
সোয়েবের সাথে পরিচয় হয়েছিলো আমার বন্ধু জাহিদের মাধ্যমে। প্রায়শই আমি আর জাহিদ ধানমন্ডি লেকের পাড়ে একসাথে আড্ডা মারতাম। সেদিন জাহিদ সাথে করে সোয়েব নামের ছেলেটাকে নিয়ে আসে। হাসিখুশি আর চঞ্চলতায় ভরা সুদর্শন বাচ্চা ছেলেটাকে প্রথম দেখাতেই আমার ভিষণ ভালো লেগে যায়। বাচ্চা বলছি কারন সোয়েব ইন্টারমিডিয়েট দ্বিতীয় বর্ষে পড়তো,আর আমি ঢাকার একটা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের তৃতীয় বর্ষের ছাত্র ছিলাম। এটাকে প্রথম দর্শনে প্রেম বলা যায় কিনা জানিনা তবে ওকে দেখার পরেই আমার কেমন জানি বিষাদগ্রস্ত ভালোলাগা এবং খারাপ লাগা কাজ করতে শুরু করলো। ভালো লাগার কারন অবশ্যই সোয়েব আর খারাপ লাগার কারন হলো, গোলাপ যেমন সুন্দর তেমনি গোলাপে আবার কাটাও থাকে।ছিঁড়তে গেলেই কাটা ফুটে যাওয়ার একটা সম্ভাবনা আছে।
এই ভালোলাগা আর খারাপ লাগার সমুদ্রে আমি যখন কদিন ধরে হাবুডুবু খাচ্ছিলাম তখন জাহিদ আমার জন্য একটা খুশির সংবাদ নিয়ে আসে। সেটা হলো সোয়েবকে টিউশনির প্রস্তাব। আমিও সাথেসাথে প্রস্তাবটা লুফে নিলাম। পরের সপ্তাহে সোয়েবকে পড়াতে ওদের বাসায় যাই। রাজপ্রাসাদে মতো সুবিশাল অট্টালিকায় সোয়েবের বসবাস। গিয়ে জানতে পারলাম সোয়েবের বাবা দেশের একজন বড় মাপের ব্যাবসায়ী এবং সেরা বিত্তবানদের মধ্যে একজন। কিন্তু আমার মতো এতিমখানায় বড় হওয়া একটা ছেলের কি রাজকুমারের প্রেমে পড়া উচিত হয়েছিলো! জীবনটা তো আর সিনেমা নয়,তাইনা?মনে মনে সোয়েবকে পড়ানোর ধান্দা প্রায় বাদই দিয়ে ফেলেছিলাম। কিন্তু সবকিছু মিলিয়ে কয়েকটি ব্যাপার খুব অনুকূলেই ছিলো-
বেতনের অংকটা খুব ভালো।
ওদের বাসার নাস্তা,এতো ভালো ভালো খাবার আমি জীবনে খুব কমই খেয়েছি।
আর প্রতিদিন সোয়েবকে দেখার সুযোগ। আর এজন্য দেড় ঘন্টা পড়ানোর বদলে আমি দুই থেকে আড়াই ঘন্টা পড়াতাম।
সোয়েব পড়াশোনা তেমন করতে চাইতোনা। পড়াতে গেলেই আড্ডা জুড়ে বসতো। সারাদিন কি কি করলো,কি কি শপিং করলো;এই গল্প,সেই গল্প করে করেই কোনরকম সময়টা পার করে দিতে চাইতো। বুঝলাম সোয়েব ওকে পড়ানোর জন্য আমার কাছে প্রস্তাব পাঠায়নি,প্রস্তাব পাঠিয়েছে আমাকে দেড়-দুই ঘন্টা পড়ানোর নামে ওর কাছে আটকে রেখে গল্প করার ধান্দায়। কিন্তু তাও আমি জোর করে ওকে পড়াতে চাইতাম কারণ পরীক্ষায় রেজাল্ট খারাপ করলে সেই দায় আমাকেই নিতে হবে।
প্রতিদিন ওর সাথে সময় কাটাতে কাটাতে আমি একরকম সোয়েবের প্রেমেই পড়ে গেলাম বলা যায়। এবার সোয়েবের বর্ননা একটু দেয়া যাক। না থাক,বর্ননা দিতে গেলে কমতি হয়ে যাবে,বা ভুল হবে। মোট কথা সোয়োবকে বর্ননা করার মতো কোনো শব্দ আমার কাছে ছিলোনা। আমার শুধু মনে হতো দুনিয়ার সব কবিদের সোয়েবকে নিয়ে কবিতা লেখা উচিত ছিলো,সমস্ত চিত্রকরদের উচিত ছিলো সোয়েবের প্রতিকৃতি আঁকা।নার্সিসাসও সোয়েবকে দেখে চোখ ফেরাতে পারতোনা।
আর সেই ক্ষেত্রে আমার মতো শ্যামলা আর রোগা পাতলা একটা ছেলের প্রেমে পড়া তো সোয়েবের কখনোই উচিত নয়।আমি নিজে যদি সোয়েব হতাম তবে আমাকে থাপড়াতাম সোয়েবের সাথে প্রেম করতে চাইবার অপরাধে৷ অথচ আমি নাকি সোয়েবের সাথে প্রেম করার স্বপ্ন দেখছি! তার ওপর আমার বয়স ২২ হলেও আমি সোয়েবের শিক্ষক । সেই হিসেবে ছাত্রের প্রেমে পড়া খুবই অশোভন কাজ।ছিঃ ছিঃ! কি লজ্জা! কি লজ্জা!
ভালো সময় বেশিদিন থাকেনা। সোয়েবের ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষা শেষ হলো, আমার টিউশনটাও চলে গেলো। তারপর মাস কয়েক ওর সাথে যোগাযোগ হয়নি বললেই চলে। আমিও আমার কাজে ব্যাস্ত হয়ে গেলাম। সোয়েবও হয়তো আমার মনের রঙিন দুনিয়া থেকে আস্তে আস্তে ধূসর হতে হতে পুরোটাই বিবর্ণ হয়ে যেতো যদিনা একদিন ধানমন্ডি লেকের পাড় থেকে ছেলেটা আমাকে ডাক না দিতো-
-এই যে মিহির ভাইয়া,মিহির ভাইয়া শুনুন।
আমি সুমধুর গলায় আমার নাম ডাকা দেখে অবাক হয়ে পিছনে তাকিয়ে দেখি সোয়েব।
সোয়েবকে দেখেই আমার পেটের ভেতরে সুড়সুড়ি দিতে দিতে পুরোনো প্রেমটা জেগে উঠলো আবার,একই সাথে রাগ হতে লাগলো।ভালোই তো ছিলাম বাপু,আজ কেন দেখা হয়ে গেলো।
-আরে সোয়েব যে,কেমন আছো? শরীর স্বাস্থ্য ভালো তো তোমার?
-হ্যাঁ সবকিছু ভালো,আপনার কি খবর? একদম লাপাত্তা হয়ে গিয়েছেন। আমি তো আপনার ঠিকানা জানিনা। আপনি তো আমার ঠিকানা জানেন। একটা খোঁজও নিলেননা একবারও।
সোয়েবের গলায় আমি সেদিন কিছুটা অভিমানের সুর পেয়েছিলাম। রাস্তায় হাটতে হাটতে আমাদের আধ ঘন্টার মতো কথা হয়েছিলো তখন।এতকাল ধরে যা ঘটেছিলো সেগুলো ছিলো প্রেমে পড়ার জন্যে,কিন্তু দুজন দুজনকে ভালোবাসার জন্যে কোন ঘটনা এখনও ঘটেনি দেখে সৃষ্টিকর্তা হয়তো ভাবলেন ইনাফ ইজ ইনাফ।এবার কিছু একটা করতে হবে।
আর তাই সেদিনই হঠাৎ করে ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি নামলো। বৃষ্টি থেকে গা বাঁচাতে দুজনে দৌড়ে গিয়ে একটা ছাউনির নিচে আশ্রয় নিলাম। সোয়েব গুনগুনিয়ে গান ধরলো, ‘আজি ঝরো ঝরো মুখর বাদর দিনে।’
-বৃষ্টি ভালো লাগে তোমার সোয়েব?
-খুউউব ভালো লাগে,বৃষ্টিতে ভিজতেও ভিষণ ভালো লাগে।আপনি ভিজবেন আমার সাথে বৃষ্টিতে?
আমাকে কিছু বলার অবসর না দিয়েই সোয়েব আমার হাত ধরে টেনে ছাউনি থেকে খোলা আকাশের নিচে নিয়ে গেলো। আর আমি ধপাস করে আছার খেয়ে মাটিতে বসে পরলাম।
‘আশ্চর্য, এমন হাবাগোবাও মানুষ হয়? একটু ভেজা রাস্তাতেও দাড়াতে পারেননা?’ বলে সোয়েব আমাকে টেনে তুললো।আমি উঠে দাঁড়ালাম, কিন্তু পরক্ষণেই আবার আছার খেয়ে পরে গেলাম। বৃষ্টির ভেতরে আমার আছার খাওয়া দেখে সোয়েব হাসতে লাগলো আর আমি মুগ্ধ হয়ে ওর হাসি দেখতে লাগলাম।
তার পরের দিন আমার ভিষণ জ্বর আসলো।
আমার মতো এতিমখানায় বড় হওয়া একটা ছেলের কাছে এই অসুস্থ অবস্থায় পাশে থাকার মতো কোনো আত্মীয় ছিলোনা। কিন্তু জাহিদ নামের এই বন্ধুটা আমার বিপদে আপদে সবসময় পাশে থেকেছে।
আমি বিছানায় শুয়ে জ্বরে কাতরাচ্ছি আর জাহিদ আমার পাশে বসে আজাইরা প্যাচাল পারতেছে। আমি বিরক্ত হয়ে ওর কথা কানে নিলাম না। আমি ভাবছিলাম সোয়েব কি জানে আমার জ্বর! জানলে কি আমাকে দেখতে আসবে! ধুর!ছেঁড়া কাথায় শুয়ে লাখ টাকার স্বপ্ন দেখা গরিবের একটা বাজে স্বভাব।কোথায় সোয়েব আর কোথায় আমি! আর আমার জ্বর হলেও বা সোয়েবের কি! ও কেনো দেখতে আসবে আমায়!
কিন্তু আমাকে অবাক করে দিয়ে ঠিক দুপুর বেলা হাতে একটা বড় টিফিন ক্যারিয়ার নিয়ে সোয়েব আমার বাসায় চলে এলো।বন্ধু জাহিদ পাশে বসে আমি যে কত বড় হাদারাম তা নিয়ে বিশাল বক্তব্য দিচ্ছিলো,সোয়েব ঢুকতেই বললো,” এতক্ষণে আসার সময় হলো তোমার?” বুঝলাম জাহিদ’ই সোয়েবকে আমার জ্বরের খবর আর আমার বাসার ঠিকানা দিয়েছে।
– আরে সোয়েব যে,কেমন আছো?শরীর ভালো তো?
-আপনি দুনিয়ায় এই এক কথা ছাড়া কিছু জানেন না আর? আর আমার শরীর নিয়ে এত সচেতন আপনার না হলেও চলবে।
-আরে বসো বসো
আমি ইশারায় জাহিদকে বাইরে যেতে বললাম।কিন্তু জাহিদ হারামজাদা আমার ইশারা না বোঝার ভান করে চুপচাপ বসে রইলো।
– এই নেন,নিজে রান্না করে এনেছি।হাজার হোক আপনি আমার শিক্ষক।আমার একটা দায়িত্ব আছে।
– আরে কী দরকার ছিলো এত কষ্ট করবার?
-যতটা ভাবছেন ততটা কষ্টও আমি করিনি। খাওয়াদাওয়া না করে তো স্বাস্থ্যের বারোটা বাজিয়েছেন । নিন খেয়ে নিন।
সোয়েব টিফিন বাটি খুলে হাঁসের মাংস ভুনা,বেগুন ভাজা,বাসমতি চালের ভাত, চিঙড়ীর ঝোল আর ইলিশ ভাপা বের করলো।
এই সময় জাহিদ বলে উঠলো
– আরে কি করো এটা?
-কেন ভাইয়া?
-মিহির তো এসব খাবার খায়না,ওর অ্যালার্জির সমস্যা।
আমি হতাশায় মাথা নেড়ে বুঝলাম আমার জীবনের অনেক ভুলের একটা এই ছেলের সাথে বন্ধুত্ব করা।সুস্থ হবার পর এর একটা বিহিত করতেই হবে।
সোয়েব আসতো রোজ দুপুর গড়ালে,আমি অবাক হচ্ছিলাম।আমার মতো একটা ছেলের জন্য এই ছেলে এত কষ্ট করে কেন রোজ আসছে? রোজ রান্না করে নিয়ে আসতো,আমি খাদ্য প্রেমিক।আরাম করে খেতাম। সোয়েব বসে বসে দেখতো আর আমার সাথে রাজ্যের গল্প করতো,ও আমার মাথায় জল পট্টি দিয়ে দিতো,ভেজা কাপড় দিয়ে গা মুছে দিতো,আমার বিছানা পরিস্কার করে দিয়ে যেতো।
এই ছেলেকে দেখে বোঝার উপায় নেই ও এতো বড়লোক ঘরের ছেলে। অথচ একটুও অহংকার নেই, খোলা মনের মানুষ।
জ্বরের কারনে বাসায় থাকার পনেরো দিন আমার করার কিছু ছিলো না,আমি শুয়ে শুয়ে বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ডের বিভিন্ন আজাইরা প্যাচাল নিয়ে ভাবতাম।এইসব ভাবনার বাইরে সোয়েবকে নিয়েও আমি ভাবতাম।এইসব ভেবে ভেবে আমি এই সিদ্ধান্তে আসতে পারলাম যে,সোয়েবকে আমি ভালোবাসি।অনেক অনেক, জীবনের চেয়েও ভালোবাসার মত কিছু অবশ্য হয় নি।তবে আমি ওকে ভালোবাসি,এবং ও ভালোবাসুক বা না বাসুক এই কথাটা ওকে জানানো দরকার!
সুস্থ হবার পর অতি বিশ্রী হাতের লেখায় চিঠি লিখে ফেললাম একটা-
” সোয়েব জানো,
আমি তোমাকে ভালোবাসি-“
এইটুক লেখার পর আর কিছু আসে নি মাথায়।
সোয়েবকে ফোন দিয়ে বললাম,
– আজ বিকেলে একটু রবীন্দ্র সরোবরে আসতে পারবা?
– কেন?
-আরে তুমি আমার জন্যে এত কিছু করলে, তোমারে ট্রিট দেবো।
– আমি কি আপনার ট্রিটের আশায় এইসব করছি? সোয়েব অভিমানী সুরে বলে উঠল।
এই ছেলে দেখি খুবই ঘিরিংগি বাজ।আমি সংশোধনের সুরে বললাম,
– আরে না না,তাও আসো না।
– আচ্ছা ।আমি আসবো।
বিকেলে সোয়েব এলো, আমি শার্ট পরে একটু বেশ ফর্মাল লুক নিয়ে এলাম।
-কেমন আছো সোয়েব?শরীর ভালো তো?
-ওমা,আপনি ফর্মাল পরেন কেন? ফর্মালে আপনাকে আরো রোগা লাগে।
সে সময়টাতে আমার ভেতর বেশ অস্থিরতা কাজ করছিলো।জীবনে প্রথম বার প্রেমপত্র দিতে এসেছি,একটু নার্ভাস হওয়া উচিত।এর আগে ভার্সিটিতে ভর্তি হয়ে র্যাগ খেয়ে এক আপুকে প্রপোজ করতে হয়েছিলো। সিনিয়র ভাইরা এক আপুকে দেখিয়ে তাকে প্রপোজ করতে বলেছিলো। আমি ভয়ে ভয়ে আপুর কাছে গিয়ে বলেছিলাম,” আপু, আমার প্রেমিকা হবেন?” আপুরা তখন আমাকে আবার দশবার কান ধরে উঠবস করিয়েছিলো। সে অনেকদিন আগের কথা। তারপর আর কাউকে প্রপোজ করা হয়নি।
আমরা দুই প্লেট ফুচকা নিলাম ,অতি নার্ভাসনেসে আমি গপগপ করে খেতে লাগলাম।খাওয়া শেষে যাবার আগে আমি সোয়েবের হাতে আমার চিরকুট গুজে দিয়ে কোন কথা আর না বলে একরকম পালিয়ে চলে এলাম!
তার পরদিন জহিদ এসে খবর দিলো,সোয়েব বিকাল চার টার সময় ওর বাসার সামনে দেখা করতে বলেছে।
মনেমনে ভয় হচ্ছিল ,একারণেই বোধহয় বড়লোকের ছেলেকে প্রেমপত্র দিতে নেই।ধরে মাইর টাইর আবার না দেয়।
বিকেলে অতি সাবধানে আমি সোয়েবের বাসার দিকে গেলাম। রাজি না হোক আপত্তি নেই- কিন্তু কোনভাবেই যেন লাঞ্ছিত হতে না হয়।
আমাকে অবাক করে দিয়ে সোয়েব এসবের কিছু করলো না। কেবল একটু হতাশার সুরে বলল,
-আপনি জীবনে কাউকে প্রেমপত্র দিয়েছেন?
আমি চুপ
-কথা বলছেন না কেন?
-ইয়ে মানে সোয়েব, আসলে…
-আপনি চুপ থাকুন! ভেবেছিলাম আমি যার প্রেমে পরবো সে হবে দারুন রোমান্টিক! আর এখন কি না যে ছেলে একটা চিঠি ও ঠিক করে লিখতে পারে না তার প্রোপোজালেও আমি রাজি হতে যাচ্ছি,অদ্ভুত ব্যাপার।
-মানে?
-আপনার মানে বুঝতে হবে না,এমন হাদারাম’ই থাকবেন,আমি মানে বুঝায় দিবো।একটা রিক্সা ডাকেন। আজ আমার ঘুরতে ইচ্ছে করছে!
সোয়েবকে প্রোপোজ করেছিলাম ওর প্রেমে পড়ে বা ফ্যাসিনেশন থেকে,কিন্তু ওকে ভালোবাসা শিখলাম প্রেম টা হয়ে যাবার পরে। আমি ওকে ভালোবাসতাম খুব,নিজের থেকেও বেশি ভালোবাসতাম।ওর হাসিকে ভালোবাসতাম,বৃষ্টির প্রতি ওর মুগ্ধতাকে ভালোবাসতাম,ওর চঞ্চলতাকে ভালোবাসতাম। আমরা নিয়ম করে দেখা করতাম। ঢাকার সব গলিপথে আমাদের হাতে হাত ধরে হেটে চলার অসংখ্য স্মৃতি।
একদিন সোয়েবকে জিজ্ঞেস করলাম,
-তুমি আমাকে এখনো আপনি করে বলো কেন?
-তুমি করে বলার জন্যে তো একটা জীবন পড়েই আছে।
কে বলেছে এক জীবন পূর্ণ করতে হাজার মুহূর্ত লাগে? সোয়েব ছিল আমার জীবনের পূর্ণতার সবটুকু।সেই জীবনের দিনগুলো আস্তে আস্তে গড়াতে থাকে,
সোয়েবের স্বপ্ন ছিলো আমাদের দুজনার ছোট্ট একটা ঘর হবে,একটা সংসার হবে। আমরা অনেক গুলো এতিম বাচ্চা দত্তক নেবো। হয়তো আমার মতো একজন এতিমেকে ভালোবেসে সোয়েব এতিম বাচ্চাদেরকেও ওর স্বপ্নের সাথে জুড়েছিলো। আমি বলতাম, “আমার তো তিন কূলে কেউ নেই। তাই আমি সমাজের তোয়াক্কা করিনা।কিন্তু তোমার বাবা কি আমাদের সম্পর্কটা মেনে নেবে?” সোয়েব বলতো ও ওর বাবার একমাত্র ছেলে,ও যখন যা চেয়েছে ওর বাবা সব এনে দিয়েছে। ওর কোনো ইচ্ছে কোনদিন অপূর্ণ রাখেনি। সুতরাং সোয়েবের এই আবদারটাও কিছুতেই ফেলতে পারবেনা।
কি ভাবছেন পাঠক? এরপরে কি হতে পারে? সোয়েবের বাবা আমাদের সম্পর্কটা মেনে নিয়েছে? আমরা অনেকগুলো বাচ্চাকাচ্চা নিয়ে সুখে সংসার করছি? গল্পটা ঠিক এমন হলেও পারতো। কিন্তু তা হলোনা। সোয়েব যখন ওর বাবাকে আমাদের সম্পর্কের কথা জানালো তখন সে ছেলের সমকামী সম্পর্কটা কোনোভাবেই মেনে নিতে পারলোনা।
শেষ যদিন সোয়েবের সাথে দেখা হয়েছিলো সেদিন সমুদ্রের ঢেউয়ের মতো চঞ্চল ছেলেটাকে ভর দুপুরের শান্ত দিঘির চেয়েও শান্ত দেখাচ্ছিলো।
-আমাদের কি আর কোনদিন দেখা হবেনা সোয়েব?
-না দেখা হওয়ারই চান্স বেশি। বাবার হার্ট অ্যাটাক হয়েছে। ডাক্তার বলেছে সে বেশি উত্তেজিত হলে আর বাঁচবেনা।তাই বাধ্য হয়ে তার সিদ্ধান্ত মেনে নিতে হয়েছে।
-কি সিদ্ধান্ত নিলে?
-বাবা তার বন্ধুর মেয়ের সাথে আমার বিয়ে ঠিক করেছে। বিয়ের পর আমাদের বিদেশে পাঠিয়ে দেবে।
-অভিনন্দন, নিশ্চয়ই খুব ভালো মানাবে তোমাদের।
-আপনি এখনে ফাজলামো করছেন?
-আরে ধুর বোকা ছেলে,আসলেই বলছি।তোমার পাশে আমি যে বড্ড বেমানান এটা বুঝতেই আমার এত বছর লেগে গেলো।
-আপনি সাবধানে থাকবেন,যত্ন নিবেন।আরেকটা কথা, আপনি আরেকটু সাহসী হবেন। না হলে জীবনে অনেক কষ্ট পাবেন!
-কিন্তু তোমাকে ছাড়া আমি কীকরে থাকবো সোয়েব?
– থাকতে হবে,আপনাকে সহ্যশক্তি বাড়াতে হবে। একটা জীবন নাহয় আমরা কষ্টেই পার করলাম।
-আজকেও আপনি বলছো,তুমি করে বলার জন্যে কিন্তু এক জীবন আর পাবে না।
সোয়েবের আর আমাকে ‘তুমি’বলা হয় নি। হয়তো অভিমানেই সম্ভোধন উহ্য রেখে সোয়েব বলেছিল,
– আমি আসি।
সেদিনও বৃষ্টি নেমেছিলো। সোয়েব আমাকে শেষ বিদায় দিয়ে চলে গেলো। সেদিনও আমি বৃষ্টির ভেতর রাস্তার পাশের একটা বেঞ্চিতে বসে রইলাম। সেদিন বিমুগ্ধ চোখে সোয়েবের প্রাণোচ্ছল হাসির বদলে ঝাপসা চোখে সোয়েবের চলে যাওয়া দেখতে লাগলাম।
হুট করে সোয়েব এসেছিলো আমার জীবনে,অগোছালো আমাকে গুছিয়ে হুট করেই চলে গিয়েছিলো।
আমি ভেবেছিলাম আমার সাথে সোয়েবের বা সোয়েবের সাথে আমার এই মানব জনমে আর দেখা হবে না।কিন্তু আমি যা ভাবি তা আর কবেই বা ঠিক হল?
আজ প্রায় ২২ বছর পর,হ্যাঁ ২২ বছর তো হবেই।এতকাল পরে এসে সোয়েবকে দেখলাম আমি শিকাগোর নর্থ ওয়েস্টার্ন মেমোরিয়াল হাসপাতালে।মনের অজান্তেই কত কথা মনে পড়ছিলো।
ক্রসম্যাচিংয়ের রিপোর্টগুলো সামনে নিয়ে ডক্টর এ নিয়ে কমপক্ষে দশবার আমাকে জিজ্ঞেস করল,
– আপনি শিওর তো মি.মিহির ?
-হ্যাঁ ডাক্তার,১০০%
-কিন্তু আপনি কি জানেন এই বয়সে আপনি একটা কিডনী দিলে সেটা আপনার জন্যে রিস্কি হতে পারে?
– কিন্তুর চেয়ে বড় কথা আমার কিডনীটা পেলে একটা বাচ্চা ছেলে ভালো হয়ে যাবে।
-আপনি এদেরকে চেনেন না,ইভেন ডোনার হিসেবে আপনি নিজের নাম ও এক্সপোস করতে চাইছেন না।
-কে বলেছে চিনি না? নিজের থেকেও ভালো চিনি ডক্টর
-বাট মি.মিহির আরেকবার ভাবুন আপনার কিন্তু কয়েকটা রিস্ক ফ্যাক্টর রয়েছে।যদি এমন হয় আপনি আর জেগেই উঠলেন না?
-তাতে কিছু যায় আসে না ডক্টর ,আমার বয়স ৪৭,আমি অবিবাহিত, পৃথিবীতে আমার কোনো আত্মীয় স্বজন নেই।আমার বন্ধু জাহিদ’ও আর বেঁচে নেই।আমি মারা গেলেও কারো কিছু যায় আসে না।কিন্তু ছেলেটাকে দেখুন। এখনো বাচ্চা,ছেলেটার মা বাবা কে দেখেছেন? কি দিশেহারা হয়ে আছে!ছেলেটা না থাকলে অনেক কিছু যায় আসে,সোয়েবের যায় আসে।
-মানে?
-মানে কিছুইনা।আমি কিডনি ডোনেটের জন্য প্রস্তুত। বাট আমার পরিচয় টা কিন্তু জানবে না কেউ।
অপারেশন টেবিলে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে আমাকে। কেমন ভয় ভয় লাগছে।সোয়েব আমায় সাহসী হতে বলেছিল। হয়তো এতগুলি বছর পেরিয়েও আমি ঠিকঠাক সাহসী হতে পারলাম না!
হঠাৎ বৃষ্টি নেমেছে। মাথার ভেতর কেমন বেজে চলেছে-
‘মোড়ের মাথায় শেষমেশ শেষ করেছিলো যারা,
হঠাৎ দেখার বৃষ্টি দিনে ভালো থাকুক তারা।’
লেখকঃ মৃন্ময় রায়
প্রকাশেঃ সাতরঙা গল্প