
লিখেছেন অরণ্য রাত্রি
শিকল পরা হাত আমাদের। এই শিকলের নাম হোমোফোবিয়া। এই শিকলের কারণে আমরা পদে পদে হই বাঁধার সম্মুখীন। এই শিকল ভাঙতে হবে।
সমকামী মানুষদের প্রতি অযৌক্তিক ঘৃণা , বিতৃষ্ণা , ভয় এবং অস্বস্তিকেই আমরা বলি হোমোফোবিয়া। অন্যান্য যৌন প্রান্তিক জনগোষ্ঠী যেমন উভকামী বা ট্রান্স জেন্ডার মানুষদের ক্ষেত্রে এই ফোবিয়া মোটামুটি একই কিন্তু একটু ভিন্ন। উভকামী মানুষদের প্রতি ফোবিয়াকে বলা হয় বাইফোবিয়া এবং ট্রান্স জেন্ডার মানুষদের ক্ষেত্রে বলা হয় ট্রান্সফোবিয়া।
সর্ষের মাঝে ভুত বলে বাংলায় একটা কথা রয়েছে। আগে বলা হত কাউকে ভুতে ধরলে সর্ষের মাধ্যমে ওঝা ভুত তাড়াতো। কিন্তু ওই সর্ষেতেই যদি ত্রুটি থাকতো বা ভুত থাকতো তাহলে তা দিয়ে ভুত তাড়ানো যেত না। আমাদের অবস্থা অনেকটা এরকম। আমরা শুধু ভাবি হোমোফোবিয়া , বাইফোবিয়া , ট্রান্সফোবিয়া শুধু মাত্র বিষমকামী মানুষদের মাঝেই বিরাজমান। কিন্তু আমাদের কমিউনিটির কিছু মানুষের মাঝে যে তা রয়ে গেছে তা আমরা জানি না। কিন্তু বাইরের জগতের মানুষের মাঝে হোমোফোবিয়া দূর করার আগে তা আমাদের নিজেদের মাঝে দূর করা প্রয়োজন।
সমকামীরা কিভাবে সমকামীদের প্রতি হোমোফোবিক হয়? আমাদের সমকামী জনগোষ্ঠী বিশাল অংশের মাঝেই কিছুটা মেয়েলিপনা রয়েছে। তা হাঁটাচলা হোক বা কথাবার্তাতে হোক। এখন কিছু কিছু সমকামী মানুষ রয়েছেন যারা বীর দর্পে বলে থাকেন আমি পুরুষালী। আমার মাঝে কোন মেয়েলীপনা নেই। এই কথা গুলো তো অনেক বিষমকামী মানুষ আমাদের উদ্দেশ্যে বলে থাকেন। তাহলে তাদের সাথে আমাদের পার্থক্য কোথায় ? আবার কেউ কেউ বেশ গর্বের সাথে বলে আমি সমকামী এবং পুরুষ তাই আমি একজন পুরুষ কেই ভালবাসবো। তাই কোন মেয়েলি ছেলের সাথে আমি কোন সম্পর্কে জড়াবো না। একেকজনের পছন্দ একেকরকম হবে এটাই স্বাভাবিক। তার মেয়েলী ছেলে পছন্দ না হতেই পারে। কিন্তু তা তো ঘোষণা করে বলার মত কিছু নয়। এমন অনেক মানুষ রয়েছে যারা তথাকথিত এই সকল মেয়েলী স্বভাবের ছেলেদের কেই কিন্তু পছন্দ করে। কারো কারো গ্রাইন্ডার আইডি বা ফেসবুক আউডি তে বড় বড় করে লেখা থাকে , “ girlish people stay away from me” । এইভাবে কোন বিশেষ মানুষদের প্রতি লেখা তাদের কি পরিমাণ হিউমিলিয়েট করা হয় তারা কি বুঝে না? নাকি বুঝেই ইচ্ছা করে এমন করে ? তারা যে কোন মেয়েলী ছেলের সাথে কোন রকম সম্পর্কে যেতে চায় না তাতো অন্যভাবেও প্রকাশ করা যেত। অনেকেই মজা করে বা সংযোগের জন্য হিজড়া সম্প্রদায়ের উল্টী ভাষা ব্যবহার করে । যেমন কতি , পান্থি। এ শব্দ গুলো যদি কেউ মজা করে ব্যবহার করে তাতে আমি দোষ দেখি না। কিন্তু অনেক সমকামী তথাকথিত পুরুষ সমকামী আছেন যারা শুধুমাত্র মেয়েলী ছেলেদেরকে নিচু ভাবে দেখার জন্য বা অপমান করার জন্য কতি শব্দটি ব্যবহার করে। সেক্ষেত্রে আমি তীব্র প্রতিবাদ করবোই। এছাড়া তারা আরও অনেক অপমানসূচক কথাবার্তা,শব্দ ব্যবহার করে যা খুব আপত্তিজনক। এটা কি হোমোফোবিয়ার একটি প্রকৃষ্ট উদাহরণ নয়?
এইবার আসুন উভকামীদের ক্ষেত্রে। সাধারনত বাইফোবিয়া স্ট্রেইটদের মাঝেই পরিলক্ষিত হয়। কিন্তু সমকামীরাও বাইফোবিয়ায় ভুগে থাকে। কারণ অনেক সমকামী মনে করে উভকামীরা প্রতারক হয়। তারা একই সাথে ২ নৌকায় পা দিয়ে চলে। বিয়ের আগে ছেলেদের সাথে সম্পর্ক করে আর বিয়ের পর সেই প্রেমিক ছেলেটিকে ভুলে যায় এবং একটি মেয়েকে নিয়ে নতুন ভাবে জীবন শুরু করে। কিন্তু হাতের পাঁচটা আঙ্গুল যেমন সমান হয় না, তেমনি সব উভকামী মানুষ একরকম হয় না। সেটা আমাদের বুঝতে হবে এবং জানতে হবে। তাছাড়া অনেক সমকামী মানুষ কিন্তু পরিস্থিতির চাপে বিয়ে করে। তখন কিন্তু আমরা তাদের কে এইভাবে দোষারোপ করি না।
ট্রান্সফোবিয়া কিন্তু সমকামী এবং উভকামী মানুষদের ক্ষেত্রেও দেখা যায়। তার আগে হোমোফোবিয়া নিয়ে আরও কিছু কথা বলা উচিৎ। অনেক সময় সমকামী অনেক মানুষ ক্রস ড্রেসিং করে। পার্টি তে ক্রসড্রেসিং করে নাচে। যখন এই নাচ গুলো হয় তখন কিন্তু পার্টি তে উপস্থিত সবাই তা উপভোগ করে। এবং কেউ নেগেটিভ কথা বলে না। কিন্তু অনেক সমকামী মানুষ পিছনে তাদের নিয়ে হাসাহাসি করে, অপমানজনক কথা বলে, মর্যাদাহানিকর কথা বলে। কেন একটি ছেলে হয়ে সে মেয়েদের পোশাক পরেছে তা নিয়ে তুমুল আলোচনা হয়। শুধুমাত্র কপালে একটি টিপ পরলে কিংবা মাথায় একটি ফুল গুজলেও তা নিয়ে আলোচনা হয়। সুতরাং যারা এটুকু নিতে পারে না তারা কিভাবে ট্রান্সজেন্ডার মানুষদের সাদরে গ্রহণ করতে পারবে? একজন ট্রান্সজেন্ডার মেয়ের কাপড় , অলঙ্কার , চলাফেরা , কথাবার্তা কি তারা নিতে পারবে? অনেক দেশেই শুনি সেক্স পরিবর্তনের অপশন রয়েছে। বাংলাদেশে কেউ তা করেছে কিনা তা আমি জানি না। কিন্তু আমার মনে হয় এই ব্যপারটাও অনেকে মন থেকে মানতে পারবে না।
একটা স্বীকারোক্তি দেই। প্রায় ১০ বছর হল আমি এই কমিউনিটিতে। কিন্তু যখন আমি নতুন নতুন এই কমিউনিটিতে আসি তখন কিন্তু আমার দৃষ্টিভঙ্গি আলাদা ছিল। আমিও অনেক কিছু মন থেকে মানতে পারতাম না। যেমন ক্রসড্রেসিং, কিংবা মেয়েদের মত পোশাক পরে নাচা। অতিরিক্ত মেয়েলী ভাব আমার বিরক্ত লাগতো। কিন্তু তখন আমার এই চিন্তা মাথায় আসে নাই যে সাধারণত একজন হোমোফোবিক বিষমকামী মানুষ কিন্তু আমাকে একি দৃষ্টি তে দেখবে। আমাকে তার বিরক্তিকর মনে হবে।তখন কিন্তু এটা কে আমরা হোমোফোবিয়া বলে থাকি। তাদের কে দোষারোপ করি। তাহলে এক্ষেত্রে আমরাও কি একই দোষে আক্রান্ত নই?
পরবর্তীতে আমি এই বিষয় গুলো নিয়ে যখন একটু পড়াশোনা শুরু করলাম, ভাবতে শুরু করলাম তখন আমার সামনে একটি নতুন দ্বার উন্মোচিত হল। আমি অনেক কিছুই বুঝলাম , শিখলাম যা আগে বুঝি নাই।জানলাম জেন্ডার আইডেন্টিটি কি , জেন্ডার ডিস্ফোরিয়া কি, এর বিজ্ঞান সম্মত ব্যাখ্যা কি। এরপর আমার নিজের অধিকার সম্পর্কে যেমন সচেতনতা বাড়ল তেমনি আমার কমিউনিটির মানুষদের প্রতি সহমর্মিতা বাড়ল। অন্যান্য প্রান্তিক যৌন জনগোষ্ঠীর প্রতি সহমর্মিতা তৈরি হল। বুঝলাম আমি নিজেই হোমোফোবিয়া , ট্রান্সফোবিয়া তে আক্রান্ত ছিলাম। আমি নতুন করে আলোকিত হলাম।
একা কক্ষনো একটি বিপ্লব ঘটানো যায় না। সবাইকে নিয়ে আগাতে হবে। কিন্তু তার আগে সর্ষের ভুত কে তাড়াতে হবে। নিজেদের ভিতরেই যদি হোমোফোবিয়া , ট্রান্সফোবিয়া থেকে যায় তাহলে বিষমকামী মানুষের মধ্য থেকে তা কিভাবে দূর করতে পারবো? তাই আগে এই কমিউনিটির মানুষ কে জেন্ডার আইডেন্টিটি , সেক্সুয়াল অরিয়েন্টেশন, হোমোফোবিয়া , ট্রান্সফোবিয়া , জেন্ডার ডিস্ফোরিয়া ইত্যাদি বিষয়ে শিক্ষিত করে তুলতে হবে।আশা করা যায় এই শিক্ষা তাদের কে আলোকিত করবে। বুঝতে শেখাবে কোনটা ঠিক আর কোনটা বেঠিক। তাদের বিবেক জাগ্রত হবে। তাহলে যেমন জনবল বাড়বে তেমনি আমাদের নিজেদের মাঝে বৈষম্য দূর হবে। আমরা আমাদের কমিউনিটিকে হোমোফোবিয়া , ট্রান্সফোবিয়া, এবং বাইফোবিয়া থেকে মুক্ত করতে পারবো। তারপর শিকল ভাঙতে হবে।