
ছোটো বেলা থেকে অন্তর্মুখী স্বভাবের ছিলাম। সেবছর স্কুল শেষ করে সবে কলেজ জীবনে প্রবেশ করেছি। প্রথমবার বাড়ি ছেড়ে দূরে হোস্টেলে চলে যেতে হলো। নতুন ক্লাস, নতুন জায়গা, নতুন জীবন। অন্তর্মুখী হওয়ায় আমি কারো সাথে সহজে বন্ধুত্ব করে উঠতে পারিনা। রুমমেট খুব মিশুক হওয়ায় মানিয়ে নিতে সমস্যা হয়নি। হোস্টেলের সবার সাথে তার আড্ডা চলে। কথা খুব কম বলি বলে তাদের আড্ডায় আমি কখনও যেতাম না। এই সময়টায় বরং আমি বই পড়া, ছবি আঁকা বা কলেজের হোমওয়ার্ক করতাম। সেদিনও তেমনই ম্যাথ করছিলাম আর তখনই তার আবির্ভাব- রুমে ঢুকেই বললো “সারাদিন এতো পড়ো কেন!” বলেই চলে গেলো।আমি হা করে তাকিয়ে থাকলাম তার চলে যাওয়ার দিকে। এই মেয়েটাকে আগে দেখিনি। আর কি অদ্ভুত চলে গেলেও কেমন একটা রেশ রেখে গেলো। আমি যেন একটা ঘোরের ভেতর চলে গিয়েছিলাম। ঘোর কাটলো রুমমেটের ডাকে। বললো ওর নাম(আমি এখানে নামটা বলছি না; ‘ও’ শব্দটা ব্যবহার করছি।) নাম জানিয়ে বললো পাশের রুমে থাকে, এসএসসি দেবে।সপ্তাহখানেক তাকে আর দেখিনি। দ্বিতীয়বার আবার দেখলাম টিভি রুমে। তার লম্বা চুলের উপর যে কেউ ঠাস করে প্রেমে পড়ে যাবে। টিভি কি দেখবো; আমার সব মনোযোগ তখন তার চুলের উপর। বাপরে; এতো লম্বা চুল সামলায় কেমনে। আমার চুল তো বাবা জীবনে ঘাড়ের নিচে নামেনি। কিসব ভাবছিলাম আর এরমধ্যেই তার ডাক- ওভাবে তাকিয়ে আছো কেন? আমি একটু ইতস্তত বোধ করলাম। আসলেই তো তাকিয়ে আছি কেন! কিছু না বলে টিভিরুম থেকে রুমে চলে এলাম। ‘চলে এলে যে’- কথা শুনে পেছন তাকিয়ে দেখি সেও চলে এসেছে। কিছু একটা অনুভব করছিলাম যা আমি আগে কক্ষনো করিনি। এরপর থেকে আমরা বেশ ভালো বন্ধু হয়ে গেলাম।
ভালোই চলছিল সব। ঈদের ছুটিটাও চলে এলো- বাড়ি যাওয়ার তোড়জোড় চলছে। রুমমেট চলে গেছে। আমি যাবো দুদিন পর। বাবা কল করে বললো রুমে একা থাকার দরকার নেই। আমি বললাম- ঠিক আছে; ওকে ডেকে আনছি।
আমরা প্রায় সারারাত গল্প করেছিলাম।
আমার একাকীত্ব দূর করতে মাঝে মাঝে কবিতা লিখতাম। খুব ভালো লিখতাম এমন নয়। কিন্তু সে রাতে আমি আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ কবিতাটা লিখেছিলাম। যেটা পরে একটা কবিতা সংকলন বইয়ের জন্য নির্বাচিত হয়েছিল। (যদিও টাকার অভাবে প্রকাশ করা হয়নি।)
প্রথম রাত এভাবেই চলে গেলো। দ্বিতীয়রাত ছিল আমার কল্পনার বাইরে; সে হঠাৎ আমার কপালে চুমু খেলো। কিছু সময়ের জন্য আমার পুরো শরীর যেন অবশ হয়ে গিয়েছিলো। এমন আগে কখনো হয়নি। আমি আস্তে আস্তে ওর ঠোঁটের দিকে এগিয়ে গেলাম। আর সেটা ছিল- ম্যাজিক!
পুরো শরীর জুড়ে ইলেক্ট্রন দৌড়াদৌড়ি করলে বোধহয় এমন হয়।
সকালে দু’জনেই অন্যরকম অনুভূতি নিয়ে বাড়ি চলে গেলাম।
বাড়ি গিয়ে তার অনুপস্থিতি বুঝতে পারছিলাম ।
ছুটি শেষে হোস্টেলে ফিরে এলাম। আমাদের সম্পর্ক আরো গভীর হলো। আমি চাইলেই তাকে চুমু খেতে পারি। সে আমায় জড়িয়ে ধরে। কত রাত একসাথে ছাদে চাঁদ দেখে কাটিয়ে দিয়েছি!
আহা! প্রেমে পড়লে বুঝি এমনই হয়!
কিন্তু কথায় আছে না- সুখের সময় দ্রুত ফুরিয়ে যায়। আমার বেলাতেই বা তার উল্টো হবে কেন!
কলেজের টেস্ট পরীক্ষার রুটিন দিয়ে দিলো! আমি প্রেমে বুঁদ হয়ে ছিলাম! পড়াশোনা করার সময় কোথায়! পরীক্ষা খুব খারাপ দিলাম! নিজেকে বুঝালাম এইচএসসির এখনো তিন-চার মাস সময় আছে। পড়াশোনা শুরু করলাম ,ওকে আর সেভাবে সময় দেয়া হচ্ছিল না! মনখারাপ করে থাকে; আমারো খারাপ লাগে কিন্তু পাশ করার মতো অবস্থাও নেই তখন আমার। ওকে বুঝালাম।
মাথা নাড়ালো শুধু।
আমরা তখনও অফিসিয়াল কাপল ছিলাম না। আসলে, এধরনের কিছু হয় সেটাই তো জানতাম না। শুধু জানতাম একজন আরেকজনকে ভালোবাসি! আর সেটাই তো যথেষ্ট ছিল। পরিবার সমাজ ধর্ম এসব যে ইফেক্ট করে সেটাও অজানা ছিল।
সব জেনেছিলাম ঢাকায় আসার পর; এইচএসসির পর ভার্সিটি কোচিং করতে। আস্তে আস্তে সব কিছু জানতে শুরু করেছি আর একটু একটু করে ডিপ্রেশন কাজ করতে শুরু করলো। এরমধ্যেই এইচএসসির রেজাল্ট দিলো! কোনোমতে পাশ করেছি। আমার খারাপ রেজাল্টের জন্য ও নিজেকে দায়ী করতে শুরু করলো আর আমার থেকে গুটিয়ে নিলো। ওর কথা- ও আমার জীবনটা নষ্ট করতে চায় না। আমিও কোন কথা বলার মতো অবস্থায় নেই তখন। মনে হলো সেটাই ভালো হবে দুজনের জন্য। সুতরাং আস্তে আস্তে আমাদের যোগাযোগ বন্ধ হয়ে গেলো।
প্রথম প্রথম কষ্ট হতো; মরে যেতে ইচ্ছে করতো।
এরপর অনলাইন হেল্প সাইট মায়ায় একদিন প্রশ্ন করে সাহায্য চাইলাম- বেশ সাপোর্ট পেয়েছিলাম। একটু যেন উজ্জীবিত হলাম। জীবনটা নতুন করে শুরু করার অনুপ্রেরণা পেলাম। একটা প্রাইভেট ভার্সিটিতে ভর্তি হলাম। এখন
দিনকাল ভালোই চলছে। নিজেকে মেনে নিয়েছি। যদিও কাউকে জানানো হয়নি। জানানোর মতো পরিবেশ এখনো তৈরি হয়নি তাই। প্রথম প্রেম- যদিও আমরা অফিসিয়াল ছিলাম না; কিন্তু আমি অনেক কিছু শিখেছি,জেনেছি, বুঝেছি। আর সেই সব ভুলগুলো শুধরে নিয়ে ভবিষ্যতে হয়তো নতুন করে কারো সাথে জীবনটা শুরু করবো। তার আগে পর্যন্ত নিজেকে প্রস্তুত করার প্রস্তুতি চলতে থাক।
মাঝেমাঝে ভার্সিটির বন্ধুদের দেখি লেসবিয়ান বা গে শব্দটাকে গালি হিসেবে ব্যবহার করে; খারাপ লাগে।
মাঝেমাঝে চেষ্টা করি পরিবারের সদস্যদের হোমোসেক্সুয়ালিটি সম্পর্কে অভিমত জানতে। কিন্তু সেটা কখনোই পক্ষে আসে না। এইখানেই একটু দমে যাই।
তারা ভীষণ রেলিজিয়াস। এমন নয় যে আমি রেলিজিয়াস নই। আমি মুসলিম এবং আমি আমার ধর্মকে সম্মান করি। যিনি তোমায় সৃষ্টি করেছেন তিনি আমাকেও সৃষ্টি করেছেন। আমি স্বেচ্ছায় বা জেনেশুনে এই পথে আসিনি। যেভাবে প্রথম এই অনূভুতির সাক্ষাৎ পেয়েছিলাম সে মূহুর্তের আগে অব্দি আমি জানতাম না এটা কি! তবে একটা জিনিস যা আমি বিশ্বাস করি- আল্লাহ নিষ্ঠুর নন। সৃষ্টিকর্তা তোমায় ভালোবাসেন; তুমি তাকে বাসো বা না বাসো।
ভালোবাসা একটা অনূভুতির ব্যাপার। এটা কখন কিভাবে কার জন্য আসবে সেটা আমি জানি না। এটাকে নিয়ন্ত্রণ করা তো আমার পক্ষে সম্ভব নয়।
তাই শেষপর্যন্ত- আমি আমিই।
Source: BAH ( Bangladesh Against Homophobia)