
ভাবছিলাম আমার ডেটিং অভিজ্ঞতা নিয়ে লিখব। শুয়ে শুয়ে ভাবছিলাম কোনটা নিয়ে লিখব। মাথার মধ্যে ঘুরছে কি হয়েছিল সেসময়গুলিতে, কোনটা সবার আগে মনে পড়ছে, সেই অনুভুতির সৃতি গুলি প্রায় ফিকে হয়ে যাচ্ছে, নাহ তেমন পাচ্ছিনা, বেশিরভাগ হুকাপ, ডেট বলা যায় না। হাতে গোনা কয়েকটা বের হল, কাকতলীয় বিষয় এই যে, প্রথমেই মাথায় আসা খুব ভাল লাগার প্রথম তিনটা ডেটিং হয়েছিল বৃষ্টির দিনে।
তখন ২০১৭ যত দুর মনে আছে, আমি তখন চুল বড় করব ঠিক করেছি। ২০১৬ এর ডিসেম্বরে বেস্টফ্রেন্ডকে আমার সমকামী সত্ত্বার ব্যাপারে বলবার পরে, তাঁর সাথে সম্পর্ক খারাপ যাচ্ছিল সে সময়। যেন কাউকে হারাতে না হয় এজন্য, ২০১৭ এর শুরুতে আমি হেটেরোসেক্সুয়াল হবার চেষ্টা করেছিলাম, দেড় মাস এক্সগার্ল ফ্রেন্ডের সাথে প্রেম করবার বৃথা চেষ্টা করে ব্রেকাপ করে বের হয়ে এসেছি। এবং আমি শিওর যে আমি একজন গে। এরপরে জীবনে প্রথমবার যেই পুরুষের প্রেমে পড়েছি,উনার আরেকজনকে মনে ধরেছে, ট্রেনটা মিস করে ফেলেছি। এমন একটা সময় ২০১৭ সালের বর্ষাতে আমি অনলাইনে একাকীত্ব কাটানর জন্য মানুষ খুজছি, তখন শুধু হুক আপটা করতাম। চুপি চুপি ঘরের ভিতর হুক আপ করে, বাহিরে সবার সামনে হেটেরোসেক্সুয়াল সাজা। অবশ্য কারন ছিল, ২০১৬ তে দেশে দুজন সমকামী মানুষকে মেরে ফেলা হয়েছিল,যার নিউজ হয় ফলাও করে। এছাড়া প্রায় অনলাইন কমিউনিটিতে প্রায়, শুনতাম যে বাসায় জানবার পরে একে ওকে বাসা থেকে বের করে দিয়েছে বিভিন্ন ছাত্র বয়সী দের। তারা হাহাকার করে পোস্ট দেয়, আমাকে বাসা থেকে বের করে দিয়েছে, কেউ থাকবার জায়গা দিবে কিংবা কাউকে বাসায় আটকে মার ধোর করছে। এসব কারনে তাই ঘরের বাইরে কোন সমকামীর সাথে যে দেখা করব কিংবা প্রেম করবার সাহস এর আগে তেমন হয় নি। এছাড়া আমি আমার নিজের বাসা থেকে বেকার থাকবার জন্য কথা শুনতাম অনেক বেশি।আর ভাল সন্তানের ইমেজ ধরে রাখার জন্য সব কথা মনে চেপে রাখতাম, এখনকার মত প্রতিবাদ করতাম না, তাই সেসময়য় বেশ ইমোশনাল ঝড়ের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছিলাম।
এমন একদিন দুপুরের সময় হঠাত করে অনলাইনে আমার গে একাউন্টে একটা মেসেজ আসে। সাধারণত মেসেজ গুলিতে সরাসরি সেক্স করবার প্রপোজ করা হয়, সেক্স করার জন্য উত্তেজনা তো সারাদিন কাজ করে না। মাঝে মাঝে তো মনে চায় কারো সাথে আমার ইমোশনাল একটা বন্ডিং হোক। তালে তাল মিলিয়ে কথা বলার মত মানুষ বেশ কম।
মেসেজের রিপ্লাই দিলাম, খুবই ইন্টারেস্টীং ভাবে চ্যাট শুরু হল, উনি কথায় বেশ পটু। আমি নিজেও তখন নতুন নতুন রসিয়ে রসিয়ে চিজি ফ্লারট করি, মাঝে মাঝে ডেস্পারেশনে গোলমেলে করে ফেলতাম, তাই নার্ভাস থাকতাম, কিন্তু আজকে হয় নি, একটা ব্যালেন্স ছিল, ছন্দ ছিল, এমনটা পাওয়া দুষ্কর। ফোন নাম্বার চাইল, আমিও দিয়ে দিলাম। বেস্টফ্রেন্ড আর গার্লফ্রেন্ড এর কাছে কামিং আউটের পরে “আমি সমকামী ” ইহা যদি সবাই জেনে যায় তাহলে কি স্ক্যান্ডাল হবে, সেই ইন্সিকিউরিটীও কিছুটা কাটিয়েছি, তাই ফোন নাম্বার দিতে সমস্যা হয় নি।
ফোন আসল, ঐ পাশ হতে মাদকতা পূর্ণ এক ভারী গলার ভয়েস। হ্যালো শুনবার সাথে সাথে শিড়দাড়া দিয়ে বিদ্যুৎ বয়ে গেল। ভরাট গলা ম্যাচিউর টোন আর লাইনগুলি শুনে আমি তো গ্যায়া। এত সুন্দর করে বলছিল। আর আমি কথা গুলি গিলছিলাম। আমি তখন বেশ দুষ্টু দুষ্টূ কথা বলি, শুনে উঁনি বার বার হাসছেন। এর মাঝেই আমাকে বললেন- আপনার ভয়েসটা বেশ সুন্দর, খুবই আকর্ষণীয়। উনি ছিলেন প্রথম কেউ যিনি আমার কন্ঠের প্রশংসা করেন, এর আগে কেউ আমার কন্ঠের এভাবে প্রশংসা করে নি। যার দিওয়ানা হয়েছি ভিতরে ভিতরে, সেই মানুষের প্রশংসা শুনে আমি তো খুশিতে গদ গদ। আর সেদিন আমি ইমোশনাল ব্যালেন্স হারাচ্ছিলাম না।
তো আমি কথা বলতে বলতে বারান্দায় চলে গেলাম, আকাশে ঘন কালো মেঘ দলা পাকিয়েছে, আকাশ ভেঙ্গে প্রচন্ড ঝড়-বৃষ্টি নামবে।
আমি মনে জেগে ওঠা সুপ্ত ফ্যান্টাসির ইচ্ছে বলে ফেললাম, “ইশ আপনার সাথে যদি এই প্রচন্ড ঝড়ের মাঝে দেখা করতে পারতাম।”
ওদিক দিয়ে বলল, “হ্যাঁ করতেই পারেন, আমি নিউমার্কেট আসছি আপনার বাসার পাশেই, বিকালের মিটিং এর আগে হাতে সময় আছে।”
শুনে তো আমার বুক ধক করে লাফ দিয়ে উঠল, যেন আমি শক খেয়েছি। ভাল লাগার একজন নতুন মানুষের সাথে দেখা করতে পারব, এই ভেবে আমি তো মনে মনে ইয়াহুউউ।
কিন্তু, ফোনে আমি যথাযথ ভাব গাম্ভীর্যের সাথে বললাম, “হুম করা যায়।”
ওদিক থেকে বলল- “আমি ১ ঘণ্টার মধ্যে আসছি।”
এর মধ্যে ঝড় চলে আসল। আমি তো ভাবছি যে ঝড় চলছে, কিভাবে দেখা করব, বাসা থেকে কি বলে বের হল, আর ওদিকে আমার ঝড়ের মাঝে দেখা করবার ইচ্ছের কথা শুনে উনি চলে আসছেন।
গেম অফ থ্রোন্সের গেঞ্জির সাথে, ব্লু জিন্স পড়ে, বড় হয়ে যাওয়া চুল গুলি ব্যাক ব্রাশ করে, আমার শখের নীল ছাতা নিয়ে বের হলাম।
উনি আসতে আসতে বৃষ্টি থেমে গেল। আমি নিরাশ হলাম, যাহ ছাতার যত ফ্যান্টাসি একটাও হবে না আজ, এরপরেও ছাতা নিয়ে বের হলাম। হাটছি আর এর মাঝে ভাবছি, আমরা তো কেউ কাউকে ছবি শেয়ার করি নাই, উনি দেখতে কেমন হবে ? আমার ভাল লাগবে? আর যদি আমাকে ভাল না লাগে ? যদি ২০১৫ এর ঐ লোকটার মত মত দেখে হাত মিলিয়ে “আমার কাজ আছে” বলে রেখে চলে যায়!!! ব্লাইন্ড ডেটে যে যাচ্ছি, কি যে আছে কপালে।
নিউমার্কেটের দিকে যেতে ঢাকা কলেজের গলির সামনে এসে ফোন দিলাম, উনি ঢাকা কলেজের মেইনগেইটের সামনে দাঁড়িয়ে আছেন। আমরা ফোনে কথা বলতে বলতেই আমরা দু দিক থেকে আগালাম, এর মধ্যে মাঝ পথে এসে দেখতে পেলাম যে সাদা নীল প্রিন্টের শার্ট আর জিন্স পড়া একজন ৬ ফিটের, শক্ত, পেটানো, চকচকে,ব্রোঞ্জ দেহের, হালকা কাচা পাকা চুলের, তরুণ থেকে মধ্য বয়সের মাঝা মাঝি, এক সুদর্শন পুরুষ ফোন হাতে হেটে আসছে।
প্রথম দর্শনে আমি তাকে দেখে নিজেকে পুরোপুরি হারিয়ে ফেললাম। দুর হতে আমাকে দেখে “কাউকে খুজছি, আপনি কি সেই” এমন একটা লুক। আমি হাত তুললাম।
উনি সামনে এসে বললেন, “আপনি মুন!কেমন আছেন?”
উনার ভয়েসের স্পেশালিটীটা বলে নেই।ভারী কণ্ঠের সাথে সুরেলা গলার একটা মাদকতা পূর্ণ ঝংকার আর করোপারেট ইংরেজির টোনে বাংলা বললে বাংলা শুনলে যেমন লাগবে, উনার গলার স্বর একদম তাই। আমি লিখছি আর আমার এখনো কানে বাজছে।
উনি বললেন “চলেন কোথাও বসি।”
আমরা হাটতে হাটতে নিউমার্কেটের ওভার ব্রিজের নিচে ছোট গেট দিয়ে ঢুকলাম, যারা ঢাকায় নিয়মিত নিউমার্কেট যান, তারা সবাই দেখেছেন নিশ্চয়ই, ঐ গেটের সাথে লাগোয়া কিছু খাবারের দোকান আছে, আমরা তাঁর প্রথমটাতে ঢুকলাম।
ফোনে যতই অন্তরঙ্গ ভাবে কথা বলি, কিন্তু সামনা সামনি দেখা হওয়ার পরে একটা আড়ষ্টতা কাজ করে। উনাকে দেখে আমি নিজের উপর নিয়ন্ত্রন একটু হারিয়ে ফেলেছি।আমার এমন অভিজ্ঞতাই ছিল না সে সময়, তাই কি বলব, কি করব বুঝে উঠতে পারছি না। আমি মনে মনে ভাবছি, আচ্ছা উনার কেমন লেগেছে আমাকে? উনি কি ভদ্রতা করে নিয়ে আসলেন।
আমরা দুজন মুখোমুখি বসলাম, আমি বেশ খোলাখুলি কথা বলছিলাম সব সময়ের মত।কিন্তু নার্ভাস, নার্ভাসনেস কাটানর জন্য কথা বলেই যাচ্ছি, আর উনি শুনছেন।
এর মাঝে আমরা কফি অর্ডার করলাম, কফিতে চুমুক ইতে দিতে শুনলাম উনি চট্টগ্রাম নিবাসী, ৩২ বছর বয়সী, ঢাকায় এসেছেন মাল্টীন্যাশনাল কোম্পানির কাজে, খুব ব্যস্ত থাকেন। উনার কিছু অভিজ্ঞতা শেয়ার করলেন। আমি আমার অভিজ্ঞতা আর কাহিনী শেয়ার করলাম। উনার মধ্যে যে ব্যাপারটা ছিল, উনি সব কিছু গভীর ভাবে শুনে খুব শান্ত ভাবে মতামত দিতেন, আমার নিজের মত নিজেকে প্রকাশ করার ব্যাপারটা উনি খুব শান্ত ভাবে কথার এঙ্গেজমেন্ট আর টোনের মাধ্যমে রেসপন্স করে প্রকাশ করছেন। আমি উনাকে বললাম যে আপনি যে ৩২ বছর বয়স। আপনাকে দেখে মনে হয় না, এত তরুণ লাগছে। উনি এবার আমার দিকে তাকিয়ে বললেন যে আমার গলা ভয়েস অনেক সুন্দর, আমি বেশ সুন্দর করে কথা বলি আর আমাকে উনার ভাল লেগেছে আর একটু ইতস্তত বোধ কাজ করছে তাঁর অনুভুতি প্রকাশ করতে। আমি তো জানি, ভাল লাগার কথা বলার সাহস করা অনেক শক্তির সঞ্চয়ের ব্যাপার। কথা বলবার সময়, খেয়াল করে দেখলাম উনি নিজেও আড়ষ্ট ভাবে বসে কেমন আড়চোখে চোঁরাভাবে আমার দিকে তাকিয়ে আমাকে দেখছেন।বড় বড় তীক্ষ্ণ গভীর চোখের তারায় খানিকটা wonder,লাবন্যময় কাঠিন্য পূর্ণ চেহারায় একটা ভয়মিশ্রিত উৎসাহ।কথা গুলি বিশ্বাস না হতে চাইলেও,তাঁর এই লুক থেকে আমি বুঝতে পারি যে, উনার আমার প্রতি আকর্ষণ আছে, আমি এবার পুরো নিয়ন্ত্রন ফিরে পেলাম নিজের উপর। এই দেবদূত, মডেল তুল্য পুরুষের সামনা সামনি আমার উপর ভাল লাগা কাজ করছে, মানে সেই রিয়েলাইজেশন আমার জন্য এক লাইফ চেঞ্জিং মুহূর্ত।
এই অভিজ্ঞতার আগে আমি নিজেকে খুবই কুৎসিত মনে করতাম। অন্তত ফ্যামিলি,বন্ধুবান্ধব,আশেপাশের মানুষেরবডিশেমিং,কালারিজমে তাদের কথাই বিশ্বাস করে নিয়েছিলাম, কিন্তু এই অভিজ্ঞতার পর থেকে বুঝতে পারি যে, তারা সবাই ভুল, কেবল এটাই সত্য। শুধু এটাই সত্য, আর কিছু নয়।
কথা বলতে সময় কিছুটা পার হয়ে গেল। উনার মিটিং আছে তাই ৪০-৫০ মিনিটের বেশি বসা হল না, এত সুন্দর একটা মানুষ তাঁর সাথে আর কবে দেখা হবে কে জানে, আর আমি কি এমন মানুষ পাব যে আসলে আমাকে পছন্দ করবে! আহা একটু ছুয়েও দেখতে পারছি না, কিন্তু চাইলেই তো এখন ছোয়া যাবে না।
আমি জিজ্ঞেস করলাম ,আপনি কোন দিকে যাবেন, উনি বললেন নীলক্ষেত। আমার বাসার উলটো দিকে।
আমি নিরাশ হয়ে বাসার দিকে যাবো, এমন সময় প্রকৃতি আমার দিকে মুখ তুলে তাকাল। দেখি টিপ টিপ করে বৃষ্টি পড়ছে খুব অল্প, সব যদিও ছাতার দরকার নেই, তাঁর পরেও আমি আমার নীল ছাতা খানা খুললাম।
ছাতা খুলে উনাকে বললাম, “ছাতার নিচে আসুন, নইলে ভিজে যাবেন যে, চলুন আপনাকে নীল ক্ষেত এগিয়ে দিয়ে আসি ।”
আমি ৫ফিট ৭ আর উনি প্রায় ৬ ফিটের মত বিশাল দেহের মানুষ, আমি এক হাতে উঁচু করে ছাতা ধরে উনাকে ছাতা নিচে আসবার সুযোগ করে দিলাম। উনি কোন কথা ছাড়া চলে আসলেন।
আমি বললাম- “আরো কাছে আসুন, ওদিক দিয়ে ভিজে যাচ্ছেন যে।”
বলে উনার হাতে ধরে একেবারে টেনে এনে আমার শরীরের সাথে লাগিয়ে দিলাম, হাত দিয়ে উনাকে ধরলাম কাধে। মানে সেই মুহূর্তের তাঁর শরীরের স্পর্শ আমি জীবনেও ভুলব না। লিখছি আর ভাবছি, সেদিনউনি যখন ডান পাশটায় যখন গা ঘেঁষে দাড়িয়েছিলেন কেমন লেগেছিল।
আর এত শক্ত শরীরের বড় মানুষটা এক টানে আমার পাশে চলে আসলেন। আর আমি উনার এত্ত বড় শক্ত কাধ কোন মতে ধরেছি।
উনি অবাক এবং বিনয়ী কন্ঠে আমাকে বললেন , না আমার সমস্যা হচ্ছে না। এত কষ্ট করে ছাতা ধরে আছেন ।
আমি বললাম- ছাতা এভাবে না ধরলে আপনাকে স্পর্শ করব কিভাবে বলুন ?
আমি বলছি আর উনার কাধের অপর প্রান্ত ধরে আছি।
এবার বলার পরে উনি বুঝতে পারলেন, এতক্ষন বুঝতে পারেন নি, কারন আমি উনাকে জাস্ট ধরে রেখেছি।
এবার একটা হাসি মাখানো বুঝতে পারা জড়তা কাটানো টিজিং সুরে বলে উঠলেন- আচ্ছা তাই নাকি। আমি অনুভব করতে পারি ,সেই মুহূর্তে উনার কন্ঠের আর দেহের সমস্ত জড়তা কেটে যায়।
আমি এবার আমার স্পর্শ পরিবর্তন করি, প্রেমিক সুলভভাবে, হাত কাধ থেকে পিঠে নামিয়ে আনি, হাত বুলিয়ে উনাকে অনুভব করি। হালকা করে স্পর্শ করতে করতে, উনার শরীরের স্পর্শে হাটছি চুপচাপ।
এর মধ্যে উনি মোহময় কণ্ঠে আমাকে চান এমন টোনে বললেন- “দিন এবার ছাতাটা আমার হাতে দিন, আমি ধরছি।” যার মানে উনি আমাকে ধরবেন।
এবার ছাতা হাতে নিয়ে, আমাকে কাধে শক্ত করে ধরলেন, উনি আমায় ধরবার পরে আমার শরীর যেন বলতে চাইছিল, আরো বেশি করে ধরুন, যেভাবে আপনি চান। লোহার মতশক্ত হাত, আর বলিষ্ঠ স্পর্শে ধরবার পরে, হাত একবারে পিঠ দিয়ে নিচে নামতে থাকে পিঠের নিচে এসে বাম দিকের কোমরে।
আমি মনে মনে ভাবি- চান্স পেয়ে কি ফাস্ট যাচ্ছেন উনি, আর আমার কাধ থেকে পিঠের দিকে নামতে আধা মিনিট লেগেছে, ভেবে মুচকি হাসছি। আর আমাকে স্পর্শ করবার জন্য উনার এত ব্যাকুলতা অনুভব করে আমার হৃদয় প্রেমে টইটুম্বুর।
এবার আমি টের পেতে লাগলাম যে উনি আমার কোমর থেক এরপরে নিতম্বে উনার হাত নিয়ে যেতে চান, কিন্তু সাহস হচ্ছে না।
এদিকে পুরো রাস্তায় কেবল আমরা দুজনেই ছাতার নিচে ,আর কেউ ছাতা ব্যাবহার করছে না খেয়াল করলাম চারদিকে। উনার নিতম্বে যাওয়ার সাহস হচ্ছে না।
এবার আমি ছাতাটা আমার হাতে চাইলাম, ছাতা বদল করে উনার কোমরের কার্ভ ধরে হেটে হেটে বাসস্ট্যান্ড চলে আসলাম। এই ২-৩ মিনীটের ছাতার নিচের হাটবার পুরো সময়টা আমরা চুপ চাপ ছিলাম একদম।
যেতে দিতে মন চাইছে না, বিদায় জানাতে হবে, ছাতাটা নামিয়ে বন্ধ করলাম, উনি মুখো মুখি দাড়ালেন, আমি উনার চেহারার দিকে তাকাতে পারছি না, একবার তাকিয়ে আবার অন্যদিকে তাকানর চেষ্টা করলাম। কিভাবে তাকাই কারন আমাকে পাবার কামনা উনার চোখে মুখে একে আছে,আমি সহ্য করতে পারব না।
উনি রিকশায় উঠবেন, আমার মুখ দিয়ে কোন কথা বের হচ্ছে না।
উনি বললেন- “আচ্ছা যাই তাহলে”
আমি বললাম, আচ্ছা, “ফোন নাম্বার তো রইল দেখা হবে, কথা হবে।”
আমরা দাঁড়িয়ে আছি দুপুর ২টা ৩০ মিনিটে নীল ক্ষেতের মোড়ে, এক দিকে একগাদা রিকশা দাডিয়ে, বাস,কার সব কিছু চলছে।উনার হাত হালকা হয়ে আসছে, আমি বুঝতে পারলাম উনি যেতে চান এবার।
বলে আমার ভাবভঙ্গিতে উনি বুঝলেন আমি জড়িয়ে ধরতে চাই। উনিও সামনে এগিয়ে আসলেন উনাকে হাত দিয়ে বুকে টেনে কোমরে জড়িয়ে ধরে শক্ত করে টেনে ধরলাম, উনিও আমাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলেন পিঠে।
বিদায় খুব কষ্টদায়ক মুহূর্ত, চোখ গুলিতে “যেতে দিতে চাই না, একসাথে থাকতে চাই” এমন ভাষা ঘোরাফেরা করে, কিন্তু বিদায়ের সময়সবার মনে ধূলো দিয়ে, আপনি আপানার প্রেমিককে জড়িয়ে ধরতে পারবেন, আর সেই শক্ত জড়িয়ে ধরবার সময়ে আমরা দুজনকে দুজনকে কতটাই চাই একটা কথা না বলেই প্রকাশ করতে পারি।
আমি উনাকে জড়িয়ে ধরে শরীরের সাথে শরীর মিশিয়ে দিতে চাই, এমন ভাবে জড়িয়ে ধরে আছি। আর বেশিক্ষন জড়িয়ে ধরলে মানুষ দেখলে কে কি ভাববে ,এই ভেবে ছেড়ে দিলাম। উনি বাঁধন হালকা করবার আগেই ছাড়লাম, উনি আগে ছাড়বেন ইহা সহ্য হবে না ।
উনি রিকশায় উঠে গেলেন, চলে যেতে দেখলাম, উনাকে বিদায় দিয়ে বাসার দিকে রওনা দিলাম, আর ভাবছি এই মুহূর্ত গুলি আমার!!! ভাবছিলাম আবার কি উনার সাথে দেখা হবে, নাকি হবে না।
কি ভাবছেন, আমাদের হ্যাপি এন্ডিং হল কিনা।
এরপরে রাত ৯-১০টা যে সময়ে কল দিতাম না কেন, চারদিক থেকে গাড়ী না হলে মানুষের কোলাহল ভেসে আসত, খুব ব্যস্ত থাকতেন, ঢাকাতে খুব কম আসতেন, অনেক দিন পর পর আমি কল দিতাম। উনার নাম্বার যে ফোনে ছিল ,ওটা ছোট ভাই বাসায় ভেঙ্গে ফেলে ২০১৮ এর ডমেস্টিক ভায়লেন্সের সময়। পরে সেটা ২০১৯ এ সারিয়ে নাম্বার বের করে সেভ করে রাখি। ২০২০ সালে এ বছরে উনাকে ফোন দেই।
এর মাঝে অনেকটা সময় পেরিয়ে গেছে, আমি আর সেই ২০১৭ এর মানুষ নেই, নিজের উপর নিয়ন্ত্রন আরো বেড়েছি, অনেক কিছু দেখেছি, জেনেছি, বুঝতে শিখেছি ।
একদিন ঢাকা কলেজের মাঠে সন্ধ্যায় একা বসে ফোন বের করে নাম্বার দেখছি, কার কার নাম্বার আছে। দেখি ক্রাশ নামে সেভ করা উনার নাম্বারটা। এখনো এভাবেই আছে আমার নকিয়া মোবাইলে।
কল দিলাম, সেই পরিচিত গলার সুর, এখনো সেই একই আবেদন দেয় আমাকে।
জানতে চাইলেন, আমি কে বলছিলাম।
আমি মনে করিয়ে দিলাম, আমাদের দেখা হয়েছিল। আমরা নিউমারকেটে একসাথে কফি খেয়েছিলাম।
এটা বলতেই উনি চিনে ফেললেন। আমার কথা জানতে চাইলেন, কেমন আছি, কি করছি।
উনাকে জানালাম যে আমার বাসায় ,আমার বন্ধুবান্ধব সবাই জানে আমার ব্যাপারে।
উনি জিজ্ঞেস করলেন- কিছু বলেনি বাসায়?এখন কি অবস্থা।
আমি জানালাম- ২০১৮এর প্রথম দিকে জানানর পরে অনেক সমস্যা হয়েছে, ৩জন মানসিক ডাক্তার দেখিয়েছে, ডাক্তাররা সবাই আমাকে সমর্থন করেছে। ডমেস্টিক ভায়লেন্স, ঝগড়া, বাসা থেকে বের হয়ে যাওয়া, প্রায় এক বছর গৃহবন্দিত্ব এর পরে, এখন বাসায় সবাই মোটামুটী সহনশীল, টিকে গেছি। এটা বুঝি যে বাসা থেকে বের করে দিবে না। এখন শুধু দেশের বাইরে যাওয়া নতুন বা জব করা,তারপরে মুক্তি।
উনি বুঝলেন, অনেক সুন্দর রেসপন্স করলেন বর্তমানকে, এপ্রিশিয়েট করলেন, ভবিষ্যৎএর জন্য উৎসাহ দিলেন।
আমি নিজের মত বলছি যে আমি স্বাধীন এখন, নিজের মত বাচতে পারি।
উনি ব্যাপারটা এপ্রিশিয়েট করছেন- এটা বড় ব্যাপার যেটা সবাই জীবনে পায় না।
আমি আমাদের কথোপকথনে একটা শুন্যতা খেয়াল করলাম ,যে আমরা কিন্তু যথেষ্ট ফ্রি, আমি সব শেয়ার করছি আর উনি কক্ষনো উনার পার্সোনাল লাইফে কি হচ্ছে তা বলেন নি। তাই আমিও আগে সরাসরি জিজ্ঞেস করি নি। আমার এত দিনের অভিজ্ঞতা, যখন কেউ নিজের জীবন নিয়ে কিছু না বলে, একটু গুটীয়ে রাখছে, গোপন রাখার ভাইব দিচ্ছে, তাঁর লাইফে কে আছে না আছে জানাচ্ছে না, তাঁর মানে হল উনার লাইফে কেউ না কেউ আছে অথবা উনি বিবাহিত, যার কারনে উনি বলতে চান না। আর উনি ৩৫ পেরিয়েছেন, বাংলাদেশের বাস্তবতায় পরিবারের সাথে থেকে সিঙ্গেল থাকা প্রায় অসম্ভব ।
সন্দেহ হল, প্রশ্নটা করলে সব মোহ ভেঙ্গে যাবে। ভেঙ্গে গেলে যাবে কিন্তু আমাকে প্রশ্নটা করতে হবে, সত্যটা জানতে হবে।
আমি এর মাঝেই জিজ্ঞেস করলাম। আচ্ছা আপনার লাইফে কে আছে এখন।
উনি ডিপ্লোম্যাটিকালি উত্তর দিলেন- আমার পরিবারের মানূষ জন, আর অফিস নিয়েই বেশি ব্যাস্ত থাকি।
আমি এবার সরাসরি জিজ্ঞেস করলাম- আপনি কি বিবাহিত?
উনি একটু বেশি সময় চুপ থেকে বললেন – হ্যাঁ আমি বিবাহিত, আমার ৭ বছরের একটা বাচ্চা আছে।
যাহ আমার সব আশায় গুড়ে বালি, কিন্তু যেহেতু উনার জীবনের সত্য শেয়ার করছেন, আমার জানতে হবে এবং এই শেয়ার করবার সুযোগ উনার জীবনে আর নাও আসতে পারে, তাই থামলাম না।
আমি -আচ্ছা আপনি কি গে নাকি বাইসেকসুয়াল।
উনি- আমি বাইসেক্সুয়াল।
আমি –কোন দিকে বেশি প্রেফারেন্স আপনার।
উনি – দুদিকেই সমান। যেকোন একদিকে হলেই হয়ে যায়।
আমি- কিন্তু আপনি তো বাইসেক্সুয়াল( উভকামী)। আপনার নারী পুরুষ দু দিকেই যৌন আকর্ষণ কাজ করে। আপনার এই যে একটা অংশ সবার থেকে লুকিয়ে রাখতে হচ্ছে, বিয়ের পরেও নিজের সঙ্গীর কাছে নিজের এমন পরিচয় আর যৌনতার বড় একটা অংশ লুকিয়ে রাখা, আর যখন আপনি ছেলেদের প্রতি আকর্ষণ অনুভব করেন তখন এটা কিভাবে ম্যানেজ করেন। কারন একজন ছেলে আপনাকে যা দিতে পারবে, সেটা তো একজন মেয়ে দিতে পারবে না শারিরিক ভাবে। সেই অভাব কিভাবে পূর্ণ করেন?
উনি- ধরুন, চা আর কফি দুটোই ভাল লাগে আমার। চা খেয়ে আছি, কফি খেতে ইচ্ছা করলেও খেতে পারি না, কফি খাবার ইচ্ছে হলে চা খেয়ে নেই, আর নিজের হাত তো আছেই।
আমার সব মিলিয়ে আসলে খারাপ লাগছে, নিজের জন্য, তাঁর চেয়ে বেশি উনার জন্য, এবং উনার স্ত্রী এর জন্য।
আমি- আই উইশ, আপনি নিজের মত করে বাই সেক্সুয়াল হয়ে বাচতে পারতেন। কিন্তু আপনার বউ আছে, বাচ্চা আছে, আর আপনি বাই সেক্সুয়াল, ন্যাচারাল বহুগামী। বাংলাদেশের বাস্তবতায় বাইসেক্সুয়াল জানার পরে, আপনাকে মেয়েরাও ছাড় দিবে না, আবার গে কমিউনিটিও ছাড় দিবে না।সত্য নিয়ে সবার সামনে আসা, আপানার জন্য অনেক অনেক গুন কঠিন, তাই আসলে আপনাকে আমার কিছুই বলার নেই।
(আমার বলার মত অবস্থাও নাই।)
উনি – হ্যাঁ আমাদের দেশে এমনটা পসিবল না, কিন্তু যা আছে সেটা নিয়েই থাকতে হবে মানিয়ে।
আমরা আরো কিছুক্ষন কথা বলি। আমার কথা বলতেও ইচ্ছে করছে না, আবার কথা বলতে ইচ্ছে করছে, এবং আমি জানি আমি এরপরে উনাকে আর ফোন দিব না উনাকে চাইবার জন্য, তাই আরেকটূ বেশিক্ষন কথা বললাম।
এইত নাম্বারটা ফোনে এখনো আছে, কিন্তু আর কখনো কল দেই নি, আর ভাবিও না ফোন দেয়ার কথা। এই কনভারসেশনের আগে ভাবতাম যে দেখা করব প্রেমিক রুপে।
What I want, is not my truth,
What I do, is my truth.
We cannot waste time on what I want.
I have to accept the truths, My truths.
We all do.
আমি একজন সমকামী পুরুষ হিসাবে যেমন নিজের পরিচয়ে বাচার সুযোগ পাই না, বাইসেক্সুয়ালদের ও সেইম অবস্থা। আমাদের মত সমকামী, উভকামী(বাইসেক্সুয়াল)রা, যদি নিজের যৌন পরিচয়ে বাচতে চাই, তাহলে হয়ত বাচতে পারব কিন্তু আমাদের জীবনের ফ্যামিলি হতে পারিবারিক পরিচয়, বন্ধু-বান্ধব হতে পরিচয় হারাতে হয় বেশির ভাগ সময়। আমি হারিয়েছি অনেক কিছু- সময়, সম্পর্ক, দক্ষতা, যোগাযোগ অনেক কিছু। কিন্তু নিজেকে পেয়েছি যেটা সবচে বড় পাওয়া।
বেশির ভাগ মানুষ নিজেকে পাবার সংগ্রামে নামতে চায় না, এই বাকি সব সমর্থন হারাতে হবে বলে, নিজের সুযোগ সুবিধা কজন হারাতে চায় বলুন, সেটা আমিও বুঝি ।
এখানে আমরা সমকামী বাইসেক্সুয়াল যৌন পরিচয়ের কারনে আজ ভিকটিম। কিন্তু ভিক্টিম হয়ে আমাদের যৌন পরিচয় গোপন রেখে আরেকজন মানুষের জীবন নষ্ট করার কোন অধিকার আমাদের নেই। আমাদের দেশে নারীরা এমনিতে পুরুষতান্ত্রিকতাঁর চরম শিকার। আমাদের কোন অধিকার নেই ,তাকেও ভিক্টীম বানানর, সেটা অন্যায়। তাই বিয়ে না করার জন্য সুযোগ সুবিধা যদি কিছু হারাতে হয়, যদি কিছু কথা শুনতে হয় সেটূকু আমাদের করতে হবে। আর একজন সঙ্গীর সাথে যদি আমি আমার জীবন শেয়ার করতে না পারি, কেউ পাশে থেকেও যদি আমরা নিজেদের কথা বলতে না পারি, কেউ পাশে থেকেও যদি একাকীত্ব অনুভব করি, তবেঁ সেই একাকীত্তের চেয়ে একা থাকা অনেক ভাল।
বাইসেক্সুয়ালদের মধ্যে অনেক সুন্দর ব্যালেন্স থাকে, আমি জীবনে যত জন বাইসেক্সুয়াল দেখেছি তারা বেশিরভাগ বেশ ডিপ্লোম্যাটিক, ম্যাচিউর।তাদেরকে যদি নিজের সত্য আর পরিচয় নিয়ে বাচতে দেয়া হয়, বিয়ে করতে বাধ্য না করা হয়, তবেঁ এমন কাহিনী গুলি কমে আসবে, এক সময় হয়ত আর হবেনা।
বাইসেক্সুয়ালদের যৌন পরিচয় যেমন হেটেরো সেক্সুয়াল ও সমকামীদের বুঝতে হবে, তেমনি সম্মান করতে হবে। আর যিনি বহুগামী, তাকে বহুগামী হিসাবেই বাচতে দিন, তাকে জোর করে শেমিং করে, মনগ্যামাস সুপ্রিমেসি দেখিয়ে,সামাজিক সুযোগ সুবিধা কেটে দেয়া ভয় দেখিয়ে বিয়ে নামক চুক্তিতে আটকে তো লাভ নেই, সবার ক্ষতি। এজন্য সবাইকে আগায়ে আসতে হবে,সচেতন করতে হবে, খোলাখুলি ভাবে কনভারসেশন করতে হবে।
আমরা এমন একটা সমাজ চাই, যেখানে আমি আমরা সমকামী যৌন পরিচয়ে বাচতে পারব, যেখানে আমার প্রেমিক উভকামী যৌন পরিচয়ে বাচতে পারবে। আমাদের যৌন পরিচয়ের জন্য আমাদের ভয়ে থাকতে হবে না।নিজের সত্য নিয়ে, নিজের পরিচয়ে বাচতে পারব।
Source: BAH (Bangladesh Against Homophobia)