
লিখেছেন মৃণ্ময় রায়
১.
হৃদয় প্রথম খুন টা করেছিলো ২০১৬ সালে।-তখন ও সবেমাত্র অনার্স প্রথম বর্ষে পড়তো।
সেপ্টেম্বরের এক সন্ধ্যায় হৃদয় আর অভ্র বসেছিলো পুরান ঢাকার এক বিল্ডিং এর ছাদে।চারদিকে অন্ধকার নেমে গিয়েছিল, মৃদুমন্দ বাতাস বইছিল। আকাশে চাঁদ না থাকলেও আশেপাশের ভবনগুলো থেকে বিচ্ছুরিত বিজলি বাতির আলোয় চারপাশ হালকা আলোকিত। ব্যাথাভরা আলোক দূষণে ভুগছে এই শহর।অভ্র আনমনে গান গাইছে,
-‘আজ আমার মন ভালো নেই,বসছেনা মন কিছুতেই,খোলা জানালায় দাড়িয়ে সুদুর আকাশ থেকে কিছু রঙ এনে দাও না…’
অসম্ভব ভালো গান করে অভ্র।সম্ভবত এই গান শুনেই হৃদয় অভ্রের প্রেমে পড়েছিল। হৃদয়ের ডাকে অভ্রের সম্মতি ফিরলো।
-অভ্র..
-হুমম,বলো হৃদয়।
-আমাকে কি একটু ভালোবাসা যায়না অভ্র?
-হৃদয়
-হ্যাঁ বলো
-কিন্তু আমি যে তানজিল কে ভালোবাসি হৃদয়। এজীবনে ওকে ছাড়া অন্য কাউকে ভালোবাসা আমার পক্ষে সম্ভব হবে না কিছুতেই।
-ওকেই যদি ভালোবাসতে তাহলে আমার সাথে সারা রাত জেগে কথা বলতে কেনো? ভালোবাসার গান কেনো শোনাতে? মন ভোলানো কথা বলে আমাকে পাগল কেনো করলে অভ্র?তোমার প্রতি আমার মনে এই অনুভূতির জন্ম কেনো দিলে?
-এক্ষেত্রে আমার কোনো দায় নেই হৃদয়। তোমার সাথে কথা বলতে আমার ভালো লাগতো,এখনো লাগে।কিন্তু আমি তোমাকে কখনো ভালোবাসিনি, ভালোবাসার কথা বলিনি।তুমি নিজ দ্বায়িত্বে আমাকে ভালোবেসেছো।সুতরাং আমার কিছু করার নেই।
-দয়া করো অভ্র। আমার নিঃস্বাস নিতে ভিষণ কষ্ট হচ্ছে। এভাবে আমাকে ফিরিয়ে দিওনা।
- আমি অপারগ হৃদয়।
অভ্র আবার গাওয়া শুরু করলো ‘ আজ আমার মন ভালো নেই..’
তখন হৃদয় ওর ব্যাগ থেকে একটা সবজি কাটার ছুরি বের করে অভ্রের নাভী বরাবর ঢুকিয়ে দিলো।তারপর সেটাকে বুক পর্যন্ত টেনে আনলো।টকটকে লাল রক্ত দেখার একটা ইচ্ছে ছিলো হৃদয়ের মনে।কিন্তু রক্তের কোনো চিহ্ন দেখতে না পেলেও অভ্রের নাড়িভুঁড়িটা দেখতে পায় স্পষ্টভাবেই।মেডিকেলে চান্স না পেয়ে ইঞ্জিনিয়ারিং’এ ভর্তি হবার কারণে মানুষের নাড়িভুঁড়ি আগে কখনো সামনাসামনি দেখার সৌভাগ্য হয়নি হৃদয়ের।
তারপরই ফোকড় পেয়ে নিখুঁত ভাবে পেটের গহ্বরে বসানো নাড়িভুঁড়িগুলো বের হয়ে আসে বাইরে। একেবারে ছাদের শেষ মাথা পর্যন্ত ছড়িয়ে গেল! মানুষের নাড়িভুঁড়ি এত লম্বা হয়?
আর্তচিৎকারের বিরাম নেই – অভ্র দুই হাতে ভেতরে ঢোকানোর চেষ্টা করছেন ওগুলো – তারপরই সব লাল হয়ে আসে। রক্তের ধারা বিভিন্ন দিক থেকে বের হয়ে আসতে শুরু করেছে। আতংকে পাগল হয়ে যায় অভ্র। দাঁড়িয়ে থাকতে পারেন না আর।
হাঁটু গেড়ে পড়ে যায় মাটিতে।
খেয়ালই করে না লাফিয়ে এগিয়ে আসছে মৃত্যুদূত!
হৃদয়ের ছুরিটা এবার অভ্রের গলাটা সুন্দর করে দু টুকরো করে দেয়।
ঘরঘরে একটা শব্দ করে মুখ থুবড়ে পড়ে থাকেন সদ্য জবাই হয়ে যাওয়া অভ্র।
পা দুটো ব্যর্থই মাটিতে ছুঁড়তে থাকে। ওর শরীরটা তড়পাতে তড়পাতে নিথর হয়ে যায়। তারপর রাতের আঁধারে সমস্ত প্রমাণ মুছে ফেলে হৃদয় সেখান থেকে চলে আসে। পরদিন পুলিশ এসে অভ্রের বাবা,সৎ মা আর সৎ ভাইকে ধরে নিয়ে যায়। মুচকি হাসে হৃদয়।
২.
দ্বিতীয় খুন করেছিলো সুমনকে।
সুমনের সাথে হৃদয়ের পরিচয় হয়েছিলো স্মরণের মাধ্যমে। একগুচ্ছ নীল শাপলা নিয়ে সুমনের সাথে প্রথমবার দেখা করতে গিয়েছিলো হৃদয়। তারপর বহুবার দেখা হয়েছিলো দুজনার।ঢাকা ভার্সিটির অলিগলি, ধানমন্ডি লেক,হাজারিবাগ,রমনা পার্কে হাতে হাত ধরে কতোদিন কতো রাত যে দুজনে ঘুরে বেড়িয়েছে তা লেখকের জানা নেই।এই ছেলেটার মুখে কিসের যেনো একটা মায়া ছিলো। হৃদয় সেই মায়ার বাঁধনে বাধা পরে গিয়েছিল ভালোভাবেই। কলাভবনের সামনের বটতলায় হৃদয়ের কোলে মাথা রেখে শুয়ে গান গাইতো সুমন। হাসিতে আর গল্পে অনেকটা সময় পার হয়ে যেতো – ঠিক ঐ সময়টাতে সুমন চুপ করে তাকিয়ে থাকতো হৃদয়ের দিকে। অনেকগুলো আবছা তারার আলো হৃদয়কে তখন অন্ধ করে দিতো।
হ্যাঁ অন্ধ’ই – তা না হলে হৃদয় হয়তো বুঝে যেতো যে ওর চোখের দিকে তাকিয়ে সুমন অন্য কাউকে ভুলতে চাইতো। সুমনের সাথে থাকতে হৃদয়ের ভালো লাগতো। আর সেই ভাল লাগাটা একসময় এতটাই নির্লজ্জ হয়ে গেল যে,হৃদয় ওকে সারা জীবন আঁকড়ে ধরে রাখতে চাইল। কিছু টের পাবার আগেই হৃদয় বুঝে গেলো, ওর বোকা মনটা ঠিক বোকার মতোই সুমনকে ভালোবেসে ফেলেছে। দিনরাত সুমনকে হারিয়ে ফেলার ভয় পেতো হৃদয়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত লাভ হয়নি- সেই ভিতু হৃদয় সুমনকে হাড়িয়েই ফেললো যেদিন সুমনকে ওর মনের কথা প্রকাশ করেছিলো।
একদিন রাতে মগবাজার ওয়ারলেস রেলগেট থেকে কিছুটা দূরে রেল লাইনের পাশে দাড়িয়ে নিজের সব সংকোচ ঝেড়ে ফেলে হৃদয় সুমনকে বলেছিলো ,
“ আচ্ছা সুজন, আমাকে কি তোমার কখনো ভাল লেগেছিল ? এই ধর , খুব অল্প সময়ের জন্য ?”
সুমন শুধু একটু হাসবার ভান করে বলেছিল , “আপনাকে তো আমার সবসময়ই ভাল লাগে, আপনাকে আমার কেন খারাপ লাগবে ? কিন্তু কিন্তু যেই সেন্সে ভাল লাগবার কথা বলছেন , – আমি আসলে সেই সেন্সে… আমি আসলে…”
সুমনের অবস্থা দেখে অতি দুঃখেও হৃদয়ের হাসি চলে এসেছিল । এই ছেলেটা হৃদয়কে কোনদিন ভালবাসতে পারেনি – এটা কি তার অপরাধের মাঝে পড়ে ?
হৃদয় তবু দাঁতে দাঁত চেপে বলেছিলাম, “ তুমি সত্যি অন্য কারো হয়ে গিয়েছো, তাইনা ? সত্যি আমার এখন গিভ আপ করা উচিত, তাইনা ?”
“ ধুর বোকা – রাজপুত্র আসবে আপনার জন্য !”
হৃদয় ওর চোখের দিকে শান্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলেছিলো,
“ সুমন, রাজপুত্র আসবার আগেই তুমি এসেছিলে কেন ?”
সুমন উত্তর দিতে পারেনি । হৃদয় অপেক্ষা করেছিলো কয়েক মুহুর্ত – তারপর একটা ট্রেন যখন সাইরেন বাজিয়ে ছুটে আসছিলো রেল লাইন ধরে তখন সুমনকে ধাক্কা মেরে ফেলে দেয় চলন্ত ট্রেনের সামনে।
৩.
মালিবাগের এই বাসাটায় হৃদয়ের নতুন রুমমেট হয়ে আসে পারভেজ। অনেক মজার মানুষ ও।সুমনের জন্য হৃদয়ের মনে যে হাহাকার ছিলো সেটা কিছুটা হলেও কমিয়ে এনেছে পারভেজ। হৃদয়ের ভিষণ খেয়াল রাখে পারভেজ। রোজ সকালে ধোঁয়া ওঠা কফি মগ হাতে হৃদয়ের ঘুম ভাঙানো, মজার মজার মুভি ডাউনলোড দিয়ে দেওয়া,নিয়ম করে হৃদয়কে নিয়ে ঘুরতে বের হওয়া,হৃদয়ের বিছানা গুছিয়ে দেওয়া থেকে শুরু করে জামাকাপড় ধুয়ে দেওয়া সবকিছুই করে দেয় পারভেজ।
পারভেজ জানে যে হৃদয় মিষ্টি খেতে খুব পছন্দ করে। তাই রোজ ভার্সিটি থেকে ফেরার সময় হৃদয়ের জন্য মিষ্টি নিয়ে আসতে একদিনও ভুল করেনা পারভেজ। হৃদয়ের যদি অসুখ করে,জ্বর আসে তাহলে দিশেহারা হয়ে যায় পারভেজ। সারাক্ষণ পাশে বসে থাকে,সারা রাত জেগে থেকে হৃদয়ের মাথায় জলপট্টি দিয়ে দেয়।এমন একটা রুমমেট থাকলে প্রেমিকের আর দরকার আছে বলে মনে করে না হৃদয়।হৃদয় ওকে আদর করে ‘ননভেজ’ বলে ডাকে। কিন্তু এই ননভেজটাও একসময় পাল্টে যেতে শুরু করে।এই প্রথম কেউ হৃদয়কে একটু কেয়ার করছিলো,হৃদয়কে সময় দিচ্ছিলো, কিন্তু তার এই পাল্টে যাওয়াটাকে কিছুতেই মেনে নিতে পারে না হৃদয়।
সাত দিনের জন্য বাড়ি যাবে পারভেজ।বাসায় হৃদয় একাই থাকবে।তাহলে এই সময়টাতে মিশনকে বাসায় ডাকা’ই যায়।কিন্তু সরাসরি বাসায় ডাকলে আসবেনা মিশন।তাই বিকল্প উপায় ভাবতে থাকে হৃদয়।মিশন হৃদয়ের কাছে ড্রয়িং শিখতে আসতো সিদ্ধেশ্বরী কালী মন্দিরে। সেদিন যখন মিশন মন্দিরে আসলো ছবি আাঁকা শিখতে তখন শরীর খারাপের বাহানা দিয়ে বাসায় আসতে বললো ওকে।বাসায় আসার পরে মিশনকে ওর প্রিয় আইসক্রিম খেতে দেয় হৃদয়, যেটাতে আগেই মিশিয়ে দিয়েছিলো ঘুমের অষুধ। কারন এই ছেলেটা বয়সে কম হলেও শারিরীক গড়নে বেশ বড়সড় এবং শক্তিশালী। ওর সাথে ধস্তাধস্তিতে পেরে উঠবেনা হৃদয়।
মিশন যখন ঘুমিয়ে পরলো তখন ওর হাত পা বেঁধে ফেলে হৃদয়। মুখটাও চমৎকার ভাবে কেটে রাখা এক টুকরো কাপড় দিয়ে শক্ত করে বাঁধে।
তারপর পড়ার টেবিল থেকে ওর কাঁটা কম্পাসটা তুলে নেয় একহাতে।
দিস উইল বি ফান!
শেষবারের মতো মিশনের কপালে চুমু খেয়ে ওর বাম হাতের নখের সামান্য ওপর থেকে ঝাঁঝরা করতে শুরু করে হৃদয়।
ডানহাতটা ওর পিস্টনের মত উঠছে নামছে – আর সেলাই মেশিনের মত ফুটো ফুটো হয়ে যেতে থাকে মিশনের হাত।
দু-তিনবার আঘাত করার পরেই ঘুম ভেঙে যায় মিশনের – তীব্র যন্ত্রণাতে লাফিয়ে উঠার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয় ও।
হৃদয়ের চোখে মুখে পৈশাচিক একটা আনন্দ খেলা করে সেটা দেখে। ভারী খাটের পায়ার সাথে এক হাত আর আরেক পা বাঁধা আছে। শত চেষ্টাতেও নড়ার কোন সম্ভাবনা নেই এই মানুষের।
অন্য পা আর হাতটা আছে মেঝে থেকে রডের সাথে বাঁধা। হাতি আটকে রাখার মত করে আটকে রাখা হয়েছে ওকে। কোন সম্ভাবনাই নেই এর থেকে মুক্তির।
কম্পাসের কাঁটার আঘাতে শিকার ব্যাথা পায় ঠিকই – কিন্তু রক্ত সেভাবে বের হয় না।
বিন্দু বিন্দু রক্তের দিকে তাকিয়ে থাকে হৃদয়।
বিষয়টা ওর কাছে বেশ মজার লাগে। আর ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক হিসেবে মিশনের হাল্কা গোঙ্গানীর শব্দটা অসম্ভব মধুর লাগছে এই মুহূর্তে।
মিশনের সাথে ফেসবুকে কয়েক বছর আগে পরিচয় হলেও দের বছর আগে সিদ্ধেশ্বরী কালী মন্দিরে কাকতালীয় ভাবে প্রথম দেখা হয় হৃদয়ের। তারপর অনেকবারই দেখা হয়েছিলো ওদের। মিশন ঠিক সেই রকম একটা ছেলে ছিলো যেমন একটা ছেলেকে হৃদয় মনে মনে চাইতো। বেখেয়ালে হৃদয় কখন যে ওর প্রেমে পরে যায় তা সে নিজেই জানে না। কিন্তু প্রপোজ করার পর সেই চিরাচরিত একই উত্তর দেয় মিশন,” আপনি ভালো মানুষ, কিন্তু আপনার প্রতি আমার ঠিক ঐ ধরনের কোনো অনুভূতি নেই।আপনি আমার থেকেও ভালো কাউকে পাবেন।” মিশনের পা পর্যন্ত ধরতে বাকি রাখেনি হৃদয় কিন্তু মিশনকে রাজি করতে পারেনি। তাই আজকে এই প্রত্যাখ্যানেরও বদলা নেবে হৃদয়।
প্রায় আধ ঘন্টা সারা শরীর ঘুরে ঘুরে কম্পাস দিয়ে ফুটো করার পর সকালে কেটে রাখা দারুণ কাপড়ের টুকরোটা হাতে নেয় ও। কয়েক স্তরের কাপড়টা দেখতে অনেকটা কুকুরের গলাতে আটকানোর বেল্টের মত। যদিও হৃদয় এটা বানিয়েছে পুরোনো বিছানার চাদর থেকে। বেল্টটার ঠিক মাঝখানে একটা সরু ফুটো।
আস্তে করে ওটা মিশনের গলাতে পড়িয়ে দেয় হৃদয়।
চকচকে মেলামাইনের বাটিটা নিয়ে ফিরে আসে এবার। পারভেজ ওকে এতে করেই মুড়ি মাখিয়ে দিতো।
মিশনের কন্ঠের হাড়ের ওপর বেল্টের ফুটো অংশটা রেখেছে ও – ওদিক দিয়ে খুব কষ্ট করে একটা পেন্সিল ঢোকানো যাবে হয়ত।
তবে হৃদয় পেন্সিল ঢোকায় না।
কম্পাসটা রেখে হাতে তুলে নেয় স্ক্রু-ড্রাইভারটি।
গলাতে টাইট করে বেল্টটা বাঁধা আছে কি না খেয়াল করে আরেকবার।
মিশনের চোখে যন্ত্রণার পাশে এই মুহূর্তে ফুটে উঠেছে মৃত্যুভয়। সেদিকে তাকিয়ে নির্মল একটা হাসিতে ভরে ওঠে হৃদয়ের মুখটা।
মিশনের চুল মুঠো করে ধরে চট করে স্ক্রু ড্রাইভারটা বেল্টের ফুটো দিয়ে পুরোটা ঢুকিয়ে দেয় হৃদয়। তারপরই ওটা বের করে এনেই একটু ঘুরিয়ে দেয় গলার বেল্টটা। পানির জগের মুখ লক করার মত করে।
ক্ষতটা ঢাকা পড়ে গেল কাপড়ের আড়ালে।
রক্তের ছড়াছড়ি থাকবে পুরো রুম জুরে – তাহলেই আর দেখতে হত না। কাজেই এই ব্যবস্থা। রক্ত মোছার ঝামেলা থেকে মুক্তি পাওয়া গেল।
চুল ধরেই রাখে হৃদয়। ঘাড়ের পেছনে রাখল মেলামাইনের বাটিটা।
গলার সামনে থেকেই তীব্র বেগে রক্ত বের হচ্ছে – কিন্তু বাইরে বের হতে পারছে না।
মধ্যাকর্ষণের অমোঘ টানে বেল্ট বেয়ে ঘাড়ের পেছন দিয়ে টপাটপ পড়তে থাকা রক্তগুলো সংগ্রহ করতে থাকলো মেলামাইনের বাটিটায়।
জানালায় কারও ছায়া এসে পড়ে এই সময়।
মুখ তুলেই চমকে ওঠে হৃদয়।
পারভেজ!
৪.
” চতুর্থ খুন টা করলি পারভেজ কে?”
জিজ্ঞেস করে চায়ের কাপে চুমুক দিলো ডাক্তার ফেরদৌস। একটা মুহূর্ত তাঁর দিকে তাকিয়ে থাকে হৃদয়।তারপর বলে,” হ্যাঁ পারভেজকে আমি ভালোবাসতাম,তবে সেটা ভালো বন্ধু হিসেবে। কিন্তু দিন দিন ওর পাল্টে যাওয়াকে আমি মেনে নিতে পারিনি।তাছাড়া মিশনকে খুন করার সাক্ষী ছিলো পারভেজ। তাই ওকেও সরিয়ে দিয়েছি।”
” পঞ্চম খুন টার ব্যাপারে আসা যাক- তানজিলকে খুন করেছিলি বিষ খাইয়ে।জন্মদিনের উপহার হিসেবে বিষ মেশানো চকলেট পাঠিয়েছিলি পার্সেল করে। মোটিভ রিজেকশন। “
মাথা নাড়ে হৃদয়। ডাক্তার ফেরদৌস বুদ্ধিমান লোক। তাকে বিশ্বাস করে হৃদয়। কাজেই তাকে সবটুকু খুলে বলেছে সে। যেটুকু অন্য কউকে বললে চৌদ্দ শিকের মধ্যে ঢুকে যেতে হতো ওকে।তবে হৃদয় কেবল ক্যালকুলেটেড রিস্ক নিয়েছে। মনোরোগ বিশেষজ্ঞের চেম্বারে মাইক্রোফোন লুকানো থাকতে পারে – কাজেই একটা রেস্টুরেন্টের প্রাইভেট কেবিনে এনেছে তাকে। একজন মনোরোগ বিশেষজ্ঞের পরামর্শ দরকার তার। আর কিছু না।
” পরের খুনটা করলি তন্ময়কে,এটারও মোটিভ রিজেকশন। “
“সরাসরি প্রপোজ করিনি।ইমরান দা’কে দিয়ে বলিয়েছিলাম কিন্তু না করে দিলো। তার কদিন পরে আমাকে দেখিয়ে দেখিয়ে অন্য একটা ছেলের সাথে রিলেশনে গেলো। কিন্তু সেটাও তো টিকলোনা।তাই ব্রিজ থেকে নদীতে ফেলে দিয়েছিলাম।সাতার জানতোনা।খরস্রোতা নদীতে মাটির ঢ্যালার মতো ডুবে গেলো। রাজনীতি করতো তাই দোষ চাপলো বিরোধী দলের ঘাড়ে। “
” সাত নাম্বার খুনের ব্যাপারে বল।”
” রুহিত,তেমন একটা আগ্রহ ছিলোনা ওর প্রতি। তবে কথা হতো মাঝেমধ্যে। তারপর আস্তে আস্তে সেটা নিয়মিত হওয়া শুরু করলো।ভালো লাগতে শুরু করলো। শুরুতেই আমি নিজে থেকে আগাইনি।অহিকে দিয়ে বলিয়েছিলো যে আমাকে পছন্দ করে।তারপর বেশ কয়েকবার বলেছিলো যে আমাকে ভালোবাসে। এরপর আমি যখন ওকে নিয়ে ভাবতে শুরু করলাম তখন হুট করে অন্য একটা ছেলের সাথে রিলেশনে চলে গেলো। একসাথে দুতিনটা অপশন হাতে নিয়ে প্রেমিক জোটানোর মিশনে নেমেছিলো। গলা টিপে মেরে ফেলেছি নির্জন চা বাগানের মাঝে। দেখতে পায়নি কেউ।”
চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে ডক্টর রায়হান বললো,
” এই পাঁচ বছরে মোট সাত জনকে খুন করেছিস। শুধু পারভেজ বাদে বাকি খুন গুলোর মোটিভ ঐ রিজেকশন, তাই তো?”
টেবিলের ওপর ঘুসি মেরে হৃদয় বলে উঠলো,” হ্যাঁ দাদা,পাগলের মতো ভালোবেসেছিলাম অভ্রকে। কিন্তু আমার ভালোবাসার কোনো দামই দিলো না।প্রত্যাখ্যান সহ্য করতে পারিনি তাই মেরে ফেলেছি। শরীরের কোথাও কেটে গেলে শরীর সেই ক্ষত আজীবন পুষে রাখেনা। কদিন পর সেটা শুকিয়ে যায়। আমিও সেভাবে নতুন করে চেষ্টা করেছিলাম অভ্রকে ভুলে নতুন করে বাঁচতে। সুমনকে তো আমি ভালোবাসতে চাইনি। ও প্রেমিকের মতো করে অভিনয় করেছে আমার সাথে। ওর অভিনয় বুঝতে না পেরে যখন ওকে মন দিয়ে দিলাম তখন জানতে পারলাম ও শুধু টাইম পাশ করেছিলো আমার সাথে। অথচ এই টাইম পাশ শব্দটাকে আমি সবথেকে বেশি ঘৃনা করতাম দাদা। তাই মেরে ফেললাম সুমনকেও। শুনেছি প্রতিটা প্রেমেই নাকি মানুষের নতুন করে জন্ম হয়। মিশনের প্রেমে পড়েছিলাম আমি। যখন ওকে প্রপোজ করেছিলাম তখন বললো,” আপনার পছন্দ দারুণ কিন্তু আপনাকে আমার পছন্দ নয়।” সহ্য করতে পারিনি এতো অপমান।আমি শুধু কাঙালের মতো একটু ভালোবাসা খুঁজেছিলাম। কিন্তু সবাই ফিরিয়ে দিয়েছে আমাকে। আমার ভাঙা মনে আঘাতের পর পুনরায় আঘাত করে চূর্ণ বিচূর্ণ করে দিয়েছে ওরা। আমি এতোটাই অযাচিত, এতোটাই অচ্ছুৎ। “
“কিন্তু তারপর তো থেমে গেলি, তাই না?’ সরু চোখে তাকান ডক্টর ফেরদৌস ।
মাথা নীচু করে হৃদয়, ‘থেমে যাই আমি। কিন্তু আমার দুঃস্বপ্নের শুরু ওখানেই।’
‘তোর খুন করা চরিত্রগুলোকে দেখতে পাস তুই স্বপ্নে। তারা তোর পদ্ধতিতেই তোকে হত্যা করে। এই সময় ঘুম ভাঙ্গে তোর। তাই না?’ কোমল গলাতে জানতে চায় ডাক্তার ফেরদৌস ।
‘এক্স্যক্টলি!’ আবার টেবিলে ঘুষি মারে হৃদয়, ‘প্রতি রাতে আমি এই দুঃস্বপ্ন দেখি দাদা। ডু সামথিং! আমি এর থেকে মুক্তি চাই।’
সামনের চায়ের কাপে একটা হাল্কা চুমুক দেন ডক্টর। তারপর মাথা তোলেন, ‘আমার ব্যাখ্যা শুনতে চাস?’
দ্রুত মাথা নাড়ে হৃদয়।
“তোর অবচেতন মন ধ্বংসাত্মক প্রকৃতির। ভালোবাসার মানুষের থেকে প্রত্যাখ্যাত হলে তাকে ধ্বংস করে ফেলার প্রবণতা আছে ওটার। অভ্রকে ভিষণ ভালোবাসতি তুই। কাজেই ও প্রত্যাখ্যান করার পর হামলা চালালি ওর ওপর। একটা খুন করে ফেলার পর প্রতিশোধপরায়ন তুই সহজেই প্রতিশোধ নিলি সুমনের ওপর। পারভেজ তোর কাছের বন্ধু ছিলো। ও দূরে সরে যাওয়ার পর ওকেও মেরে ফেললি। ভালোবাসতি মিশনকে।প্রত্যাখ্যাত হয়ে সরিয়ে দিলেন তাকেও। রুহিত তোকে অপশন হিসেবে রেখেছিলো। সেটা সহ্য করতে না পেরে তাকেও মেরে ফেললি– তন্ময়,তানজিল – যাদেরকে তুই পছন্দ করতি অত্যাধিক – নিজেই বলেছিস – এভাবে প্রতিটা খুন করেছিস যাদের থেকে প্রত্যাখ্যাত হয়েছিস। একই কারণে পারও পেয়েছিস। এরা প্রত্যেকেই তোকে সহজে বিশ্বাস করেছিল।’
ফেরদৌসের দিকে তাকিয়ে থাকে হৃদয়, লোকটা ভুল কিছু বলেনি।
‘কাজেই -’ বলে চললো ফেরদৌস , ‘তোর অবচেতন মন নিজেকে শাস্তি দেওয়ার একটা উপায় বের করল। নিজেও হয়ত জানিস না – কিন্তু তুই অনুতপ্ত। ভীষণ অনুতপ্ত প্রতিটি মার্ডারের জন্য। নিজেকে শাস্তি দিতে শুরু করলি একটা একটা দুঃস্বপ্নের মাধ্যমে। তোর অবচেতন মন চাইছিল যাদের খুন করেছিস তারা ফিরে এসে প্রতিশোধ নিক তোর ওপর। তুই দায়মুক্তি চাচ্ছিস মার্ডারগুলো থেকে। কিন্তু পারছিলি না। কাজেই স্বপ্নে ফিরে আসে ওরা। তোকে তোর মেথডেই খুন করতে থাকে।’
‘এ থেকে মুক্তির কি কোন উপায় নেই?’ হৃদয়ের গলাটা এবার ভেঙ্গে আসে।
‘অতীতকে চাপা দিতে হবে। অতীতের যন্ত্রণা সহ্য করতে হবে ততদিন – যতদিন না তুই নিজেকে সেখান থেকে বের করে বর্তমান জীবনে ফিরে আসতে পারিস।’
‘অতীতকে চাপা দেব কিভাবে?’ বিস্ফোরিত চোখে জানতে চায় হৃদয়।
‘সমাধানটা সহজ।’ মৃদু হাসলেন ডাক্তার ফেরদৌস , ‘একটা রিলেশনে যা। প্রদীপকে তিনমাস ধরে ঝুলিয়ে রেখেছিস বললি না? ওর সাথেই রিলেশনে যা। আর রিলেশনে গেলে সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে। অনেক রোগীর ক্ষেত্রে এটা পরিক্ষিত। ’
ভয়ার্ত চোখে এখনও চেয়ে আছে হৃদয় – খেয়াল করে ডক্টর একটা প্রশ্নবোধকদৃষ্টি দিলেন।
‘কারো কাছ থেকে প্রত্যাখ্যাত হলে তাকে সরিয়ে দেই আমি। প্রদীপ কি নিরাপদ?’ বিড় বিড় করে জানতে চায় ও।
‘আরে পাগল যেহেতু তুই ওর প্রপোজ এক্সেপ্ট করবি সেহেতু তোর রিজেক্ট হওয়ার চান্স নাই। আর তাছাড়া তুই যাদের ভালোবাসলি তাদের থেকে তো প্রত্যাখ্যান ছাড়া কিছুই পেলি না। তোকে যা ভালোবাসে তার সাথেই রিলেশনে গিয়ে সুখে থাকবি দেখিস।’
হৃদয়ের চোখের দিকে চোখ পড়তে চমকে ওঠে ডাক্তার ফেরদৌস ।
ধিকিধিকি জ্বলছে চোখের তারা দুটো।
যুগপৎ ঘৃণা আর জীঘাংসা সেখানে।
৫.
সারাদিন পাগলের মতো এখানে সেখানে ঘুড়ে বেরিয়েছে হৃদয়। প্রদীপের প্রপোজ এক্সেপ্ট করবে এই সিদ্ধান্ত নিয়ে শাহবাগ থেকে একগুচ্ছ গোলাপ কিনে নিলো ওর জন্য। এখনো বার বার ভেবে দেখছে ডাক্তার ফেরদৌসের প্রতিটি কথা।রিলেশনে যাওয়ার উপদেশ দিয়েছে সে।আবার এটাও সত্য – প্রত্যাখ্যাত হলে তাকে সরিয়ে দেওয়ার প্রবনতা আছে ওর। প্রদীপ যদি এখন রুহিতের মতো আচরণ করে বসে তাহলে!
উভয় সংকটে পরে গিয়েছে হৃদয়। খোলা বাতাসে ঘোরাঘুরি করে মাথা ঠান্ডা করার চেষ্টা করেও কোনো লাভ হচ্ছে না তাই। পাশের একটা শপিংমলে ঢোকে ও। দশ ইঞ্চি লম্বা একটা সবজি কাটার ছুরি কিনে নেয় সাথে। এবার ওর স্নায়ু গুলো ঠান্ডা হয়ে গিয়েছে। ঠান্ডা মাথায় সব ভাবতে পারছে।
সন্ধ্যায় প্রদীপকে বাসায় আসতে বলেছে। তাই তাড়াতাড়ি বাসায় ফেরা দরকার। ওকে এখন প্রদীপের কাছে যেতে হবে। সাবধানে ছুরিটা একবার স্পর্শ করে নিলো হৃদয়।
৬.
বাথরুমে গিয়ে ফ্রেশ হচ্ছে প্রদীপ। আয়নাতে নিজের প্রতিবিম্ব দেখে হালকা হাসলো ও। বাথরুম থেকে বের হয়ে টেবিলে রাখা গোলাপ গুচ্ছের দিকে তাকিয়ে আনমনে হাসলো প্রদীপ। কিছুক্ষণ আগে হৃদয় ওর প্রপোজ এক্সেপ্ট করেছে। হৃদয়কে ভালোবাসে ও,সত্যিকারের ভালোবাসা।
তারপর ঘর থেকে বের হয়ে এগিয়ে যায় মেইন গেটের দিকে। কী মনে করে আবার আগের ঘরে ফিরে এলো। লাইট জ্বালিয়ে চলে যাওয়া টা ঠিক হবে না।
লাইট নেভানোর আগে একবার তাকিয়ে দেখল মেঝেতে পড়ে থাকা হৃদয়কে।
পেট চিরে দুইভাগ হয়ে গেছে ছেলেটার।
প্রদীপের শরীরে শিহরণ দিয়ে ওঠে – একটু আগেই মাংসের ভেতর দিয়ে ছুরি চালানোর অভিজ্ঞতাটা হাতের মাঝে পেয়েছে ও – আরও একবার।
হৃদয় ওর হাতে ফুল গুলো দিয়ে ওর প্রপোজ এক্সেপ্ট করার পর কি হয়েছিল প্রদীপ নিজেও জানে না। শুধু জানে ওই মুহূর্তে ওকে ছুরিটা হৃদয়ের পেটে ঢুকিয়ে দিতে ইচ্ছে হচ্ছিলো। আর কোন কিছু ওর মাথায় কাজ করেনি। সেখানে শুধু ছিল ভালোবাসা!
বাসাটা হৃদয়ের ছিল। ফিংগারপ্রিন্ট সব সরিয়ে এসেছে ও নিজের।
কেউ ওর দিকে আঙুল তুলতে পারবে না। ওদের ভেতরের ব্যাপারটা ছিল সিক্রেট।
লাইট নিভিয়ে মেইন গেট বন্ধ করে দেয় প্রদীপ।‘দ্বাদশ!’ বেড়িয়ে যেতে যেতে বিড় বিড় করে বললো প্রদীপ, ‘ দ্বাদশবারের মত রিলেশনে গেলাম আমি।’