
লিখেছেনঃ ফ্লিন রাইডার
আমাদের প্রধান পরিচয়( আইডেন্টিটি) গুলির একটি হল আমাদের জেন্ডার আইডেন্টিটি বা লিঙ্গ পরিচয়। যেমন প্রচলিত সামাজিক নির্মাণ(সোশাল কন্সট্রাক্ট) অনুযায়ী আমি একজন প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষ, আপনি হয়তো নারী। মায়ের পেটে থাকতে বা জন্ম নেবার সাথে সাথেই যৌনাঙ্গ দেখে আমাদের জেন্ডার আইডেন্টিটি সমাজ নির্মাণ করে দেয়, এই ছেলে হইছে, ওর মেয়ে বাচ্চা হইছে। এরপরে যৌনাঙ্গ অনুযায়ী ভাগ করে কিছু চরিত্র, বৈশিষ্ট্য, প্রবণতার ভিত্তিতে দুটি জেন্ডার আইডেন্টিটির কঠোর সামাজিক চর্চা করানো হয়। ছেলেদেরকে পুরুষত্বের আর মেয়েদের নারীত্বের চর্চা করানো হয়। ছেলেদের চুল ছোট হবে, মেয়েদের চুল বড়। ছেলেরা পড়বে ছেলেদের পোশাক, মেয়েরা পড়বে মেয়েদের পোশাক। ছেলেদের গলার স্বর হবে ভারী আর মেয়েদের গলার স্বর হবে চিকন। এরকম বহু বদ্ধমূল ধারণা তৈরি করা হয়। সেই সমাজ নির্মিত ধারনার বাইরে অন্যকিছু দেখা গেলে অস্বাভাবিক আচরণ বা চরিত্র হিসাবে ধরা হয়।
কিন্তু যৌনাঙ্গ যাই হোক না কেন জৈবিক ভাবে যেকোন মানুষের মধ্যে পুরুষত্ব ও নারীত্ব কম বেশি দুটোই থাকে। যেমন- আমাদের সমাজনির্মিত পুরুষাঙ্গধারী ছেলেদের মাঝে অনেকেই আছেন, যাদের দেহ গঠনে এবং মানসিকতায় শিশুকাল থেকে মেয়েলি, গলার স্বর মেয়েলি, হাঁটলে কোমর দোলে মেয়েদের মতো। বয়ঃসন্ধি কালে এসে যখন আমাদের দেহে কাম-যৌন ক্ষমতা দেহে জন্ম নেয়, তখন অনেকের মাঝেই নারী সুলভ চরিত্র, বৈশিষ্ট্য, প্রবণতা প্রকট হতে থাকে। আবার অনেক পুরুষালি ছেলেও কিন্তু মাঝে মাঝে নারী সুলভ আচরন করে ফেলে।
এখানেই সেক্সিজমের সুত্রপাত। এই সময় আমাদেরকে লিঙ্গ বৈষম্য, জেন্ডার বৈষম্য করা হয় বিভিন্ন কুৎসিত মন্তব্য করে, আমাদের সক্ষমতাকে আঁটকে দিয়ে ।
আমাদের সমাজ হচ্ছে পুরুষতান্ত্রিক ,আমাদের ধর্মগুলি কট্টর পুরুষতান্ত্রিক। যেখানে পুরুষকে শ্রেষ্ঠ বা সুপিরিওর মনে করা হয়। নারীদের দুর্বল জেন্ডার হিসাবে বিবেচনা করা হয়, এবং আমাদের পরিবারে ,সমাজে, রাষ্ট্রে সবখানে তাদেরকে সে অবস্থায় আঁটকে রাখতে ক্রমাগত বিষাক্ত পুরুষতান্ত্রিক পলিটিক্স করা হয় । নারীদের কাপড় পড়বার সময় তাদের দেহ বিশেষ ভাবে ঢাকতে হয় পুরুষদের তুলনায়। ঘরের বাইরে যাওয়া থেকে, ঘোরাঘুরি, খেলাধুলা, পেশাগত জীবনে, উপাসনালয়ে ইত্যাদি সকল ক্ষেত্রে সব দিক দিয়ে নারীকে বৈষম্যের স্বীকার হতে হয়। এবং এটাই স্বাভাবিক হিসাবে দেখা হয়। একটা মেয়ে একা বাসার বাইরে যাবে কেন? তুমি মেয়ে, চাকরি করবা কেন? মেয়েদের এত পড়াশুনা করতে হয় না। মেয়ে মানুষ এত জোরে কথা বলে না। এভাবে ছোটবেলা থেকে মেয়েদের বড় করে তোলা হয়। মেয়েদের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ নিয়ে পুরুষরা কুৎসিত মন্তব্য করে, নারীদের যৌন জীবনকে নিয়ে করা হয় কটাক্ষ, দেয়া হয় গালি। কিন্তু পুরুষ সব দিক দিয়ে সুবিধাপ্রাপ্ত, পুংলিঙ্গের সব কিছুই ক্ষমতার নিদর্শন স্বরূপ, পুংলিঙ্গের তাই গালি হয় না, যেমন মেয়েরা সেক্স করলে তাকে বলা হয় মাগি, সেটা একটা গালি।কিন্তু ছেলেরা সেক্স করলে হয় মরদ, মরদ হওয়া অনেক জোশের ব্যাপার।
পুরুষদের চরম আধিপত্য বজায় রাখবার জন্য এগুলি হল পুরুষতান্ত্রিক সমাজের পলিটিক্স। যার প্রধান অস্ত্র সেক্সিজম।
তো এখন নারীত্ব তো চাইলেই চেপে রাখা যায় না। যখন তা প্রকাশ পায় তখন সেই সমাজে দ্বারা নির্মিত একজন ছেলে তার পুরুষত্ব নিয়ে আইডেন্টিটি ক্রাইসিস বা পরিচয় সংকটে পড়ে। অনেকেই তখন সেটা সামাল দিতে বিভিন্ন অসহনশীল উগ্র আচরণ করে নিজেকে পুরুষ বলে প্রমান করে।
কিন্তু প্রকৃতি প্রদত্ত মেয়েলি গলার স্বর তো চাপা দেয়া যায় না, হাটলে কোমরের দুলুনি তো ঠিক করা যায় না, কিংবা নিজের নারী সুলভ আচরণ,অঙ্গভঙ্গি তো এত সহজে চাপা দেয়া যায় না।
তখন পুরুষতান্ত্রিক সমাজ তাদের সমাজে জন্মানো সে সকল পুরুষাঙ্গধারীদের জীবন অতিষ্ট করে তোলে, পরিবার, বন্ধুবান্ধব, সমাজ সকলে তার প্রকাশিত নারীসত্ত্বাকে প্রবলভাবে আঘাত করে।
তুমি ছেলেদের মত হতে পারো না
এমনে হাটিস কেন? তুই কি হিজড়া?
ভাবী আপনার ছেলেকে এই ডাক্তারের কাছে নিয়ে যান, সেরে যাবে।
শোন, ছেলেটার সমস্যা আছে।
সাথে তাচ্ছিল্য, কুৎসিত মন্তব্য,আচরণগত বৈষম্য এসব তো চলেই।
বিষাক্ত পুরুষতান্ত্রিক রাজনীতি বা টক্সিক মাস্কুলিন পলিটিক্স এর শিকার ছেলেটি ক্রমাগত পরিচয় সংকটে ভুগতে থাকে। যা থেকে শুরু হয় অনেক মানসিক বেদনা।
আমি নিজেও আমার লম্বা চুল নিয়ে অনেক কথা শুনেছি, তুমি কি মেয়ে? এত বড় চুল রাখছ? ছিছি এত বড় চুল রাখতে হয় না ছেলেদের। তোর চেহারাটাই মেয়েদের মত হয়ে গেছে।
তুই ক্লিন শেভ করছিস কেন? তোকে মেয়েদের মত লাগতেছে।
তুই কানে ফুল দিছিস কেন? তোর কি কোন সমস্যা আছে বলতো?
তুই এভাবে হাত নাড়াস কেন মেয়েদের মত।
যারা নাচ করে তাদেরকে সোশাল মিডিয়ায় চলে অকথ্য ভাষায় আক্রমণ।
এইতো ৪-৫ মাস আগে তো একজনের ফেসবুক স্ট্যাটাস দেখলাম যে একজন মেয়েলি ছেলে গ্রামের লোকজনের এই বিষাক্ত পুরুষতান্ত্রিক রাজনীতির শিকার হয়ে আত্মহত্যা করেছে। আমি নিজেই এত বাঁধার মাঝে নিজের বড় চুল রাখার আর শক্তি পাই নি। যখন কিশোরকালে বয়ঃসন্ধির পরিবর্তন কালে আমার গলার স্বর হালকা ছিল বা মেয়েলি ছিল , তখন চারপাশের তির্যক মন্তব্য এখনো মনে পীড়া দেয়।
এভাবে অমানবিক ভাবে সেক্সিজম কেন করে, কারন তারা পুরুষ বলতে যা বুঝে সেই সামাজিক নির্মাণের মধ্যে আটকে রাখতে চায়।
এখন জেন্ডার আইডেন্টিটির আরেকটা দিকে আসি, রূপান্তরিত পুরুষ (ট্রান্সমেন-নারী হতে পুরুষ) আবার রূপান্তরিত নারী( ট্রান্স উইমেন-পুরুষ হতে নারী)
পারিবার সমাজ আমাদের দেশে অনেক সমাজ নির্মিত পুরুষ আছেন যাদের মধ্যে নারীসত্ত্বা প্রবল, তারা নারীদের মত শাড়ি পড়ে, নারীত্ব ধারন করে। তাদেরকে সমাজ নির্মিত পুরুষ বানাবার জন্য ধেয়ে পুরুষতান্ত্রিক সমাজের বিষাক্ত পুরুষতান্ত্রিক পলিটিক্স। পরিবার,সমাজ,ধর্ম সবখানে।
যেমন, আমার এক পরিচিত ট্রান্স উইমেনকে তার বাসায় সারাক্ষণ পর্যবেক্ষণে রাখে।
পরিচিত এক আইনজীবীর কাছের শুনেছি যে বাংলাদেশের ক্রসড্রেসার হবার কারনে তার পরিবার যখন তাকে মেরে রক্তাক্ত করে আঙ্গুল ভেঙ্গে দেয়, তখন সেই ছেলে আদালতের দারস্থ হয়, এবং সেটা নিয়ে আদালত পাড়াতেও আইনজীবী কটু কথার সম্মুখীন হন, একজন মেয়েলি ছেলের জন্য এই কেস কেন লড়ছেন? কি পরিমাণ পুরুষতান্ত্রিক সেক্সিজম বিদ্যমান প্রশাসনে চিন্তা করা যায় !!
আবার অনেক নারী আছে, তাদের মধ্যে পুরুষত্ব প্রবল,তারা চুল ছোট করে পুরুষত্ব ধারন করেন, ছেলেদের মত পোশাক পড়েন, তাদের ছেলদের মত দাড়ি ভাল লাগে তাই তারা শেভ করে দাড়ি উঠান। হাটা চলা ,কথা বলবার ধরণে পুরুষত্ব প্রকাশ প্রায় প্রবল ভাবে। কিন্তু হায়, তারা তো যোনি আর স্তন নিয়ে জন্মেছে, তাই তাদেরকে তো নারী হইতেই হবে, স্তন আর যোনি নিয়ে পুরুষের মত আচরণ করবে, পুরুষদের মত স্বাধীনতা ভোগ করবে!!! তা তো হইতে দিবে না পুরুষতান্ত্রিক সমাজ। সব দিক দিয়ে নেমে আসে বিষাক্ত পুরুষতান্ত্রিক পলিটিক্স।
এজন্য অনেক পুরুষালি টম বয় মেয়েরা জব পায় না, কাজের ক্ষেত্রে শিকার হতে হয় সেক্সিজমের।
কই নেই সেক্সিজম? পরিবারে, স্কুলে, কলেজে , কর্ম ক্ষেত্রে, পরিবারে, বিছানায়, সেক্সে, উপাসনালয়ে। যার প্রশ্রয় থেকে ঘটছে যৌন হয়রানি, ধর্ষণ, যৌন সন্ত্রাস এর মত ঘটনা
আমাদের সকল জেন্ডার আইডেন্টিটির সবচেয়ে বড় সমস্যা হল সেক্সিজমের জন্য জেন্ডার নিয়ে আইডেন্টিটি ক্রাইসিস।
প্রথম প্রকাশঃ ঠাহর (প্রথম সংখ্যা)