
এম ডি রহমান
অনলাইনে প্রায় একটি কৌতুক শেয়ার হতে দেখি অনেকটা এরকম ‘১৮ কোটি মানুষের দেশে সবাই যেন পরাগায়নে জন্মগ্রহণ করেছে’ যৌনতা নিয়ে মানুষের সংকীর্ণতার কারণে এধরনের কৌতুকের আবির্ভাব হয়েছে। বাংলাদেশে যৌনতা নিয়ে কথা বলাটাকে অনেক বেশি অরুচিকর ভাবা হয়। এখানে যৌন শব্দটাই একটা ‘ট্যাবু’। এই পরিবেশে যৌন প্রজনন স্বাস্থ্য নিয়ে কথা বলাটা খুব একটা সহজ না। কিন্তু যৌন শিক্ষাটা যে কতটা গুরুত্বপূর্ণ, সেটার উপলব্ধি করেই পাঠ্যবইতে ‘বয়ঃসন্ধি ও প্রজনন স্বাস্থ্য’ অধ্যায় যোগ হয়েছে৷ এটা করতে গিয়েও কম কাঠখড় পোড়াতে হয়নি। অনেক বছরের চেষ্টা, অনেক এডভোকেসির ফল হচ্ছে পাঠ্যবইয়ে যৌন প্রজনন স্বাস্থ্য বিষয়টা নিয়ে আসা। শুধু পাঠ্যবইতে অধ্যায় বাড়ালেই তো হলো না, এখানেও ঘাপলা আছে। ঘাপলার বিষয়টা পরে বলি আগে পাঠ্য বইতে কী আছে সেটা নিয়ে আলোচনা করা যাক।
ষষ্ঠ শ্রেণী থেকে দশম শ্রেণী পর্যন্ত ‘শারীরিক শিক্ষা, স্বাস্থ্যবিজ্ঞান ও খেলাধুলা’ বইয়ের ‘বয়ঃসন্ধিকাল ও প্রজনন স্বাস্থ্য’ অধ্যায়ে কিশোর-কিশোরীরদের যৌন প্রজনন স্বাস্থ্য সম্পর্কিত বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। বয়ঃসন্ধিকাল কী ও বয়ঃসন্ধিকালের পরিবর্তন, ছেলে এবং মেয়েদের বয়ঃসন্ধিকালে যে সকল শারিরীক, মানসিক, আচরণিক পরিবর্তন হয় সেগুলো সম্পর্কে বিস্তারিত বর্ণনা আছে। শারিরীক পরিবর্তনের স্পর্শকাতর বিষয়সমূহ যেমন : ছেলেদের স্বপ্ন দোষ হওয়া, মেয়েদের ঋতুস্রাব ইত্যাদি বিষয়ও বলা হয়েছে। বয়ঃসন্ধিকালে বিভিন্ন মানসিক চাপ ও পরিবর্তনের সাথে খাপ খাওয়ানোর ব্যাপারে সবিস্তারে বলা আছে বেশ সহজ ভাষাতেই। এছাড়াও আছে বয়ঃসন্ধকালে পুষ্টির প্রয়োজনীয়তা, সুষম খাদ্য, প্রজনন স্বাস্থ্য সুরক্ষা, প্রজননতন্ত্রের বিভিন্ন রোগ সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে। বলা যায় পাঠ্য বইয়ের এই অধ্যায়টি সহজে বয়ঃসন্ধকালে একজন কিশোর কিশোরীর কী ধরনের সচেতনতা গ্রহণ করতে হবে সে বিষয়ে প্রায় সম্পূর্ণ তথ্যই দেওয়া আছে।
কিন্তু ঘাপলাটা হচ্ছে পাঠ্য বইতে থাকা স্বত্তেও এই সম্পর্কে বয়ঃসন্ধিকালের ছেলে মেয়েরা বেশির ভাগই জানতে পারছে না। এর অন্যতম কারণ এই বিষয়ে বেশির ভাগ স্কুলেই ক্লাস নেওয়া হয়না। প্রথমত, এই বিষয়ে বোর্ড থেকে কোন পরীক্ষা নেওয়া হয়না, কোন মার্কিং দেওয়া হয়না, দ্বিতীয়ত, এই অধ্যায় পড়াতে বা যৌন স্বাস্থ্য নিয়ে কথা বলতে প্রচন্ড দ্বিধান্বিত থাকেন শিক্ষকেরা। শিক্ষার্থীদের সামনে সেক্স নিয়ে কথা বলাটাই নিষিদ্ধ বা লজ্জার বিষয়। অনেকে ভাবে এগুলো প্রাকৃতিক বিষয়, সবার মাঝে আছে, তারা এমনি এমনিই শিখে যাবে। আর ছাত্রছাত্রীরাও পরীক্ষা বা মার্কিং সিস্টেম নেই বলে এই বইটা কখনো খুলে দেখে না। মোটকথা, এই সম্পর্কিত কোন জ্ঞান বা ধারণা শিক্ষার্থী অব্দি পৌঁছাতে পারছেনা।
তবে ব্যতিক্রম উদাহরণও আছে বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে চিত্রটা একেবারেই অন্যরকম এখানে শিক্ষার্থীরা কম্পিউটার গেম, মনোপলি বোর্ড গেম ব্যবহার করে শিখছে জেন্ডার এবং সেক্স বিষয়ে নানান রকম গুরুত্বপূর্ণ তথ্য। কনডম, যৌনসঙ্গম, কনসেন্ট ইত্যাদি বিষয়ে জানছে কোন ধরনের সংকোচ ছাড়াই৷ যদিও এখানকার শিক্ষক শিক্ষার্থীরাও প্রথম দিকে সংকোচ বোধ করছিলো, কিন্তু যৌনতা নিয়ে ট্যাবুটাকে ছুড়ে ফেলতে সক্ষম হয়েছে। ‘জেনারেশন ব্রেক থ্রু’ প্রকল্পের মাধ্যমে বাংলাদেশে আরো ৩৫০ টি স্কুলে এই কার্যক্রম পরিচািলত আছে৷ এমন কি ৫০ টি মাদ্রাসাতেও এই প্রকল্পটি চলছে ভালোভাবেই।
যদি ধীরে ধীরে বাংলাদেশের প্রত্যকটি স্কুলে এই ধরনের কার্যক্রম পরিচালিত হয় তাহলে হয়ত এই বিষয়ে ট্যাবু, সামাজিক বাঁধাকে অতিক্রম করা সম্ভব হবে। এর সাথে পাঠ্যবই কে আরো যুগোপযোগী করা দরকার, শ্রেণীকক্ষে পাঠদান করা দরকার। পাঠ্যবইতে জেন্ডার, সেক্সুয়ালিটি, বৈচিত্র্যময় লিঙ্গ সম্পর্কে তথ্য যোগ করাটাও জরুরি৷
প্রথম প্রকাশ
ঠাহর (প্রথম সংখ্যা)
মন্দ্র থেকে প্রকাশিত জেন্ডার, সেক্সুয়ালিটি এবং কুইয়্যার বিষয়ক ম্যাগাজিন