
তখন বাজে দুপুর ২টা, প্লেটে ভাত নিয়ে বসেছিলাম। খেতে একদমই ইচ্ছে করছিল না কারণ সকাল থেকে মন মেজাজ অনেক খারাপ। কারন আর কিছুই নয়, সারাদিন তুর্যর কোন খোঁজ খবর ছিল না। ওর সাথে অনলাইনে সময় কাটানো আমার জন্য ছিল সারাদিনের বিশেষ একটা কাজ। ফেসবুক জিনিসটার প্রতি হয়তো এই কারনেই অনেক নেশা বেড়ে গিয়েছিলো।
মনের মধ্যে একগাদা বিরক্তি নিয়ে ফেসবুক এ ঢুকতেই তুর্যর মেসেজ দেখতাম। অনেক গুলো নদীর ছবি আর নিচে ছোট্ট করে লেখা থাকতো “তুই যেদিন আসবি তোকে নিয়ে এখানে বসে আড্ডা দিবো”।
একটু অভিমান নিয়ে আমি ওর ম্যাসেজ এর উত্তর দিতাম সবসময়, “প্রথমত এরকম সাংকেতিক ভাষায় কথা বলা বন্ধ কর, আর দ্বিতীয়ত তোর সাথে এখন পর্যন্ত ফোন এ কথা বলার সৌভাগ্যটুকু হলও না আর নদী ভ্রমণ তো অনেক দুরের চিন্তা”।
তবে বেশিক্ষণ অভিমান করে থাকতে পারতাম না ওর উপর। ফেসবুকের মাধ্যমে বন্ধুত্ব হয়েছিলো আমাদের। কখনো ফোনে কথাও হয়নি, অথচ অনেক দিনের চেনা পরিচিত মানুষ হয়ে উঠেছিলো তূর্য। তুর্য থাকতো বরিশালে, ওর কাছে সেই জায়গার এতো গল্প শুনেছিলাম যে পরবর্তীতে বরিশাল শহরে টুরিস্ট গাইডের চাকুরী পেতেও কোন সমস্যা হতো না আমার। রাখাইন বুদ্ধ মন্দির, হরিণঘাটা, শাহী মসজিদ আরও কতো জায়গার যে গল্প লিখে পাঠাতো। কুয়াকাটা সমুদ্রবন্দর নাকি মাত্র ১০৮ কিমি বরিশাল শহর থেকে।
তুর্য বলতো আমি যেদিন যাবো ওর শহরে সেদিন নাকি ও আমাকে সমুদ্র দেখাতে নিয়ে যাবে। আমি বসে বসে কল্পনা করতাম দুই বন্ধু মিলে অনেক মজা করবো, অনেক ঘুরে বেড়াবো। ওকে বারবার মনে করিয়ে দিতাম বছরের শেষে ইউনিভার্সিটিতে লম্বা ছুটির কথা। তুর্য তখন লিখত, “এতো বেশি লাফাস না, যদি আমি অন্য কোথাও চলে যাই তখন কিন্তু কান্নাকাটি শুরু করে দিবি”। আমি হাসতাম আর বলতাম আমার সাথে দেখা না করে তুই এই শহর ছাড়তে পারবি না।
ওর প্রতি নিজের মধ্যে অন্যরকম একটা বিশ্বাস কাজ করতো আমার। কেন করতো? কি কারনে করতো? এটা কি বোকামি ছিল নাকি অন্যরকম ভালোলাগা ছিল, এতো কিছুর হিসাব কষতে যেতাম না। কিন্তু আজ বুঝি আমি ভুল ছিলাম, নিজের আবেগকে অনেক বেশি প্রাধান্য দিতে গিয়ে বাস্তবতা কি তা আমি ভুলে গিয়েছিলাম।
তুর্য একদিন আমার সেই ফেসবুক এর ছোট্ট পরিসর থেকে হারিয়ে গেলো। বেশ কিছুদিন লাগাতার আমার লেখার কোন উত্তর দিচ্ছিল না সে, এরকম করে দেখতে দেখতে একদিন তার ফেসবুক আইডিও হাওয়া হয়ে গেলো। কেন যোগাযোগ বন্ধ করে দিলো তা জানানোর কোন প্রয়োজন মনে করেনি সে। হয়তো তার কাছে এক বছরের সেই ভার্চুয়াল বন্ধুত্ব শুধু সময় কাটানোর একটা মাধ্যম ছিল। আর অন্যদিকে আমি বন্ধুত্বকে সেই মাপকাঠিতে বিচার করিনি বলে এতোটা কষ্ট পেয়েছিলাম।
সাল ২০১৫।
চাকুরী, জীবন, আরও অনেক চিন্তার চাপে বেশ ব্যাস্ত আমি। সব থেকে মজার বিষয়টি হল চাকুরীর সূত্রে গত দুই বছর ধরে আমি থাকি বরিশালে। কাজের ফাঁকে ফাঁকে ঘুরে বেড়াই এই শহরে আর সুযোগ পেলে চলে যাই কিত্তনখোলা নদীর পাড়ে, যার ছবি তুর্য আমাকে পাঠাতো। নদীর ধারে একলা সময় কাটাতে বেশ লাগে। আবার পুরনো সেসব বন্ধুত্ব, ভালোলাগার কথা মনে পরলে বেশ হাসিও পায়। কি আবেগ যে কাজ করতো সে সময়!
যাকে কখনো চোখে দেখি নি তার প্রতি অদ্ভুত ভালো লাগা কাজ করতো। ঠিক কি কারণে তার উত্তর আমি আজও খুঁজে পাইনি। একদিন একলা বসে এসব ভাবছি ঠিক সেই সময় পিছন থেকে একটা ছেলে আমার কাঁধে হাত রেখে বলল “ভাইয়া আমার নাম তুর্য। সাইকেল চালিয়ে মাঝে মধ্যে এদিকে আসি আর আপনাকে প্রায় দেখি এই একখানে বসে থাকেন”।
কি বলবো না বুঝে আমি হা করে ছেলেটার দিকে তাকিয়ে আছি। আমার উত্তরের অপেক্ষা না করে ছেলেটা বলে উঠলো “নদীর ওই পাড়টা আরও বেশি সুন্দর, আপনার সমস্যা না থাকলে আমার সাথে গিয়ে ঘুরে আসতে পারেন”।
তূর্য বরিশাল জিলা স্কুলে ক্লাস টেনে পড়ে। মাঝে মাঝেই আমরা নদীর পাড়ে সাইকেলে ঘুরে বেড়াই। মৃদু বাতাসে আমার চুল ওড়ে আর তখন ভাবি জীবন আমাদের কতো অবাক করা মুহূর্ত উপহার দেয় যা চিরজীবন স্মৃতিতে জড়িয়ে থাকে।