
লিখেছেন নিঃশব্দ বৃষ্টি
ঠিক সন্ধ্যার মুখে, ফোনটা বেজে উঠলো, ধরতেই ওপাশের উত্তেজিত কণ্ঠস্বরঃ “তুমি কোথায়? বাসায়ে যাও! এখুনি! বাসায় গিয়ে নিউজ দেখো। আমি পরে কল দিচ্ছি।” একটু বিভ্রান্ত হয়েই ফেসবুকে ঢুকলাম। খবরটা খুঁজে পেতে বেশী একটা সময় লাগেনি; অনেকেই খবরটি শেয়ার করছে- নিজের বাড়িতে হত্যা হয়েছে আরেকজন। কিন্তু এবারের খবরের সেই মানুষটা আমার পরিচিত।
খুব অনেকদিনের চেনা জানা ছিল না জুলহাজের সাথে, এই এক বছরের মত হবে আমাদের পরিচয়। এক সাথে একটা কাজে দু’জনে সাইন আপ করেছিলাম, সেই সুবাদেই বেশ কয়েকবার দেখা, গল্পগুজব, কফি আড্ডা। চিন্তা-চেতনার মিল থাকলে মনে হয় বন্ধুত্ব হতে খুব বেশী একটা সময় লাগে না।
খবরটা দেখেই প্রথম কথা মাথায় আসলো, জুলহাজ গল্পে বার বার বলতো যে ওর বাসাতে একদিন যেতে হবে; যে কেউ যে কোন সময় সেখানে ওয়েলকাম। আমি কখনও যাইনি, কিন্তু যে বাড়ি নিয়ে ওর এতো গর্ব, এতো ভালোবাসা, সেখানেই এরকম হল। প্রথমবারের মতো আমি আমার এই নিজের বাসাতে নিরাপত্তাহীন বোধ করলাম। বন্ধুরাও বলতে থাকলো, তাই সেদিন রাতে আমি আমার মায়ের বাসায় গেলাম।
এই কয়েক ঘণ্টার মধ্যে অনেকের কথা ভাবছিলাম- কে কোথায় আছে, কি করছে – কিন্তু কাকে কি জিজ্ঞেস করবো সেটা বোঝা যাচ্ছিল না। এই এলোমেলো অবস্থা অনেক দিন এমনি ছিল। আমি মা’র বাসায় গিয়ে শুধু একবার আম্মুকে বলেছিলাম, ওই ছেলেটা আমার চেনা। আর কিছু জিজ্ঞেস করেনি আম্মু। সপ্তাহ শেষে যখন বাড়ি ফিরতে যাচ্ছি, তখন শুধু একবার বলেছিল যে আরও কিছুদিন থাকবো কিনা। এখন মনে হয়, কতটাই না সাহস সে আমাকে দিয়েছিল আমাকে না থামিয়ে। ফিরে যাবার পরে অবশ্য সব কিছু সাধারণ হয়ে ওঠেনি, আমি CCTV ক্যামেরার খোঁজ করেছি, বাড়ির দরজা-জানালা চেক করা, লকগুলি ঠিক করা, কত ধরনের চিন্তা নিজের সুরক্ষা নিয়ে।
আমার মনে পরে না এর মধ্যে আমি এক দিনও জুলহাজের জন্যে কেঁদেছিলাম বা শোক ঠিক ভাবে প্রকাশ করেছিলাম। ফিল করছিলাম হতাশা, মনে হচ্ছিলো কেউ কিছু মুখ খুলে বললাম না, কেউ ওদের পক্ষে তেমন ভাবে উঠে দাঁড়ালাম না। সেলফ প্রেসারভেশনটাই ছিল সবকিছুর উপরে। এই অনুভূতি মনে হয় না কখনো পুরোপুরি কেটে যাবে। এক বছর পরে, জুলহাজের মৃত্যুবার্ষিকীতে প্রথমবার মন খুলে কেঁদেছিলাম। কতদিন সেই দুঃখ, রাগ, ভয় নিজের ভেতরেই ধরে রেখেছিলাম।
জুলহাজের মৃত্যু শুধুমাত্র lgbtqi+ কাজের জন্যেই প্রতিবন্ধক হয়ে ওঠেনি, আমরা অনেকেই যারা জেন্ডার সেক্সুয়ালিটি নিয়ে কাজ করছি, নিজের নিজের ছোট পরিসরে কার্যক্রম এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছিলাম অনেকেই থমকে গিয়েছিলাম তখন। অনেকেই নিরাপদ বোধ করছিল না, কোনটা করবে-করবে না তা নিয়ে অনেক সমালোচনা। অনেক কিছু থমকে গেল, অনেক সময় লেগেছে কিছুটা সাধারন পরিস্থিতি ফেরত আসতে। শুধু কিছুটাই এখনও। মাঝের মধ্যে সেটাও অদ্ভূত লাগে, কি করে আমরা সেই সময় থেকে আবার এগিয়ে যাই, আবার আস্তে আস্তে কাজে লেগে পরি। অনেকটাই আগের মত, কিন্তু সম্পূর্ণরূপে পরিবর্তিত।
বিক্ষিপ্ত অনুভূতি, একটি সংগৃহীত সংকলন, যা জুলহাজ-তনয় হত্যাকাণ্ডের পঞ্চম বছরে প্রকাশ করা হয়।
লেখকদের অনুভুতি, অভিজ্ঞতা এবং মতামত একান্তই তাদের নিজেদের। ‘মন্দ্র’ এর অনুমতি ছাড়া এই লেখা পুনঃপ্রকাশ করা যাবে না।