
লিখেছেন হ্যামিলনের হাসিওয়ালা
১।
—— Our school is a two stories…
——-storeyed.
—— Our school is a two storeyed building. It has a nice…
——playground!
——playground. Our headmaster এর নাম is মকবুল হোসেন আহমেদ। he is a very good man. He is not a bad man. Our school is a good school. Our school not a bad school…আমমম..
মহা মুশকিল! দু’সপ্তাহেও যদি একটা প্যারাগ্রাফ শিখতে না পারে, বাকী সিলেবাস শেষ হবে কবে? আজ বাদে কাল পরীক্ষা।আদরে বাঁদর করা মা বাবার বিকার নেই। যেন টিউশনে দিয়েই উদ্ধার। রেজাল্ট খারাপ হলে সব দোষ টিউশন মাষ্টারের। শরীরকিড়মিড় করছে রাগে। তখনই গেল কারেন্টটা। ছাত্রের খুশি দেখে কে! ছাত্রের মা-কে প্রচ্ছন্ন হুমকি দিয়ে বললাম কালকেপ্যারাগ্রাফটা শেষ না করতে পারলে আমি পড়শু থেকে আসব না।
——- কী বল রুমেল! আমি ওকে চ্যালা কাঠ দিয়ে পেটাব। কাল সব পড়া শেষ করে রাখবে। তুমি চিন্তা করো না।
এ কথা গত তিনমাস ধরে শুনছি। গ্যাসের চুলায় রান্না করে চ্যালা কাঠ জোগাড় করবেন কোত্থেকে তা বোঝার আশা জলাঞ্জলিদিয়ে বের হলাম বাড়ির উদ্দেশ্যে। এমনিতেও আমি মারের পক্ষে না। তাই বলে দুটো গাট্টা কি দেয়া যায় না?
লোডশেডিংয়ে পুরো মফস্বল ডুবে গেছে অন্ধকারে। নিত্যদিনকার ঘটনা। টিউশন শেষে মেজাজ খারাপ হওয়াটাও নিত্য দিনের।পনের’শ টাকা মাইনের দুই ঘন্টার টিউশনি আমার ‘হাই টেম্পারড’ মেজাজের জন্য দুষ্কর হলেও ছেড়ে দেওয়ার ফলাফল মোটেওসুখকর হবে না। একজন গ্র্যাজুয়েট তরুণ তার বাবা আর ভাইদের কাছে হাত পাতছে, দৃশ্যটি কেমন বিদঘুটে। ধোপাবাড়ি মোড়েরদুটো গরম জিলাপী পেটে গেলে ওসব দু:খ বেমালুম ভুলে যাই।
——রুমেল, বাড়ি ফিরছিস?
মেঝ ভাইয়ার সাথে দেখা। অনার্সের মাঝপথে ‘ছাত্রনং অধ্যয়নং তপ:’র ভরাডুবি। কমপ্লিট বাউন্ডুলে। নরেশের দোকানে ক্যারামখেলতে যাচ্ছে নিশ্চয়।
——এক শিশি কেরোসিন নিয়ে যাস তো। আজকে কারেন্ট আসতে দেরী হবে।
মুখে জিলাপী ঠেসে নির্বিকার ভঙ্গিতে জিজ্ঞেস করলাম,
——-দেরী হবে কেন? কারেন্টও কি ক্যারাম খেলতে গেছে সারারাতের জন্য?
খোঁচাটা বিলকুল গায়ে না মেখে গর্বিত বাউন্ডুলে জানালেন মেইন গ্রিডে সমস্যা। ঠিক করার প্রচেষ্টা চলছে। এমনভাবে বললেনযেন লোকজন তার আন্ডারে কাজ করে। তিনি হলেন পিডিবির মহা পরিচালক।
তবে ঘটনা যে সত্যি পরিবেশ দেখে আন্দাজ করতে পারছি। সারা শহর নেমে এসেছে রাস্তায়। ছেলে বুড়ো নির্বিশেষে আয়োজনকরে লোডশেডিং উপভোগে ব্যস্ত। অন্যদিনের মত বিরক্তি নেই কারোর। তার কারণ হল তারাময় আকাশে ফ্লাডলাইটের মতঝলমল করছে হৈমন্তি চাঁদ। সবাই আজ সোমপায়ী। সৌভাগ্যবশত ‘মনুষ্য সৃষ্ট লোডশেডিং’ দৈব সৃষ্ট পনেরো দিনেরলোডশেডিংয়ে পড়ে নি। তিথির গড়মিল হলে ঝামেলা বেঁধে যেত।
২।
কেরোসিন নিব সঙ্গে বোতল আনি নি। অগত্যা পলিথিন ব্যাগে করে নিতে হচ্ছে। জিলাপীর গন্ধ ছাপিয়ে আমার হাতকেরোসিনের গন্ধে সয়লাব। ভাতের মাড় দিয়ে জোড়া লাগানো পকেটের একমাত্র কুড়ি টাকার নোটটা খুব সহজে ‘বাহক বদল’ করানো গেল। ছোটবেলায় সাইকেল ভাড়া দেওয়ার নাম করে দোকানদার আমার দুই টাকা মেরে দিয়ে বলে আমি নাকি টাকা দেইনি। বলাবাহুল্য তার লোক ঠকানোর অভ্যাসটা এখনো যায় নি। এতদিন পর ছোট্ট প্রতিশোধে বড় আত্মতৃপ্তি পেলাম।
অসীমের সাথে দেখা করা দরকার। শংকরের ‘চৌরঙ্গী’টা ফেরত নিতে হবে। সবারই একটা বই ‘ধার’ নেওয়া বন্ধু থাকে যে নিজথেকে বই ফেরত দেওয়ার মননে থাকে না। অসীমের আবার টাকা ধার চাওয়ারও বাতিক রয়েছে। তাকে বই ধার দেওয়ার এটাঅন্যতম কারণ। লোন ম্যাটেরিয়াল ভিন্ন হলে সুবিধা আছে।একজনের কাছে দুটো জিনিস ধার চাইতে মানুষ লজ্জাবোধ করে।
——কি রে? পড়ছিস?
ওর রুমের স্টিলের জানালাটা খোলাই ছিল।
——-আমাকে হ্যারিকেনের আলোতে পড়তে দেখেছিস কখনো?
——-কিছু লিখছিলি। তাই জিজ্ঞেস করলাম।
——-তিতাস গ্যাসে একটা সার্কুলার ছেড়েছে। দরখাস্ত লিখছি। তুই তো করবি না। সম্রাট শাহজাহানের ছেলে কি তৃতীয় শ্রেণীরচাকুরি করে!
আমি শাহজাহানের বংশধর না। আবার কাঙাল ঘরেও জন্ম না। চাকুরির শ্রেনীর বিষয়টি গায়ে মাখাতাম না যদি গ্র্যাজুয়েট নাহতাম। ‘মোলক্যিউলার অরবিটাল থিউরী’র কাটাছেঁড়া করে সরকারী বিল্ডিংয়ের ফ্লোর ঝাড়ু/মোছা দেওয়ার মন মানসিকতাএখনো তৈরী হয় নি; আদৌ হবে কিনা জানি না।
——-পোস্ট অফিস গেছিলি?
——-হুম।
অসীম আবার দরখাস্ত লেখায় মনযোগ দেয়।
——-দুটো রেভেনিউ স্ট্যাম্প আনতে বলেছিলাম।
——-এই যে।
গ্রিলের ফাঁক গলে দুই আঙুলে এগিয়ে দিয়ে বলে,
——-পাভেলদের ম্যাচ আছে পড়শু। তোকে খেলতে বলেছে।
খেলাধুলার জন্য ম্যুড লাগে। একটা বয়স লাগে। ইউনিভার্সিটি থেকে বের হবার পর নিজেকে জোরপূর্বক ম্যাচিউর ভাবা শুরুকরেছি। অসীমকে ‘দেখি’ বলে চলে এলাম।
বাড়ির রাস্তায় উঠে মনে পড়ল বইটাই নেওয়া হয় নি।
জমিদার আমলের পুরনো একতলা বাড়িটির দূর থেকে ভেসে আসছে একদল তরুণ-তরুণীর উচ্ছ্বসিত কন্ঠ। ছাদে দল পাকিয়েগান গাচ্ছে। তাদের মধ্যে একজন বলল,
“এখন এমন একটা গান গাইতে হবে, যেটাতে সংখ্যা রয়েছে।”
কে যেন মাধুরী দীক্ষিতের গান ধরল,
“এক দো তিন চার পাঁচ ছে সাত আট ন…”
“এ্যাই না না, হিন্দী গান চলবে না। নো বিদেশী গান।”
“তোতা পাখির মত সারাদিন শাহরুখ খানের গান বিলাপ করিস, তখন এ কথা মনে থাকে না? শালা ডাবল স্ট্যান্ডার্ড।”
লেগে গেল তর্কাতর্কি। আমি নিচে দাঁড়িয়ে গলা ছেড়ে গান ধরলাম,
“আমি ১২ মাস তোমায় ভালোবাসি
তুমি সুযোগ পাইলে বন্ধু বাসিও।”
রেলিংয়ের দিকে দৌড়ে আসা আবছা আলোতে প্রথম মুখটাই ছিল পলার। যেরকমটা আশা করেছিলাম।
——রুমেল! মুহিতকে পাঠিয়েছিলাম তোদের বাসায়। কোথায় ছিলি এতক্ষণ? উপরে আয় জলদি। আজ সারারাত আড্ডামারব।
——কীরে শালা! থাকিস কই আজকাল।
মুহিত এসে বলে।
আমি ঘাড় বাঁকা করে উপরে তাকিয়ে বললাম,
——-পড়াতে গেছিলাম। সন্ধ্যায় টিউশনি থাকে জানিস না মনে হয়?
——-এখনও সন্ধ্যা আছে? বাজে তো রাত ন’টা।
পলা ঈষৎ রাগান্বিত স্বরে বলে।
——-আচ্ছা আসছি। বাজারটা রেখে আসি।
ব্যস্ত রাস্তায় চেঁচিয়ে ‘কেরোসিন রেখে আসি’ বলার সাহস হয় নি।
পলা কি আজ পুরো ডিপার্টমেন্ট তুলে এনেছে ছাদে? ওর বাবা-মা অবশ্য আধুনিক মনের। একমাত্র সন্তানের উপর আস্থা অনেক।বেশ বুদ্ধিমত্তাসম্পন্না। চাচী তো সেদিন সরাসরি বলে ফেলেছে পলা আমাকে পছন্দ করে। তাদেরও কোনো আপত্তি নেই। কিলজ্জায় পড়ে গেছিলাম। বিব্রত অবস্থা কাটিয়ে কোনোরকম পালিয়েছিলাম। একজন দুজন করে বন্ধু মহলে প্রায় সবাই ধরেনিয়েছে চাকুরি হলেই আমার সাথে পলার বিয়ে।
৩।
বাসায় ঢুকলাম তাড়াহুড়ো করে। মাঝঘরে শুধু একটা হ্যারিকেন জ্বলছে। ভাবী কিছু একটা নিয়ে চেঁচামেচি করছে। সম্ভবত তেলনেই দেখে। ছোটখাট বিষয় নিয়ে ভাবীর তুমুল হৈচৈ করার বাতিক রয়েছে। অবশ্য এই একটা মানুষ চেঁচায় বলেই বাড়িতে মানুষআছে বলে বোঝা যায়। বাকী সবাই শান্ত। তিন বছরের ভাতিজিটাও হয়েছে বাপ চাচাদের মত। আব্বা রাশভারী হলেও প্রয়োজনীয়কথা ছাড়া অন্য আলাপচারিতায় তিনি থাকেন না। ভাগ্যগুণে মাঝঘরে ঢুকেই আম্মাকে পেয়ে গেলাম।
——-ভাত দাও আম্মা। বের হব এক্ষুণি। ফিরতে দেরী হবে।
——-দেরী হবে মানে? এখনই তো বাজে ন’টা। তুমিও কি হিমেলের পথ ধরেছ?
অন্ধকার থেকে ভেসে এল আব্বার দরাজ কন্ঠ। একদমই খেয়াল করি নি।স্বভাবসুলভ রেডিওটা হাতে নিয়ে আর্মচেয়ারে বসেআছেন। বাজছে না। রিট্যায়ারমেন্টের পর এ দুটো জিনিস আব্বার সকাল সন্ধ্যার সঙ্গী।
——-দেখ তো রেডিওটার কি হল। নতুন ব্যাটারী লাগিয়েছি। তাও প্লে হচ্ছে না কেন?
আমি রেডিওটা এপাশ-ওপাশ ঘুরিয়ে দেখে বললাম,
——-আব্বা একটা মেকানিকের কাছে নিয়ে গেলে ভাল হয়। আমি কাল ঠিক করিয়ে আনব।
——-মেকানিকই যখন লাগবে তুমি কেন ইঞ্জিনিয়ার হয়েছ? ওসব পড়শুনা করে আদৌ লাভ হয়েছে কোনো?
বলতে ইচ্ছে করছিল “আব্বা আমি ইঞ্জিনিয়ার না। মাস্টার্স কম্প্লিট হলে বড়জোড় কেমিস্ট বলতে পারেন।” পারি নি শুধরে দিতে।বয়সের ভারে আমার আদর্শবান বাবা প্রায়ই অনেক কিছু ভুলে যান। এই যে কিছুক্ষণ আগে ফিরতে দেরী হবে শুনে আমাকেশাসালেন, একটু পর আর খেয়াল থাকবে না আমি বাসায় আছি কি নেই। তাঁর খুব ইচ্ছা তিন ছেলের একজন প্রকৌশলী হবে।দুর্ভাগ্যবশত কেউই হই নি। সেই আক্ষেপ থেকে হয়ত তাঁর বয়স্ক মন গেঁথে নিয়েছে আমি ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে পড়ি। উত্তর না দিয়েচুপচাপ হাত-মুখ ধুতে চলে গেলাম।
আম্মার চেহারাটা কেমন শুষ্ক হয়ে আছে।
——-ভাবী কি নিয়ে চেঁচামেচি করছে আম্মা?
আম্মা প্লেটে মাছের ভাজিটা নি:শব্দে তুলে দিলেন। কোনো কথা বলেন নি।
——টাকা চেয়েছিলে?
আমি আবার জিজ্ঞেস করলাম।
——দুধওয়ালার ৪৫০টাকা বাকী পড়ে আছে।
আম্মা অন্যদিকে তাকিয়ে বললেন।
——-মাসকাবারারের টাকার বাইরে ভাবী এক টাকাও দিবে না। তা জেনেও কেন টাকা চাইতে যাও?
আম্মা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন।
——-আর চাইব না।
তখুনি ভাবী বের হলেন রুম থেকে। হাতে কিছু শপিং ব্যাগ। ধরাম্ করে ডাইনিং টেবিলের উপর রাখলেন।
——-মা, বিকেলে পান্নাদের বাসা থেকে ফেরার পথে শপিংয়ে গিয়েছিলাম। ঐ যে শ্যামপাড়ার নতুন মার্কেটটায়! দেখুন আপনারজন্য একটা পিতলের গেলাস এনেছি। কাগমারীর বিখ্যাত কাঁসা। জামবাটিটার নাম ‘সরফুলি’। সুন্দর না?
আম্মা সংক্ষেপে বললেন,
——-সুন্দর।
——-বাবার জন্য একটা চাদর কিনেছি। শীত তো প্রায় চলেই এল।
ভাবী ব্যাতিব্যস্ত হয়ে তাঁর ঝুলি থেকে আরো কিছু বের করছেন। আমি খেতে খেতে আড়চোখে দেখছি।
——-কার্ডিগানটা হিমেল ভাইয়ের হবু বৌয়ের জন্য। দেখুন কী দারুণ জরির কাজ করা।
আমি ফিক করে হেসে ফেললাম। পাত্রীর নামে খবর নাই, হবু বৌয়ের জন্য কার্ডিগান কেনা হয়ে গেছে।
———আরে হাসির কি হল? আজ নাহয় কাল মেয়ে তো পাব না কি। তুমি খাওয়া শেষ করে এন্টেনাটা ঘুরিয়ে দাও, ‘বন্ধন’টাশুরু হল বলে। চুড়িগুলো কোথায় রেখেছি আবার?
——-ভাবী, এত কিছু কিনেছো, টিভিটার জন্য একটা বড় ব্যাটারি কিনতে পারলে না?
আমি বেসিনে হাত ধুতে ধুতে বললাম।
———একি! কারেন্টই তো নেই! দেখেছ? এক বাড়িতে থেকে থেকে বাবার রোগ পেয়ে গেছি।
আপনমনে আরো কিসব বকবক করতে করতে নিজের রুমে চলে গেলেন।
আম্মার আঁচলে হাত মুছতে মুছতে বললাম,
———একটা জিনিস এনেছ বড় ভাইয়ার জন্যে।
বের হতে যাব তখনই ভাবী আবার হন্তদন্ত হয়ে বেরিয়ে এলেন।
——-এ্যাই রুমেল, চুড়ি খুঁজে পেয়েছি। এগুলো পলাকে দিও। তোমার হাতে পেলে খুশি হবে।
——-ভাবী! মুখে কিছু আটকায় না নাকি?
কন্ঠে বিরক্ত ভাব।লজ্জা লজ্জা চোখে আম্মার দিকে তাকালাম। আম্মা না শোনার ভান করে রান্নাঘরে চলে গেলেন।
——-আহা ভুল কি বললাম। দেখ এক ডজন মাত্র বিশ টাকা। কত সস্তায় পেয়েছি।
——ভাবী দোহাই লাগে। এগুলো তুমি নিজের হাতে দিও। পলার হাত ধরে একটা একটা করে পরিয়ে দিও। আমাকে নিতে বলোনা প্লিজ!
বহু অনুনয় বিনয় করে ভাবীকে মানাতে পারলাম। একটা অদ্ভুত মানুষের সাথে বাস করি আমরা। ‘লাখে এক’ কথাটার সৃষ্টিহয়েছে ভাবীর জন্য। তবে আমার গোবেচারা ভাই এমন খাঁটি মনের বউ পেয়েছে এটা শুধু তাঁর না, আমার পুরো পরিবারের ভাগ্য।টাকা পয়সার ব্যাপারে তিনি ভীষণ সাবধানী, কিন্তু খরচের ব্যাপারে উল্টো। এমনিতে নগদ এক টাকাও খসানো যাবে না। অথচসংসারের যাবতীয় প্রয়োজনীয়/অপ্রয়োজনীয় কেনাকাটার দায়িত্ব তাঁর । ছোট বিষয়ে উত্তেজিত হওয়া রোজকার ধরণ। আবারকিছুক্ষণের মধ্যে ঠান্ডা হতেও সময় লাগে না। দুধওয়ালার বাকী টাকা আম্মার হাতে দিবে না, দেখা যাবে কাল নিজেই পরিশোধকরেছেন।
পলাদের ছাদে কেউ গান গাচ্ছে না এখন। জম্পেশ আড্ডা চলছে। পলার খিলখিল হাসির শব্দে ঝনঝন করছে পুরো বাড়ি।আমি উপরে তাকিয়ে নি:শব্দে হাঁটছি। গেটের কাছাকাছি এসে দ্রুত পা চালালাম। বাঁক নিয়ে চলে গেলাম পরের গলিতে। হোল্ডিংনং ৭৭৩ এর হাফ বিল্ডিং বাড়িটির মেইন গেট ধরে ঢুকলাম। ভেতর থেকে অশ্লীল গালি গালাজ ভেসে আসছে। বিপাকে পড়েগেলাম। ফিরে যাব তাহলে? দুনোমনা করে বাইরের দিকে পা বাড়াতে যাব, ঠিক ঐ মুহূর্তে অন্দর গেট খোলার শব্দ শুনতে পেলাম।একটা লম্বা ছায়ামূর্তি এগিয়ে আসছে আমার দিকে। এলোমেলো ঝাঁকড়া চুলগুলো আঁধারেও স্পষ্ট বোঝা যায়। বাইরে যাবারউদ্দেশ্যে আমার হাত ধরে শুধু বলল,
——-চলো।
৪।
——-বাইরে এসেই ছেড়ে দিলি কেন হাতটা?
——-অস্বস্তি হচ্ছে।
——-বল এলার্জি হচ্ছে।
——-বাজে বক না রুমেল ভাই। ভাল লাগছেনা। কোথাও নিয়ে যাও আমাকে।
——-কবরস্থানে যাবি?
——-জ্যান্ত পুঁতে ফেলতে চাও?
——-তোকে জ্যান্ত পুঁততে গেলে যে বাকীরা জেগে যাবে! বরং জিন্দা দেখলে কেউ উঠে আসার সাহস পাবে না।
অলি ফিক করে হেসে ফেলল। আমি জানি এ হাসি প্রথম পক্ষের চাঁদের মত আস্তে আস্তে চওড়া হবে ঠোঁটে। রূপালী আলোয় এইমোহময় চমৎকার হাসিটির সৃষ্টি করাতে পেরে গর্বিত বোধ করছি। এই মুহুর্তে ওর টোল ভাঙা গালের গভীরতায় রোম্যানিয়ানজিপসিদের মত বারবার হারিয়ে যেতে চাওয়া আমার অপরাধ হতে পারে না মোটেও। বরং পৃথিবীর সব মায়া একজনকে ঢেলেদেওয়া প্রকৃতির অপরাধ। ঘোর অপরাধ। অথচ শাস্তি পাচ্ছি কিনা আমি।
——-অলি শোন, তুই যেতে চাইবি না। আমি জোর করে তোকে টানতে টানতে নিয়ে যাব। ঠিকাছে?
——-হাত ধরার বাহানা। তাই তো?
——-এক্সাক্টলি।
——-টানতে হবে না। পাশাপাশি হাঁটো। হাত ধরলেও অন্ধকারে কেউ বুঝবে না।
আমি এক লাফে অলির কাছে চলে আসি। এখন হাত ধরতে নিজেরই লজ্জা লাগছে। হাতের সাথে হাত স্পর্শ পাচ্ছে শুধু। অলিবুঝতে পেরে নিজে থেকে মুঠি মেরে ধরল। দুজনের মুখে স্মিত হাসি। অনেকক্ষণ কেউ কোনো কথা বলি নি। অনেকটা পথহেঁটেছি। হাইওয়েতে উঠে একটা রিকশা নিলাম। শুধু হাত না, শরীরের সাথে শরীর লেগে আছে এখন।
৫।
বহুদিন পর একসাথে রিকশায় চড়েছি। শেষবার উঠেছিলাম মাস ছয়েক আগে। অলির ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষার প্রথম দিন। ওরবাবা মা অফিসে ছুটি পায় নি। মনে মনে কী যে খুশি হয়েছিলাম। এডমিট পেপার, পেন্সিল বক্স, কাঠের স্কেল সব আমার উপরউজার করে দিয়ে সারা রাস্তা আঙুলের গিঁট ধরে দোয়া পড়তে পড়তে গেল। পুরনো ছাত্রের সুবাদে কলেজ প্রাঙ্গনে আমিও ঢুকেপড়েছি। পরীক্ষা শুরু হওয়ার বিশ মিনিট বাকী। সে হলে ঢুকছে না।
——-কী রে, এরকম করছিস কেন? যা ভেতরে!
——-দাঁড়াও না পাঁচ মিনিট।
——-নার্ভাস লাগছে?
——-নাহ্। বেল পড়ুক। সবার ঢোকা শেষ হলে আমি ঢুকব।
ওয়ার্নিং বেল পড়ল। একে একে সবাই ঢুকে গেছে। হঠাৎ আমাকে তাজ্জব করে দিয়ে পা ছুঁয়ে সালাম করে ভো দৌঁড় হলের দিকে।আমি হতভম্ব দাঁড়িয়ে আছি। সবার সামনে লজ্জা পাবে দেখে ঘন্টা পড়ার জন্য অপেক্ষা করছিল। বুড়ো জামগাছটার তলে একাএকা অনেক্ষণ হেসেছিলাম সেদিন।
মসৃণ পিচঢালা রাস্তায় রিকশা চলছে দুজনকে নিয়ে। নীরবতা ভেঙে বললাম,
——-তীর্থকের নতুন ক্যাসেটটা দিয়েছিলাম, শুনেছিস গানগুলো?
——-শুনেছি। ক্যাসেটের গায়ে লিরিক্সের পাতাটাও পেয়েছি।
——-কথাগুলো সুন্দর না?
অলি গান ধরে,
“তুমি বাসো কিনা তাও আমি জানি না
আমার কাজ আমি বন্ধু করিয়ারে যাব।
চিন্তা হতে আমি চিতানলে যাব..”
অলি গান থামিয়ে আমার দিকে তাকায়।
———কথাগুলো আন্ডারলাইন করা কেন?
আমি বললাম,
——-এমনি। গানে একটা প্রশ্ন ছিল কিনা। তাই হাইলাইট করেছি। তুই জানিস এর উত্তর?
অলি মুচকি হাসে। সামনে তাকায়। তারপর মুখ উদাস করে বলে,
——-মনে আছে একবার ধলেশ্বরী ঘুরতে গেছিলাম? কি নি:স্তব্ধ বিকেল। নদীর পাড়ে সারি সারি গাছপালা। কিছু কাশফুলওছিল। ছই তোলা নৌকায় আমি তুমি পাশাপাশি বসে দূরের মেঘগুলো দেখছি। পানিতে বৈঠার মৃদু শব্দ। একটা দুটো চিল উড়েযায় কার নাম ধরে ডেকে। কী অপার্থিব আবহ। যেন শূন্যতার অপর নাম। আমি জানি না তোমার প্রশ্নের উত্তর রুমেল ভাই। শুধুএটুকু জানি ওয়াকম্যানে যখন কোনো প্রিয় গান শুনি, আমার আখিঁপল্লবে দৃশ্যটি জ্বলজ্বল করে ভাসে। তখনও মনে হয় তুমিপাশে বসে আছ।
ভীষণ তৃষ্ণার্ত অনুভব করছি। একটা চুমুর জন্য হাহাকার করছে বুক। ওর কানের কাছে চুলে নাক ডুবাতে ইচ্ছে করছে। ব্যাকুলতাএকটু গন্ধ পাবার। পাঁজরের সাথে আষ্ঠেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরার আকাঙ্ক্ষা। লোভাতুর মন আমার।
৬।
চারিদিকে সুনশান নীরবতা। দূরে একটা অটো সার্ভিসের দোকান। তার পাশে টিমটিম আলোয় জ্বলছে একটা চায়ের টঙ।দোকানটি বেশ রাত অবধি খোলা থাকে। অটো সার্ভিসের সাথে একটা গ্যারেজও আছে। সিএনজি ড্রাইভাররা গাড়ি জমা রাখতেএলে এক কাপ চা না খেয়ে ঘরে ফেরে না। তার ঠিক একশো গজ দূরে হাইওয়ের পাশে সরকারী জমির উপর বিশাল কবরস্থানটি।ছোটবেলায় দাদু মারা যাবার সময় যখন এসেছিলাম, এতটাও বড় ছিল না তখন। বার্ষিক মৃত্যুর হার দিনদিন বাড়ছে তাহলে। যেহারে জনসংখ্যা বাড়ছে, মৃত্যুর অনুপাত ঠিকই আছে।
——-তোমার সাহস আছে রুমেল ভাই। সত্যি সত্যি একা এত রাতে চলে এলে?
——-দুজন মানুষ একা হয় কি করে? কত জোনাকি দেখেছিস? এরা আমাদের পাহারা দিবে। লিটল এ্যাডভেঞ্চার হয়ে থাকবেআজকের রাতটা।
——-আশ্চর্যের বিষয় হল, আমি একদমই ভয় পাচ্ছি না। নিজেকে প্রচন্ড স্বাধীন লাগছে।
অলি উঁচু নিচু মাটির ডিবি ধরে হাঁটছে। আমি পিছনে পিছনে। কবরস্থানের পাশে মাটির রাস্তাটার উপর বসলাম। একটু উঁচুহওয়াতে এখান থেকে পুরো এরিয়া-টা বোঝা যায়। রুপালী আগুনে সহস্র জোনাকি নক্ষত্রের মতন জ্বলছে। কুয়াশার ঘনত্ব ঠিকমেঘের মত। আকাশ তবে কোনটা? স্বাক্ষী দিবে কোন চন্দ্র? মাথার উপর শুকতারার সঙ্গীটি নাকি যে চাঁদ আমি আগলে রেখেবসে আছি?
——-রুমেল ভাই?
——-হুম।
——তুমি কি বোঝো আমি তোমার সাথে থাকলে অন্যরকম হয়ে যাই? কেমন উদ্বেলিত বাতাসের মত তরল।
——বুঝি।
——বোঝো না। ঠিক এই কারণে আমি আজকাল তোমার সাথে বাইরে বের হই না। আমার এ অদ্ভুত চঞ্চলতা লোকে না বুঝেফেলে। কৈফিয়তের শকুনের চাহনিকে কি ব্যাখ্যা দিব তুমি বলতে পারো?
——-শুরু হল তোর স্তবগান?
——-যে স্তবগান চিরন্তন সত্য। দূরের ঐ লুব্ধকের মত জ্বলন্ত।
এই একটা জায়গায় আমি চুপ হয়ে যাই। আমার শক্ত শরীরের কঠিন মনের দুর্বলতর স্থান। ব্লাডস্ট্রিমিং স্লো হয়ে যায়। বুকের বাপাশটা কেমন নিস্তেজ লাগে। কিছুক্ষণ চুপ থাকার পর অলি বলল,
——-আবৃত্তি আজকাল করই না মনে হয়।
——-সরাসরি বল কবিতা শুনতে চাস।
——-তুমি ভীষণ নির্লজ্জ।
——-কবে থেকে মনে হল? সে রাতে চুমু চাওয়ার পর?
——-ধ্যাৎ।
অলি রেগে যায়। রাগের উৎপত্তি লজ্জা থেকে। লজ্জা পেলে আগুনমাখা জোছনা বিস্ফোরিত হয়। ভ্রমর চোখ দুটো পারিজাতেরমত হাসে।
“চপল ভ্রমর, হে কালো কাজল আঁখি,
এখনো তোমার সময় আসিল না কি।
মোর রজনীর ভেঙেছে তিমিরবাঁধ
পাও নি কি সংবাদ।
এল যে আমার মন-বিলাবার বেলা,
খেলিব এবার সব-হারাবার খেলা,
যা-কিছু দেবার রাখিব না আর ঢাকি
হে কালো কাজল আঁখি।”
দুই চার লাইন রবীন্দ্রনাথ আওড়িয়ে আমার ভ্রমরের মুখে হাসি ফিরে পেলাম। নরম সুরে আমার কানের কাছে ঠোঁট এনে বলে,
——তুমি আমার প্রজাপতি হও?
——প্রজাপতি কেন, তুই ভ্রমর হলে ইউফ্রেটিসের তীরে আরেকটা ব্যাবিলন হতে পারি। উদ্যান জুড়ে থাকবে লক্ষ কোটিক্যামেলিয়া।
৭।
‘The moon shines brights is such a night as this, when the sweet wind did gently kiss the trees.’
মাধুকরী চাঁদের দিকে চেয়ে ‘মার্চেন্ট অফ ভেনিসে’র লরেন্সোর উক্তিটি মনে পড়ে গেল। পোড়া মবিলের অপরিচ্ছিন্ন গ্যারেজআর বেতের বেড়ার টঙ দোকানটি পোর্শিয়ার বাড়ির বাগানের চেয়েও আকর্ষণীয় লাগছে।
——-চাচা দুটো রঙ চা দিন, চিনি কম।
——-দুইটাতেই চিনি কম?
——-হ্যাঁ। আর দুটো গোল্ড লিফ।
——-দুইজনরেই গোল্ডলীফ?
হেসে ফেললাম। টঙের চাচা তো জানে না অভ্যাসগুলো চুম্বকের সাথে লোহার ঘর্ষণের ফল।
———এই যে তুই আমার সামনে সুরুৎ সুরুৎ করে চা খাস, আমার কতটা অসুবিধা হয় তুই জানিস?
অলি আস্তে করে বলে,
——-গরুর বাজার থেকে একটা লাগাম কিনে আনব তোমার জন্য।
——-মুখের জন্য লাগাম। তৃষ্ণার জন্য?
——-যে তৃষ্ণা সহসা আসে, সহসা চলে যায়?
——-তুই ‘চরিত্রহীন’ পড়েছিস? ওখানে বিধবা বৌটা বলে না, “যে তৃষ্ণায় মানুষ নর্দমার কালো জল অঞ্জলি ভরে পান করে, আমার হল সেই পিপাসা।” নিবারণ বড় কঠিন রে। খুব চেষ্টা করছি।
অলি দুষ্টুমি মাখা হাসি ছুঁড়ে দিয়ে বলে,
———ধীরে চল পথিক, ধৈর্যের ফল মিঠা হয় জানো না?
৮।
অলি সিগারেট ধরায়। জ্বলন্ত দিয়াশলাই এগিয়ে ধরে আমার ঠোঁটের কাছে। ধোয়া নি:সরণের মুহূর্তে ওর মাথা পেছনে কাঁত হয়।ঝাঁকড়া লম্বা চুলগুলো ঝুলে ঝুলে দোল খায়। কী তৃপ্তি ভরা টান! পুঁচকে ছেলেটা দেখতে দেখতে বড় হয়ে গেল। সিগারেট টানছেযে তালগাছ ন্যায় ছেলেটি, তাকে প্রথম দেখি পাড়ার দোকানে, ল্যাবেনচুষ কিনতে। আমি তখন ক্লাস নাইনে। টুথপেস্ট কিনতেগেছি। দোকানির খবর নাই। কে যেন আমার পাজামা ধরে টানছে। বিরক্ত হয়ে তাকিয়ে দেখি একটা গাট্টা-গোট্টা ৯/১০ বছরেরছেলে। রাজ্যের মায়া মুখে। সৌরজ্জ্বল দুটি চোখ। কেন মনে হচ্ছে আমি তাকে বহুকাল ধরে চিনি? কোথায় আমাদের সংযোগ? কেহও তুমি আমার? খুব স্পষ্ট গলায় বলল,
———ভাইয়া, একটু বয়ামটা খুলে দিবে?
সেদিন থেকে “বয়াম” খোলার দায়িত্ব আমার উপর ন্যস্ত হয়। ক্রিকেট খেলতে খেলতে নাকের নিচে গোঁফ জন্মায়। আমিইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হই। দুজন কোলাব্যাঙের মত এখানে ওখানে ঘুরে বেড়াই। হাঁটুর বয়সী ছেলের সাথে খাতির দেখেভাইয়াদের বকা খাই। গ্রাহ্য করার প্রয়োজন বোধ করি না যখন দেখি বাবা মার কুৎসিত ঝগড়ার প্রভাব অলির চোখে জোয়ারআনে। আমার প্রাণে কাঁপন ধরে। আমি আগলে রাখি নিজের কাছে।
——-তোমার একবার পলা আপাদের বাসায় যাওয়া উচিত। খুব হৈ হৈল্লোড় হচ্ছে। সবাই আছে। তুমি না গেলে খারাপ দেখায়।
——-তুই যাবি?
——-আমার পরিচয় কি সেখানে? তোমার ভ্রমর?
——-তখন তুই আমার হেফায়েশ্চান, আমি তোর আলেকজান্ডার। like Aristotle says, one soul abiding in two bodies.
——-সাররিয়েলিজম থেকে বের হও রুমেল ভাই। যখন একটু একলা হই, ছাদে যাই কিংবা পৌরনীতির বইটা খুলি, আমাদের এঅধিবাস্তব জগত মুহুর্তে তাসের ঘরের মত লুটিয়ে পড়ে।
———তাহলে পৌরনীতি পড়া বাদ দে।
———চোখ বন্ধ করে অন্ধ সাজতে বলছো?
অলি ভুল তো বলে নি। আলেকজান্ডার উপমা নেওয়া সহজ, সত্যিকারের যোদ্ধা হওয়া কি তত সোজা? পারব কি কখনো প্রতিকূলআবহাওয়ায় তরবারি উঁচিয়ে মুক্তির ঘোষণা দিতে? চারিদিক থেকে ছুঁড়ে মারা তীর বল্লমের খোঁচায় আমার লৌহবর্ম কতক্ষণ টিকেথাকবে? কাছের মানুষেরাই যে প্রতিপক্ষ আমার।
৯।
চাঁদটা ৯০ডিগ্রী কোণে সোজা মাথার উপর। চন্দ্রাহত জোছনায় রাজপথ ধরে হাঁটছি দুজন। চারিদিক হিম শীতল বাতাস।এরচেয়ে সুখের কি হতে পারে? আমার তো এ অল্পেতেই তুষ্টি। তাতেও ঈশ্বরের এত কার্পণ্য? তাঁর বিশাল বসুধায় লাখ কোটি ক্ষুদ্রব্রক্ষ্মান্ডে আমার নাম না যোগ হলে মনুষ্য অস্তিত্ব মুখে থুবড়ে পড়বে না নিশ্চয়। তবুও কেন এ জোড় জবরদস্তি? সত্তার সাথেসমাজের রেষারেষি?
পলাদের বাসার নিচে দাঁড়িয়ে।
উপরের অনেকেই দল ভেঙে গুচ্ছ গুচ্ছ হয়ে গল্প করছে। অনেককে রেলিং ঘেষে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখছি।
আমাদের দুজনের করতল জোড়া বেঁধে আছে এখনও। অলি আমার দিকে তাকায়। ভর দুপুরের দীঘির মত শান্ত চাহনি।
——-সকালে চট্টগ্রাম থেকে ছোট মামার চিঠি এসেছে।
অলি চুপ হয়ে যায়। চোখ ভিজে যায়। নিস্পন্দ্য হয়ে যাই আমি। জানি ভেজা চোখের মর্মার্থ। অলি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে সিলেক্টহয়েছে। কে যেন আমার বুকের খাঁজ চূর্ণ-বিচূর্ণ করে হৃদপিন্ডে পেরেক মারছে। কেমন অসহায় বোধ করছি। অথচ এখুনি তো যেতেহচ্ছে না তাকে। সকালেই হন্তদন্ত হয়ে আমার ঘরে ঢুকে বলবে, “আর কত ঘুমাবে কুম্ভকর্ণ?” তবে এমন কেন অনুভব হচ্ছে যেনএই রাতই শেষ রাত? চিরকালের জন্য শুকতারা হারিয়ে যাবে ভোরের আকাশে? দুজনের মাঝে হবে মহাকালের দুরত্ব? আবেগেরপ্লাবনে প্রাকার তোলার নিরন্তর চেষ্টা চালিয়েও ব্যর্থ হচ্ছি।
———আর…আর কিছুক্ষণ থাক না?
——-ব্যাটল অফ ইসাসের অবসান হল। হেফাশ্চিয়ান আলেকজান্ডারকে রোক্সানের কাছে অর্পণ করবে। হেফাশ্চিয়ান দূর থেকেদুফোটা চোখের জল ফেলবে। নোনা জলের প্রতিটি অণুর গায়ে থাকবে আলেকজান্ডারকে সুখে দেখার প্রার্থনা।
আমার চোখ ভরে উঠে। আমার চোখের জলে কোনো প্রার্থনা নেই। আছে এক ব্যর্থ প্রেমিকের আর্তনাদ। নৈশব্দিক হাহাকার।একটু গাল ছুঁয়ে দেখব অলির? বুকের ভেতর ধ্বংস প্রলয় কিছুটা কমবে কি তাতে? হঠাৎ চারপাশ আলোয় আলোয় ভরে উঠল।রাস্তার আবছা সোডিয়াম লাইট তীব্র হয়ে চোখে ঢুকলো। অলির মুষ্টিমেয় হাতটা ফট্ করে ছেড়ে দিলাম। আমার চোখে ভয়।অলির চোখে বিস্ময়। মুহূর্তে হেসে ফেলে। আমি জানি এ হাসি সাধারণ হাসি না। ছিল তিরষ্কার আর ভরসা ভঙ্গের কষ্ট। বিদায়নিয়ে চলে গেল প্রাণের ভ্রমর। ‘মধুর, তোমার শেষ যে না পাই প্রহর হল শেষ।’ প্রজাপতি উড়ে গেল বাহারি ফুলের মেলায়।যেখানে শুধু নেই প্রিয় ক্যামেলিয়া।