
লেখক : ছোটন
জর্জিন ডেভিসের বয়স ৩৫ বছর, তিনি নিজেকে একটা মেয়ে হিসেবেই জানতেন। তার শারিরীক বৈশিষ্ট্যও নারীর সুলভ। কিন্তু যখন সে ২০ বছর বয়সের একজন তরুণী,ঠিক তখনই তিনি নিজের মেডিকেল রেকর্ড দেখে হোঁচট খেলেন কারণ মেডিকেল রেকর্ড অনুযায়ী সে একজন পুরুষ। তার দেহের জেনেটিক বৈশিষ্ট্য বা দেহ কোষে Y ক্রোমজমের অস্তিত্ব আছে। যখন জর্জিন ১৩ বছর বয়স তখন ডাক্তাররা তার এই সমস্যাটি চিহ্নিত করেন। জর্জিনের পরিবার তার কাছ থেকে বিষয়টি লুকিয়ে রাখে এবং ১৭ বছর বয়সে একটি অস্ত্রেপচার করায়। তাহলে এই পরিস্থিতিতে আপনি জর্জিনকে নারী নাকি পুরুষ বলবেন? রাষ্ট্র, সমাজ, ধর্ম তাকে কীভাবে চিহ্নিত করবে কোন গোত্রে রাখবে?
এই লেখাটির উদ্দেশ্য হচ্ছে বায়োলজিক্যাল সেক্স যে জেন্ডারের মতো বৈচিত্র্যময় সেটাকে বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণ থেকে ব্যাখ্যা করা।
আমরা যে সমাজে বাস করছি, এই সমাজ কাঠামোয় মানুষের লিঙ্গ এবং জেন্ডার (সামাজিক লিঙ্গ) ধারণার একটি বাইনারী রুপ রয়েছে; সেটা হচ্ছে নারী এবং পুরুষ৷ কিছুক্ষেত্রে এখন তৃতীয় লিঙ্গ শব্দটি ব্যাপভাবে ব্যবহার হচ্ছে অর্থাৎ নারী-পুরুষের বাইরের লিঙ্গের অস্তিত্বকে বোঝাতে তৃতীয় লিঙ্গ টার্মটি ব্যবহৃত হয়। আমাদের দেশে তৃতীয় লিঙ্গ অনেকটা হিজড়া জনগোষ্ঠীকে বোঝানো হয়৷ যদিও এটা ভীষণ রকম বৈষম্য মূলক একটি শব্দ। সরকার বা সমাজ এই হিজড়া জনগোষ্ঠীকে আবার আইডিন্টিফাই করে শারীরিক লিঙ্গ বা জননাঙ্গ দেখে। এখানেই আসে মূল সমস্যাটি৷ বাংলাদেশ সরকার উভলিঙ্গ বা ইন্টারসেক্স ব্যক্তিকে হিজড়া হিসেবে চিহ্নিত করেছে৷ কিন্তু হিজড়া এবং ইন্টারসেক্স এক নয়৷ ইন্টারসেক্স বা উভলিঙ্গত্ব হচ্ছে বায়োলজিক্যাল জননাঙ্গের একটি অবস্থা। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে বায়োলজিক্যাল সেক্স বলতে তিনটি জননাঙ্গকে বোঝানো হয় নারী, পুরুষ এবং ইটারসেক্স। আর হিজড়া হচ্ছে ভারতীয় উপমাহাদেশের এমন একটি জনগোষ্ঠী যাদের আলাদা সাংস্কৃতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক ব্যবস্থা রয়েছে। যেখানে হিজড়া জনগোষ্ঠীর মানুষেরা নিজেদের মতো করে আলাদা ভাবে সমাজ ব্যবস্থা পরিচালিত করে। হিজড়া জনগোষ্ঠীর সাথে বায়োলজিক্যাল সেক্সের কোন সম্পর্ক নেই। তবে জেন্ডারের একটা সম্পর্ক আছে। যাই হোক, এই আলাপ আরো বিস্তৃত পরিসরে আলোচনার বিষয়। এই প্রবন্ধে শুধুমাত্র বিজ্ঞানে কিভাবে লিঙ্গকে বর্ণনা করা হয়েছে সে বিষয়ে আলোচনা করবো।
মানুষের জননাঙ্গ বা লিঙ্গ মোটা দাগে দেখে ছেলে অথবা মেয়ে নির্ধারণ করলেই হয়ে যায় না। মানুষের লিঙ্গ নির্ধারণ প্রক্রিয়াটি জটিল ৷ সমাজিক কাঠামোয় বাইনারি বিভাজন যতটা রক্ষণশীল, বায়োলজি বা জিনশাস্ত্রের দৃষ্টিতে এটি মোটেও কোন রক্ষণশীল ব্যাপার না বরং বৈজ্ঞানিক অগ্রগতির ফলে নতুন নতুন তথ্য আমাদের সামনে প্রতিনিয়তই উন্মোচিত হচ্ছে এবং সামাজিক রক্ষণশীলতাকে চ্যালেঞ্জ করছে। আমরা এতদিন জেনে এসেছি এবং স্কুলের জীববিজ্ঞান বইয়ে পড়ে এসেছি যে XX ক্রোমোজম হলো মেয়ে হওয়ার জন্য দায়ী এবং XY ক্রোমোজম ছেলে হওয়ার জন্য দায়ী। বৈজ্ঞানিক ভাবে এইভাবে লিঙ্গ নির্ধারণ দীর্ঘদিন ধরে চলে আসছে৷ কিন্তু সম্প্রতি সময়ে এই ব্যাখ্যাকে অসম্পূর্ণ এবং অযৌক্তিক বলছে জীববিজ্ঞান। বিজ্ঞানের এই অগ্রগতি বাইনারী ভাবে লিঙ্গকে নির্ধারণ করার পদ্ধতিকে একেবারেই বাতিল করে দিয়েছে। অর্থাৎ XX এবং XY ক্রোমজম লিঙ্গ নির্ধারনের পুরো গল্পটি ব্যাখ্যা করে না। আমরা মনে করি XX থাকলে ডিম্বাণু, যোনি, এস্ট্রোজেন থাকলে সেটি ফিমেল আইডিন্টিটি৷ আবার অন্য পাশে XY থাকলে অন্ডকোষ,পেনিস, টেস্টেস্টরন এগুলোর জন্য মাসকিউলিন ধাঁচের হয়।
ভ্রুণ গঠনের প্রাথমিক স্তরে লিঙ্গ উন্মেষের সময় X এবং Y ক্রোমজোম দুটি একজোড়া দেহকোষ ক্রোমজোম থেকে তৈরি হয়, ফলে স্বাভাবিক ভাবেই X ক্রোমজোমে কিছু Y ক্রোমজোমের জিন আবার ওয়াই ক্রমোজমে কিছু এক্স ক্রোমজমের জিন উপস্থিত থাকে। কার্যত, এক্স এবং ওয়াই ক্রোমজম কখনোই বিচ্ছিন্ন হতে পারেনা৷ বরং দুটি ক্রোমজোম একে অপরের সাথে কতটুকু জড়িয়ে আছে, একে অপরের ভিতর কতটুকু ছাপ রাখতে পারছে তারই উপর নির্ভর করে মানুষের লিঙ্গের স্বরুপ।
আবার প্রত্যেক ভ্রুণ প্রাথমিক একজোড়া অঙ্গ দিয়ে গঠিত। যার নাম প্রোটো-গোনাড যা ছয় থেকে আট সপ্তাহের মধ্যে ছেলে এবং মেয়ে গোনাডে পরিণত হয়। যৌন পার্থক্য সাধারণত Y ক্রোমজোমের একটি জিন দ্বারা নির্ধারিত হয়ে থাকে।সেটি হচ্ছে SRY জিন যা প্রোটো-গোনাডকে অন্ডোকোষে পরিণত করে, টেস্টোস্টেরন এবং অন্যান্য পুরুষ হরমোন যা অ্যান্ড্রোজেন নামে পরিচিত, এরপর ভ্রুণ একটি প্রোস্টেট এবং পুরুষ লিঙ্গ বিকাশ করে। SRY জিন ব্যাতীত প্রোটো-গোনাড ডিম্বকোষে পরিণত হয় যা এস্ট্রোজেন নিঃসরণ করে এবং ভ্রুণটিতে জরায়ু, যোনি এবং ভঙ্গঙ্কুর বিকাশ করে।
তবে SRY জিনটি সব সময় তার কাজটি খুব সরল পদ্ধতিতে করে না। এক্সওয়াই ভ্রুণে SRY জিন থাকতেও পারে আবার নাও থাকতে পারে, থাকলে সেটা আবার অকার্যকর অবস্থায়ও থাকতে পারে। অর্থাৎ এখান থেকে আমরা খুব সহজেই বুঝতে পারি যে XY ক্রোমোজমে থাকলেই সেটা সবসময় পুরুষ হরমোন, লিঙ্গ বিকশিত হয় না। যদি না সেই ক্রোমোজমে SRY জিন থাকে, থাকলেও যদি সেটা কার্যকর অবস্থায় থাকে। SRY জিন না থাকলে এবং অকার্যকর অবস্থায় থাকলে তাহলে ভ্রুণটি XY ক্রোমোজম হওয়া স্বত্ত্বেও ছেলে গুণাবলি আর বিকশিত হয় না। এখন প্রশ্ন হচ্ছে তখন সেই ভ্রুণের স্বরুপটা কী হবে? তখন ভ্রুণটি শারিরীক গঠনে ছেলে গুণাবলি আর বৃদ্ধি না পেয়ে, সেটি মেয়ে শারিরীক গঠনে বৃদ্ধি পেতে থাকে এবং সেভাবেই জন্ম হয় ও বড় হতে থাকে।
এই SRY জিন ছাড়াও, জিনগত ভিন্নতার কারণেও লিঙ্গের উপর প্রভাব পরে। প্রথমে অংশে যে জর্জিন নামের মেয়েটার কথা বললাম। চিকিৎসা বিজ্ঞানের ভাষায় যাকে ‘Complete Androgen Insensitivity Syndrome’ সংক্ষেপে (CAIS) বলে। অভিজিৎ রায়ের সমকামিতা বইয়ে উল্লেখিত মারিয়া নামের একজন স্প্যানিস অ্যাথলেটেরও এই CASI ছিলো। তাকে অলিম্পিক গেইমসে অংশগ্রহণ করতে দেওয়া হয়নি কারণ তিনি চিকিৎসা বিজ্ঞানের দৃষ্টিতে সে মেয়ে না। শারিরীক বৈশিষ্ট্য নারী সুলভ হলেও ক্রোমজমের গঠন অনুসারে সেখানে Y ক্রোমজমের অস্তিত্ব থাকে। দেহের ভিতর সুপ্ত অবস্থায় পুরুষাঙ্গ লুকানো থাকে, এমনকি ডিম্বাশয় এবং জরায়ু থাকে না। মারিয়ার অন্যসব পুরুষদের মতো অন্ডোকোষ থেকেও প্রচুর পরিমাণ টেস্টেস্টরোন নিঃসৃত হতো। এর কারণ ভ্রুণ অবস্থা থেকেই এদের দেহকোষ পুরুষ হরমোনের সংকেত সনাক্ত করতে পারেনি বা সাড়া প্রদান করতে ব্যর্থ হয়েছিলো। ফলে মারিয়া বা জর্জিনের দেহে পুরুষ সুলভ বৈশিষ্ট্যগুলো অনুপস্থিত থেকে গিয়েছিলো। দেহ অ্যান্ড্রোজেনের প্রতি সংবেদনশীল না হওয়ায় তাদের স্তন বৃদ্ধি, যোনি, কোটিদেশ বাহ্যিক সব কিছু নারী বৈশিষ্ট্য বিকশিত হলো। দেখতে শুনতে এবং মানসিকতায় মেয়ে হিসেবেই বড় হতে থাকে। তাহলে এক্ষেত্রেও আমরা বুঝতে পারছি নারী পুরুষ পরিচয় কেবলই শারিরীক চিহ্নের উপর নির্ভর করে না।
আমরা আরো একটা উদাহরণ দেখতে পারি মানব দেহের লিঙ্গ গঠন ও নির্ণয় প্রক্রিয়া কীভাবে নির্ধারিত হয়। ভ্রুণ থেকে বয়ঃসন্ধিকাল পর্যন্ত মস্তিষ্ক, হরমোন এবং যৌনাঙ্গের মধ্যে৷ একটি লুপ বা চক্র পরিচালিত হতে থাকে। এই চক্রকে বলে ‘ফিডব্যাক লুপ’। এই লুপের সময়কাল এবং গতিপথের উপরও নির্ভর করে মানব দেহের লিঙ্গ গঠন।
এতসব বিষয়ের উপর নির্ভর করে মানব দেহের লিঙ্গ। জেন্ডর, সেক্সুয়ালিটির যেমন নির্দিষ্ট কোন সংখ্যা বা অবস্থান নেই। তেমনি শারিরীক লিঙ্গেরও নির্দিষ্ট কোন বাইনারি অবস্থান নেই৷ এটারও একটা বর্ণালী আছে, যে বর্ণালীর বিভিন্ন স্তরে বিভিন্ন লিঙ্গের মানুষ অবস্থান করে।
তথ্য সূত্র :
১) https://blogs.scientificamerican.com/voices/stop-using-phony-science-to-justify-transphobia/
2) https://www.nationalgeographic.com/magazine/2017/01/how-science-helps-us-understand-gender-identity/
3) https://www.scientificamerican.com/article/the-new-science-of-sex-and-gender/
6) সমকামিতা বই, অভিজিৎ রায়।
7) কৃত্তিবাস পত্রিকায় প্রকাশিত প্রবন্ধ ‘রুপান্তর : নির্ধারণ থেকে নির্বাচনের দিকে।
প্রথম প্রকাশঃ ঠাহর (প্রথম সংখ্যা)