আমি একটু আলাদা

আমার গল্পটার সূচনা হয়েছিল ২০১১ সালে

তখন আমি সবে ক্লাস সিক্সে পড়ি।

ঔ টুকু বয়েসে আমার জীবনে সর্বপ্রথম ভালোবাসা শব্দটা দাগ কেটেছিল।

তাও আবার একটা মেয়ের জন্য ।

ওর নাম ছিল সুবর্না।

ও তখন ক্লাস ফাইভ পড়তো;

আমি ও  সবে ফাইভে পরিক্ষা দিয়ে সিক্সে উঠেছিলাম।

তখন ভালোবাসা সম্পর্কে তেমন জানাশোনা ছিল না আমার।

শুধু এই টুকুই বুঝতাম যে ওর জন্য সামথিং স্পেশাল কিছু ফিল হয়।

ওর কথা + হাসি ভালো লাগে।

ও একটু চোখের আড়াল হলে কেমন যেন একটা অস্থিরতা কাজ করে!!

আস্তে আস্তে আমার আচরণে ও হয়তো কিছু একটা বুঝতে পেরেছিল।

আমাকে দেখলেই মুচকি করে হাসতো।

আর এটা দেখে আমি বুঝতাম যে ও নিজেও আমার জন্য হয়তো কিছু ফিল করে;

এভাবেই চোখাচোখিতে কেটে গেলো এক বছর।

এর পর একটু একটু করে ওর আচরণের পরিবর্তন হতে শুরু করে;

আকার ইঙ্গিতে ও বুঝিয়ে দিতে লাগলো আমাকে ওর বিরক্তি লাগে এখন আর সহ্য হয়না।

এভাবে ই হঠাৎ একদিন ও কোথায় যেন হারিয়ে গেল দীর্ঘ এক বছর ওর কোন খোঁজ পাইনি আমি!

তখন বয়স কম থাকার কারণে হাসি আনন্দ আর দুষ্টুমির ভিড়ে অল্প কয়েক দিনের ব্যবধানে ভুলে গিয়েছিলাম ওকে।

এর পরে ২০১৪ সাল।

 আমি তখন ক্লাস নাইনে পড়ি।

তখন পরিচয় হয় আমার দু ব্যাচ জুনিয়র একটা মেয়ের সাথে ।

ওর নাম ছিল নিপু;

 হঠাৎ একদিন অকারণে ক্লাসে বসে ওর সাথে ঝগড়া  হয়!!

এরপর ঝগড়া থেকে পরিচয়+বন্ধুত্ব।

আস্তে আস্তে দিন গড়াতে লাগলো

সময়ের সাথে সাথে আমাদের সম্পর্ক আরো ঘনিষ্ঠ হওয়ার শুরু করলো..

আমার দুজন দুজনকে প্রচন্ড ভালোবাসতাম

হয়তো স্বাভাবিকের তুলনায় একটু বেশি ছিল আমাদের ভালোবাসা তাই মাঝেমধ্যেই লোকের কথা শুনতে হতো।

কিন্তু আমরা কিছুর পরোয়া করতাম না।

আর এভাই কেটে গেল দু’বছর ।

আমি তখন ইন্টারে পড়ি।

দু’বছর পর আমি একদিন জানতে পারলাম নিপুর বয়ফ্রেন্ড আছে।

আর ও এ ব্যাপারটা আমার থেকে গোপন রেখেছিল।

কেন জানি না তখন ওর যে বয়ফ্রেন্ড আছে এই কথাটা আমার হজম হচ্ছিল না।

কিছুতেই মেনে নিতে পারছিলাম না।

শুধু মনে হচ্ছিল ও শুধু আমার একান্তই আমার!!

কিছুটা সময় চুপচাপ থাকার পর ভাবতে লাগলাম

ও তো একটা মেয়ে ওর একজন ছেলে ফ্রেন্ড থাকবে এটাই স্বাভাবিক;

এতে আমার খারাপ কেন লাগছে ?

আমি মানতে কেন পারছিনা?

তবে আমি কি স্বাভাবিক নোই?

এমন হাজারো প্রশ্নের উপর প্রশ্ন ছুড়ে চলেছিলাম নিজের উপর।

নিজের সাথে নিজের মনের লেগে গিয়েছিল এক মহা প্রশ্নের যুদ্ধ।

এভাবে নিজের সাথে যুদ্ধ করে দিন যেতে লাগলো।

হঠাৎ একদিন নেট ঘাটতে ঘাটতে জানতে পারল লেসবিয়ানদের ব্যপারে;

এর আগে এই ব্যপারে কিছুই জানতাম না আমি।

এসব জানার পর বুঝতে পারলাম আমি স্বাভাবিক নোই অন্য সব মেয়েদের মতো নয় আমার চাওয়া পাওয়া!!

কিন্তু কিছুতেই আমি নিজেকে লেসবিয়ান বলে মেনে নিতে পারছিলাম না..;

শুধু মনে হচ্ছিল আমার সাথেই কেন এমন হলো?

কেন আমিই এমন হলাম?

তখন মনে মনে ঠিক করে নেই নিজেকে শুধরে  নেব!!

এই কারণে নিপুর সাথে যোগাযোগ বন্ধ করে দেই ।

আর সম্পর্কে জড়িয়ে নেই নিজেকে এক ছেলের সাথে..

কিন্তু দুর্ভাগ্য বশত শত চেষ্টা করেও নিজেকে মানিয়ে নিতে পারছিলাম না তার সাথে;

তার জন্য কোন অনুভূতি কাজ করতো না আমার;

কিছু ফিল করতাম না তার জন্য।

কিছুদিনের মাথায় ব্রেকআপ হয়ে যায় তার সাথে।

কিন্তু আমি হাল ছাড়তে বড্ড নারাজ ছিলাম।

নতুন করে আবার শুরু করলাম।

কিন্তু না এক সপ্তাহ ও সম্পর্ক টিকিয়ে রাখতে পারিনি!!

এভাবেই দেখতে দেখতে ইন্টার শেষ করলাম..

পরিক্ষা শেষ হতে না হতেই পরিবার থেকে বিয়ের জন্য প্যারা দেয়া শুরু করে;

এমনিতেই অজশ্র প্রশ্নের সাথে যুদ্ধ করতে করতে আমি ক্লান্ত তার উপর পরিবারের নতুন প্যারা শুরু;;

তখন একটু একটু করে বুঝিয়ে  পরিবারকে আপাতত থামাতে সক্ষম হয়েছিলাম।

এবং তাদের কথা দিয়েছিলাম পড়ালেখা কমপ্লিট করে তাদের পছন্দের ছেলেকে বিয়ে করব।

সেই সাথে মনে মনে আমি ও ঠিক করে নিলাম

অনার্সে ভর্তি হয়ে নতুন যায়গায় আর নতুন পরিবেশে নিজেকে এবার স্বাভাবিক করে নেব।

কিন্তু সেখানে যাওয়ার পরে হলো তার ঠিক উল্টো!!

অনার্সে ভর্তি হবার পর বেশ ভালো কাটছিল সময় গুলো।

নতুন বন্ধু বান্ধবীদের সাথে আনন্দ উল্লাসে মেতে ছিলাম।

মনে মনে নিজেকে স্বাভাবিক করার চেষ্টা ও করতেছিলাম দিব্বি;;

অনার্স লাইফের দু’মাস পড়

হঠাৎ একদিন ক্লাস রুমে ঢুকলো এক অপূর্ব সুন্দরী মেয়ে।

প্রথম দেখাতেই আমি মুগ্ধ হয়ে হা করে তাকিয়ে ছিলাম।

তাকে দেখে মনে হচ্ছিল আল্লাহ পাক তাকে প্রকৃতির সবটুকু সৌন্দর্য দিয়ে সৃষ্টি করেছে।

ও যখন হাসতো তখন মনে হতো মুক্তা ঝড়ে পরছে!!

ও কথা বললে যাস্ট চোখ ফেরানো যেত না!!

ওকে দেখার পর কল্পনায় স্বপ্নে কিংবা বাস্তবে সব যায়গায় শুধু ওর হাসি মুখ দেখতে শুরু করলাম।

এক নিমেষেই ভুলে গেলাম নিজেকে শুধরে নেয়ার সেই চিন্তা!!

এর পর খোঁজ নিয়ে জানতে পারলাম ও আমার ডিপার্টমেন্টে পড়ে।

আমার ব্যাচ মেট;

নাম রিয়া রায় চৌধুরী

ধর্ম: হিন্দু

কিন্তু আমি মুসলিম।

আর তখন এসব ভাবার সময় ছিল না

মাথায় ওকে ছাড়া আর কিছুই আসতে ছিল না।

তখন অনেক কষ্টে আমি ওর কন্টাক্ট নাম্বার জোগাড় করেছিলাম ।

নিয়ম করে রোজ ওকে কল করতাম কিন্তু ও হ্যালো বললেই ফোন কেটে দিতাম কারণ ওর কন্ঠ শোনার পর আমার গলা শুকিয়ে যেত!!

কিছু বলার অবস্থায় আর থাকতাম না আমি।

এর পর সময় যেতে যেতে আমার বন্ধু হলাম।

একসাথে ঘোরাঘুরির, খাওয়া-দাওয়া, হাঁটু গেড়ে বসে ফুল দেয়া, ঘন্টার পর ঘন্টা ফোন আলাপ ইত্যাদি চলতে শুরু করে। 

শেষমেষ দুজন দুজনকে ভালোবেসে ফেললাম ফাইনালি ।

দেখতে দেখতে তিন মাস হয়ে গেল আমাদের রিলেশনশিপ।

হঠাৎ ভার্সিটি বন্ধ দেওয়াতে

আমি বাড়িতে এলাম।

বাড়িতে এসে পা দিতে না দিতে জানতে পারলাম পরিবার আমার বিয়ে ঠিক করে রেখেছে।

এরপর পরিবার জোর করে সেই ছেলের সাথে আমার কথা বলাতে শুরু করে।

কিন্তু আমি কিছুতেই তাকে সহ্য করতে পারছিলাম না।

কোন ভাবেই মানিয়ে নিতে পারছিলাম না।

আর তাছাড়া আমি এতো দিনে বুঝে গেছি

আমি একটু আলাদা।

আমার ভালো লাগা আলাদা ।

আর এটাও জানি কোন ভাবেই কোন ছেলের সাথে আমার সম্পর্ক হতে পারে না।

অনেক কষ্ট হলেও আমি নিজেকে লেসবিয়ান বলে মেনে নিয়েছিলাম এতো দিনে।

আর আমি জানতাম এটা ঠিক হবার নয়।

কারণ এটা শুরু হয়েছিল তখন থেকে যখন আমি ভালো মন্দ বুঝতাম না।

সেই ছোট্ট বেলা থেকেই নিজের অজান্তে

আমি লেসবিয়ান হয়েছিলাম।

তাই কোন ভাবে আমি একটা ছেলেকে বিয়ে করতে পারিনা!!

এতে আমার সহ ছেলেটার জীবন ও নষ্ট হয়ে যাবে।

অন্য দিকে আমার ধর্ম সমকামীতা সাপোর্ট করে না।

সমাজ এটাকে ঘৃণার দৃষ্টিতে দেখে।

আমরাও যে মানুষ আমাদের ও যে স্বাধীন ভাবে বাঁচার অধিকার আছে।

আমাদের যে ভালো লাগা ভালোবাসা আছে

তা এই সমাজের মানুষ বুঝতে চায়না।

তাছাড়া সমাজ তো দূর পরিবার ও মেনে নেয়না।

 আমার এখনো গ্রাজুয়েশন কমপ্লিট হয়নি

আমি এখনো আমার পরিবারের উপর নির্ভরশীল।

অন্যদিকে আমি আমার পরিবারকে খুব ভালোবাসি ।

এমতাবস্থায় বুঝতে পারছি না আমার কি করা উচিৎ!!

প্লীজ সাজেস্টেড মি 🙁🙁

Source: BAH( Bangladesh Against Homophobia)

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.