
লিখেছেন কাজল সরকার
আমি সমপ্রেমী পুরুষ। পুরুষ হয়ে পুরুষের প্রেমে পড়া সমাজে বারণ। কিন্তু আমি প্রেমে পড়েছি, প্রেম করেছি সমাজকে লুকিয়ে। যতক্ষণ সমাজ জানবে না আমি সমপ্রেমী, ততক্ষণ বাজে অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হতে হবে না। তবে ঘটনাক্রমে যারা জেনেছে তারা বাজে প্রতিক্রিয়া দেখায়নি।
জুলহাজ তনয়ের হত্যাকাণ্ডের আগ পর্যন্ত বেশ কয়েক বছর নিজের সমপ্রেমী পরিচয় একটু লুকিয়েই রেখেছিলাম, এমনকি নিজের কাছেও। বাম ধারার ছাত্র রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলাম। এই হত্যাকাণ্ডের পর আমি নিজেকে আবার গে হিসেবে নিজের কাছে আত্মপ্রকাশ করি। সে বছরই একজনের সাথে কমিটমেন্টের বন্ধনে আবদ্ধ হই, এরপরের পাঁচ বছর অনেকটা নির্বিঘ্নেই কেটেছে।
জুলহাজ মান্নান প্রকাশিত ‘রূপবান’-এর গ্রাহক ছিলাম আমি। বেশ কয়েকটি সংখ্যা আমি কিনে পড়েছি। তার এই উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়েছি। সাহসের অভাবে ‘রংধনু যাত্রা’-এ যোগ দিতে না পারার আক্ষেপ আমার আজও আছে। জুলহাজ-তনয় বাংলাদেশের কমিউনিটির জন্য কাজ করছিলেন, অনেক দূর এগিয়েও গিয়েছিলেন। হয়ত আরো অনেক দূর এগিয়ে নিয়ে যেতে পারতেন। হয়ত জুলহাজ-তনয়ের হাত ধরে বাংলাদেশে সমপ্রেমীরা সামাজিক স্বীকৃতি পেত, হয়ত দণ্ডবিধি থেকে বৈষম্যমূলক ৩৭৭ ধারা মুছে যেত এক সময়। জুলহাজ মান্নান এবং মাহবুব রাব্বি তনয়-এর হত্যাকাণ্ড বাংলাদেশে এলজিবিটি কমিউনিটির জন্য অপূরণীয় ক্ষতি হয়ে থাকবে।
জুলহাজ মান্নান বা মাহবুব রাব্বি তনয়ের সাথে আমার পরিচয় ছিল না। আমি নিজে কমিউনিটি থেকে বিচ্ছিন্ন ছিলাম। আমি রূপবানের গ্রাহক হয়েছিলাম, ফেসবুকে পোস্ট পর্যন্ত করেছিলাম ছবি তুলে। কিন্তু এই দুই বন্ধুকে চেনার সৌভাগ্য আমার হয়নি। তাদের মৃত্যুর দিনই প্রথম তাদের নাম জানতে পারি, এরপর বিভিন্ন পত্রিকার মাধ্যমেই তাদের কাজের সাথে পরিচিত হই।
আমার বয়স তখন ২৫। ঢাকা থেকে নিজ বাড়িতে গিয়েছি, থাকব বেশ কিছু দিন। যে কোন সুন্দর দিনের মত সেদিনটাও সুন্দর ছিল, একটা মফস্বলের সুন্দর দিন যেমন হয় আর কি! বিছানায় শুনে জুলহাজ তনয়ের মৃত্যুর সংবাদটি দেখি ফেসবুকে।
আমি পুরুষ, সমপ্রেমী। বাম ধারার ছাত্র রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলাম। কিন্তু নিজেকে ‘শুধু শুধু এক্সপোজ’ করার মত ঝুঁকি নিতে চাইনি। আমি যখন সোশ্যাল মিডিয়া ফেসবুকে জুলহাজ তনয়ের মৃত্যু সংবাদটি দেখি তখন আমার আশেপাশে কেউ ছিল না। এর আগে ব্লগার, অনলাইন অ্যাকটিভিস্টদের হত্যার সংবাদ পেয়েছি এই ফেসবুকেই। হত্যার প্রতিবাদে মিছিল-সমাবেশ করেছি। আবার একটা হত্যা, আবার মিছিল-সমাবেশ। হয়ত বিচারহীনতার সংস্কৃতি একটু একটু করে গা-সওয়া হয়ে যাচ্ছিল। এর মধ্যে জুলহাজ মান্নান আর মাহবুব রাব্বি তনয় খুন হলেন। যেহেতু আমি রাজনীতিতে ছিলাম সেহেতু অভিজিৎ রায়-অনন্ত বিজয়ের হত্যা আর জুলহাজ-তনয়ের হত্যা আমার কাছে একই ধরনের হত্যাকাণ্ড বলে মনে হয়েছিল; মত প্রকাশের জন্য মৌলবাদীদের দ্বারা হত্যা।
আমি জানি এবং স্বীকার করি সমপ্রেমী, আমার মধ্যে কখনোই কোন ধরনের হোমোফোবিয়া ছিল না। কোন ধরনের হত্যাকাণ্ডকেই আমি জাস্টিফাই করি না। কোন ধরনের বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড সমর্থন করি না।
আলোচনা করার মত অনেক মানুষ ঢাকায় ছিল, আমার নিজের রাজনৈতিক পেরিফেরি ছিল। কিন্তু আমি তখন ঢাকায় ছিলাম না। ফলে আমার আশেপাশের মানুষের প্রতিক্রিয়া কেমন ছিল এটা জানাতে পারছি না। আমার আশেপাশের মানুষ বলতে পরিবার ধরলে তাদের কোন প্রতিক্রিয়া নেই আর আমার রাজনৈতিক সহযোদ্ধাদের ধরলে তারা কোনভাবেই এই হত্যাকাণ্ড সমর্থন করেনি।
আমি যেহেতু ওপেনলি গে না, তাই আমি নিজেকে নিয়ে খুব একটা শঙ্কিত নই। তবে আমি অনিরাপদ অনুভব করি, সমপ্রেমী হওয়ার জন্য যে দেশে খুন হতে হয় সে দেশে আমি এখনই নিজের আত্মপ্রকাশ করতে চাই না।
আমি আসলে কমিউনিটি থেকে বিচ্ছিন্ন আজ বহু বছর হল। কয়েকবার ফেইক আইডি থেকে কমিউনিটির সাথে যুক্ত থাকার চেষ্টা করেছিলাম, হয়ে ওঠেনি। কিন্তু আমার বিচ্ছিন্নতার জন্য জুলহাজ তনয়ের হত্যাকাণ্ড দায়ী নয়। বরং তাদের হত্যাকাণ্ডের পর আমি নিজেকে আস্তে আস্তে এক্সপোজ করা শুরু করি। আমার আশেপাশের কমবেশি সবাই আমার ব্যাপারটা এখন জানে।
ঠিক এই সময়টায় জুলহাজ মান্নান এবং মাহবুব রাব্বি তনয় হয়ত তাদের কার্যক্রমের মাধ্যমে আমাকে সঠিক পথের দিক-নির্দেশনা দিতে পারতেন। আমি আরো মানুষকে জানাতে চাই আমার পরিচয়। আমি জানাতে চাই আমি সমপ্রেমী কিন্তু ধর্ষক নই। আমি বই পড়ি, সিনেমা দেখি, প্রেম করি, প্রেমে পড়ি। সমকামিতাকে কাম বা যৌনতার ঊর্ধ্বে তুলে ধরে জুলহাজ মান্নান এবং মাহবুব রাব্বি তনয় যে বার্তা দিতে চেয়েছেন, আমি ‘সমকাম নয়, সমপ্রেমে বিশ্বাসী’।
বিক্ষিপ্ত অনুভূতি, একটি সংগৃহীত সংকলন, যা জুলহাজ-তনয় হত্যাকাণ্ডের পঞ্চম বছরে প্রকাশ করা হয়।
লেখকদের অনুভুতি, অভিজ্ঞতা এবং মতামত একান্তই তাদের নিজেদের। ‘মন্দ্র’ এর অনুমতি ছাড়া এই লেখা পুনঃপ্রকাশ করা যাবে না।