একজন রুপান্তরিত নারীর পথচলা

ন্যারেটিভ : আনিকা

আমি আনিকা। কিশোরী থেকে যেন ধীরে  ধীরে যৌবনে পদার্পণ করছি এবং নিজের ভিতরের এই বিবর্তনের সাক্ষী হয়ে থাকছি। নিজের দেহ, অস্তিত্ব অধিকার সম্পর্কে যতোই জানছি ততোই  বুঝতে পারছি আমি একটু একটু করে বড় হচ্ছি। আমার এই বড় হওয়াটা শুধুমাত্র বয়স কিংবা শারিরীক বৃদ্ধিই নয় বরং একজন নারী হিসেবে বেড়ে উঠা। ট্রান্সউইম্যান বা রুপান্তরিত নারী হিসেবে আত্নপ্রকাশের পর থেকেই সামাজিক, শারীরিক, মানসিক নির্জাতনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি। আত্নপ্রকাশের পর থেকেই প্রচুর জাজমেন্টের স্বিকার হয়েছি পরিবারের , ডাক্তার এবং এলজিবিটি কমিউমিটির মানুষদের কাছ থেকেও। 

শুরু থেকে নিজর অস্তিত্ব নিয়ে যে সংগ্রামে নেমেছি তা শেষ কবে জানিনা। তবে নিজের আইডিন্টিটি নিয়ে আমি শতভাগ নিশ্চিত ছিলাম এবং আছি। বাবা মা যখন জানতে পারলো তখন থেকেই মনোরোগ বিশেষজ্ঞের কাছে নিয়ে যেতে লাগলেন। সব মিলিয়ে আমি চারজন মনোরোগ চিকিৎসকের কাছে গিয়েছি। কারো কাছে আবার একাধিকবারও গিয়েছি। প্রত্যেকবারের ডাক্তারের কাছে যাওয়ার অভিজ্ঞতা নিয়ে বিস্তারে লেখা যাবে। মানুষ মনোরোগ চিকিৎসকের কাছে যায় মানসিক সমস্যা নিরাময় করতে কিন্তু এই চিকিৎসকেরা আমাকে দিন দিন মানসিক ভাবে অসুস্থ করে তুলেছিলো। আর তারা করবেই বা কী,  আমার তো কোন মানসিক সমস্যা নেই। আমি কেবল আমার আইডিন্টিটি সবাইকে জানিয়েছি এটা এমন না যে হুট করেই একদিন আমি মেয়ে হয়ে গেছি। আমি যখন থেকেই নিজেকে বুঝতে শিখেছি তখন থেকেই আমি নিজেকে একজন মেয়ে হিসাবে জেনে এসেছি৷ যতবার বাবা মা আমাকে মনোরোগ বিশেষজ্ঞের কাছে নিয়ে গেছে ততবারই আমি মানসিক ভাবে নির্যাতিত হয়েছি, তারা আমাকে মেয়েদের সাথে প্রেম করতে বলে, ছেলেদের সাথে মিশতে বারণ করে৷ আমার নাকি বয়স হলে সব ঠিক হয়ে যাবে। এমনকি আমাকে স্ট্রেইট পর্ণ দেখারও পরামর্শ দেওয়া হয়। আমার বাবা মায়ের সামনে আমার যৌনতা নিয়ে স্পর্শকাতর প্রশ্ন করতে থাকে।আমি কোন ছেলের সাথে ফিজিক্যাল যৌন সম্পর্কে জড়িয়েছি কিনা, এসব জিগেস করত। তারা এতবড় মনোরোগবিদ্যার ডাক্তার হয়েছে অথচ এতটুকু বোধ বা শিক্ষা তাদের মাঝে তৈরি হয়নি যে  ১৭-১৮ বছর বয়সের কিশোর বা কিশোরীর নূন্যতম প্রাইভেসির দরকার হতে পারে, এতে তারা আহত হতে পারে! শুধু মানসিক ভাবে বলছি কেন, তারা আমাকে শারীরিক ভাবেও অসুস্থ করে তোলে সবগুলো ডাক্তারই আমাকে ঘুমের ঔষুধ দিত, এমন কি ছেলেদের হরমোন বৃদ্ধি কারক ঔষুধও আমাকে খেতে দেওয়া হতো। এতে আমি ভীষণ অসুস্থ বোধ করতাম৷

আমার পরিবার শুধু আমাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে গিয়েই ক্ষান্ত ছিলো না এরপর হুজুরের কাছেও নিয়ে যাওয়া হলো, হুজুর আমাকে বঝানোর চেষ্টা করলো এগুলো শয়তানের ধোকা। আমাকে কোরানশরীফও স্পর্শ করানো হলো। এরপর যখন এলজিবিটি কমিউনিটির মানুষদের সাথে পরিচিত হতে লাগলাম তখন তারাও আমাকে বলতে শুরু করলো ছোট থাকতে নিজেকে এমন মেয়েদের মতো মনে হয় বয়স বাড়ার সাথে সাথে বদলাতে শুরু করে। আমি তাদেরকে বেঝাতে পারতাম না আমি সত্যিই কোন ছেলে নই আমি একজন মেয়ে। আমি একটা ভিন্ন শরীরে আটকে আছি৷ এবং চিরদিনই নিজেকে নারী হিসেবেই জেনে আসবো৷ সব মিলিয়ে আমার মানসিক অবস্থার চরম অবনতি হতে থাকে। একটা সময় আমি খুব আত্নহত্যা প্রবণ হয়ে গেলাম। ঠিক তখন কমিউনিটির একটা বড় ভাই একটা সংগঠনের কথা বললেন তারা নাকি ট্রান্সউইম্যানদের সাহায্য করে৷ আমি সেই সংগঠনে নিয়মিত যেতে থাকি এবং নিজের মতো আরো মানুষদের সাথে পরিচিত হতে থাকি। ঐ সংগঠনের এক ট্রান্সউইম্যান আপু আমাকে ভীষণ সাপোর্ট করে, তাকে দেখে আবার নিজের মধ্যে আশার সঞ্চার ঘটতে থাকে। 

সেখান থেকেই আমি ট্রান্সউইম্যান কমিউনিটির সাথে মিশতে শুরু করি, নানা ধরনের কাজ এবং প্রশিক্ষণের সাথে যুক্ত হতে থাকি। এই প্রথমবারের মতো যেন জীবনের মানে খুজে পেলাম। গতবছর এমনি এক প্রশিক্ষণে অংশগ্রহণ করি একটি এনজিও এর আয়োজনে। ১২ দিন সেই প্রশিক্ষণে ছিলাম৷ সেখানে একটা সেশন ছিলো ট্রান্সউইম্যান এবং ফেমিনিজমের উপর। ঐদিন সবার সামনে আমি নিজেকে পরিচিত করি একজন ট্রান্সউইম্যান হিসেবে, চেহারায় ছেলেদের মতো হলেও আমি অন্তরে একজন নারী। সেদিনের ঐ সেশনটাতে একজন নারী ছিলো খানিকটা ধার্মিক ধরনের তিনি কিছুতেই মনে নিতে পারছিলেন না আমি একজন নারী। এরপর আমাকে একা পেলেই ঐ মহিলা জেরা করতে শুরু করে, আমি কেন ছেলে হয়ে নিজেকে মেয়ে বলছি, আমি কেন এই পাপ কাজ করছি, এমন কি তিনি আমাকে হাদিসের ব্যাখ্যা দিয়েও জানাতেন যে এটা পাপ। আল্লাহ যাকে যেভাবে বানিয়েছে তাকে সেভাবেই থাকা উচিত। কিন্তু আমি যখন তার কথার প্রতিবাদ করার শুরু করি তিনি আরো উগ্র হয়ে ওঠেন আমাকে বলেন যে আমাকে হত্যা করা জায়েজ। তখন আমি ভয় পেয়ে সংশ্লিষ্ট কতৃপক্ষকে জানাই। এবং তারা ঐ মহিলাকে বের করে দেন।  

 আমি মনে করি এই পুরুষতান্ত্রিক সমাজই আমাকে এত সমস্যার মুখোমুখি করে তুলছে৷ সবশেষে এইটুকুই বলতে চাই পুরুষতান্ত্রিক সমাজ দ্বারা তাড়িত পরিবার, ধর্ম, চিকিৎসক কেউই নারী বা রুপান্তরিত নারীদের জন্য নিরাপদ নয়। 

প্রথম প্রকাশঃ ঠাহর (প্রথম সংখ্যা)

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.