
লেখকঃ সুধাংশু
আজকে যদি ছোটবেলার স্বপ্ন নিয়ে এগোতাম, হয়তো ভালো গাইয়ে না হয়ে নাচিয়ে হয়ে উঠতাম। ভাইদাদা (নানা) কুরিয়ার করে মার কাছে আমার জন্য ঘুঙুরও কিনে পাঠিয়ে ছিলো। তার চার বছর বয়সী নাতি “মম চিত্তে নৃতে নৃত্যে” গানের সাথে ‘তা তা থৈ থৈ’ নাচতো আর তা দেহে ভাইদাদা-র খুশি আর ধরতো না। কিন্তু, না! ছেলে যে আমার হিজড়ে হয়ে যাবে! এই ভয়ে আমার বাবা আমাকে জোর করে গানের স্কুলে ভর্তি করে দিলেন আর বললেন, ‘ঘুঙুর পায়ে পরে নয়, হাতে নিয়ে তালের সাথে ঝম ঝম করে বাজিয়ে গান গাও, না হলে ওগুলো ফেলে দাও!’
যেখানে আমাদের সমাজ সংস্কারীরা ভাবছেন যে, সমাজের একক পরিবার গুলো থেকে সংস্কৃতি চর্চা উঠেই গেছে, সেখানে আমার বাড়িতে কিন্তু তা পুরো দমেই চলছে। খালি ছেলে আর মেয়েদের জন্য ভাগ করে দেওয়া হয়েছে। আজ আমি পুরো দমে গান গাইতে পারি, কিন্তু তাও কথা শুনতে হয়। ঐযে, ‘ওভাবে গান গাও কেন? হিজড়ে নাকি?’
হোম-কোয়ারেন্টাইনে আমি চুল বড় রেখেছি, জীবনেও তো চুল দু’ইঞ্চির চেয়ে বড় করতে পারলাম না। এবার করোনার ভয় দেখিয়ে, সেলুন যাওয়া আটকেছি। এখন আমার ঘাড় ছুই ছুই লম্বা চুল। বড় শখ করে সেদিন, স্নানের পর চুল ঝাঁকি দিয়েছিলাম। ওপাশ থেকে ঝাড়ি এলো, “ফিতে কিনে দেবো?”
হাঁটতে চলতে উঠতে বসতে সর্বক্ষণ শুনতে হয়, হিজড়াদের মতো করি কেন! আচ্ছা, ছেলেদের মতো কি করে করতে হয়, কেউ কি জানেন?
আমি জানি এটা কোনো নতুন সমস্যা নয়। কমবেশি সব কুইয়্যার মানুষকেই এরকম পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হয়, বিশেষ করে সমকামীদের। কিন্তু, আমার এ লেখার পেছোনের একটা উদ্দেশ্য আছে। আমরা ভাবি সমাজে সংস্কৃতির অভাবে হয়তো এমন অনেক ঘটনাই ঘটছে, যা মননের বিকাশের সুযোগ থাকলে কমে যেতো। কিন্তু, তা ঠিক নয়। আমরা সমাজ ব্যবস্থার এমন এক সংস্করণে দাঁড়িয়ে আছি, যেখানে মানুষ নিজের সংস্কৃতিকেও জেন্ডার রোলের ফ্রেম বা কাঠামোর মধ্যে বেঁধে ফেলেছে। মানুষের জন্মগত আচরণ আর যৌনতা যেমন নিয়মের ধার-ধারে না, ঠিক তেমনি, সংস্কৃতিও নিয়মনীতির উর্ধ্বে গিয়ে সকলের।
আমার মা-বাবা, যথেষ্ট সংস্কৃতি মনা। কিন্তু মনের সংকীর্ণতা তাদের শেষ করে দিচ্ছে। এসমাজে আমাদের সমকামী কিংবা কুইয়্যারদের জন্য একটা বড় সমস্যা মানুষের মানসিকতা। এ মানসিকতা দেশি-বিদেশি কোনো রকমের সংস্কৃতি চর্চার দ্বারা যাবে না। আমার মতে এখন দরকার পুনর্শিক্ষা বা Re-education এর। ভূত যদি সরষের ভেতর থাকে, তবে সরষে খেতে হাল চাষ করে তো আর লাভ নেই, না? এই পুনর্শিক্ষার একটা বড় অংশ জুড়ে রাখতে হবে বিভিন্ন জিনিসের সাথে জেন্ডার রোল এসাইন করার প্রবণতার প্রতি অনুৎসাহ।
ভয় করে, কবে যেনো বলে বসে, “এই ছেলে, হিজড়াদের মতো দম ফেলো কেনো?”