সাইবার অপরাধ ও লিঙ্গ ভিত্তিক সহিংসতা

লেখক : অশ্বিণী

ডিজিটাল প্রযুক্তি মুহূর্তের মধ্যে তরুণদের রাজনৈতিক মতাদর্শ, অভিব্যক্তি প্রকাশ করতে অভিনব উপায় হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। অনলাইনে তর্কবিতর্ক, ভালো লাগা, মন্দ লাগা, নিজস্ব প্রকাশ ভঙ্গি ইত্যাদি বিষয় নিয়ে দ্রুততার সাথে সোস্যাল মিডায়ায় নাগরিক অংশগ্রহণ অনেক সহজ  হয়ে উঠেছে৷ নতুন নতুন প্রযুক্তি যেমন সম্ভাবনার দ্বার খুলে দেয়, ঠিক তেমনি নতুন নতুন অপরাধেরও জন্ম দেয়। তেমনি হচ্ছে সাইবার ক্রাইম। ইন্টারনেট, কম্পিউটার, সোস্যাল মিডিয়া ইত্যাদি মাধ্যমের উপর নির্ভর করে সাইবার অপরাধ গুলো গড়ে ওঠে। ডিজিটাল স্পেসগুলো মতামত গঠনের স্থান, বিতর্ক এবং জড়োকরণের স্থান কে শক্তিশালী  করতে পারে, সে জন্য সকল নারী, কুইয়্যার এবং ভিন্ন ভিন্ন মতালম্বির মানুষের অংশগ্রহণ বেশি দেখা যায়। তবে প্রযুক্তির ডিজিটালাইজেশনের ফলে সাইবার হ্যারেসমেন্ট দিন দিন বেড়েই চলছে। আর এর প্রধান শিকার হয় নারীরা এবং কুইয়্যার মানুষেরা। সোস্যাল মিডিয়াতে বুলিং দেখা যায় সচরাচর, কোন মেয়ে ছবি শেয়ার করলে ওড়না নেই, বোরকা পরো না এসব কমেন্ট দেখতে পাওয়া যায়। এমন কি কোন সেলিব্রিটিও এই আক্রমণ থেকে রক্ষা পায় না। 

আমি দুইটা ঘটনার কথা স্মরণ করতে পারি,  আমার এক বন্ধু ছেলে হয়ে কেন বড় চুল রেখেছে সেটা নিয়ে কিছু লোকের মাথা ব্যাথার শেষ নেই। তার ছবি নিয়ে বিভিন্ন জায়গায় আপলোড করে ভীষণ বাজে বাজে মন্তব্য করতে থাকে। ওরা একটুও ভাবতে পারে না যে যার ছবি তার মানসিক অবস্থা কী হতে পারে। এগুলো করে যেন পৈশাচিক আনন্দ পায়। আরেকটা ঘটনাতে আমার আরেক বন্ধু ডেটিং এপসে ছবি বিনিময় করে। অপরজন যখন দেখা করতে চায়, আমার বন্ধুটি দেখা করতে না চাওয়ায়। তাকে “শালা চাকমা” বলে গালাগালি করে৷ তার কাছে চাকমা একটা গালি৷ বর্ণ বিদ্বেষ কোন মাত্রায় পৌঁছালে সেটা গালি হিসেবে ব্যবহৃত হয় ভাবতেই কষ্ট লাগে। এই ঘটনাগুলো অহরহ প্রতিদিন ঘটছে এবং এর খারাপ প্রভাবও সমাজে পরছে।  

নারীদের সাথে ঘটা সাইবার হ্যারেসমেন্টগুলোর কিছুটা পরিসংখ্যান থাকলে, কুইয়্যার মানুষদের সাথে ঘটা সাইবার অপরাধের কোন পরিসংখ্যান নেই। এমনি কি কুইয়্যার মানুষেরা আইনি সহায়তা একদমই পায়না। তবে নারীদের ক্ষেত্রেও যে সেটা খুব সহজ এমনটি নয়। একটি গবেষণায় দেখা গেছে, ৭৩ % নারী ইন্টারনেট ব্যাবহারকারী সাইবার ক্রাইমের রিপোর্ট করেছেন। ২০১৭ সাল পর্যন্ত সরকারের তথ্য ও সাইবার প্রযুক্তি বিভাগে,  সাইবার হেল্প ডেস্কে ১৭ হাজার এরও বেশি অভিযোগ এসেছে। অভিযোগ কারীর ৭০ শতাংশই নারী ভুক্তভুগী।২০২০ সালে এসে এই সংখ্যাটা বাড়াবে ছাড়া কমবে না।  অনলাইন সহিংসতার প্রায় ৯০ শতাংশ উদাহরণ ভুক্তভোগীদের দ্বারা প্রতিবেদন করা হয়না। অর্থাৎ যিনি ভিকটিম তিনি অনেক কারণে সরাসরি অভিযোগ দাখিল করে না। এর অনেক কারণ হতে পারে, সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গী, পরিবারের চাপ,  পুলিশি হয়রানি ইত্যাদি। এই কারণে তথ্য অধিকার আইনের অধীনে প্রাপ্ত তথ্য থেকে জানা গেছে সাইবার ক্রাইম ট্রাইব্যুনালে প্রাপ্ত ৫২০ টি মামলার মধ্যে ৩২৮ টি মামলা বাদ পড়ে। 

ব্লাক মেইল, বুলিং, ইনবক্সে পর্ণ পাঠানো এগুলো থেকে আরো বড় পর্যায়ে অপরাধগুলো ঘটতে থাকে। ফলে মানসিক চাপ, সামাজিক রক্ষণশীল দৃষ্টিভঙ্গী থেকে আত্মহত্যার মতো ঘটনাও ঘটে। সাইবার হ্যারেসমেন্টের ক্রমবর্ধমান সংখ্যা মোকাবিলায় বাংলাদেশ পুলিশ একটি সাইবার উইং চালু করেছে। সাইবার অপরাধের উপর নজরদারি ও অপরাধীদের সন্ধানের জন্য এটি কাজ করে। কিন্তু দুঃখের বিষয় হচ্ছে অনলাইনে লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতার জন্য, সুনির্দিষ্ট ভাবে এটি কাজ করে না। তাই সকলের উচিত ইন্টারনেট ব্যবহারের ক্ষেত্রে সচেতন হওয়া। সাইবার নিরাপত্তা এবং ডিজিটাল নিরাপত্তা ধাপগুলো মেনে চলা। 

প্রথম প্রকাশঃ ঠাহর (প্রথম সংখ্যা)

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.