
লিখেছেনঃ অরণ্য রাত্রি
আজ কেন জানি খুব নস্টালজিক লাগছে। ঘর অন্ধকার করে রবীন্দ্র সংগীত শুনছি। মনে পড়ে যাচ্ছে আমার জীবনের নানা রঙের দিন গুলোর কথা।
প্রত্যেক মানুষের জীবনেই কিছু সময় থাকে যে সময়ের কথা বার বার মানুষের পড়ে যায়।হতে পারে সেটা খুব দুঃখের স্মৃতি কিংবা খুব সুখ স্মৃতি। আমাকে কেউ কেউ প্রশ্ন করে আমার জীবনের সেরা সময় কোনটি। আমি বলি ২০০৭ , ২০০৮ এবং ২০০৯ সাল। আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ সময়টুকু তখনই আমি পার করেছি।
আমি তখন সদ্য যৌবনে পা দিয়েছি। আমি খুব দ্বিধাগ্রস্ত ছিলাম। আমার আইডেন্টিটি ,অরিয়েন্টেশনের ব্যাপারটা তখন আমার মাথায় শুধু ঘুরপাক খেত। বিষণ্ণতা আমাকে চেপে ধরেছিল। সাল ২০০৬। সবে মাত্রএইচএসসি পার করে উচ্চশিক্ষার পথে পা বাড়িয়েছি। এই সময়টা তে প্রায় সবাই জীবনে একজন সঙ্গী চায়। আমার বন্ধুরা মেয়েদের ব্যাপারে আগ্রহী হয়ে উঠে। আড্ডায় মেয়েদের কে নিয়ে দীর্ঘ আলোচনা হত।কেউ কেউ মেয়েদের সাথে সম্পর্কেও জড়িয়ে গিয়েছে। আগে যেসকল বন্ধু দের সাথে ফোনে দীর্ঘ সময় কথা হত তারা তখন মেয়েদের সাথে ফোনে ব্যস্ত থাকতো। আমাকে সেরকম আর সময় দিত পারতো না। আর তারপরও যদি কথা হত তার বিশাল একটা অংশ জুড়ে থাকতো বিপরীত লিঙ্গের মানুষের কথা। আমি সেই সকল কথায় অংশ নিতে পারতাম না। ভালউ লাগতো না আমার।
কেমন একটা বিষণ্ণতা চেপে ধরতো আমাকে। এত বন্ধু থাকা সত্ত্বেও আমি একা বোধ করতাম। আর একটা বিষয় আমাকে কুঁড়ে কুঁড়ে খেত। সেটা হল আমি সমকামী। আমি জানতাম না আমার মত যারা সমকামী তারা কিভাবে একজন আরেকজনের সাথে যোগাযোগ করে। তখন আমার ইন্টারনেট ছিল না। ফেসবুক একাউন্ট ছিল না। এমন কি স্মার্ট ফোনও ছিল না।তখন মনে হত যেভাবে হোক আমার স্ট্রেট হতে হবে। নাহলেই এইরকম একাই থাকতে হবে। কিন্তু তা হওয়া তো সম্ভব না। এত কিছু আমি জানতামও না।
২০০৭। তখন মাত্র জাভা আর সিম্বিয়ান সেট গুলো মার্কেটে আসা শুরু করেছে। ফল্ডিংসেট গুলোর চাহিদা খুব বেশি ছিল। আমি একটা সিম্বিয়ান্ সেট কিনলাম। সেই সময় সেটটি খুব আধুনিক ছিল। তখন মোবাইল ইন্টারনেট আসা শুরু করেছে।এক বন্ধু আমার সেট এ একটা এপ ইন্সটল করে দিল। যেই এপ টা সিম্বিয়ান এবং জাভা সেট গুলো তে চলতো। এপ্টার নাম মিগ৩৩। আমি আইডি খুলে এপ টা চালানো শুরু করলাম।অনেকের সাথে চ্যাট হত। কিন্তু ছেলেরা আমার সাথে খুব একটা চ্যাট আগ্রহী থাকতো না। তারপরও একটা ছেলের সাথে খুব ভাল ভাবে পরিচিত হল। অনেকটা বন্ধুর মতই। সে একদিন আমার কাছে কাম আউট করলো সে বলল যে সে সমকামী। আমি চমকে উঠলাম। তখন আমি স্ট্রেট হবার জন্য ব্রত। আমি ঠিক করলাম আমি আর কক্ষন ওর সাথে চ্যাট করবো না।কিন্তু সারা দিন শুধু ছেলেটার কথাই আমার মাথায় ঘুরছিল। পরের দিন আমি আমার সিদ্ধান্তে অটল থাকতে পারলাম না। কি একটা অজানা নেশায় তাকে নক করলাম।
সেইদিন শুনলাম এক অজানা গল্প। যা আমার চিন্তা ভাবনা কে এলোমেলো করে দিল। আমি জানতে পারলাম এই এপটিতে গে বাংলাদেশ নামে একটি চ্যাট রুম রয়েছে। সেখানে অনেক সমকামী মানুষ নিয়মিত আসে। আমি ভাবলাম একবার ঢুকে দেখেই আসি ব্যপারটা আসলে কি। আমি একটা নতুন আইডি খুলে সেই গে বাংলাদেশ রুমে ঢুকলাম। আমি ঠিক করেছিলাম আমি আর কোন দিন ঢুকবো না। এটাই প্রথম এবং এটাই শেষ। কিন্তু প্রথম দিন ঢুকেই আমার কেমন নেশা হয়ে গেল। এত মানুষ আমার মত!তারপর আমি আমার ভাবনা পরিবর্তন করলাম। নিয়মিত আসা শুরু করলাম। সেখানেই প্রথম আমার সমকামী বন্ধু হল। খুব ভাল বন্ধু। অনেক ভাল বন্ধু। সে চট্টগ্রাম থাকতো।
প্রথম দিকে আমি আমার পরিচয় কাউকে বলতে চাইতাম না। যা বলতাম সব মিথ্যে। আসলে সাহস ছিল না। কি একটা অজানা ভয় কাজ করতো। তখন মনে হত কেউ আমার পরিচয় জেনে গেলে মহা বিপদ হবে। আমাকে হয়তো ব্ল্যাকমেইল করতে পারে। আমি প্রথম আত্মপ্রকাশ করেছিলাম আমার সেই চট্টগ্রামের বন্ধুর কাছে।তখন তার সাথে প্রতিদিন চ্যাট হত।এক সময় ফোন নাম্বার বিনিময় করলাম। তখন প্রায় প্রতিদিন কথা হত। দুঃখের বিষয় এই যে এখন তার সাথে আমার কোন যোগাযোগ নেই। তাকে সেই সময় আমার সেরা বন্ধু মনে করতাম।যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হবার দায়টুকু আমিই নিব।এখনো তার কথা আমার প্রায় মনে পরে। এত ভাল একজন বন্ধু কে হারিয়েছি আমি। মনে পড়ে তার সাথে যখন দেখা হয় তখন সে আমার জন্য ফুল নিয়ে এসেছিল।প্রেম নয়। বন্ধুত্বের খাতিরে। বই মেলায় দেখা করেছিলাম।খুব সুন্দর একটা স্মৃতি আমার জন্য।
প্রথম দেখা তার সাথে আমার হয় নি। প্রথম কারো সাথে দেখা করাটা খুব মজা ছিল। আমি এক সাথে ২ জনের সাথে মিট করেছিলাম। তারা বলা যায় কাপল ছিল। সেই দেখা করার আগে সে কি প্রস্তুতি। কোন কাপড় টা পরবো। কি কথা বলবো সেসব নিয়ে পেরা খাচ্ছিলাম। মিট করেছিলাম বসুন্ধরা সিটি তে।আমার সে কি নার্ভাসনেস।তারা আমার সাথে কথা বলবে তো নাকি খ্যাত ভাববে। তবে তাদের সাথে খুব ভাল বন্ধুত্ব হয়ে গিয়েছিল। তাদের সাথে আমার সব কথা শেয়ার করতাম। কিন্তু এখন তারাও বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছে। আমিও বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছি। তাদের একজনের সাথে ফেসবুকে জন্মদিন বা অকেশন গুলোতে উইশ করা হয়। এই পর্যন্তই। খুব মিস করি সেই সময়টা এবং তাদের ২ জন কে।
প্রথম ভালবাসা, প্রথম সম্পর্ক আমার মিগ থেকেই হয়। আমাদের রিলেশন টা আমাদের ভুল ছিল। আমরা একে অপরের জন্য উপযুক্ত ছিলাম না। খুব অল্প দিনের মাঝেই আমরা দুজন তা অনুধাবন করলাম। ২ জনেই আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম সম্পর্ক শেষ করার জন্য। তারপরও আমাদের বন্ধুত্ব ছিল। অনেক দিন ছিল। এখন আসলে সময়ের সাথে সম্পর্ক যেমন পরিবর্তন হয় শেষও হয়। সেইরকম আমাদের বন্ধুত্ব শেষ পর্যন্ত আর রইলো না। যতদূর জানি সে এখন দেশের বাইরে রয়েছে এবং বিয়ে করেছে। তাকে নিয়ে খুব সুন্দর স্মৃতি আছে। আমার পহেলা বৈশাখে খুব ধুতি পড়ার শখ ছিল।আমি ধুতি পরতে পারতাম না।সে ধুতি পরিয়ে দিয়েছিল আমাকে।
এই রকম হাজার হাজার স্মৃতি মিগ৩৩ নিয়ে আছে।মিগের বাইরে একটা বড় প্লাটফর্ম ছিল। বয়েজ অনলি বাংলাদেশ। আর ছিল একটা সাইট। মাই গে ডার। আমার বাসায় আসলো নেট এবং পিসি। আমার হাতে চলে আসলো মিগ এর বাইরের জগত।তখন কমিউনিটি তে এত কম মানুষ ছিল যে অধিকাংশ মানুষ একজন আরেক জন কে চিনতো। আমি গে ডার এ প্রফাইল খুললাম।ইয়াহু মেসেঞ্জার খুললাম।সেখানেই তখন চ্যাট করা হত। ফেসবুক তখন এত জনপ্রিয় ছিল না। অনেকের সাথে পরিচয় হল। বন্ধুত্ব হল। তাদের অনেকের সাথে এখনো আমার যোগাযোগ আর বন্ধুত্ব রয়েছে।
জুলহাজ ভাইয়ের কথা বলবো। আমি জুলহাজ ভাইয়ের কাছে অনেক কিছু শিখেছি। এই মানুষটার সাথে আমার প্রথম পরিচয় হয় গে ডার এ। অনেক দিন চ্যাট হয়েছে। তারপর দেখা হল। তার একটা পার্টি তেই তার সাথে আমার প্রথম দেখা। তার মত আরেকটি মানুষ আমি আর কক্ষন দেখি নাই। এত প্রাণ চঞ্চল আর উচ্ছল তিনি ছিলেন। তাকে বেশির ভাগ সময় এত হাসিখুশি দেখতাম। তার সাথে দেখা করলে আমার মনও খুশি হয়ে যেত।আমার জীবনে সেই ২০০৮ আর ২০০৯ এ জুলহাজ ভাইএর ভূমিকা আমি অস্বীকার করতে পারবো না।তখনও সেলিব্রেটি তকমা টা তার গায়ে লাগে নাই।কিন্তু তখন থেকেই তিনি কেমন জানি সব কিছু এরেঞ্জ করে ফেলতেন। জন্মদিনের পার্টি , ইফতার পার্টি , নব বর্ষ উজ্জাপন, পিকনিক সব কিছু।তখন এত বড় ইফতার পার্টি হত না। মনে পড়ে খুব অল্প কিছু মানুষের উপস্থিতে খুব অল্প পরিসরে ইফতার পার্টি করেছিলাম। বর্ষার প্রথম দিন উজ্জাপন করেছি।প্রথমে চারু কলায় গান শুনলাম। হাল্কা বৃষ্টি হচ্ছিলো। তার মাঝেই সবাই মিলে আজিজ সুপার মার্কেটে গিয়ে খিচুরি খেলাম। কত সাধারণ অথচ কত ভাল লাগার একটি স্মৃতি। আরও কত কি! লিখে শেষ করা যাবে না। এই মানুষটার সংস্পর্শে এসেছিলেম বলে এখনো নিজে কে ভাগ্যবান মনে হয়।
এখন তো কত পার্টি হয়। গেট টুগেদার হয়। তখন কিন্তু এত হত না। তারপরও একটা পার্টির জন্য কতদিন অপেক্ষা করে থাকতাম। ঈদের চেয়েও মনে হয় বেশি প্রস্ততি নিতাম পার্টির জন্য। কি পরে যাবো । কোন কন্টাক্ট লেন্স পরবো তা নিয়ে আমার বন্ধুদের সাথে দীর্ঘ আলোচনা চলতো। একি সাথে শপিং করতাম। পার্টির আগের দিন তো উত্তেজনার ঘুম আসতো না। তখন বয়েজ অনলি বাংলাদেশের পার্টি সব চেয়ে বড় হত। এটা ২০০৮ , ২০০৯ সালের কথা।
২০০৮ এর শেষে এসে আমি আমার সেরা বন্ধু টি কে পাই। যার সাথে এখনো আমার একই রকম সম্পর্ক রয়েছে। এখন তো তাকে ছাড়া জীবনটা অসম্পূর্ণ মনে হয়। কোন কথাই আমাদের মাঝে গোপন থাকে না। দীর্ঘ এক যুগ তো কম সময় নয়। আমার এই সুখের সময় সে যেমন ছিল তেমনি নানা বিপদে, কষ্টে তাকে আমি সব সময় পেয়েছি।
সময় চলে যাবে। জীবনে অনেক মানুষ আসবে , অনেক মানুষ চলে যাবে। এটাই তো জীবন। কিন্তু কখনো কখনো মনে পড়ে যায় তাদের কথা। নস্টালজিক হই। কিছুক্ষণের জন্য খুব কষ্ট লাগে। মনে হয় কেন এই দিন গুলো চলে গেল। মানুষ গুলো চলে গেল।ফিরে পেতে ইচ্ছা করে। আবার রাত কাটে দিন আসে। ব্যস্ত হয়ে যাই নিজের জীবনে।নতুন নতুন মানুষ এসেছে জীবনে। হয়তো তারাউ হারিয়ে যাবে। তাদের কি নিয়েও হয়তো নস্টালজিক হব। লিখবো নানা রঙের দিন গুলোর কথা।