
লিখেছেন অরণ্য দেব
পশ্চিমের প্রাচ্য থেকে ইসলাম এ দেশে আসতে আসতে বারবার ঠোকর খেয়েছে কিছুটা কিন্তু কিছুটা দ্বন্দ্বে পড়ে গেছে এ দেশে এসেই। হাজার বছর ধরে চলা বাঙ্গালি সংস্কৃতির সাথে হয়ত কিছুটা সামঞ্জস্য করে নেবার চেষ্টা ছিলো। কিন্তু ১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গকালীন সময়ের রাজনৈতিক পট১ পরিবর্তনের কারনে সামাজিক এই দুই ধারার যে বিপরীতগামিতা শুরু হয়েছিল তা মাঝে হয়ত ’৭১ কালীন সময়ে আরেকটি মিথস্ক্রিয়ায় যেতো কিন্তু একাত্তর পরবর্তী নানা বৈশ্বিক ও অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক ও সামাজিক অস্থিরতায় সেটা হয় নি। দ্বিমেরুকরনের এই ব্যাপারটা হয়ত ভেতরে ভেতরে ছিলো, কিন্তু ২০১৩ সালের যুদ্ধাপরাধী বিচার আন্দোলনের সময় এই মেরুকরণের চূড়ান্ত রূপ দৃশ্যমান হয়।
মূল লেখার আগেই এতসব ঐতিহাসিক তথ্য দেবার কারন এই যে, শিরোনামে উল্লেখিত ‘বাঙালি-ইসলামী’ শব্দটি লেখা হয়েছে তা যে আদোতেই দুটি ভিন্ন ধারা নির্দেশ করে এবং সেটার যে একটা দীর্ঘ ঐতিহাসিক ভিত্তি আছে সেই জায়গাতে দৃষ্টি দেয়া। এছাড়া ৯০ ভাগ মুসলিমের এবং মোটামুটি শতভাগ বাঙালির দেশে সামাজিক পরিকাঠামো বোঝানোর ক্ষেত্রে এটি যে একটি মানদণ্ড হতে পারে সেটা বোঝানো।
তবে আমাদের এটা বোঝা জরুরি যে, বিপরীতগামী এই দুই সমাজ আসলে বাংলাদেশের সমাজ পরিবর্তনযোগ্য দুটি শ্রেণী নির্দেশ করে। একদল বাঙালি প্রগতিশীল সমাজ আর অন্যটি মৌলবাদী ইসলামিক সমাজ। এর কারন হল এই যে, এই দুই শ্রেণীই চলা-বলা-কৌশল দিয়ে বাংলাদেশের মানুষের চিন্তা-মনন পরিবর্তন করতে সক্ষম। আর এই দুই শ্রেণীর সহাবস্থানে মধ্যম যে সমাজ, তারা হয় সমাজ পরিবর্তনের মতন অতটা শক্তিশালী নন অথবা ঐ দুই শ্রেণীর সাথে দ্বন্দ্বে যেতে আগ্রহী নয়।
এবার এমন একটি সমাজে একজন সমকামী পুরুষের নারীভাবনা কেমন তা জানতে গেলে কোন পথে যেতে হবে? আসলে এ প্রসঙ্গে সরাসরি যাবার আগে আমাদের এটা জানা জরুরি যে, সমাজে প্রভাব বিস্তারকারী শ্রেণীগুলোতে নারী নিয়ে ভাবনা কেমন এবং একই সাথে এটাও জানা জরুরি যে সমাজটিতে সমকামী পুরুষটির অবস্থান কোথায়।
বস্তুত, আমাদের আলোচ্য দুই শ্রেণীই নারীদেরকে মর্যাদা, অধিকার, সম্মান ইত্যাদি দেবার কথা বললেও কোন শ্রেণীই ঠিক কি কি উপায়ে মর্যাদা দেয়া যাবে সেটা এখনো ঠিক করতে পারেনি। তাই রমনীয়-শৈল্পিক নারী রঙ ফর্সাকারী পণ্যের বিক্রি বাড়াতে গিয়ে নিজেই পণ্যে রূপান্তরিত হয়, অথবা পায়ের নীচের জান্নাত নিয়ে ঘোরা নারী হয়ে যায় তেঁতুলের চাটনী। সমাজ একই হলেও নারীর মর্যাদা দেবার ক্ষেত্রে তার নারীভাবনার বহুরূপ। নারীর প্রতি ভাবনার এতো রূপের মাঝে একজন সমকামী পুরুষ আসলে কোনটি বেছে নেন? নাকি তার নিজস্ব কোন ভাবনা আছে?
আসলে সামাজিকীকরণের নানা ধাপে নিজস্ব ভাবনা তখনই তৈরি হয় যখন সমাজে তার আলাদাভাবে নিজস্ব অবস্থান থাকে। এক্ষেত্রে আমাদের বাঙালি সমাজ হোক কিংবা ইসলামিক সমাজ, কোন সমাজই নারী ভাবনা কেমন হবে সেটা যেমন ঠিক করতে পারেনি, তেমনি সমাজে সমকামিতার অবস্থান কোথায় হবে সেটাও ঠিক করতে পারেননি। তবে ঠিক করতে পারে নি বলার চেয়ে এটা বলা ভালো যে, সমকামীদের যে অবস্থান দরকার অথবা আরো ভালোভাবে বললে, সমকামী বলেও যে সমাজে কেউ থাকতে পারেন সেটা স্বীকার করেনি। এখন পর্যন্ত বাঙালি বা ইসলামিক দুই শ্রেণীতেই সমকামিতা একটি ট্যাবু আকারেই আছে। তাই সমাজিক সংকটে থাকা সমকামী ব্যক্তিদের আলাদা করে নারী ভাবনা তৈরি করবার চাইতে সমাজের প্রচলিত নারীভাবনাকেই নিজের বলে ধার করবার প্রবণতাই একমাত্র উপায় বলে গণ্য হচ্ছে।
তবে এটা বলা বোধহয় ভুল হবে না যে, অন্য দুই শ্রেণীর পুরুষদের মাঝে নারী ভাবনার যে প্রকৃতি (যৌনতার দিক থেকে), একজন সমকামী পুরুষের নারীভবনায় সেটা লক্ষ্য করা যাবে না। বস্তুত, একজন সমকামী ব্যক্তি নারীদের নিয়ে কতটা ভাবেন সেটাও একটা প্রশ্নের বিষয়। যেটা থাকে সেটা হল সমাজে এবং সম্পর্কে নারী নিয়ে তার ব্যক্তিগত অবস্থান। সেই অবস্থানের ভিত পেতেই আসলে তাকে সমাজের অন্যান্য মতাদর্শের শরণাপন্ন হতে হয়।
কিন্তু সমস্যা হয়ে দাঁড়ায় যখন সমাজের মতাদর্শের সাথে ব্যক্তির মতাদর্শের দ্বন্দ্ব তৈরি হয়। সমাজে সেটার সমাধান হয় ব্যক্তির সামাজিকীকরণের মাধ্যমে অথবা সামাজিক কাঠামোর অন্য শ্রেণীতে উত্তরণ বা অবতরণের মাধ্যমে। যেহেতু সমকামিতা একটি জন্মগত আচরণ তাই একজন সমকামী ব্যক্তির পক্ষে ছেড়ে দেয়া সম্ভব হয় না। আর বাংলাদেশী সমাজের কোন অংশই সমকামিতাকে স্বীকার করে না বলে অন্য শ্রেণীতে নিজেকে উন্নীত করার মাধ্যমে কোন সমাধান আসে না।
মোটকথা হলো এই যে, সমাজে সমকামিতার কোন সামাজিক স্বীকৃতি না থাকায় আলাদা করে ভাবনা২ বা মতাদর্শ তৈরির হয় না এবং একই সাথে কোন কোন প্রচলিত ভাবনার ক্ষেত্রে যে দ্বন্দ্ব তৈরি হয় তার সামাজিক সমাধান হয় না।
কিন্তু প্রচলিত বাংলাদেশী সমাজে যে নারীর অবস্থান পরিষ্কার নয় সেটা আগেই বলা হয়েছে। কিন্তু তারপরও প্রচলিত সমাজেই নারীদের জন্য যে সকল বৈষম্যমূলক প্রথা প্রচলিত আছে সেগুলো নিয়ে কি সমকামী পুরুষদের কোন দ্বন্দ্ব তৈরি হয়? শুধুমাত্র নারীকেই সতীত্ব রক্ষার যে ভার এ সমাজ তাকে দেয় সেখানেই বা তার মত কি? নারীর স্বাধীনতা, অধিকার নিয়ে কি সমাজের বাইরেও আলাদা করে কোন ভাবনা আছে? সমাজের নারীভাবনা নিয়ে কি ব্যক্তি সমকামী পুরুষের দ্বন্দ্ব তৈরি হয়? যদি দ্বন্দ্ব না হয় তাহলে বুঝতে হবে যে সমকামী ব্যক্তিরা প্রচলিত নারীভাবনাতেই বিশ্বাস করেন।
এই সকল বিষয়ই আসলে বেশ ব্যক্তিগত এবং সামাজিক শিক্ষার উপর নির্ভরশীল। ঢালাওভাবে সমকামীদের নারীচিন্তা কি সেটা বলবার আগে বিষদভাবে গবেষণার প্রয়োজন। আমাদের দেশের মাদ্রাসাগুলোতে যে ধরনের সমকামীতার খবর পাওয়া যায় সেখানকার নারীভাবনার সাথে একজন সমকামী শিল্পচর্চাকারী ব্যক্তির নারীভাবনার মিল নাও থাকতে পারে। এর কারন হতে পারে যে এরা দুটি সামাজিক শ্রেণীতে বাস করেন, তারা সমাজটাকেই দুই ভাবে দেখেন।
এক্ষেত্রে আমরা যদি একজন ব্যক্তি সমকামী পুরুষকে বিবেচনা করে নেই তাহলে আমাদের নিজেদের বুঝে নিতে সুবিধা হবে। আমাদের সুবিধার জন্য ধরে নেই এই ব্যক্তিটি একজন শিক্ষিত-মধ্যবিত্ত শ্রেণীর প্রতিনিধিত্ব করেন এবং তার মাঝে বাঙালি ও ইসলামী দুই সমাজের মূল্যবোধই সমানভাবে কাজ করে। আর সর্বশেষ আমরা এটি ধরে নেই যে তিনি সমাজের অন্য সকলের কাছে সমকামী হিসেবে পরিচিত নন।
এমন একজন সমকামী পুরুষের কাছে পারিবারিক, সামাজিক বা রাজনৈতিকভাবে নারীর অবস্থান কিছুটা হলেও ভিন্ন এ কারনে যে নারীর সাথে তার কোন প্রচলিত দাম্পত্য সম্পর্কের চিন্তা করতে হয় না। নারীর সাথে তার সম্পর্ক অনেকটাই প্লাটনিক। ফলে নারীর প্রতি সামাজিক কর্তৃত্ব প্রকাশের সামাজিক চেষ্টা থেকে তিনি মুক্ত থাকতে পারেন। এর ফলশ্রুতিতেই ব্যক্তিটি পারিবারিক সম্পর্কগুলোকেও কিছুটা ভিন্নভাবে দেখতে পারেন। ফলে সামাজিকভাবে নারীর জন্য নির্ধারিত পারিবারিক কাজগুলো করতে সমকামী ব্যক্তিকে কম দ্বিধায় ভুগতে হয়। রান্না করা, ঘর পরিষ্কার রাখা বা জামাকাপড় পরিষ্কারের ক্ষেত্রেও হয়ত সমকামী পুরুষটি বেশি যুক্ত হন। আমাদের বাঙালি- মুসলিম সমাজের একটি প্রচলিত ধারনা হল পুরুষেরা সাংসারিক কাজ করা থেকে বিরত থাকবেন। কিন্তু যেহেতু সমকামী ব্যক্তিটির সমাজের ‘পুরুষ’ ধারণাটির সাথেই দ্বন্দ্ব তৈরি হয়। এই দ্বন্দ্ব তাকে কিভাবে প্রভাবিত করে, তার সাথে নারীভাবনার সম্পর্কটিই বা কি এই ব্যাপারে দীর্ঘ গবেষনা হওয়া প্রয়োজন।
তবে এটা ঠিক যে ‘নারী’র পরেই আসে ‘নারীসুলভ’। আমাদের বাঙালি-মুসলিম সমাজে শুধু নয়, বিশ্বের সবখানেই কিছু আচরণকে নারীসুলভ বলে আখ্যা দেয়া হয়। যদিও এর বিপরীতে পুরুষসুলভ আচরণ বলে কোন কিছু বাংলাদেশের সমাজে না থাকলেও এটা ঠিক যে, ঠিক কি কি করলে পৌরুষ প্রকাশ করা যায় সেটা নিয়ে সমাজের একটি ধারনা আছে। অনেক সমকামী ব্যক্তি নিজেই অনেক সময় নারীসুলভ আচরণ করেন। প্রচলিত সমাজের প্রভাবেই সমকামী ব্যক্তিটির সেটির প্রতি বিতৃষ্ণা তৈরি হয়, অন্তত প্রথম ক্ষেত্রে। এরপর বড় হবার প্রক্রিয়ায় এর সাথে তৈরি হয় দ্বন্দ্ব। মানে সমাজের নারী-পুরুষ এই ধারনাটির উপরই তার একটি দ্বিধা প্রকাশ পেতে থাকে।
এখন যদি ধরি আমাদের সমকামী ব্যক্তিটি নিজেই নারীসুলভ আচরণ করেন তাহলে প্রথম বয়সের এই বিতৃষ্ণা কেটে গিয়ে গ্রহণযোগ্যতা তৈরি হতে পারে। অথবা তিনি পুরুষের মতন আচরণের চেষ্টা করতে থাকতে পারেন। হয়ত তিনি পুরুষসুলভ আচরণের এই চেষ্টায় সফল হন। অথবা তিনি ব্যর্থ৩ হয়ে তার নিজের প্রতি ঘৃণা জন্ম নিতে পারে। তবে আমরা আশা করব যে তিনি যেমন সেভাবেই তিনি নিজেকে মেনে নেবেন।
এখন যদি চিন্তা করি যে, সমকামী ব্যক্তিটি আগে থেকে নারীসুলভ আচরণ না করেন তাহলে পুরুষের নারীসুলভ আচরণের প্রতি যে বিতৃষ্ণা সেটি ততক্ষণ পর্যন্ত থাকে যতক্ষণ পর্যন্ত না তিনি অন্য আরেকজন নারীসুলভ আচরণের পুরুষের কাছাকাছি এসে সামাজিকীকরণের সুযোগ পান।
তবে এর সম্পূর্ণ ভিন্ন জিনিস পাওয়া যাবে যদি আমরা দেখি যে, সমকামী ব্যক্তিটি অনেক বেশি মুসলীম মূল্যবোধ দ্বারা তাড়িত। মুসলিম সমাজে পুরুষের নারীসুলভ আচরণ নিষিদ্ধ। এমন পর্যায়ে তিনি নিজের নারীসুলভ আচরণ আড়াল করবার পাশাপাশি নারীসুলভ আচরণ প্রকাশ পায় এমন সকল কাজ যেমন নারীদের পোশাক পরা, গহনা পরা এমনকি রান্নাবান্না, ঘর গোছানোর মত পারিবারিক ব্যাপারগুলোও এড়িয়ে যেতে থাকেন।
তবে অনেক সমকামী পুরুষ আছেন যারা যৌনগতভাবে নারীসুলভ আচরণের প্রতি আকৃষ্ট হলেও মানসিকভাবে নারীসুলভ পুরুষদের পছন্দ করেন না। এটির থেকে স্পষ্টই বোঝা যায় যে, এটি সম্পূর্ণ ভাবেই সমাজের নারীসুলভ আচরণের প্রতি মনোভাবের ফলাফল। এর মানে হল, ঐ সমকামী ব্যক্তিটিকে সমাজ কিভাবে দেখছে সেটির একটি প্রভাব তার নারীভাবনার উপর পড়ে। অনেকের একটি প্রচলিত ধারনা হল যে সমকামী পুরুষেরা অনেক বেশী পরিবারকেন্দ্রিক বিষমকামী পুরুষের তুলনায়। এর বিপরীতে কোন বৈজ্ঞানিক ভিত্তি এখনো প্রতিষ্ঠিত না হলেও সমকামী পুরুষদের প্রতি বিষমকামী নারীদের আচরণ নিয়ে বেশ কিছু গবেষণা হয়েছে।
একটি গবেষণায় দেখা গেছে যে, বিষমকামী নারীরা বিষমকামী পুরুষদের তুলনায় বেশি সমকামী পুরুষদের প্রতি বেশি নির্ভরতা দেখান৪। কিন্তু বাঙালি সমাজে কে সমকামী আর কে বিষমকামী সেটির খোলাখুলি প্রকাশ না থাকায় এ ব্যাপারে তুলনামূলক আলোচনা অর্থহীন। তবে এরপরও দেখা যায় যে জ্ঞাত বা অজ্ঞাতে নারীরা সমকামী ব্যক্তিদের সাথে অনেক ব্যাপারেই খোলাখুলি আলোচনা করতে পারেন। এর কারন হয়ত এই যে, সমাজের বিষমকামী পুরুষদের (সকলের নয়) নারীদের দেখার দৃষ্টি৫ নারীদের জন্য খুব একটা প্রীতিকর নয়। সেখানে একজন সমকামী পুরুষ বন্ধুকে তারা অনেক বেশি আপন মনে করতে পারেন। যদিও নৈর্ব্যক্তিক গবেষণার জন্য আমাদের পশ্চিমের প্রতি একটি নির্ভরতা আছে কিন্তু বাস্তবিক দিক বিবেচনা করে এটি বলা যায় যে, একজন সমকামী পুরুষের নারীর মনের ভেতরকার কথা একজন বিষমকামী ব্যক্তির তুলনায় জানবার সুযোগ বেশি। একই সাথে এই সমাজে নারীর প্রতি বিভিন্ন বৈষম্যমূলক আচরণ কিংবা অধিকার না দেবার প্রবণতার সাথে নিজেকে বেশি যুক্ত করতে পারেন, বিষমকামী ব্যক্তির তুলনায় বেশি অনুধাবন করত পারেন।
ঠিক এই কারনেই সমাজের নারী অধিকার নিয়ে সচেতনতার প্রবণতা তার বেশি থাকে। সরাসরি যদি নাও থাকে, নারীর প্রতি সহিংসতা কিংবা অর্থনৈতিক মুক্তির আন্দোলনে একটি প্রচ্ছন্ন অংশগ্রহণ থাকে। যদিও এটাকে ঢালাও ভাবে বলা যাবে না, এখন অনেক বিষমকামী পুরুষও এ ব্যাপারে উদারতা দেখাচ্ছে। কিন্তু বাংলাদেশের সমাজে নারীকে সর্বসংহা হিসেবে দেখবার একটি প্রবণতা আছে, ব্যাপারটি এমন যে নারীরা চাকরী করুক কিন্তু বাড়ির সকল কাজ সামলে। এই প্রবণতা থেকে উদার বিষমকামী পুরুষেরাও উদারতা দেখাতে পারেননি এখনো। এই সকল ক্ষেত্রে আমাদের সমকামী পুরুষটি সামাজিকতার এই ধারা হতে মানসিকভাবে মুক্ত। তবে অনেক সমকামী ব্যক্তি এই সময়ে সামাজিকতা হিসেবে এই সকল ব্যাপার এড়িয়ে যান।
তবে এ সমস্যা একটু ঘনীভূত হতে পারে যদি সমকামী ব্যক্তিটি ইসলামিক মূল্যবোধকে প্রাধান্য দিতে চান। ইসলামিক মূল্যবোধে নারীর দ্বায়িত্ব-কর্তব্য, আচার-আচরণ নিয়ে যে সকল নির্দেশনা আছে সেগুলো তার সামনে চলে আসে। কিন্তু আমাদের এটাও মাথায় রাখা প্রয়োজন যে সমকামিতার এই ব্যাপারটাই ইসলামে স্বীকৃত নয় এবং এর প্রতি কঠোর বিধিনিষেধ এর পাশাপাশি শাস্তির উল্লেখ আছে। এমন অবস্থায় ইসলামের মূলভাবের সাথে আমাদের ব্যক্তির মানসিক সংঘর্ষ হয়। একজন বিষমকামী ব্যক্তি হয়ত এটিকে প্রকৃতিবিরুদ্ধ হিসেবে বিবেচনা করতে পারে। কিন্ত আমাদের সমকামী পুরুষ ব্যক্তিটি যেহেতু নিজেই নিজেকে সমকামী হিসেবে আবিষ্কার করেছেন, তাই ধর্মীয় দৃষ্টিকোণের সাথে নিজস্ব ভাবনার সংঘর্ষ শুরু হয়। এই অবস্থায় বাঙালি-ইসলামিক সমাজে নারীর অবস্থানও তার প্রশ্নের সম্মুখীন হয়ে পড়ে। পোশাক-পরিচ্ছদ, পরিবারের প্রতি কর্তব্য, বিবাহ বহির্ভূত যৌন সম্পর্ক ইত্যাদির ক্ষেত্রে আমাদের নারীর প্রতি যে একপেশে দৃষ্টিভঙ্গি পোষন করে সেটাকে আমাদের ব্যক্তিটির প্রশ্ন করবার চেষ্টা থাকে। সেই চেষ্টা থেকেই হয়ত তিনি আরো বেশি সংবেদনশীল হয়ে ওঠেন।
প্রচলিত সমাজ পুরুষের যে সংজ্ঞা দেয় সেই তুলনায় একজন সমকামী পুরুষের কাছে পুরুষের সংজ্ঞা অনেক ক্ষেত্রেই ভিন্ন। একই সাথে পুরুষের সংজ্ঞা ভিন্ন বলেই নারীর সংজ্ঞাও তার কাছে ভিন্ন। এই ভিন্নতার একটি ভাল দিকও আছে। ভিন্ন বলেই সমকামী পুরুষেরা এই সমাজকে একটি নতুন ভঙ্গিতে দেখবার সুযোগ পান।
১. ১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গ বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদের উত্থানের সময়। কিন্তু অনেক গবেষকই মনে করেন যে, পশ্চিমবঙ্গের জন্য এ কথা সত্য হলেও পূর্ববঙ্গে অনেকটা নিশ্চুপভাবেই শুরু হয় ইসলামী জাতীয়তাবাদের। ‘ইসলামী’ কথাটি শুনে এমন ধারনার কোন কারন নেই যে, এটি একটি নেতিবাচক সূচনা ছিল। ইসলাম পুঁজি করে নেতিবাচক ঘটনাগুলোর সূচনা হয় মূলত পেছনের ভূরাজনৈতিক কারনগুলোর কারনে সাম্প্রতিক সময়ে।
২. সমকামীদের আলাদা করে সামাজিক ভাবনা থাকা উচিত কিনা সেটা নিয়ে প্রশ্ন করা যেতে পারে। সমকামীরা যেহেতু সমাজচ্যূত নন এবং সেটা হতেও চান না। (বিশ্বায়নের যুগে বৈচিত্র্যই সম্পদ, আলাদা বলে সমাজচ্যুতি একটি মধ্যযুগীয় ধারনা) তাই সমকামীদের আলাদা সামাজিক কাঠামো তৈরি হবে না। তাই আলাদা সামাজিক ভাবনা (মুল্যবোধ) তৈরির সম্ভাবনা কম।
৩. এটাকে ব্যর্থতা হিসেবে চিহ্নিত করবার কোন দরকার আছে কি না এটা একটি বড় প্রশ্ন। একজন মানুষের সফলতা বা ব্যর্থতা পুরুষ বা নারীর মতন আচরণ করবার উপর নির্ভর করে না।
৪. Russell, E. M., Ickes, W., & Ta, V. P. (2018). Women Interact More Comfortably and Intimately With Gay Men. Psychological Science, 29(2), 288-303. doi:10.1177/0956797617733803
৫. সমকামী পুরুষেরা যে এক্ষেত্রে খুব শালীন আচরণ করেন সেটা নয় বরং কিছু কিছু ক্ষেত্রে পুরুষদের প্রতি দৃষ্টিও অপ্রীতিকর (যৌনহয়রানি) পর্যায়ে চলে যায়। বিষমকামী পুরুষেরা এ ব্যাপারটাতে অতো সচেতন নয় বলেই হয়ত দৃষ্টি এই প্রীতি-অপ্রীতির ব্যাপারটি ধরতে পারে না।
শিরোনামের ‘একজন’ শব্দটি লেখা এই কারনে যে, এই লেখার কথাগুলো সার্বজনীনভাবে সমকামী পুরুষ, বিষমকামী পুরুষ ও নারীদের ক্ষেত্রে খাটবে না। লেখাটি লেখকের ব্যক্তি মতামত এবং নিজস্ব অভিজ্ঞতা থেকে লেখা।
প্রথম প্রকাশঃ ঠাহর (প্রথম সংখ্যা)