
লিখেছেন শৈলবালা দেবী
১.
তীর্থঘাটের সন্ধ্যেটা ভীষণ নির্জন। কোলাহল ফুরিয়ে যায়। ফুরফুরে হাওয়া আর দুধচা’য়ের ঘ্রাণ। বাঁশবনের ভেতরের গ্রামের মসজিদে মাগরিবের আযান হয়। পুবের আসমানে আষাঢ়ে গোল চাঁদ। পাড়ের দোকানগুলোয় ইলেকট্রিক বাতি জ্বলে ওঠে। নদীপাড়ের পাথরভাঙ্গা মেশিন বন্ধ হয়ে যায় ততক্ষণে। মজুরেরা কাজ শেষ করে নদীতে স্নান করে। পেশিবহুল বাহু, পেটানো দেহের ওপর গজানো বুকপশম বেয়ে নদীর জল টপ টপ করে ঝরে। মহিলা মজুরেরা কয়েকজন বাড়িতে চলে যায়। কয়েকজন নদীতে স্নান করতে নামে পুরুষদের সাথে। নদীজলে শরীর ডুবিয়ে দিলে ভেজা শাড়ি শরীরে লেপ্টে যাওয়ার মতোন লম্বা চুল খোলা পিঠে লেপ্টে যায়। পুরুষ মজুরদের সাথে কথা বলতে বলতে নারীর ব্লাউজহীন বুকের কাঁপন, পেটের ভাঁজ ভেজা শাড়ি ছাপিয়ে খিলখিল করে ওঠে। কেউ হাসতে হাসতে নদীজলে গড়িয়ে পড়ে। কেঁপে ওঠা বুক, মেঘের মতোন এলোকেশি চুলের মেয়েটা ডুবসাতার দেয়। পুরুষটিও নদীজলে ডুবসাতার দিয়ে তাকে ধরতে চেষ্টা করে। দিনের আলোটা ম্লান হয়ে যায় ধীরে ধীরে। রাতের অন্ধকার নেমে আসে খেয়াঘাটে। অন্ধকারেও তাদের খিলখিল হাসির শব্দ শোনা যায়। পুরুষটি বোধহয় ডুবসাতারে এলোকেশীকে ধরে ফেলেছে। তখন আদিম অন্ধকারে ডুবে গেছে চারপাশ।
কাঁধে কারোর শক্ত হাত রাখে। চমকে ওঠি। পিছন ফিরে ফজু ভাইকে দেখি। অন্ধকার ছাপিয়ে মুখে একটা চওড়া হাসি ফুটে।
টিপু, আয়। চা খাবি। ফজু ভাইয়ের জন্যই অপেক্ষা করছিলাম এতক্ষণ। আমি ফজু ভাইয়ের পেছন পেছন পাড়ের দোকানগুলোয় ওঠে আসি। * এবারের গ্রীষ্মের ছুটিতে নানাবাড়িতে বেড়াতে এসে প্রায় বিকেলই তীর্থঘাটের চায়ের দোকানগুলোয় এসে সময় কাটাই। কয়েকদিনের যাওয়ায় দোকানের ছেলেটা আমায় চিনে নেয়। চা-ষ্টলের কোণায় বসলেই গো-দুধের মালাই দিয়ে চা বানিয়ে দিয়ে যায়। স্কেচবুকটা সাথে করে নিয়ে যাই। শখের বসে আঁকায় দক্ষতা বাড়াতে হাবিজাবি আঁকি। চা-পানের সাথে স্কেচের খাতায় চায়ের কেতলী, কাপ-প্লেট, তীর্থ নদী আঁকি। নাহয় কানে ইয়ারফোন গুঁজে গান শুনতে শুনতে পাথরভাঙ্গা মেশিনের পরিশ্রমী উদোম দেহ পর্যবেক্ষণ করি। একটা মজুরকে বেশ লাগে। মাথায় ঝাকড়া চুল। গালভর্তি শেভ না করা খোঁচা দাড়ি। আবলুস কাঠের মতোন পেটানো দেহ। পাথরের টুকরি মাথায় নেয়ার সময় যেন মাংস ফেটে পরতে চায় শরীর থেকে। ঘামে জবজবে হয়ে থাকা দেহ চিকচিক করে ওঠে রূপোর মতোন। চওড়া শক্ত বুকজমিনে কাঁশবনের মতোন পশম। মানুষটাকে আঁকতে ইচ্ছে করে। চা-দোকানে বসে এক দৃষ্টে তারদিকে তাকিয়ে থেকে ধীরস্থিরভাবে আঁকি। তার সুচালো চাহনী, পাথর গড়ে বানানো ভাস্কর্যের মতোন শক্ত দেহ, পুরু ঠোট, বুকের কাঁশবন। আঁকার চেয়ে পর্যবেক্ষণ হয় বেশি। একদিন চা-দোকানে বসে একমনে আঁকছিলাম। পিচ্চি বেয়ারাটা চা দিয়ে গেছে খেয়ালই করিনি। ধূমায়িত দুধ-চা’য়ের গন্ধ ছাপিয়ে হঠাৎ পুরুষালি ঘামগন্ধ নাকের ডগায় ধাক্কা দেয়। আঁকতে আঁকতে ভাবলাম, হয়তো আমার মতোনই কোন ক্রেতা বসেছে সামনে। আঁকাটা শেষ করে চা-য়ে চুমুক দিয়ে ভুল করলাম। চা কোমল পানীয় ন্যায় ঠান্ডা হয়ে আছে। সামনে তাকিয়ে ভ্যাবাচেকা খাই। পেটানো দেহের পুরুষটি সামনে বসা। লোকটা মিষ্টি হাসি দিয়ে বলেন, আপনিতো বাক্কা সুন্দর আঁকইন।
হতভম্ব ভাবটা কাটিয়ে ওঠার জন্য বেয়ারাকে আরেক কাপ চা দিতে বলি। নিজেকে সামলে আমিও একটা হাসি ফেরত দিয়ে বললাম,
আমার আঁকার চেয়ে আপনার দেহগড়ন আরো ভীষণ সুন্দর। বেয়ারা চা নিয়ে আসায় কথা চাপা পড়ে। সামনে থাকা মানুষটাকে জিজ্ঞেস করলাম, চা খাবেন? মাথা ডান-বাম নাড়িয়ে বললেন, আরেকদিন খামুনে। আইজ যাই। বাড়িতে বাজার নিতে অইবো। আফনার আঁকন দেখতে গিয়া দেরী হইয়া গেছে। আরেকদিন কথা অইবোনে।
উনি সাইকেলে করে চলে গেলেন। শরীরের গন্ধটা এখনো রয়ে যায়। চা’য়ে চুমুক দিয়ে চোখ বন্ধ করে গন্ধ নিই। সেদিন থেকেই লোকটার সাথে কথা শুরু হয়েছিলো। তারপরের বিকেলে আবার দেখা। কথায় কথায় পরস্পরের পরিচয় হয়। ফজলু মিয়া। দক্ষিণপাড়ায় বাড়ি। বৌ আর এক ছেলে নিয়ে বছর দেড়েকের সংসার। পাথরভাঙ্গা মেশিনে মজুরী দিয়ে সংসারযাপন। এভাবেই পরিচয়। তারপর প্রত্যেক বিকেলে নিয়ম করে তীর্থঘাটে বসে থাকাটা আমার অভ্যেস হয়ে গেলো। ফজু ভাইয়ের মুখটা ঠিক নেশার মতোন। বিকেলে তীর্থে গিয়ে বসে থাকি উনাকে দেখতে। ভুজুংভাজুং আঁকায়াঁকি করে আসর নামার অপেক্ষায় থাকি। কাজ ফুরোলেই ফজু ভাই আমার সাথে বসে চা খান। আমি উনাকে দেখতে দেখতে আঁকি। উনার সিগারেট খাওয়া পুড়া ঠোট, ঠোটের উপর নেমে আসা অগুছালো গোফ আর চেরাই চাহনী। যেদিন ফজু ভাইয়ের সময় থাকে, সেদিন তীর্থজলে সন্ধ্যা নামে, চাঁদ ওঠে। দু তিনেক কাপ চা বেশি খাওয়া হয়। ঝালমুড়িওয়ালার নাগামরিচ আর সরিষা মাখানো মুড়ি খেতে খেতে গপ্পো হয় হরেক রকমের। উনার মধ্যে মিশুক ভাব আছে। অল্পতেই সখ্যতা বেড়ে ওঠে। সম্পর্ক্য নেমে আসে তুই-তুমি তে। সন্ধ্যে মিলিয়ে গেলেও আলাপ ফুরোয়না। তারপরও মাঝেমাঝে দুজনে চুপ হয়ে যাই। উনি সাইকেল করে চলে যান বাড়িতে।
*
বোশেখের গরমে আম পাকা শুরু হয়। জষ্ঠীতে কাঠালের গন্ধে বাড়ির উঠোন ভরে যায়। গন্ধরাজে কলি আসে। রাত বাড়লেই গন্ধরাজের ঘ্রাণে আমার বারান্দা ঘর ভরে আসে। বর্ষার প্রারম্ভিক বৃষ্টি আসে। নদীতে জল নামে। বাড়ির পেছনে বোশেখের ধানক্ষেত পানিতে ডুবে যায়। সেদিন তীর্থঘাটে গিয়ে ফজু ভাইয়ের দেখা পেলাম না। সারাবিকেল ঠায় বসে রইলাম চা-দোকানে। পাথরভাঙ্গা মেশিনে ফজু ভাই নেই। বেয়ারা ছেলেটা বার-বার বলছিলো, ভাই চা দিমু? আমি ডানেবামে মাথা নাড়ি। আঁকায় মন বসেনা। মুড়িওয়ালার দোকানে জিজ্ঞেস করে, আপনি আজকে একলা ক্যান? মনটা কেমন অস্থির লাগে। আজকে ফজু ভাই আসলোনা ক্যান? নাকী আমার সাথে দেখা না করার জন্য আসলোনা। কোন সমস্যা হয়েছে? অযাচিত ভাবনা মাথায় আসে। বোশেখের আসমানে কালো মেঘদলের মতোন ভেতরে মন খারাপ নামে। একটা চিনচিনে ব্যথা শরীরে ছড়ায়। একটু ব্যাকুলতা, একটু আক্ষেপ কাজ করে। গোস্বা লাগে ফজু ভাইয়ের প্রতি। মন খারাপ নিয়ে বাড়ি ফেরা হয়। মনে মনে ভাবি, পরেরদিন থেকে ফজু ভাইয়ের সাথে কথাই বলবোনা। ফজু ভাই’র প্রতি একটা অনুভূতি হচ্ছে! প্রেমিকার প্রতি অধিকারবোধের অনুভূতির মতোন। উনার বৌ’য়ের কথা ভেবে অপরাধবোধ লাগে। এরপর কদিন যাওয়া হয়না। ইচ্ছে করেই যাইনি। পশ্চিমাকাশ কালো হয়ে আষাঢ় নামে। বৃষ্টিজলে দাপাদাপি করে স্নান সের ক্লান্ত দেহ নিয়ে ঘুম দিই। রাত্রিরে বড়মামী-র ডাকে ঘুম ভাঙ্গে। প্রচন্ড অবসাদ আর জ্বরে শরীর ভেঙ্গে আসে। টানা কদিন জ্বরে শরীর পুড়ে। সেদিন রাত্রির খাবার সেরে উত্তাপ শরীর কম্বল মুড়িয়ে বসে আছি জানালা খুলে। আকাশ খারাপ করলে বর্ষায় ইলেকট্রিসিটি থাকেনা। আকাশে আষাঢ়ে কোণাভাঙ্গা চাঁদ। কখনো কালো মেঘে ঢেকে অন্ধকার নামে, কখনো মেঘের বাহিরে এসে ম্লান জোছনা ছড়িয়ে যায়। জানালা দিয়ে তাকালেই গন্ধরাজ গাছটা চোখে পড়ে, এরপর তীর্থনদীতে ফেঁপে ওঠা রূপোলি জল। গন্ধরাজের কলিগুলোয় পঁচে যাওয়া ফুলের বোটা। আধেক ফুল পঁচে ঝরে গেছে বৃষ্টিজলে। জোয়ার এলে নদীপাড়ে আছড়ে পড়া ঢেউয়ের শব্দ ঘর থেকে শোনা যায়। হঠাৎ একটা মানুষমাথা বাইরে থেকে গরাদহীন জানালা গলিয়ে ঘরে ঢোকায়। আমি হকচকিয়ে মোবাইলের ফ্ল্যাশটা জ্বালিয়ে দেখি ফজু ভাই। টানা কদিন জ্বরের ঘোরে ফজুর ভাইয়ের কথা একরকম ভুলেই গিয়েছিলাম।
ফজু ভাই! আপনি এতো রাতে? উনি ফিসফিসিয়ে বাইরে বের হয়ে আসতে বললেন। জানালা বন্ধ করে দরজা খুলে বাইরে বের হই। ফজু ভাই মাছ ধরার গাইঁতি নিয়ে গন্ধরাজতলায় দাঁড়িয়ে আছেন। পরনে লুঙ্গিটা কাছা মেরে উপরে গামছা দিয়ে টাইট বাঁধুনী। উনি বললেন, তোদের গন্ধরাজের গেরাণ আছে। ফুল পইচা গেছে কিন্তক গেরাণ লাগে এখনো।
আমার হতভম্ব ভাব এখনো কাটেনি।
আয় যাই। জিজ্ঞেস করলাম, কই যামু? মাছ ধরতে।
ভাবছিলাম উনার সাথে অনেকদিনের দেখা না হওয়ায় রাগ দেখাবে। উনি সামনে আসতেই ভেতরের অপরাধবোধ যেন গলে ওঠছে। শুধু বললাম,
যাবোনা। ফজু ভাই আমার হাত ধরে হ্যাচকা টানে নদীপাড়ে ওঠে। তোর শইল্যে জ্বর ওঠসে?
আমি হু বলেই চুপ করে রইলাম।
তাইলে থাক। তোর জ্বর নিয়া যাওনের দরকার নাই। আমি এইবার গো ধরে বসলাম। আমি যাবো। অগত্যা সাইকেলে প্যাডেল দিলেন। আমি সাইকেলের পিছনের ক্যারিয়ারে বসে উনার কোমর ধরে আছি। বাঁশবনের ভেতরে চলে যাওয়া রাস্তায় জ্যোৎস্না ম্লান হয়ে যায়। বাঁশের চিরল পাতা গলে জোছনা মাটিতে নামার আগে বাঁশপাতাতে আটকে যায়। ফুটিফুটি জ্যোৎস্নাকণা মাটিতে পড়ে থাকে। জোছনায় আঁধো আঁধারে মাটিপথে সাইকেল ঝাকি খায়। আমি ফজু ভাইয়ের কোমর আরো জোরে খামচে ধরি। উনি টর্চ লাইট জ্বালিয়ে দেন। উনি বললেন, ভয় পাচ্ছিস?
না। তুমি সাইকেলের টর্চ লাইট অফ করে দাও। টর্চলাইট অফ করে দিতেই আমাদের আবার জোছনা-আঁধার ঝেকে ধরে। ছোটকাল থেকে বেড়ে ওঠা পথে অন্ধকারেও সাইকেল চালাতে ভুল করেনা ফজুভাই। বাঁশবনের পথ পেরিয়ে সাইকেল হাওড়পথে নামে। হাওড়ের ওপাশে গঞ্জ। হাওড়ের বুক চিড়ে সরলরেখা পথ গঞ্জে যাওয়ার জন্য। রাস্তার দুপাশে কানায় কানায় ম্লানরূপোলি আষাঢ়ে জল। মেঘভরা আকাশের নীচে কেবল নিস্তব্ধতা। নিস্তব্ধতার বুক চিড়েছে সাইকেলের ক্যাচক্যাচ শব্দ তুলে চলা আওয়াজ। আষাঢ়ের জলের গন্ধ ছাপিয়ে ফজু ভাইয়ের শরীরের আদিম বুনো গন্ধ নাকে ধাক্কা দেয়। চেতনাহীন অষুদের মতোন আমার শরীর অবশ করে দেয় সেই গন্ধ। আমি চোখ বন্ধ করে দিই। কোমর থেকে হাত খসে পড়ে উনার পুরুষালী লোমশ উরুতে। আমার ভেতরের একটা আদিম সত্তা তখন টগবগিয়ে ছুটে। আমার শরীর গলিয়ে যেন বেরিয়ে আসতে চায় ভেতরটা। আঙুলগুলো ফজু ভাই’র উরুবেয়ে খাজের ভেতর ঢুকে যেতে চায়। আশপাশের আষাঢ়ে জল, কাদাজলের রাস্তা মিলিয়ে যায়। মিলিয়ে যায় মেঘভরা আসমান, কোণাভাঙ্গা চাঁদ আর ম্লান জোছনা। আমি যেন অসীম শূন্যের মধ্যে ছুটে বেড়াচ্ছি। নাক কান দিয়ে যেন আগুনের হলকা বের হয়। আমার শরীরের উত্তাপের পারদ ফজু ভাইকেও স্পর্শ করে। উনার সাইকেল থেমে যেতেই আমার ঘোর ভাঙ্গে। আমার ঘোরলাগা চোখে দেখে উনি কিছুটা ভয় পান। কপালে হাত দিয়ে বলেন, তোর জ্বর তো বাড়তাসে দেখি। আজকে আর মাছ মারতে হইবোনা। চল বাড়ি ফিইরা যাই।
আমার বাড়ি ফিইরা যাইতে ইচ্ছা করতাসেনা ফজু ভাই। আজকের রাতটা আমরা এই মাঝহাওড়ে কাটাইয়া দেই??? উনি কী মনে করে সাইকেলটা খানিক চালিয়ে স্ট্যান্ড করেন। আমাকে পাজকোলা করে নামিয়ে রাখেন বাঁশচাটের ডেরায়। বোশেখের জলে হাসের ঝাঁক নিয়ে হাসপালকেরা রাস্তার পাশে ডেরা বানিয়ে থাকে। আষাঢ়ে জলে ডেরা ছেড়ে চলে গেছে উজানের দিকে। রোদেবৃষ্টিতে বাঁশের চাটাই পঁচে গলে কেবল মাচাটাই রয়ে গেছে। গাইঁতি সাইকেলের পাশে রেখে উনিও পাশে বসেন। আমাদের সামনে তখন দারিদ্র্যিক সমুদ্দুর। রাত্রিরে খোলা আসমানের নীচে হাওড়কে সমুদ্দুরের মতোনই লাগে। আসমানের মেঘদল উড়ে চলে গেছে। কোণাভাঙ্গা চাঁদের ফিনিক জোছনায় হাওড় ভরে গেছে। হাওড়জলে সমুদ্দুরের মতোন উত্তাল ঢেউ নেই। নিশ্চুপ ঢেউ ছলাৎ করে পাড়ে আছড়ে পড়ে। দূরের অস্পষ্ট গ্রাম আর ধূ ধূ জোছনায়, হাওড়জলে মনে হয় স্বর্গপুরী। ফজু ভাই আরেকটু ঘেষে বসে থুতনীর নীচে হাত রাখেন। আমার শরীরের উত্তাপ যেন জোছনার সাথে পাল্লা দিয়ে বেড়েই চলছে। মাঝরাত্রিরে জ্বর শরীরে আমায় উনি বোধহয় কিছুটা বিব্রত। আমি উনার দিকে তাকিয়ে বললাম, বিপদে ফালাইয়া দিসি?
উনি হে হে করে হেসে ওঠেন। জ্বরের ঘোর আবার বাড়ছে বোধহয় শরীরে। মাথাটা ভার হয়ে আসতে চায়। মাথায় হাবিজাবি চিন্তা আসে। আমি উনার উরুতে মাথা রেখে হাটুভাজ করে শুয়ে পড়ে। উনার একটা হাত বুকের মাঝে জড়িয়ে ধরে হাওড়ের দিকে তাকিয়ে শুয়ে শুয়ে জোছনার গলে পড়া দেখি। উনার শক্ত হাতটাকে আমার অনেকদিনের আশ্রয় মনে হয়। এতোদিন যে আশ্রয়ের জন্য ছুটে বেড়িয়েছি, সেটা যেন আজ বুকের খাঁজে আঁকড়ে ধরেছি। আশ্রয় হারানোর ভয়ে শক্ত হাতটাকে আমার ভেতরের উত্তাপ দিয়ে সিদ্ধ করে নিজের শরীরের সাথে মিশিয়ে নিতে ইচ্ছে করছে।
উনি আমার চুলের খাঁজে আঙ্গুল বুলিয়ে দিন। আরামে চোখে বুজে আসে। জোছনার চেয়েও ওই শক্ত আঙুলের পরশ যেন আরো বেশি নরম। এতো ভালোবেসে কেউ কোনদিন আমার মাথায় হাত বুলোয়নি ভেবে ভেতরে দলা পাকিয়ে ওঠে। আমার ভেতরটা উলটপালট হয়ে যায়। আমি উনার জড়িয়ে ধরা হাতটা ঠোটের কাছে লাগিয়ে বলি,
ফজু ভাই আপনি জানেন? কিছু কিছু মানুষ আছে যারা খানিক মায়াতেই গলে যায়। সামান্য ভালোবাসা পেলেই তারা নিজেকে উজাড় করে অপর মানুষটাকে ভালোবেসে ফেলে। হ জানি । তুই এট্টু চুপ থাক। তোর কি খারাপ লাগতেসে? জলপট্টি দিই?
না ফজু ভাই। লাগবেনা। আপনি মাথায় হাত বুলাইয়া দেন। ভালো লাগতাসে। ফজু ভাই নিরবে হাত বুলিয়ে দেন চুলে। আমার ভেতরটা যেন ফাঁক হয়ে যাচ্ছে এট্টু ভালোবাসা পাওয়ায়। আমার মুখ যেন নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে গেছে। অযাচিত ভেতরের কথাগুলো বের হয়ে আসতে চাইছে। কষ্টে সামলে রাখতে চাচ্ছি। চোখ বেয়ে টপ করে জল নামে উনার হাতে। উনি খানিকটা নুয়ে আমার কপালে চুমু খেলেন। আমার যেন বাঁধ ভেঙ্গে একটা চুমোয়। আমি আমার ভালোবাসাহীন জীবনের যন্ত্রণায় গ্রামের অশিক্ষিত এক মজুর যুবকের ভালোবাসা পেয়ে ডুকরে কেঁদে ওঠি। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে বলে দিই কাটাতার দিয়ে বেঁধে রাখা অনূভুতি। ফজু ভাই। আপনি জানেন, আমি আপনারে খুব ভালোবেসে ফেলসি।
গাধা। তুই খুব ভালো। আমারে কত তাড়াতাড়ি আপন করে নিছস। এইজন্যইতো তোরেও আমি ভালোবেসে ফেলসি। এই ভালোবাসাটা ঠিক তেমন না ফজু ভাই। আপনারে এই কদিন না দেখায় ভেতরের টান প্রেমিকার মতোন। আপনার বউ যেমন আপনারে ভালোবাসে, ঠিক তেমন করেই ভালোবাসি।
উনি কথা বললেননা। জ্বরের ঘোর যেন আমার বেড়েই চলেছে। ফজু ভাইয়ের পুরু ঠোট দুটো চুম্বকের মতোন আকর্ষণ করছে। আমার শরীরের উত্তাপ সারিয়ে দেবে যেন ওই ঠোট। আমি খানিকটা নিজেকে এগিয়ে দিই উনার ঠোটের দিকে। উনি নিজের মুখটাকে অন্যদিকে ফিরিয়ে দেয়।
_দ্যাখ টিপু। তুই আমারে খুব বেশি ভালোবাসস। আমি বুঝতে পারতেসি। কিন্ত আমিতো তোর এতো ভালোবাসার যোগ্য না রে। তুই অপাত্রে ভালোবাসা দিতেছস। আর তুই আমায় যতোই ভালোবাসস, আমার বউয়ের মতোন হতে পারবিনা। তুই ছেলে। ছেলে হয়ে ছেলের বউ ক্যামনে হবি?
আমার সামনে দুনিয়াটা থমকে যায়। ঠোট দুটো অসাড় হয়ে আসে। যেন সম্বিত ফিরে পাই। আসলেইতো,
ছেলে হয়ে অন্য ছেলের বউ কীভাবে হবো? আবার ভালোবাসা না চিনে ভুল মানুষকে প্রস্তাব দেওয়ায় নিজের অপরাধবোধ ভেতরটাকে ছিড়েখুঁড়ে খেয়ে নেয়। আমার চোখের সামনে স্বর্গপুরী ধ্বসে পড়ে। হাওড়জল, জোছনা খটখটে হয়ে ওঠে। নিজেকে অন্যগাছের উপর বেয়ে ওঠা পরগাছার মতোন মনে হয়। অন্য দুজনের সম্পর্ক্যে ঢুকে যাওয়া পরমানুষ। যেমন পরমানুষ ছিলাম রাসু ভাই, জাশেদ ভাইকে ভালোবেসে।
মাঝেমাঝে নিজেকে মনে হয়, নারী-পুরুষের সম্পর্ক্যে পরগাছার মতোন পরমানুষ হয়ে ভালোবাসা নেয়ার চেষ্টা করি।
সমাপ্ত