পৌরাণিক গল্প ও ধর্মে লিঙ্গ তারল্য (Gender fluidity)

বাংলা অনুবাদ করেছেন – পঞ্চশর

মূল লিখাটি ইংরেজিতে লিখেছিলেন দেবদূত পট্টনায়ক

বিভিন্ন সংস্কৃতি তাদের মতো করে, বিষমকামিতা ছাড়াও, যৌনতা প্রকাশ করে থাকে।  

গ্রিক পুরাণতত্বের অনেকটা জুড়েই সম-লিঙ্গের প্রণয়ের দৃষ্টান্ত খুঁজে পাওয়া যায়; পুরুষ ও পুরুষের মধ্যে, নারী ও নারীর মধ্যে এবং পুরুষ ও বালকদের মধ্যে প্রণয়, অর্থাৎ আন্তঃপ্রজন্মের প্রণয়। হিন্দু পুরাণতত্বে খুঁজে পাওয়া যায় রূপান্তরকামী মানুষদের কথা – পুরুষ যারা নারীতে রূপান্তরিত হয় এবং নারী যারা পুরুষে রূপান্তরিত হয়। অন্যভাবে বললে, বিভিন্ন সংস্কৃতি তাদের মতো করে, বিষমকামিতা ছাড়াও, যৌনতা প্রকাশ করে থাকে।

গ্রিক পুরাণতত্বে বলা আছে কীভাবে দেবতাদের রাজা জিউস ট্রয়ের রাজকুমার গ্যানিমিডিজের প্রেমে পড়ে এবং একটা ঈগলের রূপ ধরে তাকে অপহরণ করে। আরও বলা আছে কীভাবে অ্যাপোলো হায়াসিনথাসের প্রেমে পড়ে। যে কারণে সে বাতাসের দেবতা যেফারাস সাথে দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়ে এবং তারা এই সুদর্শন যুবককে পাওয়ার জন্য যুদ্ধ করে। তারপর আছে শিল্পকলার দেবী অ্যাথিনা যে দাবী করতো তার মহিলা পূজারীরা তার প্রতি ভক্তিস্বরূপ কুমারী থাকবে। আর আছে শিকারের দেবী আর্টেমিস যে তার কাছাকাছি কোনো পুরুষ আসুক তা পছন্দ করতো না এবং কেবল নারী সঙ্গি গ্রহণ করতো। এইসব গুল্পগুলো সমকামিতার ইঙ্গিত দেয়।

হিন্দু পুরাণতত্বে খুঁজে পাওয়া যায় রাজপুত্র সদ্যুম্নের কাহিনী, যে শিব ও শক্তির মায়াবনে প্রবেশ করার ফলে নারীতে রূপান্তরিত হয়। তার অশ্ব অশ্বীতে রূপান্তরিত হয় আর কুকুর স্ত্রীকুকুরে। সদ্যুম্নের নারী রূপ ইলা নামে পরিচিত। সে বিয়ে করে বুধ গ্রহের দেবতাকে, এক অভিশাপের কারণে যার কোনো নিশ্চিত লৈঙ্গিক পরিচয় ছিল না। বৃহস্পতি গ্রহের দেবতা যখন জানতে পারে যে তার স্ত্রী তারা চন্দ্র দেবতার সন্তান গর্ভে বহন করছে তখন সে বুধকে এমন অভিশাপ দেয়। হিন্দু পৌরাণিক গল্পে সদ্যুম্ন চন্দ্রবংশের পূর্বপুরুষ হিসেবে বিখ্যাত। এই বংশের অন্তর্ভুক্ত ছিল পাণ্ডব ও কৌরব।

আরেকটি গল্প হলো মহাভারতের শিখণ্ডীর। সে আজীবন জানতো সে একজন পুরুষ যদিও তার জন্ম হয়েছিল নারীর দেহে। জীবনের পরবর্তীকালে স্থুনকর্ণ নামে এক যক্ষের সাহায্য নিয়ে সে পুরুষে রূপান্তরিত হয়। তারপর শিখণ্ডী কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে অংশ নেয় ও ভীষ্মকে পরাজিত করে। কৌরবদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ জয়ে পাণ্ডবদের শিখণ্ডীই সাহায্য করে।

রামায়ণের লোকগাঁথায় আছে কীভাবে বানররাজ রিসখা জলাশয়ে পড়ে গিয়ে নারীতে রূপান্তরিত হয়। সে বৃষ্টির দেবতা ইন্দ্র ও সূর্য দেবতাকে বিয়ে করে বালি ও সুগ্রীবের জন্ম দেয়। আরেকটি গল্পে সুগ্রীব ও বালির মা হলো সূর্য দেবতার রথচালক অরুণি যে নারীর রূপ ধারণ করেছিল ইন্দ্রলোকে অপ্সরাদের নৃত্য দেখার জন্য। শিব পুরাণ শক্তির সাথে শিবের মিলিত হয়ে অর্ধনারীশ্বরে পরিণত হওয়ার গল্প বলে। বৃন্দাবনস্থল পুরাণে বলা আছে শিবের নারী সেজে গোপেশ্বর মহাদেব হয়ে মথুরাতে কৃষ্ণের রাসলীলায় অংশগ্রহণের গল্প। বিষ্ণু পুরাণ বলে বিষ্ণুর মোহিনী রূপ নিয়ে অসুরদের মন্ত্রমুগ্ধ করার গল্প। তাহলে দেখা যাচ্ছে যে দেবতারা দেবীতে রূপান্তরিত হয় আর দেবীরা দেবতায়।   

খ্রিস্টধর্ম ও ইসলামের মতো আব্রাহামিক ধর্মগুলোতে সমকামিতা বা রূপান্তরকামী মানুষদের গল্প খুঁজে পাওয়া যায় না। এটা মানুষের ভ্রান্ত ধরাণা যে “সোডোম ও গোমরাহ” সমকামিতার সাথে সম্পৃক্ত। এটা আসলে অতিথিদের সম্মান না করার সাথে সম্পর্কিত। যখন মানুষ অতিথিদের সম্মান করে না সৃষ্টিকর্তা তখন তাদের শাস্তি দেয়। কিন্তু এটাকে ভুল করে সমকামিতার প্রত্যাখ্যান হিসেবে ধরা হয়। গস্পেলগুলোতে যীশু খ্রিস্ট বলেছে নপুংসকরাও স্বর্গে স্থান পাবে: কিছু মানুষ জন্ম থেকেই নপুংসক, কিছু মানুষকে নপুংসক বানানো হয়, কিছু মানুষ স্বেচ্ছায় নপুংসক হয়। তিনি কি সেসব রূপান্তরকামী মানুষদের কথা বলছে যারা একসময় নিকটবর্তী প্রাচ্যের মন্দিরগুলোতে সমৃদ্ধি লাভ করেছিল? হাদিসে কিছু ঘটনার বর্ণনা আছে যা আভাস দেয় যে মহানবী (স) এমন পুরুষদের জানতেন যারা নারীদের প্রতি আকর্ষণ বোধ করে না। সুফি ঐতিহ্যে এমন পুরুষ কবি আছে যারা সৃষ্টিকর্তাকে পুরুষ রূপে ভাবে আর নিজেদের নারী রূপে। সুফি দ্বারা প্রভাবিত হিজড়া ঐতিহ্যগুলোতেও শিক্ষককে প্রায়ই পুরুষ হিসেবে দেখা হয় আর শিষ্যকে নারী হিসেবে যেখানে শিক্ষক মারা গেলে শিষ্যরা “বিধবাদের” মতো শোক প্রকাশ করে।  

জৈন সন্ন্যাসীরা মানুষের অস্তিত্বকে দুই ভাগে ভাগ করেছিল, “দ্রব্য শরীর” বা ভৌত রূপ এবং “ভাব শরীর” বা মানসিক রূপ। ভাব শরীর” বা মানসিক রূপ আমাদের অন্য জিনিসের প্রতি আকর্ষিত করে। তারা বলেছে যে একজন ব্যক্তি পুরুষের দেহে থাকা সত্ত্বেও কেবল মাত্র নারীর প্রতি আকর্ষিত না হয়ে একজন পুরুষের প্রতিও আকর্ষিত হতে পারে। সুতরাং, ভাব শরীর দ্রব্য শরীরের থেকে ভিন্ন। ভৌত রূপ এবং মানসিক রূপ সবসময় একটি অপরটির সাথে মিলে না। তারা নারীসুলভ সমকামীদের (স্ত্রী-রূপীনি নপুংসক) কথাও বলেছেন যারা পুরুষসুলভ সমকামীদের (পুরুষ-রূপীনি নপুংসক) থেকে আলাদা। এটি একটি যথেষ্ঠ পরিশীলিত চিন্তাধারা যেটা খুঁজে পাওয়া যায় প্রায় ১৫০০ বছর আগের জৈন পুঁথিগুলোতে। অবশ্য এই চিন্তাগুলো ভিন্নধারার যৌনতার গুনকীর্তনের জন্য ছিল না বরং ছিল ভিন্নধারার যৌনকামীদের সন্ন্যাসীর চক্র থেকে বাহিরে রাখার উদ্দেশ্যে। বৌদ্ধ পুঁথিগুলোতেও একই রকম চিন্তাধারা খুঁজে পাওয়া যায় যেখানে সমকামী (পাণ্ডক) থেকে রুপান্তরকামী ব্যক্তি পর্যন্ত সকল ভিন্নধারার যৌনকামীদের সন্ন্যাসীর চক্র থেকে বাহিরে রাখা হতো।

যেহেতু হিন্দুধর্ম কম সন্ন্যাসমনা ছিল রুপান্তরকামী ব্যক্তিরা সমাজে গৃহীত হত, সাধারনভাবে না হলেও বিনোদনকারীদের দল তৈরী করতো বা মন্দিরে কাজ করতো। সেসময়ের সমকামীদের ব্যাপারে আমরা খুব কম জানি। তাদের অস্তিত্ব অবশ্যই ছিল, কিন্তু তারা বিয়ে করবে এবং বাচ্চার জন্ম দিবে কোনো না কোনোভাবে সম্ভবত এমনটা প্রত্যাশিত ছিল। তাদের যৌনকর্ম বিষমকামীদের ব্যাভিচারগুলোর থেকে কোনো দিক দিয়েই বেশি খারাপ মনে করা হতো না। দুটির জন্যই শাস্তি ছিল স্নানের মাধ্যমে বিশুদ্ধিকরণ।

ইংরেজিতে মূল লিখাটির উৎস , মুম্বাই মিররের লিংক:

https://mumbaimirror.indiatimes.com/others/sunday-read/who-is-a-hindu-gender-fluidity-in-hinduism/articleshow/77309815.cms?

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.