্ধুত্বে নগ্নতা তৃপ্তিকর। বন্ধুত্বে আড়াল বাহুল্য, গোপনীয়তা অপ্রয়োজনীয়। রাতুল-শ্রাবণের সাথে তেমনি বন্ধুত্ব। তবুও কি সমাজের বিধিনিষেধ না মেনে সব কথা কি বলা যায়? পাছে বন্ধুত্ব নষ্ট হয়? তাই বলি, সীমারেখা মিলিয়ে দিতে না পারলে বন্ধুত্ব কিসের?
সীমারেখা মিলিয়ে দেবার সিদ্ধান্তই নিলাম। মেকি পোশাক ছেড়ে নগ্ন হয়ে দাঁড়ালাম ওদের সামনে। আমি সমপ্রেমী তা বললাম। শ্রাবণ সাথে রিক্সায় ফিরছিলাম বাসায়, একবার হু বলে চুপ করে গেল। রাতুলের সাথে চা দোকানে বসে ছিলাম। বললো, ‘পরিবারের কথা চিন্তা করিস।’
ওদের জানানো কি আসলেই দরকার ছিল? না বললেই বা মন খুলে ওদের সাথে কথা বলতাম কিভাবে? একটা মেয়ের প্রতি ভালোবাসার কথা ওরা অবলীলায় বলতে পারে। আমিও তো আমার ভাললাগার কথা বলতে চাই। ওদের বলতে না পারলে তো আর কারো কাছেই বলা সম্ভব না। ওদের সবটুকু যেমন আমি জানি, আমার সবটুকুও ওদের জানা উচিত।
ভালও না, খারাপও না, এমন প্রতিক্রিয়াহীন প্রতিক্রিয়া পেয়ে আমি দমে গেলাম। নগ্নতা একটু বেশি দৃষ্টিকটু হয়ে গেল বোধকরি। আগেই দোনামনা ছিল। জীবনের এই অংশটা নিয়ে বড় একাকী হয়ে পড়েছিলাম। বন্ধুদের জানিয়েও ভরসা পেলাম না। বান্দরবান ভ্রমণের চিন্তা বাতিল করে বাসায় শীতনিদ্রা যাপন শুরু করলাম।
শহুরে আকাশ অপরিষ্কার, তারার দেখা পাওয়া মুশকিল। বান্দরবনের সরকারী রেস্টহাউস পাহাড়ের ওপর রাতের খাবার সেরে পাহাড়ের চিকন রাস্তা বেয়ে উঠছিলাম চার বন্ধু। রাতুল, শ্রাবণ, জাসেদ আর আমি। কি মনে করে চার বন্ধু একসাথে আকাশের দিকে তাকালাম। ঝকমকে তারায় আকাশ ভর্তি, আকাশটা যেন তারায় বোনা।
জীবনের শ্রেষ্ঠ একটা দৃশ্য ছিল, একলা নয়, বন্ধুদের সাথেই দেখা। ৬০০ টাকা কিংবা আমার যৌনপরিচয় কোনটাই বাধা হয়ে দাড়ায় নি।
বন্ধুত্ব প্রকৃতই সীমারেখাহীন, লজ্জাবিহীন নগ্ন।