
লিখেছেন নিউট্রন
প্রথমেই বলে রাখি, এটা কোন গবেষণালব্ধ ফলাফল নয়। একান্তই আমার ব্যক্তিগত পর্যবেক্ষণ এবং অভিমত। চলার পথে বেশ কিছু উভকামী মানুষের সংস্পর্শে আসার সুযোগ হয়েছে। সম্পর্ক তৈরী হয়েছে। কারো সাথে প্রেমের, কারো সাথে বন্ধুত্ব, কেউ কেবলই পরিচিতজন। যদিও আমি মৌলিক কিছু মানবিক আচরণ দিয়ে মানুষের ভালো- মন্দ বিচারে বিশ্বাসী, কিন্তু সামাজিকভাবে যৌনতা কিংবা যৌন অভিমুখিতাকে স্বতন্ত্র ব্যক্তির অন্যতম একটা পরিচিতি হিসেবে অস্বীকার করার কোন উপায় নেই।
আচ্ছা এসব কথা ছাড়ুন৷ ভাবুন আপনার একটা জিনিস কেনা খুব প্রয়োজন। সেটা কেবল আপনার বাসার পাশের নিউমার্কেটে পাওয়া যায়, অথবা কেবল মিরপুর দশ নাম্বারে পাওয়া যায়৷ তখন আপনার হাতে কোন অপশন নেই। দরকারী জিনিসটা আপনাকে নিউমার্কেট অথবা মিরপুর দশ থেকেই কিনতে হবে। কিন্তু ভাবুন তো, আপনি সেটা দুই জায়গায়ই পাচ্ছেন। তখন কী আপনি রাজ্যের জ্যাম ঠেলে মিরপুর দশে যাবেন? নাকি ঘরের পাশে নিউমার্কেট থেকে কিনে নেবেন? আমরা ধরে নিতে পারি আপনি সহজ পথটাই বেছে নিয়েছেন৷ সিংহভাগ মানুষই আসলে তাই। তারা অপেক্ষাকৃত সহজ এবং নির্ঝঞ্ঝাট পথটা বেছে নিতে পছন্দ করে।
যে সমাজব্যবস্থায় সমকামিতা একটি ঘৃণ্য অপরাধ এবং সমলিঙ্গের মানুষের প্রতি আকৃষ্ট হওয়াকে পাপ হিসেবে গণ্য করা হয়, সেই সমাজব্যবস্থায় কেউই বিনা কারণে স্বেচ্ছায় চাইবে না এই জীবনটাকে বেছে নিতে৷ আপনি যদি ব্যতিক্রম হন আপনাকে সাধুবাদ। কিন্তু যেখানে আপনি চাইলে বিপরীত লিঙ্গের মানুষকে বিয়ে করে স্বাভাবিক শান্তিপূর্ণ সামাজিক জীবন কাটাতে পারছেন সেখানে কেন খামোখা ওই পথ মাড়ানো? আমরা কেবল উভকামীদের কথা বলছি কেন? অনেক সমকামী মানুষও বিপরীত লিঙ্গের মানুষকে বিয়ে করে সুখে না হলেও শান্তিতে ঘর সংসার করছেন, বাচ্চাকাচ্চার জন্ম দিচ্ছেন, এই সামাজিক গ্রহণযোগ্যতার জন্যই তো? মানুষ গোষ্ঠিবদ্ধ জীব। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে তারা সামাজিক জীবনযাপন করে আসছে। চাইলেই তারা সমাজে গ্রহণযোগ্য হওয়ার এই আবেদনটাকে নাকচ করে দিতে পারে না। এবং এটা নিয়ে কাউকে বিচার করাটাও অনুচিত।
এখন প্রশ্ন আসতেই পারে তাহলে কেন খামোখা সমকামী সম্পর্কে জড়ানো? প্রশ্নটা জটিল। কে কার সাথে কবে, কখন, কিভাবে, কেন, কোন সম্পর্কে জড়াবে সেটা একান্তই তার এবং তাদের ব্যক্তিগত বিষয়। সেখানে প্রবেশের এখতিয়ার আমার নেই। যতটুকু এখতিয়ার পাওয়া যায় তাতে দেখা উচিত সম্পর্কে যথেষ্ট স্বচ্ছতা আছে কিনা। উভয়পক্ষ সম্পর্কে নিজ নিজ জায়গাটা পরিষ্কার রেখেছেন কিনা। আপনি কমিটমেন্ট চান, কিন্তু আপনার পার্টনারের কমিটমেন্ট ইস্যু আছে, এক্ষেত্রে হয় আলোচনার মাধ্যমে বিষয়টা সমাধান করুন, অথবা পারষ্পরিক শ্রদ্ধার জায়গাটা অক্ষুণ্ণ রেখে সম্পর্কটা থেকে সরে আসুন। আপনার বা আপনার পার্টনারের যৌন অভিমুখিতা এখানে নিতান্তই নগণ্য বিষয়। আবার আপনার পার্টনার যদি মিথ্যা প্রতিশ্রুতি দেয় কিংবা প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করে আমি অত্যন্ত দুঃখিত যে আপনি একজন ফ্রডের পাল্লায় পড়েছেন। আমি আশা করতে পারি, আপনার জীবন অফুরন্ত ভালোবাসায় ভরে উঠুক, কিন্তু আপনি যদি বলে ফেলেন উভকামী মাত্রই ফ্রড আমি আপনার সাথে একমত হতে পারলাম না। যেমন একমত হতে পারি না “সব ছেলে খারাপ, সব মেয়ে খারাপ, সব গে/লেসবিয়ান/ট্রান্স রা মানসিকভাবে অসুস্থ” ধরণের কথাগুলোর সাথে। ব্যক্তির কৃতকর্মের দায়ভার ব্যক্তির উপর বর্তায়, গোষ্ঠির উপর নয়।
সব সম্পর্কই আমৃত্যু টিকবে না। কারো সাথে সম্পর্কে জড়ালেই আজীবন তার সাথে থাকতে হবে এমন মাথার দিব্যি কেউ দেয় নি৷ যে সম্পর্কটা ঠিকঠাক কাজ করে না, কিংবা বিষাক্ত- এমন সম্পর্ক থাকার চেয়ে না থাকাই ভালো। ব্যাপারটা বরং আপনার মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী। মানুষের জীবনে দিনশেষে কেবল যেটা ম্যাটার করে সেটা হচ্ছে নিজের ভালো থাকা। বিচ্ছেদ সবসময়ই যন্ত্রণার। তাই বলে বিচ্ছেদের পর কেবল অপর পক্ষকে দোষারোপ এবং শাপ- শাপান্ত করা অনুচিত। মানুষটা আপনাকে ছেড়ে চলে গিয়েছে, তার মানেই সে প্রতারক নয়। পরষ্পরের প্রতি, সম্পর্কটার প্রতি এবং একসাথে কাটানো সময়গুলোর প্রতি শ্রদ্ধাবোধ বজায় রেখেই সম্পর্ক শেষ করা উচিত। কেউ কখনো প্রতারণা করে না কিংবা প্রতারণার শিকার হয় না তা বলছি না। বলছি যে ধারণাটা যেন সার্বজনীন না হয়ে ব্যক্তিবিশেষে হয়।
বাইসেক্সুয়ালিটি একটা ট্রেন্ড, এটা অস্বীকার করার উপায় নেই। একাধিক মানুষ দেখেছি যারা আদতে বিষমকামী কেবল “কুল” হতে কিংবা “নতুন এক্সপিরিয়েন্স” এর আশায় সমলিঙ্গের মানুষের সাথে সম্পর্কে জড়ান। এটাও স্বাগত, যদি আপনি আপনার পার্টনারের কাছে আপনার অবস্থান, চাওয়া- পাওয়া ইত্যাদির ব্যাপারে স্বচ্ছ থাকেন এবং আপনার পার্টনারেরও তাতে সম্মতি থাকে। আপনি আপনার জীবনে যা খুশি করতে পারেন। কিন্তু প্রথম নিয়মটাই হচ্ছে আপনাকে ফেয়ার গেইম খেলতে হবে।
আরেকটা জিনিস খেয়াল করেছি। অনেক সমকামী ব্যক্তি নিজেদের উভকামী হিসেবে পরিচিত করেন। এর কারণ বোধহয় সমকামী হিসেবে গ্রহণযোগ্যতা পাওয়ার চেয়ে উভকামী হিসেবে গ্রহণযোগ্যতা পাওয়া কিছুটা সহজ। সেটা নিজের কাছে এবং অন্যের কাছেও। দিনশেষে বিপরীত লিঙ্গটাই যেহেতু আপনার সামাজিকভাবে স্বীকৃত গন্তব্য সুতরাং যে কোনভাবে নিজেকে সেই গন্তব্যে পোঁছানোর যোগ্য হিসেবে প্রমাণ করা, মিথ্যে করে হলেও। এইতো!
আপনি সমকামী/ উভকামী, আপনি সব বাধাবিঘ্নকে অতিক্রম করে, আপনার ভালেবাসার মানুষটার হাতটা শক্ত করে ধরে রাখতে চান কিংবা রাখতে পারেন, আপনাকে অভিনন্দন, শুভকামনা এবং ভালোবাসা। কিন্তু কেউ না পারলেই তাকে খলনায়ক বানিয়ে দেওয়া অযৌক্তিক। সবাই সুপার হিউম্যান না। বেশিরভাগই সাধারণ মানুষ। তাদের সীমাবদ্ধতা থাকে। অন্যের সীমাবদ্ধতাকে সম্মান করতে, গ্রহণ করতে পাড়তে হয়। মানুষ হিসেবে প্রত্যেকটা মানুষকে শ্রদ্ধা করতে হয়।পারষ্পরিক শ্রদ্ধাবোধ কোন ঐচ্ছিক বিষয় না, এটা আবশ্যক। সবাইকে হুটহাট বিচার করে ফেলতে হয় না। আপনি মহামান্য আদালত না। আপনার কাছে কেউ বিচার চেয়ে কাঁদে নি। বাঁচুন এবং বাঁচতে দিন।
যাইহোক, দিনশেষে আমরা সবাই একই কমিউনিটির অংশ। দিনশেষে যুদ্ধটা আমাদের সবার। আমরা কেউ কম মানুষ আর কেউ বেশি মানুষ নই। আমরা সবাই সমান মানুষ।
প্রথম প্রকাশঃ ঠাহর (প্রথম সংখ্যা)