তোমাদের নগরীতে

লিখেছেন রুদ্রনীল আসলান

আজ না তোকে খুব মনে পড়ছে। বাহিরে বৃষ্টি নেমেছে। উফ সে যে কী বর্ষা! বৈশাখী হাওয়া যেন পুরো ঢাকাকে উড়িয়ে নিতে চাচ্ছে। আমার মনটা না বুঝলি খুব খারাপ। মনে আছে, এমন দিনে তোকে আমি বস্তাপচা কবিতা লিখে পাঠাতাম। তুইও যে কী ভালো ছিলি! খালি বলতি খুব ভালো হয়েছে। আমিও আরো জোর উদ্দমে কবিতা লিখতাম। এরপর তুই চলে গেলি একদিন। না পরকালে নয়। ওখানে গেলে অন্তত খুঁজে পেতাম তোকে নক্ষত্রের মাঝে। তুই যে দুনিয়ার মাঝে হারিয়ে গেলি, এখানে কোন নক্ষত্রের দিকে তাকাবো?
সব তো ঠিকঠাকক চলছিল রে! কেন চলে গেলি? কী পাড়াপ্রতিবেশীদের ভয়ে? না না, এ আমি মানি না। তোর মত ছেলে বিবাহবন্ধনহীনতার ভয়ে পালাবে এমন তো আমি মানি না। জানিস, আজ পুরো ঢাকা বেয়ে চুয়েচুয়ে বর্ষার পানি ঝড়ছে। কী মজার না? আমার খুব ভালো লাগছে, বারান্দায় বসে বসে “বাদল দিনের প্রথম কদম ফুল” ছেড়ে হাতে চা নিয়ে তোর কাছে এই চিঠি লিখতে বসেছি। ভাবিস না এটাই তোর জন্যে লেখা প্রথম চিঠি। আরও অনেক লিখেছি। কিন্তু ব্যাপারটা কী জানিস? ওসব চিঠির কোনটাই যে তোর কাছে যায় না। যাবে কেমনে? প্রেরক যে তোর ঠিকানা জানে না! তাই ছাইগুলো বাতাসে মিশিয়ে দিই। পাঁচ বছরে কত যে ছাই উড়য়েছি! হ্যাঁ রে? ওখানে জীবনটা কী খুব ভালো? আমি জানি তুই আমেরিকায় চলে গেছিস। তোর কী মনে হয় পাঁচ বছরে তোকে ভুলে গেছি? কাহিনীটা বড়ই অদ্ভুত, সৌম্য!
মনে আছে আমাদের প্রথম দেখা? ভার্সিটির সেকেন্ড ইয়ারে তোর সাথে পরিচয়। কী সুন্দর ছিল তোর হাসি। আমার অবাক লাগত যে একজন পুরুষের হাসিতে কেমন করে পুরো মুখ ঝলমল করে? হিসাববিজ্ঞানের ক্লাস ছিল আমাদের। তখন সবে মাত্র পরিচয়। ওই হাই হ্যালো তেই বদ্ধ। তুই ছিলি ক্লাসের হার্টথ্রব! আর আমি ছিলাম বইয়ের মাঝে মুখগোঁজা ছেলে। চোখে ভারি চশমা, হাতে মোটামোটা বই, ইকনমিক্সের আতেলমার্কা জ্ঞানের মাঝে ডুবে থাকা ছিমছাম নিরালায় বসে থাকা শান্ত ছেলে। অন্যদিকে তুই হচ্ছিস টাইট জিন্স আর টিশার্ট পরা ছেলে। আড্ডার মাঝে গিটার হাতে কোরাসে গান গাওয়া চঞ্চল দুরন্ত ছেলে। ক্যাম্পাসে তোকে একদিনও ভদ্রভাবে হাঁটতে দেখি নাই। সারাক্ষণ যে দৌড়াদৌড়ি করতি, তোর ক্লান্ত লাগত না? আমি ভাবতেও পারিনি যে, এই ছেলেটার সাথে আমি আমার ঘর বাঁধব!
একদিন হিসাববিজ্ঞানের ক্লাসে প্রফেসর মইনুদ্দিন স্যার আমাকে বের করে দেয়। এমন কিছু আমার সাথে কখনো হয়নি, লজ্জায় মরে যেতে ইচ্ছে করছিল। গড়মসি করে ক্লাস থেকে যেই না বেরিয়েছি দেখি তুই পিছন থেকে এসে আমার কাঁধে হাত রাখলি। আমি তোর দিকে লজ্জায় তাকাতে পারছিলাম না। না, সেদিনের লজ্জা অপমান থেকে এসেছিল। তুই হেসে বললি,”আরে চিল! শোন এসব প্রায়ই হয়। চিন্তা করিস না।” আমাকে কেউ কখন তুইতুকারি করেনি। কেমন আজব লাগছিল তবুও তুই যে ক্লাস ফেলে আমার জন্য বের হয়ে এসেছিলি এতে আমার যে কী ভালো লেগেছিল, সৌম্য বলে বুঝাতে পারব না! তাই ফ্যাকাসে একটা হাসি দিলাম। তুই তখন বললি,”তোর নামটা জানা হলো না। আমি সৌম্য শিকদার।” বলে হাত বাড়িয়ে দিলি। আমিও হাত মিলিয়ে বললাম,”আমি আহসান রাজভী।” তুই হেসে বললি,”বাবা কী ভারি নাম।” সেবার আমার প্রথম মনে হল, তোর হাসিটা পুরো মুখে ছড়িয়ে পরে কেমনে? এরপর আমরা চা খেতে গেলাম। খুব যে কথা হলো তা না। কিন্তু সময়টা সুন্দর কেঁটেছিল!
এরপর কতবার দেখা হল, কথা হল। হ্যাঁ রে সৌম্য, ভার্সিটি ছাড়ার পর সবচে’ বেশি আফসোস চায়ের দোকানের মামারাই করেছে মনে হয়! আমি যেমন আমার নিজের বই পত্রের জগৎ ছেড়ে বাইরে আসছিলাম, তুইও তোর বন্ধু মহল থেকে সরে পড়ছিলি। কেউ ভাবতে পারে নাই, দ্য গ্রেট সৌম্য লাইব্রেরীতে বসে বই পড়বে! আমিও পাল্লা দিয়ে শান্তশিষ্ট ছেলে থেকে বদলাতে লাগলাম। একটা দুরন্তপনা আমাকে গ্রাস করছিল। আমিও তাতে নিজেকে সপে দিলাম। থার্ড ইয়ারে উঠতে উঠতে তুই আর আমি এত কাছে এসে পড়লাম, বলার মত না! তুই যেমন বইয়ের মধ্যে বুঁদ হওয়া শিখলি, আমিও মেটাল গানে গিটার বাজানো শুরু করলাম! জীবনটা বড়ই অদ্ভুত ছিল। আমার বাবা-মা তোকে খুব পছন্দ করেছিল। আমার মত ছিমছাম ছেলেকে তুই নাকি ‘ধরে বেঁধে’ শক্ত বানিয়েছিস! সবকিছুই সুন্দর চলত সেদিন তুই যদি আমার বাসায় না আসতি!
তোকে ফোনে বাসায় আসতে বলেছিলাম। বাবা-মা বাইরে গিয়েছিল আর কালকে পরীক্ষা, তোর নোট্স লাগবে। তুই খুব খামখেয়ালি ছিলি তাই শক্ত করে বলেছিলাম যে আজ না আসলে তোর সাথে কথাই বলব না। এরপর দেখি বাইরে ঝড়! বুঝলাম তুই আসতে পারবি না। তাই নিজেই পড়তে বসে গেলাম। এক ঘন্টা পর দেখি কলিংবেলের শব্দ। দরজা খুলে দেখি কাকভেজা তুই সেই চিরচেনা সলজ্জ হাসিতে। আমি অবাক। খুব রাগারাগি করেছিলাম সেদিন। তোকে টাওয়েল দিতে দিতে বললাম,”এই ঝড়ে আসতে গেলি কেন?” তুই বলে উঠলি,”তোর জন্যে!” বুকটা ছ্যাত করে উঠল। এরপরের ঘটনা খুব দ্রুত হল। যেন প্রকৃতি নিজেই করিয়ে দিল। ঠোঁটের সাথে ঠোঁট মিলে গেল। আমার বুকের ধ্বকধ্বক আওয়াজ তুই শুনতে পেলি, আমি পেলাম তোর উষ্ণ শ্বাসের পরশ। কিন্তু তুই দূরে সরে গেলি, দিশেহারা ভাব তোর মধ্যে। দৌড়িয়ে সেই ঝড়ের মধ্যে বের হয়ে গেলি। এরপর থেকে আমাকে এড়িয়ে চলতে লাগলি। কথা বলতে চাইতি না। যদি আমি মেয়ে হতাম, তাহলে এমন করতি না তাই না? তুই যে আমার চোখের ঘুম কেড়ে নিয়েছিস। তোকে আমি ভালোবাসি। তাই একদিন চেপে ধরলাম। অসহায় গলায় বললাম,”আমাকে এড়িয়ে যাচ্ছিস কেন?” তুই কথা বলতে চাচ্ছিলি না তাই আরো জোর করি। এক সময় কাজ হলো, তুই চিৎকার করে উঠলি,”আমি তোর মত গে না, আহসান। কখনো আমার সামনে আসবি না!” আমাকে ধাক্কা মেরে চলে গেলি। এরপর কত যে রাত বুক ভাসিয়ে কাঁদলাম, পুরো আর্দশ দেবদাস হয়ে গিয়েছিলাম! এভাবে দেড় বছর কাটল, তোর হদিস নেই। হিসাববিজ্ঞানের ক্লাসেও ঠিকমতত আসতি না। আমিও খামছাড়া হয়ে উঠেছিলাম। তুই ঠিকক বলেছিলি, আমি গে, সমকামী।
তবে কখনো টের পাইনি। পড়ালেখার মাঝে ডুবে ছিলাম যে, মেয়েদের দিকে তাকানো হয়নি, ছেলে তো পরের কথা। তুই আমাকে চুমু দেয়ার পর ব্যাপারটা টের পেলাম। নিজের মাঝে কোন লজ্জা না বরং একটা বিদ্রোহ অনুভব করলাম। তখন আমার কয়েকজন বন্ধুকে ব্যাপারটা বলি। ওরা হাসিমুখে মেনে নেয়। কিন্তু বপত্তি ঘটায় সাহাফ। ও ভার্সিটিতে খবর ছড়িয়ে দেয়। তবে কাজে লাগেনি, নিজের মধ্যে গুটিয়ে থাকার কারণে কেউ সন্দেহ করেনি, পাত্তাও দেয়নি। তবে খটকা থেকে যায়। আমি আবার নিজের আগের রূপ ধারণ করি। এমন করে ফোর্থ ইয়ারের মাঝখানে এসে পড়ি। শুক্রবার ছিল সেদিন। মেসেন্জার চালাচ্ছিলাম। হঠাৎ প্রায় দেড় বছর পর তুই মেসেজ দিলি,”আসতে পারবি?”
আমি বিস্ময় কাটিয়ে লিখলাম,”কোথায়?”
—আমার বাসায়
—কেন, সৌম্য? (আজও মন বলে, কেন সৌম্য?)
—তোকে কিছু বলার ছিল। প্লিজ আয়।
মাথা বলছিল,”যাসনে।” হৃদয় হুংকার মেরে বলল,”যা!” সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগতে ভুগতে দেখি সৌম্য মেসেজ দিয়েছে,”ওকে আয়” স্ক্রীনে তাকিয়ে দেখি আমি আনমনে “আসছি” লিখে বসে আছি! আমি চাইলে নাও যেতে পারতাম, কিন্তু আমার শুষ্ক হৃদয় আজ মেঘ দেখে নাচতে শুরু করে দিয়েছে। তাই গেলাম তোর বাসায়। দেখি তুই গম্ভীর মুখে দরজা খোলা রেখে দাঁড়িয়ে আছিস। আমি ঘরের ভেতরে আসলাম। আমি তখন ঘর দেখছিলাম। তোদের বাড়ি সেই আগের মতই আছে। জিজ্ঞেস করলাম যে তোর বাবা মা কই? দেখি কোন সাড়া শব্দ নেই। পিছন ফিরে দেখি তুই কাঁদছিস। একদম ছোট্টবাচ্চার মত নীরবে কাঁদছিস। বুঝতেই পারিস যে আমার হৃদয়ের সব কিছু খানখান হয়ে গেল। আমি তোর কাছে যেতেই তুই আমাকে জড়িয়ে ধরলি। তোর গায়ের গন্ধ আমি দেড় বছর পর পেলাম। আমি বললাম,”কী হয়েছে বলবি?” তুই তোর ভাঙা গলায় বললি,”আহসান, আমি আর পারছি না! আমি তোকে ভালোবাসি। আমি…..আমি….” আর পারলি না, না? তুই শব্দে কখনোই ভালো ছিলি না। আবার সেই কান্না। আমি হেসে তোর মুখ ধরে বললাম,”আমিও যে তোকে ভালবাসি, বোকা! এতদিন কোথায় ছিলি?” তোর কান্না কমল। আবার সেই বৃষ্টির দিনের মত ঘটনা হল। ঠোঁটে ঠোঁটে ঠুকোঠুকি। তবে এবার আগের চেয়ে বেশি কিছু হল। থাক সেসব না হয় নাই বা লিখলাম। তবে তোর ঘুমন্ত শক্ত বাহুর মাঝে শুয়ে থাকার সময় বুঝলাম, আমি জীবনের সবচে সুখী মানুষ হতে চলেছি!
সৌম্য, মনে আছে আমাদের সম্পর্কের শুরুটা কত সৌভাগ্যপূর্ণ ছিল। আমরা কাউকে কোনকিছু বলিনি। ঘরের সবাই আমাদের ‘বন্ধুত্ব’-এ খুশি ছিল। আমরা একই গ্রেড নিয়ে ভার্সিটি থেকে বের হই। তবে সবচে’ আশ্চর্যজনক ঘটনা হল, তুই আর আমি একই ব্যাংকে চাকরি পাই! তবে তোর পোস্টিং হয় চট্টগ্রামে। তখন আংকেলের দ্বিতীয় স্ট্রোক হয়েছিল। তাই মুখ বুজে মেনে নিলি। ঢাকা তোর আর আমার খুব পছন্দের ছিল। কিন্তু তুই চট্টগ্রামে গেলে আমাদের কি হবে! যাহোক তুই চলে গেলি চট্টগ্রামে আর আমি ঢাকায় চাকরি করছি।
ছ’মাস বাদে একদিন চট্টগ্রামে খুব বৃষ্টি। ৬ নম্বর বিপদ সংকেত। এমন সময় তোর দরজায় টোকা পড়ে। সৌম্য, সেদিন তোর হাসি আমি কখনো ভুলতে পারব না। শক্ত করে জড়িয়ে ধরলি। রীতিমত গায়ের উপর উঠে বসেছিলি। জানতে পারলি আমি লুকিয়ে লুকিয়ে চট্টগ্রামে ট্রান্সফার নিয়েছি। এরপর তোর বাসায় থাকতাম। বাংলাদেশে তো আর আমাদের বিয়ে হবে না, তাই লিভ ইন করতে থাকলাম। দুবছরে কত ঝগড়াঝাটি রাগারাগি হল, তাই না? আবার আমার রাগ ভাঙানোর জন্য কফি নিয়ে আসতি। আজ একটা সত্য বলি সৌম্য। তোর কফি কখনোই ভালো হত না। আমার মেজাজ আরো বিগড়ে যেত। তাহলে আমার রাগ ভাঙত কেমনে? তুই কফি হাতে দেয়ার পর কৌতুহলী মুখ নিয়ে চেয়ে থাকতি। যেন একটা বাচ্চা প্রথমবার কিছু বানিয়েছে। খারাপ হয়েছে এটা বলা আমার পক্ষে তখন সম্ভব ছিল না। আর হ্যাঁ তোর উসখোখুসকো চুল! ওগুলো দেখলে আমার হাত বুলিয়ে দিতে ইচ্ছে করত! কী মোলায়োম চুল ছিল তোর! কেন যে কাকের বাসা বানিয়ে রাখতি কে জানে! ঝামেলা বাঁধে দুবছর পর। আন্টি তোর বিয়ে দিতে চায়।
তুই করতে রাজি ছিলি না। অনেক ঝগড়ঝাটি তো আমার সামনেই ফোনে করেছিস। আন্টি জানতে পেরেছিল আমাদের কথা, কিন্তু কেমনে? তার উত্তর আমি কখনোই পাইনি। এক সময় ব্যাপারটা বাড়াবাড়ি পর্যায় চলে যায়। তখন আন্টি ফোন করে আমার মাকে অপমান করে। আমি নাকি তোকে বিয়ে করতে দিচ্ছি না। মা কথাটা অন্যভাবে নেয়, যেভাবে ব্যাপারটা সত্য ছিল। আমাকে মা বলে ও বাড়ি থেকে বের হয়ে আসতে। আমিও রাজি না। বাবাও পরে ফোন দেয়। কিন্তু আমি নড়তে রাজি ছিলাম না। তুইও না। কিন্তু আশু ঘটনার জন্য দুজনের কেউই প্রস্তুত ছিলাম না। আমার বাবা একদিন আমাদের বাসায় এলো।
মনে আছে আমাকে টেনে নিয়ে যেতে চেয়েছিল। পরে মারধর করা শুরু করল। তুই আমাকে বাঁচাতে এলে তোকেও মারতে এসেছিল। এসব করেও আমাকে নড়াতে পারেনি। আমার বাবা পরে ঘরের সব কিছু ছুড়ে মারছিল। অনেক পাগলামি করছিল। এক সময় জ্ঞান হারায়। হাসপাতালে ডাক্তার বলে বড় ধরনের হার্ট অ্যাটাক। বাম পাশ সম্পূর্ণ প্যারালাইজড। ঘটনা এখানেও থামেনি।
আমার মা চট্টগ্রামে চলে আসল। আমি ভেবেছিলাম মাও স্ট্রোক করবে। কিন্তু মা অনেক ঠান্ডা মাথায় কাজ করল। বাবাকে রিলিজ করিয়ে আমাকে আর তোকে কুলাঙ্গার বলে ট্রেনে উঠল। আমাদের সম্পর্ক এর মধ্যে বিধ্বস্ত। নাহলে বাবার মত তোর দিকে ফুলের টব ছুড়ে মারতাম না। ঝগড়া তো অনেক করেছি। এমন কিছু কখনো হয়নি। সত্য বলতে আর কখনো হয়নি। আমরা তিনদিন ধরে কথা বলিনা। সেদিন খুব বৃষ্টি ছিল। আমি সোফায় বসে বর্ষা দেখছিলাম।
হঠাৎ মুখের সামনে কফির মগ এগিয়ে এল। তুই হাসি মুখে এসে বললি,”সরি!” আমিও কফি মগ হাতে নিলাম। মুখে দিয়ে দেখলাম মারাত্মক তেতো! চিনি দিসনি। বলার পর তুই বললি চিনি দিয়ে আসছিস। আমি হাসছিলাম। তুই রান্নাঘর থেকে তাড়াহুড়ো করে ফিরলি। বললি,”সর্বনাশ! চিনি নেই। দাঁড়া আমি চিনি নিয়ে আসছি!” বলেই বাইরে যেতে চাইলি। আমি তোকে আটকে বললাম,”তোর মাথা গেছে! এই ঝড়ে চিনি আনতে যাবি? এত বড় মজনু হয়ে কাজ নেই। আমার পাশে বস।” তুই বললি,”আরে ধুর! কী হবে এতে? দাঁড়া আমি চিনি নিয়ে আসছি।” বলেই দৌড় দিলি।
জানতাম না যে তোর সুটকেস নিচেই ছিল। সব প্যাক করে রেখেছিলি। আমি জানালা দিয়ে তোকে দুটো বড় বড় সুটকেস ট্যাক্সিতে উঠাতে দেখলাম। একবার মনে হল যে তুই আমাদের বাসার দিকে শেষবারের মত তাকিয়েছিস। ট্যাক্সি ঝড়ের মধ্যে চলে গেল।
পাঁচ বছর কেটে গেছে। তুই আমেরিকার কোথায় আমি জানি না। ঢাকায় ফেরার পর মা এমনভাবে চলতে থাকলো যেন আমাকে কখনো কুলাঙ্গার বলেননি। আন্টির সাথে দেখা হয়নি আর। তোর কথা কেউ আর বলে না। সৌরভ গতমাস বলেছিল যে তুই আমেরিকা চলে গিয়েছিস।
এখন মা আমাকে বিয়ে করতে বলে। নিজের সংসার বানাতে বলে। “কিন্তু মা, আমার যে মেয়ে ভালো লাগে না। যে ছেলেকে ভালবাসতাম তাকে তো মেনে নিলে না। আমি সৌম্যকে ছাড়া আর কাউকে ভালোবাসি না। এই ভনিতা কেন করছ মা?” কিন্তু এসবের কোনকিছুই বলা হয়না। আমরা সবাই নিজের স্রোতে ধাবমান।
এই যা, রোদ উঠে গেছে আমাদের নগরীতে, সৌম্য। তুই যাবার পরে এই ঢাকা খুব একটা বদলায়নি। কিন্তু তোর জন্যে চট্টগ্রমে ছুটে যাওয়া একটা ছেলে অনেক বদলে গেছে।

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.