বাইসেক্সুয়ালিটির অদৃশ্য অক্ষর

মনে করুন আপনি একদিন আলাদীনের চেরাগের মত আশ্চর্য কিছু পেয়ে গেলেন।  আজ আমরা এই নিয়েই কথা বলবো। আপনাকে যদি কোনো একটি অতিপ্রাকৃত শক্তি বেছে নিতে বলা হয়, আপনি কোনটি বেছে নেবেন? অসীম শক্তির অধিকারী? ক্ষিপ্র গতি? এক্স-রে’র মতো মর্মভেদী দৃষ্টি? নাকি আপনি ওড়ার ক্ষমতা চাইবেন? টাইম মেশিনের মতো অতীত-ভবিষ্যতে ঘুরে বেড়ানোর ক্ষমতা? নাকি ইচ্ছাশক্তি দিয়েই সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করতে চাইবেন? হয়তো স্রেফ আপনার গাড়ির চাবি খোঁজার জন্য! ধরুন আপনার অতিপ্রাকৃত ক্ষমতাটি হচ্ছে অদৃশ্য হতে পারা। হয়তো আপনি এটাই বেছে নিয়েছেন বা আপনার ভেতর আপনা হতেই জন্ম নিয়েছে এই ক্ষমতা। যেটাই হোক না কেন, এই ক্ষমতা কিন্তু বেশ কাজের মনে হচ্ছে।  বদমাশের দল ক্ষ্যাপানোর জন্য আপনাকে খুঁজে পাবে না। আপনি যেখানে খুশি সেখানে যেতে পারবেন, যা মনে চায় তাই করতে পারবেন এমনকি একটু কৌশলী হলেই কেউ জানতেই পারবে না যে আপনি সেখানে বর্তমান। এমনকি যদি দেখেও ফেলে তারা আপনাকে ঠিক চিনতে পারবে না। তারা কেবলই আপনার পরিপাটি সচেতন রূপটি দেখতে পাবে। আপনার সত্যিকারের পরিচয় থাকবে সর্বদাই গোপনীয়।   

 শুনে বেশ রোমাঞ্চকর লাগছে, তাই না? কেমন লাগবে আপনার যদি আমি বলি এই অদৃশ্যময়তা এক অর্থে সত্যি, এমনকি ততোটাও বিরল নয় যতোটা আপনি ভাবছেন? সত্যি বলতে আমার নিজেরও এই ক্ষমতা রয়েছে এবং এই মুহূর্তে তা ব্যবহারও করছি। এখন আপনাদের কেউ কেউ পাশের জন কে গুঁতো মেরে বলবেন, “কী যা তা বলছে সে? আমি তো দিব্যি তাকে ড্যাবড্যাবিয়ে দেখছি!” হ্যাঁ, তা সত্য বটে। কিন্তু আপনারা কী দেখতে পাচ্ছেন? এই মুহূর্তে, আমি আপনাদের সামনে যা প্রদর্শন করছি তা হলো মোটামুটি মাঝবয়েসি ছোটখাটো এক ককেশীয় মহিলার ছবি। এটা সত্যি। তার চুলগুলো ঢেউ খেলানো, চোখে চশমা এবং ঢেউ খেলানো চুলগুলো ক্রমশ ধূসর হতে চলছে। সে একটা ছোট মিডওয়েস্ট শহরের কাঠের বেড়া দেওয়া পুরনো এক বাড়িতে বাস করে। তার তিনটা বাচ্চা ও একটা কুকুর আছে এবং সে একটা স্টেশন ওয়াগনের মালিক। লোকজন সচরাচর তাকে “ম্যা’ম” বলেই সম্বোধন করে এবং তাতে সে বেশ স্বাচ্ছন্দ্যেই সাড়া দেয়। সে মদ খায় না কিন্তু ইয়োগা প্যান্ট ঠিকই পরে এবং সে যেসব সেলেব্রিটিদের ভক্ত – মাইরি বলছি কোনো কোনো ব্রিটিশ তারকাদের তো মহাকাশ থেকেও দেখা যায়! “নেটফ্লিক্স এন্ড চিল” কথাটা তার জন্য কখনো কখনো একদম আক্ষরিক হয়ে ধরা দেয় কেননা রাত নয়টা বাজতে না বাজতেই সে টিভি সেটের সামনে ঝিমুতে থাকে। আপনারা তার ধরণ টা কী তা জানেন, অন্তত নিজেরা তো তেমনটাই ভাবেন। 

 আমার মতো অদৃশ্য হওয়ার ক্ষমতা আরো অনেক মানুষেরই আছে,হয়তো এই ঘরেই এখন অনেকে রয়েছেন। আমাদের কারো আঙুলে আবার আমার মতই শক্তিশালী জাদুর আংটি রয়েছে যা আমাদের অদৃশ্য হওয়ার ক্ষমতাকে বহুগুণে বাড়িয়ে তোলে। যদি আমরা তা খুলে ফেলি তারপরও আমাদের চারপাশে যারা আছেন তারা আমাদের সেই রূপই দেখতে পাবেন যেমনটি তারা চান, যা তাদের মাথার মধ্যে কাঙ্ক্ষিত ও নির্মিত।  এইমাত্র আমার আরেক আমি সম্বন্ধে যা যা বললাম তার সবটাই সত্য। কিন্তু এই সত্য সম্পূর্ণ সত্য নয়।  আমার এই অদৃশ্য ক্ষমতার ভিত্তি হচ্ছে আমার বাইসেক্সুয়ালিটি এবং তা আরও সুদৃঢ় হয় বিপরীত লিঙ্গের একজন ব্যক্তির প্রতি আমি অঙ্গীকারাবদ্ধ বলে। আর আমার সেই জাদুর আংটি, খোদা রক্ষা করুক যদি তা আমি ফেলে দিতে চাই, সেটা আমার বিয়ের আংটি! লোকজন ধরে নেয় যে যারা বিপরীত লিঙ্গের সাথে আছে বা যারা তাদের যৌন পরিচয় উল্লেখ করে না তারা আবশ্যিকভাবে বিষমকামী বা স্ট্রেইট। 

 অনেকে বলতেই পারে এটা এক ধরণের সুবিধা বা আরো ভালোভাবে বললে এ যেন এক অসামান্য অধিকার। লোকের চোখে স্ট্রেইট হওয়ার কারণে আমরা অনেক বৈষম্যের হাত থেকে বেঁচে যাই যার ভুক্তভোগী সমকামী যুগল বা যারা তাদের যৌন পরিচয় সকলকে জানান দিয়েছে।  উদাহরণ হিসেবে বলা যেতে পারে আমরা সকলের সামনে আমাদের বিপরীত লিঙ্গের সঙ্গীর হাত ধরতে পারি কোনোরকম রূঢ় প্রতিক্রিয়ার আশঙ্কা না করেই। অফিসের টেবিলে আমরা পরিবারের ছবি রাখতে পারি আমাদের সহকর্মী বা ভোক্তাগণ কী ভাববে তা নিয়ে দুশ্চিন্তা না করেই। আমাদের বিবাহবার্ষিকী এবং সম্পর্কের অন্যান্য বিশেষ দিনগুলো ঘটা করেই উদযাপিত হয় এবং আমরা সকলের কাছ থেকেই অভিনন্দন পাই। যদি আমাদের বাচ্চা থাকে তবে কেউ জিজ্ঞেস করে না, “তোমাদের মধ্যে ঠিক কোনজন ‘মা’?” আমরা যদি সকলের সামনে ঘনিষ্ঠ হই তাহলে আমাদের দিকে তীব্র ঘৃণা ও শ্লেষ ছুটে আসে না। চিকিৎসার প্রয়োজনে আমরা আমাদের সঙ্গী বা সন্তানের অবস্থা প্রশ্নহীনভাবে জানতে পারি। আমাদের বিয়ের আবেদন কোনোরকম ঝামেলা ছাড়াই জমা পড়ে এবং কেউ এই ভেবে আতঙ্কিত হয় না ঠিক কোন বাথরুম আমরা ব্যবহার করি।   

 তারপরও, সবকিছুরই তো কার্যকারণ থাকে। ক্ষমতার জন্য মূল্য তো দিতেই হয় এবং অদৃশ্যময়তার মূল্য কম কিছু নয়। এই গোপন জীবন যাপিত হওয়াকে মনে হতে পারে যেন মিথ্যার সাথে বসবাস। এই ধরণের ক্ষমতা বেশ ক্ষ্যাপাটে এবং তা আপনার বশবর্তী হয়ে থাকে না। এই ক্ষমতা ত্যাগ করা খুবই, খুবই কষ্টকর এমনকি যখন আপনি সত্যিই তা ত্যাগ করতে চান। এই ক্ষমতা আপনার ভেতর পরিপুষ্ট হতে থাকে ‘মানুষ কী ভাবছে’ এর মাধ্যমে। এই ‘মানুষ কী ভাবছে’ এর সাথে যদি ভীতির ক্ষমতাও যুক্ত হয় তখন এই অদৃশ্যময়তা এতটাই শক্তিশালী হয়ে ওঠে যে আক্রান্ত ব্যক্তি নিজের সত্তা থেকেও বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন। আমাদের আত্মপরিচয়ের একটা অংশ আমরা নিজেরাই ভাগ ভাগ করে আলাদা করি এবং আমরা আমাদের পরিচয়ের সেই অংশটুকুর সাথেই একাত্বতা পোষন করি যেটুকু লোকের চোখে স্বাভাবিক। আমরা একটা মিথ্যার আবরণ তৈরি করে প্রকাশ্য দিবালোকে তার মধ্যে লুকিয়ে থাকি। আমরা নিজেদের নিস্তব্ধতার মধ্য দিয়ে নিজেদের প্রতি অন্যায়ে শামিল হই। 

 আমাদের সবাই কিন্তু এরকম না। কিছু বাইসেক্সুয়াল প্রকাশ্যেই এই অদৃশ্যময়তাকে প্রত্যাখান করেন। তারা ক্রমাগত কথা ও কাজের মধ্য দিয়ে বলে যেতে থাকেন কিভাবে তাদের যৌনপরিচয় তাদের আত্মপরিচয়ের চক্রকে পূর্ণতা দেয়। ব্যস, এটাই মোদ্দা কথা! তাই নাকি? আসলে এতটাও সহজ নয় যতটা শোনাচ্ছে। কারণ অদৃশ্যময়তার একটা খবিশ চামচা আছে যার নাম হচ্ছে ‘মুইছা ফ্যালো’। এই ‘মুইছা ফ্যালো’ ক্রমাগত বলে যেতে থাকে বাইসেক্সুয়ালরা আসলে দ্বিধাগ্রস্ত, অস্থিরমতি, এ তো কেবলই জীবনের একটা মুহূর্ত বা আমরা এসব করছি কেবলমাত্র সকলের মনোযোগ আকর্ষণের জন্য। এ আমাদের চিহ্নিত করতে থাকে লোভী, অবিশ্বস্ত, এবং একগামী বা দীর্ঘসময়ের সম্পর্কে অক্ষম হিসেবে। এই ‘মুইছা ফ্যালো’ আমাদের চৈতন্য কে গিলে ফেলে এবং বাকিদের হাতে আমাদের যৌনপরিচয় ঠিক করার দায়িত্ব দেয় আমাদের সঙ্গীদের লিঙ্গীয় পরিচয়ের ভিত্তিতে। ‘মুইছা ফ্যালো’র দ্বিমুখী নীতি বাইসেক্সুয়ালদের বলে থাকে “তুমি ক্যুইয়ারদের কাছে একটু বেশিই স্ট্রেইট আবার গে হওয়ার জন্যও পর্যাপ্ত ক্যুইয়ার নও।” এই সত্তা বাইসেক্সুয়াল পুরুষদের বলে “হ্যাঁ হ্যাঁ, আমরা জানি তুমি আসলে গে, তুমি এইটা স্বীকার করতে চাইতেছ না”। ‘মুইছা ফ্যালো’ চায় বাইসেক্সুয়াল নারীরা পারফর্ম করার মাধ্যমে তাদের বাইসেক্সুয়ালিটি প্রমাণ করুক। এই ‘মুইছা ফ্যালো’ কে পাত্তা দেওয়ার মানে হচ্ছে বারবার কামিং আউট করেই যাওয়া, ক্রমাগত লোকের অসংখ্য প্রশ্নের উত্তর দিয়েই যাওয়া, নিজেকে ক্রমাগত না বেশি কঠোর না বেশি কোমল প্রমাণ করে যাওয়া। এই ‘মুইছা ফ্যালো’ খুবই ক্লান্তিকর এবং তা নৈরাশ্যের জন্ম দেয়। 

 তো, তাহলে লড়াইটা কিসের? আমরা জানি আমরা কী, তাই না? ‘স্ট্রেইট’ বা ‘গে’ কোনোটাই অপমানসূচক শব্দ নয়, কেবল এগুলো যথাযথ শব্দ নয় আমাদের চিহ্নিত করার জন্য। তাহলে কি আমরা সেই সময়েই ফিরে গেলাম না যখন আমরা লোকজনকে যা খুশি ভেবে নিতে দিতাম আর নিজেদের ছুঁড়ে ফেলতাম দুর্যোগের ভাগাড়ে? কারণ একটা মিথ্যা বাইনারিতে জোর করে খাপ খাইতে চাওয়ার অর্থই হচ্ছে যা তুমি নও তার ভান করে যাওয়া এবং তুমি যা তাকে লুকিয়ে রাখা। এও আরেক ধরণের ক্লজেট জীবন। এটা বিষাক্ত এবং ধীরে ধীরে তা আমাদের অনেককে মেরে ফেলছে। বাইসেক্সুয়াল হচ্ছে তারাই যারা বিপরীত লিঙ্গ বা জেন্ডারের মানুষের পাশাপাশি সমলিঙ্গের বা জেন্ডারের মানুষের প্রতিও কোনো ধরণের রোমান্টিক বা যৌন আকর্ষণ বোধ করে। আমরা এলজিবিটি শব্দটার ৫২ শতাংশ পূরণ করা সত্ত্বেও আমরা নীরব দর্শক। আমরা গে বা লেসবিয়ানদের থেকে ৬ গুণেরও বেশি নিজেদের যৌনপরিচয় আড়াল করি, এমনকি তা আমাদের প্রিয় বন্ধু বা পরিবারের সদস্যদের থেকেও। মাত্র ৪৪ শতাংশ বাইসেক্সুয়াল কিশোর কিশোরী তাদের অবস্থান জানানোর জন্য কোনো বিশ্বস্ত প্রাপ্তবয়স্কের সন্ধান পায়। বাইসেক্সুয়াল প্রাপ্তবয়স্ক ও কিশোর কিশোরীদের একটা বিরাট অংশই অত্যাধিক মাদকাসক্তি, ধূমপান এবং বিভিন্ন ধরণের ড্রাগে আসক্ত হয়ে পড়ে। প্রতি তিনজনের একজন প্রাপ্তবয়স্ক বাইসেক্সুয়াল তাদের চিকিৎসকের কাছে তাদের যৌনপরিচয় গোপন করেন। এই গোপনীয়তা আমাদের ও স্ট্রেইটদের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের মধ্যে বিরাট ফারাক গড়ে তোলে, যার ফলে আমরা অনেকেই উচ্চতর মাত্রায় হৃদরোগ, কিছু নির্দিষ্ট ধরণের ক্যান্সার, অধিক মাত্রায় স্থুলতা, অ্যাংজাইটি এবং ডিপ্রেশনে ভুগি। প্রচুর যৌন স্বাস্থ্য শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালিত হয় কেবলমাত্র বিষমকামিতার প্রেক্ষিতে অথবা এসব থেকে দূরে থাকো বলে থামিয়ে রাখা হয়। যার ফলে বাইসেক্সুয়াল নারীরা হয়তো জানতেই পারছেন না তাদের নারী সঙ্গীদের সাথে যৌন আচরণের সময় যৌনবাহিত রোগ থেকে সুরক্ষা পেতে কী কী ব্যবস্থা গ্রহণ করা সম্ভব। গে পুরুষদের চেয়ে বাইসেক্সুয়াল পুরুষরা তাদের এইচআইভি স্ট্যাটাস জানতে কম আগ্রহী এবং অনেকেই নারী সঙ্গীর চেয়ে পুরুষ সঙ্গীর ক্ষেত্রে কনডম ব্যবহারে অনুৎসাহী। লেসবিয়ান বা স্ট্রেইট নারীদের তুলনায় বাইসেক্সুয়াল নারীরা ৩০ শতাংশের অধিক হারে দাম্পত্য ও যৌন সহিংসতার শিকার হন। ৪০ শতাংশ প্রাপ্তবয়স্ক বাইসেক্সুয়াল হয় আত্মহত্যা করেছেন বা অন্তত চেষ্টা করেছেন। 

 এখন দেখেন, কেউই এত এত পরিসংখ্যান ও তথ্য উপাত্ত জেনে তারপর এই ট্রাজিক পথে এগোয় না। কখনো কখনো শুরুটা হয় মাথার ভেতরের ছোট্ট একটা কণ্ঠস্বর থেকে যেটা বলে, “আমি ভাই চুপচাপই থাকবো, কে না জানে শয়তান প্রমাণিত হওয়ার চেয়ে অদৃশ্য থাকাটাই ভালো বুদ্ধি। আমাকে ভুলভাল পরিচয়ে চিহ্নিত করলেও সমস্যা নেই যদি না এতে আমাকে খুঁতওয়ালা এক ঊনমানুষ বানিয়ে ছাড়ে।” এই কণ্ঠস্বর কখনো কখনো খুবই প্রবল হয়ে উঠতে পারে। দয়া করে কখনোই এর কথা শুনবেন না। এই মিথ্যা থেকেই শুরু হয় নিজেকে ঘৃণা করা এবং এই ঘৃণা আপনাকে জ্যান্ত খেয়ে ফেলবে। এটা সত্য নয়, সমতা নয় এবং কারোর জন্য কাম্যও নয়। বাইসেক্সুয়াল হওয়াটা সমস্যার কিছু না। সমস্যাটা হচ্ছে অন্যান্য মানুষেরা কিভাবে এটিকে ভুলভাবে ব্যাখা করে এবং এই ব্যাখা থেকেই যত বাজে প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়।  

 আমি সবার সামনে কামিং আউট করেছি দুই বছরেরও কম সময় হলো। ভাবা যায়! আমি এজন্য করিনি যে আমার একঘেয়ে লাগছিলো বা বিয়ে নিয়ে আমি অসুখী ছিলাম। এমনও না যে আমার হঠাৎ সবার মনোযোগ আকর্ষণের দরকার পড়েছিল বা আমার কোনো ধরণের মিডলাইফ ক্রাইসিস চলছিলো। না। আমি কামিং আউট করেছি কারণ আমি ব্যক্তিগত জীবন ও গোপন জীবনের মধ্যকার পার্থক্য বুঝতে চেষ্টা করেছি এবং দেখেছি কিভাবে তা আমার ও অন্যান্যদের জীবনে প্রভাব ফেলছে। ব্যক্তিগত বিষয়গুলো কিছু নির্দিষ্ট মানুষের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে কারণ তারা আপনার জীবনে বিশেষ কেউ। অপরদিকে গোপনীয়তা আসে কোনো কিছুর ভয় বা লজ্জা থেকে। আমি যখন পেছন ফিরে আমার পুরোনো সম্পর্কগুলো দেখি যেখানে আমি আমার যৌনপরিচয় বা সম্পর্কটাকেই গোপন রেখেছি তখন আমি মনে করতে পারি কিভাবে ভয় এবং লজ্জা আমার সিদ্ধান্তগুলোকে ঘিরে ধরেছিলো। ভয় ছিলো যে আমার সঙ্গী তার প্রতি আমার প্রতিশ্রুতিকে প্রশ্নবিদ্ধ করবে, ভয় ছিলো যে তারা আমাকে কেবলই তাদের কিছু ফ্যান্টাসি হিসেবে দেখবে, ভয় ছিলো যে তারা আমায় ছেড়ে চলে যাবে। এটা খুবই লজ্জার যে আমি জানতাম যে আমি নিজের ব্যাপারে সৎ নই, কী লজ্জার যে আমি সারাক্ষণ চিন্তা করতাম মানুষ আমার সমলৈঙ্গিক সম্পর্ক নিয়ে কী ভাববে- যার ফলে আমি কেবল আমার বিপরীত লৈঙ্গিক সম্পর্কগুলোর ব্যাপারেই কথা বলতাম, এটা লজ্জার যে এই সিদ্ধান্তগুলো বহু মানুষকে আঘাত করেছে। আমি আমার মুখ বন্ধ রেখেছিলাম, আপনারা বিশ্বাস করবেন কি না জানি না আমি কেবল সেটাই করেছি যা আমার কাছে সবচেয়ে কম জটিল ছিলো। আমি নিজেকে বুঝিয়েছি যে এটাই সবচেয়ে ভালো উপায়, যখন স্পষ্টতই তা ছিলো না। আমার মনে আছে যখন আমি এই চক্র ভেঙে ফেলতে চাইলাম তখন আমি কেবল নিজের সাথে লুকোচুরি খেলা বন্ধ করেই ক্ষান্ত হলাম না বরং ঝুঁকি নিলাম এমন কারো কাছে নিজেকে সত্যিকারের খোলামেলাভাবে তুলে ধরতে যাকে আমি বিশ্বাস করি। একদম শুরু থেকেই আমার স্পাউস আমার যৌনপরিচয় সম্পর্কে অবগত ছিলো, সেও আঠারো বছর আগের কথা। সেই সময়ে আমার কাছের মানুষদের মধ্যে একমাত্র সে ই জানতো। বহু বছরের দাম্পত্য সঙ্গী হিসেবে আমরা বহু চড়াই উৎরাই এর মধ্য দিয়ে গিয়েছি, এসবের কোনোটাই আমাদের দুজনের কারোর অপরের প্রতি মিথ্যা, কোনো কিছু লুকানো বা ভান করার সন্দেহ থেকে জন্ম নেয়নি। 

 আমাদের বিয়েটা দুটো বিপরীত লিঙ্গের মানুষের মধ্যে বিয়ে, কোনো স্ট্রেইট বিয়ে নয়। আমি ‘স্পাউস’ শব্দটা ব্যবহার করি কারণ এর অর্থ ‘বেছে নেওয়া জীবনসঙ্গী’।  এটা আমার জন্য সমান সত্য হিসেবেই থাকবে তা আমি স্টেফান বা স্টেফানিকেই বিয়ে করি না কেন। আমি একজন সঙ্গী বেছে নিয়েছি, কোনো পক্ষ নয়। আমি একজন বিষমকামী সিসজেন্ডার পুরুষের সাথে একক বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ। আমি তিন সন্তানের মা। তারপরও আমি বাইসেক্সুয়াল। আমাকে প্রায়শঃ জিজ্ঞেস করা হয় আমার সন্তানেরা কি আমার যৌনপরিচয় জানে বা আমি কি তাদের জানানোর ব্যাপারে কোনো পরিকল্পনা করেছি? তারা প্রত্যেকেই জানে যখন তারা তাদের ঠিক বয়সটিতে পৌঁছেছে এবং এর কারণ হলো আমি চেয়েছি তারা বুঝুক যে যৌনপরিচয় লজ্জার কিছু নয় এবং কোনো ট্যাবু নয়। ক্যুইয়ার মানুষেরা বাস্তবে সিনেমার ভাঁড় এবং সমাজের বাধাধরা চিন্তার চেয়েও বেশি কিছু। আমাদের সম্পর্কের ভেতরেও মানসিক যোগাযোগ, মায়া-মমতা, ধৈর্য এবং প্রতিশ্রুতি থাকে। আমরা প্রত্যেকেই আমাদের অঙ্গ প্রত্যঙ্গের সমষ্টি এবং তার সাথে আমরা কী করি তারচেয়েও বেশি কিছু। আমাদের সন্তানদের কেউ যদি কখনো ডিনার টেবিলে বলে বসে “মা, বাবা, আমি _” শূণ্যস্থান পূরণ করুন— “করলা খেতে চাই”, তাহলে আমি তাদের জানাতে চাই যে এই পুরো বক্তব্যের সবচেয়ে ভয়ঙ্কর অংশটি হলো সবজি খেতে তার আগ্রহ প্রকাশ করা। 

যখন অদৃশ্যময়তা বিষাক্ত হয়ে পড়ে, যখন তা আর কেবল ব্যক্তিগত থাকে না বরং গোপন এবং অর্ধসত্য হয়ে ওঠে তখন সময় হয় একে রাস্তা থেকে ভাগিয়ে দেওয়া। ভাগিয়ে দেওয়া কখনোই সহজ কিছু নয় কিন্তু আমি আপনাকে বলছি তা আপনাকে আরো শক্তিশালী করে তুলবে। নিজেকে প্রকাশ করার মধ্য দিয়ে আমরা নিজেদের পরবর্তী করণীয় নিজের হাতে তুলে নিতে পারি। আমরা নিজেদের কাছে নিজেকে বৈধ করে তুলতে পারি। একবার যখন এই অতিপ্রাকৃত ক্ষমতার ভেতর থেকে বেরিয়ে আসতে পারবো, তখনই কেবল বুঝতে পারবো এই ক্ষমতার বোঝা ঠিক কতটুকু ছিলো এবং এই ক্ষমতা ছাড়া আমরা কতটা স্বাধীন। আমরা কতটা গে আর কতটা স্ট্রেইট এই চিন্তা থেকে বের হয়ে আমরা কতটা যথেষ্ট, ঠিক তাই বুঝতে পারবো। দৃশ্যমান হওয়া এবং নিজের পরিপূর্ণ সত্তাকে জানান দেওয়ার শুরুটা হতে পারে এভাবেই- পরিপূর্ণ সত্যের মধ্য দিয়ে সম্পর্কের শুরু এবং পুরো বিশ্বের কাছে নিজেকে উপস্থাপন করা যেমনটা আমরা চাই। প্রকাশ্যে ভালোবাসার মধ্য দিয়ে আমরা তাদেরকে সাহায্য করতে পারি যারা সত্যিকারের রোল মডেলের অপেক্ষায় রয়েছে। এই অবস্থায় আসতে হয়তো বেশ সময় লাগবে এবং লাগবে অনেক সাহস ও ছোট ছোট পদক্ষেপ। এই অগ্রযাত্রার সিঁড়ি সবসময় মসৃণ হবে না এমনকি কখনো মনে হতে পারে যে আমরা আসলে এগোতে পারছিই না। অনেক কিছুই ঘটতে পারে, পুরো প্রেক্ষাপট ঘেঁটে যেতে পারে, অস্বস্তিকর এমনকি বীভৎসও হয়ে উঠতে পারে। আপনাকে হয়তো আপনার সত্যিকারের বন্ধু ও সহমর্মীদের কাছে পৌঁছানোর জন্য সবচেয়ে দুর্গম পথটিই অতিক্রম করতে হবে। যদি আপনার কখনো থামার প্রয়োজন পড়ে, থামুন, বিশ্রাম নিন। আপনার সত্যের কোনো সময়সীমা বা মেয়াদোত্তীর্ণ হওয়ার কিছু নেই। যদি এই মুহূর্তে আপনার মনে হয় আপনি কেবল নিজের কাছে ফিসফিসিয়ে সত্যিটা বলতে পারেন, তবে তাই করুন, যেভাবেই হোক বলুন। সবার আগে নিজের কাছে দৃশ্যমান হয়ে উঠুন। হিরো হয়ে ওঠার তাগিদে আপনার অদৃশ্যময়তাকে বিকিয়ে দেবেন না, আপনি তার জন্য কারো কাছে দায়ী নন। একমাত্র যেই মানুষটাকে রক্ষা করার জন্য আপনি সম্পূর্ণরূপে দায়বদ্ধ তা হলেন আপনি স্বয়ং।  

লিখেছেনঃ মিস্টি জেডলিনস্ক* ; অনুবাদ করেছেনঃ উৎসারিত আলো

* মিস্টি জেডলিনস্ক মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অশ্কোশ শহরে টেডেক্স অশ্কোশে একটি বক্তৃতা প্রদান করেন যা ইউটিউবে ১৯ জানুয়ারি,২০১৯ এ প্রকাশিত হয়। জেডলিনস্ক এবং টেডেক্স সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে দেখুন, https://www.ted.com/talks/misty_gedlinske_bisexuality_the_invisible_letter_b এই লিংকটি।   

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.