
ঘড়ির কাঁটা সকাল ৭ টা ছুঁয়েছে কেবল, আর ওমনিই ঘড়িতে অ্যালার্ম বাজতে শুরু করলো। অ্যালার্ম বাজছে তো বেজেই চলেছে কারো কোনো সাড়াশব্দ নেই। সময় এখন ৭ টা বেজে ২০ মিনিট, গত বিশ মিনিট ধরে অ্যালার্ম দেয়া ঘড়ির যদি প্রাণ থাকত তবে এতক্ষণে তার সাহেবের আর রক্ষে ছিল না। অবশেষে আরো মিনিট পাঁচেক পর অ্যালার্ম বন্ধ হলো। তিনি উঠলেন, হ্যাঁ সাহেব বাবুর এতক্ষণে হুঁশ হলো। উঠেই ঘড়িতে সময় দেখে তড়িঘড়ি করে টয়লেটে ঢুকে পড়ল সে।
ওহ পরিচয়ই তো দেয়া হয়নি, ছেলেটার নাম নিলাঞ্জ। নামের মতই সুন্দর, সুঠাম দেহের অধিকারী টগবগে যুবক। যৌবনের সব রূপ যেন ঠিকরে পড়ছে তার উপর। নামের নীলের মতই নিলাভ চোখ তার, মুখভর্তি দাড়ি সুন্দর করে কাটা। গোলাপি ঐ ঠোঁটে যে কেউই আঁটকে যাবে এক পলকেই, আর মন ভোলানো তার হাঁসি। সব মিলিয়ে অপরূপ এক যুবক নিলাঞ্জ। চট্টগ্রাম শহরে বেড়ে ওঠা নিলাঞ্জের, মা-বাবা অনেক ছোটবেলাতেই মারা গেছেন, এরপর এক অরফানেজেই ঠাই মেলে ছেলেটার। নিলাঞ্জ খুব উচ্চাভিলাষী একটা ছেলে, দুচোখ ভরা তার অনেক স্বপ্ন, আশা। বড় হয়ে অনেক কিছু করার ইচ্ছে আছে তার। লেখাপড়া শেষ করে নিলাঞ্জ এখন ঢাকায় একটি বহুজাতিক কোম্পানিতে চাকুরি করছে ।
ঘড়িতে ৮ টা বেজে গেছে, নিলাঞ্জ গোসল সেরে কোনোমতে কাপড়চোপড় পড়ে নিয়ে অফিসের উদ্দেশে রওয়ানা দিল। পথে যেতে যেতে সে ভাবছে আজ আর রেহায় নেই তার, নির্ঘাত বসের বকুনি খেতেই হবে। ঢাকা যানজটের রাজধানী হিসেবে সুপরিচিত, তাই যাতায়াতে ভালোই বেগ পেতে হয় এখানকার মানুষদের। বাস স্ট্যান্ডে এসে নিলাঞ্জের চোখ তো একেবারে কপালে উঠে গেল, বিশাল লম্বা লাইন কিন্তু বাসের কোন দেখা নেই। অফিসে আজ নিজের পরিস্থিতি চিন্তা করতে করতে তার কপাল থেকে অঝোরে ঘাম ঝরছে। অবশেষে অনেক চরাই উতরাই পার করে ৯ টার অফিসে নিলাঞ্জ পৌঁছল ১০ টা বেজে ৩০ মিনিটে। হাত পা থরথর করে কাঁপছে ছেলেটার, নিজের ডেস্কে গিয়ে বসতেই তার ডাক আসলো বসের কেবিন থেকে। অনেক কিছু জল্পনা-কল্পনা করে কেবিনের দরজা দিয়ে ভেতরে ঢুকতেই নিলাঞ্জ যেন আকাশ থেকে পড়ল, তার বস সহ অফিসের সব সহকর্মীরা এক্সুরে বলে উঠল, “হ্যাপি বার্থডে নিলাঞ্জ”। হ্যাঁ, আজ ৭ই আগস্ট, নিলাঞ্জের জন্মদিন। সকাল থেকে এতো ঝক্কি-ঝামেলায় নিজের জন্মদিনই ভুলে গিয়েছিল নিলাঞ্জ। অফিসে সবাই মিলে জন্মদিনের কেক কাটলো, সঙ্গে অনেক উপহারও দিল, তারপর ছবি তোলার ধুম। সবমিলিয়ে অনেকটা স্বপ্নের মতই মনে হচ্ছিল নিলাঞ্জের কাছে, কারণ জন্মদিন কখনও সেরকম স্থান পায়নি তার মনে। আজ নিলাঞ্জের নিজেকে খুব ভাগ্যবান মনে হচ্ছে, মনে হচ্ছে যেন দিনটা এভাবেই থেমে যাক, আর না আগাক। তবে তা কি আর হয়, দিনশেষে অফিস শেষ করে বাসায় ফিরল সে। এতো আনন্দ, উদযাপনের পরেও কেনো যেন নিলাঞ্জ খুব অস্বস্তি বোধ করছে, কোথাও যেন কিছু একটা নেই, কেমন অপরিপূর্ণ মনে হচ্ছে তার কাছে সবকিছু।
১লা মার্চ, ২০১৯ আজ থেকে প্রায় ৫ মাস আগের কথা, নিলাঞ্জ তার অফিসে নতুন একটা প্রজেক্টে কাজ করছিল। প্রজেক্টের একটা জরুরী মিটিং আছে আজ, তা নিয়ে সবাই খুব সিরিয়াসলি কাজ করছে, শেষ মুহূর্তের প্রস্তুতি নিয়ে সবাই ব্যাস্ত, নিলাঞ্জ নিজেও। হঠাৎ করে মোবাইলে একটা নোটিফিকেশন আসলো ফেসবুকে একটা মেসেজ রিকুয়েস্ট এসেছে। চট করেই মেসেঞ্জারে ঢুকে দেখতেই দেখল একজন “Hi” লিখেছে, কিন্তু নিলাঞ্জ তাকে চিনতে পারলো না তাই আর সময় না নিয়ে মোবাইলটা রেখে অফিসের কাজে ব্যাস্ত হয়ে পড়ল। যথাসময়ে মিটিং শেষ হলো, নিলাঞ্জকে বেশ হাঁসি খুশিই মনে হচ্ছে, নিশ্চয়ই মিটিং এ ভালো কিছু হয়েছে। হ্যাঁ, আজ সবাই মিটিং এ নিলাঞ্জের কাজের খুব প্রশংশা করছিলো তাই মনটা খুব ভালো তার। ভালোয় ভালোয় দিনটা কেটে গেলো, অফিস শেষে বাসায় ফিরল সে। আজ রাত ৯ টায় নিলাঞ্জের পছন্দের সিরিয়ালটার স্পেশাল এপিসোড আছে, তাই তাড়াতাড়ি রান্না-বান্না, হাতের কাজ শেষ করছে। নিলাঞ্জ আবার টিভি সিরিয়াল দেখতে খুব ভালোবাসে, নাটকের চরিত্রগুলো ওকে খুব স্পর্শ করে মানসিকভাবে। ঘড়িতে ৮ টা বেজে ৫০ মিনিট, নিলাঞ্জ সব কাজ শেষ করে টিভির সামনে বসে অপেক্ষা করছে, এমন সময় মোবাইলে নোটিফিকেশন এল, মেসেঞ্জারে আবারো মেসেজ এসেছে ‘Hello, anyone there?’ অনিচ্ছাকৃতভাবেই মেসেজ টা দেখলো, তবে রিপ্লাই কি দিবে বা আদৌ দিবে কিনা চিন্তা করছে নিলাঞ্জ। হঠাৎ তার মনে পড়ল সে তো মানুষটাকে চেনে না, কে সে? প্রোফাইলে গিয়ে দেখতে পেলো নাম তার নাবিল, ছেলেটাকে আগে কোথাও দেখেছে বা পরিচয় হয়েছিলো কিনা মনে করার চেষ্টা করল, কিন্তু পেলো না কিছুই। অপরিচিত ছেলেটা কি প্রয়োজনে তাকে মেসেজ দিচ্ছে। এরকম হাজার চিন্তা ভাবনা করতে করতে কখন ঘড়ির কাটা ১০ টা ছুঁইছুঁই নিলাঞ্জ একদমই টের পায়নি। সিরিয়াল দেখা মিস করে মনটা খারাপ করে খেয়ে দেয়ে তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়ল সে। যদিও অন্যান্য সময়ে আরো অনেক দেরি করে ঘুমাতে যায়, তার উপর কাল শুক্রবার, অফিস ছুটি, কোন তাড়াও নেই। কিন্তু তারপরও শুয়ে পড়ল ছেলেটা। শুয়ে সে এখনও চিন্তা করছে নাবিল ছেলেটার মেসেজ দেওয়ার কারণ নিয়ে। অনেক চিন্তা ভাবনার পাহাড় গুনে শেষ করে অবশেষে নিলাঞ্জ রিপ্লাই দিল, ‘Hello, how are you doing?’. সঙ্গে সঙ্গেই অপর পাশ থেকে ফিরতি জবাব আসলো ‘Doing well, what about you?’. এরকম কথাবার্তা চলতে চলতে কখন যে ঘড়ির কাটা রাত ২ টায় পৌঁছেছে টেরই পায়নি দুজনের কেউ। কথা বলতে ভালোই লাগছিল নিলাঞ্জের, অনেকদিন পর কারো সাথে কথা বলে অনেকটা ভালো অনুভব করছে সে, মনটা খুব প্রফুল্ল লাগছে। হঠাৎ চোখের কোনে দুফোটা জল গড়িয়ে এলো, তবে কেন, কি ভাবছে নিলাঞ্জ, কার কথা মনে করছে, রুপম নয় তো? হ্যাঁ, রুপম, নিলাঞ্জের জীবনের সেই ঢেউ যা সে প্রথমবারের মত অবগাহন করেছিল, প্রথম প্রেম, প্রথম ভালোবাসা, প্রথম চুমু, প্রথম কাউকে কাছ থেকে পাওয়া, সবকিছু প্রথম ছিলো। কি ভাবছেন? হ্যাঁ, নিলাঞ্জ সমপ্রেমি, আর দশজনের মতই সেও স্বাভাবিক, রক্ত-মাংশে গড়া, সৃষ্টির সেরা সৃষ্টি। তবে সে ছেলেদের প্রতি আকর্ষিত হয়, তার ভালোলাগার কেন্দ্রবিন্দুতে একজন পুরুষ বসবাস করে, আর কিছুনা। ভালো-মন্দের অনুভূতি, সুখদুঃখের অনুভূতি তারও একইরকম। কিন্তু তারপরও মানুষ কেনো যেন বোঝে না, মনে করে ওরা অস্বাভাবিক, বিকৃত। যাই হোক কথায় ফিরে আসি, হ্যাঁ রুপম, নিলাঞ্জের সাথে রুপমের প্রেম, ভালোবাসা বেশিদিন টেকে নি, একটা ঝড় এসে নিমেষেই সব লণ্ডভণ্ড করে দিয়েছে, আর সাথে বদলে দিয়েছে নিলাঞ্জের জীবনটাও। ২ বছর আগে যখন রুপম নিলাঞ্জের জীবন থেকে বিদায় নেয়, তারপর থেকে ভালোবাসাকে আর কাছে ঘেঁষতে দেয়নি ছেলেটা। একা কেঁদেছে, কষ্ট পেয়েছে তবে সব একাই সহ্য করেছে সে। কিন্তু এই দীর্ঘ সময় পর আবার কেন এমন মনে হচ্ছে যে কেউ যেন মনের দুয়ারে কড়া নাড়ছে, কি হতে যাচ্ছে সামনে, এইসব চিন্তা করতে করতে ঘুমিয়ে পড়ে নিলাঞ্জ। পরদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখে মোবাইলে নাবিলের মেসেজ ‘Good morning’. বিছানা ছেড়ে না উঠেই ওমনি কথায় লেগে পড়ল নিলাঞ্জ, পছন্দ-অপছন্দ, ভাললাগা-মন্দলাগা সবকিছু নিয়ে কথা হচ্ছে দুজনের মাঝে, কথার ফাঁকে কখন যে সময় পেরিয়ে যাচ্ছে তার কোন তাল নেই। কথার গাড়ি চলছে তো চলছে, মেসেঞ্জারের গন্ডি পেরিয়ে সোশ্যাল মিডিয়াতে একে অপরের পরিচিতি বেড়েছে সঙ্গে ফোন নাম্বারেরও আদান প্রদান হয়ে গিয়েছে। চোখের পলকেই যেন ২ দিন পার হয়ে গেল, শুক্রবার, শনিবার পার হয়ে কাল রবিবার আসতে চলল, নিলাঞ্জের কাছে সবকিছু কেমন জাদুর মত মনে হল, কি হচ্ছে তার সাথে সে বুঝতে পারছে না কিছুই। পরদিন সকালে যথাসময়ে অফিস গেল, কিন্তু কাজে আর মন বসছে না, সারাদিন যাচ্ছে নাবিলের চিন্তায় আর তার সাথে কথা বলতে বলতে। এইভাবে সপ্তাহ দুই তিনেক পার হয়ে গেল, নিলাঞ্জের মনে বসন্তের ঘনঘটা, মনের বাগিচায় ফুল ফুটছে, কেমন যেন বদলে গেছে সে, আর আগের মত নেই, মনে হচ্ছে যেন কোন মরা গাছে নতুন পাতা গজিয়েছে। অবশেষে নিলাঞ্জ প্রথমবারের মত দেখা করতে যাচ্ছে নাবিলের সাথে, আগামী ৫ই মে তে। দিনটা অনেক গুরুত্বপূর্ণ নিলাঞ্জের কাছে, শুধু এজন্য নয় যে সে আজ প্রথম দেখবে তার ভালোলাগার মানুষটাকে, আজ নাবিলের জন্মদিনও। কি উপহার কিনবে, নাবিলের পছন্দ হবে কিনা, এই সেই ভেবে ভেবে গত ২/৩ দিন আর ঠিকঠাক ঘুমোতে পারে নি সে। অফিসে বসে শুধু ঘড়ি দেখছে আর সময় গুনছে নিলাঞ্জ, কখন ছুটি হবে আর সে যাবে নাবিলের কাছে, যত ঘড়ি দেখে সময় যেন আরো বাড়ে, কমে না আর। অপেক্ষার প্রহর গুনতে গুনতে অবশেষে সেই সময় আসলো, নিলাঞ্জ অপেক্ষা করছে রেস্টুরেন্টে বসে নাবিলের জন্য। একটু পরেই নাবিল এসে দাড়াল চেয়ারের কাছে, নীল রঙের একটা পাঞ্জাবী পড়েছে নাবিল, দেখতে অসাধারণ সুন্দর দেখাচ্ছে তাকে যেন স্বর্গ থেকে কোন দূত এসেছে। কাঁধে নাবিলের স্পর্শে বাস্তবতায় ফিরল নিলাঞ্জ, সে তো কল্পনার রাজ্যেই চলে গিয়েছিল নাবিলকে দেখে। করমর্দন করে কুশলাদি জিজ্ঞেস করতে করতে যার যার চেয়ারে বসল দুজন, বসতেই ‘শুভ জন্মদিন’ বলে উপহারটা নাবিলের দিকে এগিয়ে দিলো নিলাঞ্জ, খুলে দেখে নাবিলের খুব পছন্দ হল উপহারটা। এরপর খাবার দাবার আর কথা বার্তায় সময় কেটে গেল। দুজনে বেরিয়ে পথ ধরে হাটছে আর চারিদিকের নিস্তব্ধতা যেন একটা অমায়িক পরিবেশ সৃষ্টি করেছে। নাবিল পাশে এসে আস্তে করে নিলাঞ্জের হাতে নিজের হাতটা রাখল, নিলাঞ্জ মুহূর্তেই কেমন বিচলিত হয়ে উঠল, সারা গায়ে কেমন যেন বিদ্যুৎ খেলে গেল, কেমন যেন লজ্জা পাচ্ছে সে। কিছুদূর হেঁটে সামনে একটা জায়গায় বসল দুজন, এখনও হাত ধরেই আছে একে অপরের, দুজন দুজনের দিকে তাকিয়ে কি যেন দেখছে, কেউ কিছু বলার মত ভাষা খুজে পাচ্ছে না, এ যেন একটা স্বপ্ন। নাবিলের ফোনের শব্দে দুজনের ঘোর কাটল, ওর মা ফোন দিয়েছে, এবার বাসায় যেতে হবে। মন চাইছিল না তবে তারপরও বিদায় জানাতে হল নাবিলকে। বাসায় ফিরে নিলাঞ্জ সেই খুশি, সুখের মেঘে ভাসছে যেন, কারো নজর যাতে না লাগে এই খুশিতে। এভাবেই ধীরে ধীরে ভালোলাগা, ভালোবাসায় নিলাঞ্জ আর নাবিলের দিন ভালোই কাটতে লাগলো, এরপর আরো বেশ কয়েকবার দেখা করেছে দুজনে, ঘুরেছে, রেস্টুরেন্টে খেয়েছে, আড্ডা দিয়েছে, বেশ ভালোই যাচ্ছে সব মিলিয়ে। নিলাঞ্জ হঠাৎ কিছুটা চিন্তিত মনে হল, সে ভাবছে কিভাবে বিষয়গুলো নিয়ে আরো কথা আগানো যায়, এই যেমন সম্পর্কের বিভিন্ন দিক, ভবিষ্যৎ সবকিছুই। আজ ১৬ই জুন, নিলাঞ্জ নাবিলের সাথে দেখা করতে যাচ্ছে, আজ নিলাঞ্জ ঠিক করেছে নাবিলের সাথে সবকিছু নিয়ে কথা বলবে, কিন্তু ভয়ও পাচ্ছে যদি সবকিছু ভেঙ্গে যায় এই সমাজের রীতিনীতি আর নিয়ম-কানুনের মাঝে। দেখা হল, দুজন একটা কফি শপে বসল, একথা ওকথা করতে করতে নিলাঞ্জ সাহস করে বলা শুরু করল যা সে ভেবে এসেছে। সম্পর্কটা এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার কথা শুনতেই নাবিল কেমন ঘাবড়ে গেলো, এমনটা তো চাচ্ছিল না সে, নাবিলের মতে সে এই সমাজের বিধিনিষেধ ভাঙতে পারবে না, পারবে না নিলাঞ্জকে নিয়ে সুখের সংসার করতে, এসব শুনে নিলাঞ্জের মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়ার মত অবস্থা, সে কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছে না মুহূর্তেই সব শেষ হয়ে যাচ্ছে। অনেক কথা কাটাকাটির পর সব ভেঙ্গে তছনছ হয়ে গেলো, সব মাটিতে মিশে গেল নিমেষেই, দুজন দুজনের মত যে যার পথে চলে গেলো, আজ আর যাওয়ার আগে জড়িয়ে ধরা হল না একে অপরকে, হাতে হাত রেখে হাটা হল না। চোখের অথই সমুদ্রে আবারও নিলাঞ্জ ডুবে গেলো, নাওয়া, খাওয়া, অফিস, কাজ কিছুই হচ্ছে না ওকে দিয়ে, শুধু নাবিলের কথা মনে করে করে ডুকরে ডুকরে কাঁদে। অফিসে বসের কাছে কাজ ঠিকমত না করার জন্য অনেক বকুনিও খেলো, শেষে কয়েকদিনের ছুটি নিল সে অফিস থেকে। নিলাঞ্জ কিছুতেই এই বিচ্ছেদ সহ্য করতে পারছিল না, দিন পার হয়ে যাচ্ছে কিন্তু কোনমতেই অবস্থা ঠিক হচ্ছে না, না পারতে নিলাঞ্জ ফোন করল নাবিলকে, কিন্তু নাবিলের একই কথা, আর কিছু সম্ভব না, তার নাকি অনেক বড় ভুল হয়ে গেছে, নিলাঞ্জ নাকি নাবিলের কাছে শুধু একটা ভুল ছিল, আর কিছুই না। এসব শুনে নিলাঞ্জ স্তব্ধ হয়ে গেলো, “ভুল” এই শব্দই তার কানে সারাক্ষন বাজে। শোকে দুঃখে নিলাঞ্জের আত্মার যেন মৃত্যু ঘটলো, কোথায় যেন সে হারিয়ে গেলো, কেমন যেন অপরিচিত হয়ে গেলো চিরপরিচিত, উচ্ছসিত, হাস্যজ্বল নিলাঞ্জ।
হঠাৎ ফোনের শব্দে ঘোর কাটলো নিলাঞ্জের, তার এক ভালো বন্ধু ফোন দিয়েছে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানাতে। কথা শেষ করে খেয়ে দেয়ে নিল, বিছানায় গিয়ে মোবাইলে নাবিলের ছবিগুলো বের করে দেখছে আর কাঁদছে। এই দিনটির কত প্ল্যান করেছিল দুজন মিলে কয়েকমাস আগে তার কিছুই আর হল না। খুব মনে পড়ছে তাই আজকের দিনে নাবিলের কথা আর বারবার কানে শুধু বাজছে ‘ভুল’ শব্দটি। নাবিলের কথা চিন্তা করতে করতেই ঘুমিয়ে পড়ল নিলাঞ্জ। পরদিন সকালে উঠে অফিসের জন্য বের হল নিলাঞ্জ, বাসের জন্য অপেক্ষা করছে, বাস এলে বাসে উঠে বসল, পথে যেতে যেতেও নাবিল তার মনে ঘুরপাক খাচ্ছে। বাস থেকে নেমে রাস্তা পারাপার হতেই হঠাৎ জোরে কি যেন একটা এসে ধাক্কা দিল, নিলাঞ্জ মাটিতে লুটিয়ে পড়ল, চোখ বন্ধ হওয়ার আগে শুধু একটা শব্দই বলেছিল সে, ‘নাবিল’। হাসপাতালে নেয়া হলে ডাক্তার তাড়াতাড়ি নিলাঞ্জকে অপারেশন থিয়েটারে নিয়ে গেলো, অপারেশন থিয়েটারের বাইরে একটা লোক খুবই বিচলিত হয়ে পায়চারি করছে, হ্যাঁ এই লোকটার গাড়িই তো ধাক্কা দিয়েছিল নিলাঞ্জকে, কে সে, এতটা চিন্তিত মনে হচ্ছে কেন তাকে, সে কি নিলাঞ্জকে চেনে, সামনে আসতেই দেখি এতো নাবিল। তাহলে কি নাবিলই………………..ভাবতেই সারা গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠছে। ‘নাবিল’ ডাক আসলো পেছন থেকে, ঘুরতেই দেখি এ যে নিলাঞ্জ, যাক ভালো তাহলে, সুস্থ আছে ভেবে মনে প্রশান্তি আসলো। কিন্তু নাবিল কেন ডাকে কোন সাড়া দিচ্ছে না, নিলাঞ্জ আবার ডাকল ‘নাবিল?’ কিন্তু নাবিলের কোন সাড়া নেই। একটু পর অপারেশন থিয়েটার থেকে ডাক্তার কি যেন বলতেই নাবিল কান্নায় ভেঙ্গে পড়ল, আমি এখনও কিছু বুঝে উঠতে পারছি না কি হচ্ছে, হঠাৎ দেখি নিলাঞ্জের নিথর দেহ অপারেশন থিয়েটার থেকে বের করে আনা হল। আমি আর কিছু ভাবতে পারছিলাম না, হতবাক হয়ে শুধু দেখছিলাম দূর থেকে নিলাঞ্জ দাড়িয়ে হাসছে, সেই হাঁসি যখন সে নাবিলকে পাশে পেয়েছিল, জগৎভুলানো হাঁসি হেসেই নিলাঞ্জ সব দায় ছেড়ে গেলো আর দূর থেকে শুধু একটা কথা কানে ভেসে আসছিল, ‘ভুলের সমাপ্তি অবশেষে ভুলেই হল।’ কয়েক ঘন্টা পর অরফানেজ থেকে কিছু লোক এলো নিলাঞ্জের মৃতদেহ নিয়ে যাওয়ার জন্য। এ্যাম্বুলেন্সে করে নিয়ে যাওয়ার সময় পাশে একটা দোকানে বাজছিলো নিলাঞ্জের পছন্দের গানটি…
তুমি যাকে ভালোবাসো
স্নানের ঘরে বাষ্পে ভাসো
তার জীবনে ঝড়
………………………..
………………………..
তুমি অন্য কারোর সঙ্গে বেঁধো ঘর
তুমি অন্য কারোর সঙ্গে বেঁধো ঘর
লেখকঃ কর্ণফুলী