মহামারীর কালে জেন্ডার বৈষম্য

লেখক : অনির্বাণ

আমার মা একজন দর্জী। খুব ছোট সেলাই কাপড়ের একজন উদ্যোক্তাও বলা যায়। মায়ের কাছে গ্রামের কয়েকজন মেয়েও কাজ শিখতে আসে, সেই সাথে আম্মুর কাছে অনেক অর্ডার আসে তিনি সেই কাজগুলো করেন এবং ঐ সকল মেয়েদেরকে দিয়েও কাজ করান। সেই টাকা দিয়ে মা নিজের খরচ নিজেই চালাতে পারে, আমাদের ভাই বোনদের টুকিটাকি খরচও চালান। তার বৃদ্ধ বাবাকেও কিছু দিতে পারে, আবার কিছু সঞ্চয়ও করতে পারে। বলা যায় একজন স্বাবলম্বি গৃহিণী। ইদ কিংবা যে কোন উৎসবের আগে আগে মায়েদের ঐ ছোট্ট দলের কাজের পরিমাণ কয়েক গুণ বেড়ে যেত। ঐ সময়টাতে বেশ ব্যস্ত সময় পাড় করত৷  কিন্ত এবারের ইদের আগের চিত্রটা একেবারেই ভিন্ন। কারণ এবার বৈশ্বিক মহামাহরি কোভিড-১৯ এর কবলে পুরো বিশ্ব। 

“সারা পৃথিবী জুড়েই মহামারী বিস্তার করছে। বাদ যায়নি মফস্বল এবং গ্রামও। বৈশ্বিক মহামারী কেবল মাত্র স্বাস্থ্যগত কোন বিষয় নয়। সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিকও।”

বাংলাদেশেও চাকরী হারানোর আশংকায় আছে নারীরাই বেশি। তৈরী পোশাক খাতে বা গার্মেন্টস কোম্পানি গুলোতে বেশ কয়েক বছর ধরেই নারী শ্রমিক কমতে শুরু করেছে। ২০১৯ সালের এক জরিপ অনুযায়ী এখন পুরুষের তুলনায় নারীদের অংশগ্রহণ  ৪৬.১৮ শতাংশ নেমে এসেছে। বিগত চার বছরে সেটা ১০.৬৮ শতাংশ কমেছে অথচ ২০১২ এর হার ছিলো ৫৮.৪ শতাংশ।  দেখা যাচ্ছে গার্মেন্টস খাতে নারীরা দিন দিন কাজ হারাচ্ছে এবং সেই জায়গাটা পুরুষ শ্রমিকেরা দখল করে নিচ্ছে। এর কারণ হিসেবে বলা হচ্ছে পুরুষের তুলনায় নারীর দক্ষতার ঘাটতি। এই ক্ষেত্রেও নারীকে আধুনিক প্রযুক্তির সাথে দক্ষ করে তুলবার কোন উদ্যোগ দেখা যায় না। কয়েকদিন আগেই ব্যাবসায়িদের সংগঠন বিজিএমইএ থেকে ঘোষণা আসছে, তারা এই মহামারীর সময়ে শ্রমিক ছাঁটাই করবে এছাড়া নাকি তাদের কোন পথ খোলা নেই৷ অথচ সরকারের সবচাইতে বড় প্রণোদনার অংশটা গার্মেন্টস মালিকেরাই নিয়েছে। তাহলে এ থেকে খুব সহজেই অনুমান করা যায়, এখানে নারী শ্রমিকেরাই বেশি ছাঁটাই হবে। আর মহামারী কতটা নারীকে অর্থনৈতিক ভাবে কোনঠাসা করে দিচ্ছে সেটা পরিষ্কার। শুধু পোশাক খাতেই নয়, অন্যসকল সেক্টরেই নারীরা এই বৈষম্যের শিকার হচ্ছে। ছোট উদ্যোক্তাদের জন্য সরকারী কোন প্রণোদনা নেই, গ্রামীণ নারীরা যে ঋণ নিয়ে ব্যবসা শুরু করেছে সেটাও প্রায় বন্ধ হওয়ার পথে কিন্তু ঋণ মওকুফ হচ্ছে না। 

 সবচাইতে খারাপ অবস্থা ভাসমান যৌনকর্মী, হিজড়াদের।  এই সময়ে তাদের ইনকাম সোর্স পুরোপুরি বন্ধ। হিজড়ারা কোথাও টাকা তুলতে পারছেনা। যৌনকর্মীদের এখন কোন কাজ নেই। সরকারী ত্রাণ এই অব্দি পৌঁছায় না, এদের নিয়ে ভাবেছেও না। 

ইতিহাসের সকল মহামারীতেই দেখা যায় নারীরাই সামাজিক ভাবে এর ভিকটিম। মহামারীর সময়ে যৌন সহিংসতা বৃদ্ধিপায়, পারিবারিক নির্যাতন, গর্ভধারণ রোধক পিলের সংকটের মতো বিষয়গুলি তীব্রভাবে দেখা যায়। কোভিড-১৯ এর ক্ষেত্রেও একই রকম, লকডাউনের পরপরই সারা বিশ্বে কনডমের ঘাটতি দেখা দেয়। এর ফলাফল শেষ পর্যন্ত নারীকেই ভুক্তভোগী করে। পারিবারিক নির্যাতন উন্নত অনুন্নত সকল দেশেই কয়েকগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে।  ফ্রান্সে ৩০%,  সিঙ্গাপুরে ৩৩%, আর্জেন্টিনাতে ২৫% বাংলাদেশে এই সংখ্যা ৪৯.২% ছাড়িয়েছে। বিশেষজ্ঞদের মতে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এবং আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের মধ্যকার ঝামেলা, নারী স্বাস্থ্য খাতেও প্রভাব ফেলতে পারে। আমেরিকা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাকে সম্পূর্ণ অর্থায়ন বন্ধ করার ফলে, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার কাজ বিঘ্নিত হবে। সারা বিশ্বে লক্ষ লক্ষ নারীস্বাস্থ্য, শিশুর টিকার কাজ পরিচালনা করে এই সংস্থাটি। অর্থের অভাবে এই খাতে কাজ চালানো সহজ হবেনা। ফলাফল আরো ভয়াবহ হবে।

১) https://www.unwomen.org/en/digital-library/publications/2020/04/policy-brief-the-impact-of-covid-19-on-women

২) https://www.undp.org/content/undp/en/home/news-centre/news/2020/COVID19_sparks_justice_for_women_new_report_calls_action.html

প্রথম প্রকাশঃ ঠাহর (প্রথম সংখ্যা)

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.