
লিখেছেন অনুপমা
মাঝেমধ্যে আমি নিজেকে প্রশ্ন করি। কতো দিন হল? ১ মাস? ২ মাস? ১ বছর? ২ বছর? আর কতো বছর পর-এ ঘোর কাটিয়ে উঠতে পারব?
প্রথম প্রথম ঘোরের মধ্যে ছিলাম। যখন নিউজটা শুনি। ঠিকমতো বুঝতে পারছিলাম না জীবনে কতো বড় পরিবর্তন চলে এসেছে। যখন ঘোর কাটিয়ে একটু-আধটু বোঝার চেষ্টা করতে শুরু করলাম তখন বড় বড় দীর্ঘনিঃশ্বাস বুকে জমতে শুরু করলো। একটা নিউজ আচমকা এক ঝটকায় সব লণ্ডভণ্ড করে দিল যেন। নিউজটা প্রথমে আমি ফেসবুকেই দেখি। তখন বেশ ছোট ছিলাম, নিজের সম্পর্কে জানতামও না তেমন। কমিউনিটিতে তখনও এতো বিস্তার লাভ করিনি। তবে কিছু পরিচিত শব্দ এবং নিজের অনুভূতি বুঝিয়ে দিয়েছিল এই মানুষগুলো আমারই প্রতিবিম্ব। এবং আমি আমার দু’জন সহযোদ্ধা বীরদের হারিয়েছি।
যতদূর জেনেছি,অন্যান্য ম্যাগাজিনের মত রূপবানের প্রথম সংখ্যার পর দ্বিতীয় প্রকাশ কিছুটা মসৃণ হবার কথা ছিল। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী নাকি মন্ত্রীসভার স্ট্যান্ডিং কমিটিতে রূপবান দেখে নাখোশ হয়েছেন। এদিকে ভোরের কাগজে বড় করে রিপোর্ট বের হয়েছিল, গোয়েন্দা বাহিনী রূপবানের পেছনের লোকদের খুঁজছে। শুনেছি, রূপবানের প্রথম সংখ্যা বের হয়েছিল যে ছাপাখানা থেকে, ভোরের কাগজের রিপোর্ট বেরোবার পরের দিনই জানিয়ে দিলো তারা আর এই ম্যাগাজিন ছাপাতে পারবে না।
জুলহাজ ভাই সবসময় তার সহযোদ্ধাদের বলতেন, পুলিশ আসলে কোনো ঝামেলা করবা না। কোনো কিছু অস্বীকার করবা না। চুপচাপ থানায় যাবা। ওখানে গিয়ে সবার আগে আমার নাম বলবা। বলবা জুলহাজ মান্নান সব নাটের গুরু।
বৈষম্য বিলোপ আইন বিষয়ক একটা আলোচনায় অংশ নিতে গিয়ে টেবিলের আরেক মাথা থেকে তাদের একজনকে পরিষ্কার বলে দেয়া হয়েছিল সরকার এমন কিছু করতে পারবে না, যা ৩৭৭ ধারার বিপক্ষে যাবে। এই অশান্ত পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে না পেরে তারা এলজিবিটি শব্দটা শুনতেও তারা নারাজ।
দীর্ঘ অভিজ্ঞতা আমাদের শিখিয়েছে যে, বাংলাদেশের লিঙ্গ ও যৌন সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর (এলজিবিটি+) অধিকারের সংগ্রাম বাংলাদেশের অন্যান্য প্রগতিশীল রাজনৈতিক লড়াইয়ের সাথে জড়িত। প্রতিনিয়ত আমাদের অস্তিত্ব মুছে ফেলার যে চেষ্টা অব্যাহত আছে।
মানুষের নিজের ভাব প্রকাশ করার স্বাধীনতা এবং অবাধে জীবনযাপনের অধিকারকে আমরা দ্বিধা-হীন ভাবে সমর্থন করি।
আমি জানি এ পথে আমার মৃত্যুও হতে পারে। তারপরও আমি দেখতে চাই ওরা কত খেলা খেলে। আমার কাছে অস্ত্র নেই। আমি অস্ত্রের রাজনীতি করি না।
তারা দুটি লাশ ফেলল।
সবকিছু এখন কেমন যেন অনেক অন্তঃসার শূন্য মনে হয়। এই পথে বার বার থমকে গিয়েও হাটতে শিখেছি। হাটার পথে কখনো কৃষ্ণচূড়া গাছ দেখলে জুলহাজ ভায়ের মুখটা চোখের সামনে ভেসে ওঠে।শুনেছি তার পছন্দের ছিল।
আরেকটু বেশী সম্মান কি রাষ্ট্রের কাছে তোমাদের প্রাপ্য ছিল না?
এ কেমন মাতৃভূমি? যেখানে আমারদের বেঁচে থাকার অধিকারটুকু নেই!
বাংলাদেশের রক্ষণশীল সমাজ সমকামীদের প্রতি অনেক অ-সংবেদনশীল।
তনয়ের বাসার পরিবেশটা একটু অন্যরকম ছিল। বাসার সবাই জানত তাদের ছেলে একটু আলাদা। পাড়ার আর দশটা ছেলের মতন নয়। ছোটবেলা থেকেই সে নিজেকে লুকাতে চাইতো না। ছেলে হয়ে মেয়েলী স্বভাব, মেয়ের কাপড়ে পারিবারিক উৎসবে নাচ, এসব কারণে বহুবার তার বাবার দ্বারা শারীরিক নির্যাতনের শিকার হতে হয়েছিল ওকে অনেকবার। সেও আজকের দিনে শহীদ হয়েছে।
বাংলাদেশে যারা এলজিবিটি নিয়ে কাজ করছেন, তারা এখন পর্যন্ত নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন এই দুই কর্মীর মৃত্যুর পর। এদের অনেকেই ফেসবুক প্রোফাইল বন্ধ করে, ফোন নম্বর, বাসা বদলে ফেলে বেঁচে থাকার যুদ্ধে নাম লিখিয়েছেন। কারন, অর্ধ-যুগ কেটে গিয়েছে।কিন্তু এখন পর্যন্ত এই অপরাধের জড়িত থাকা জঙ্গিদের বিচার হয়নি।
পরিবার যখন দেখে তাদের সন্তান আর দশটা ছেলে-মেয়েদের মত নয় তখন তারা বড্ড ভয় পায়। আমিও এই রক্তের হোলি-খেলার পরে ভয়ে ভীত হয়ে থাকি প্রায় সময়। হুমকি-ধমকিগুলো নিত্য দিনের সঙ্গী। এই ঘটনা ঘটার পর আমার কাছের যে কয়টি মানুষ আছে তারা সবাই আমাকে বলেছে দেশ ছেড়ে চলে যেতে। আমি ছোটবেলা থেকে অনেক বড় বড় স্বপ্ন দেখেছি কিন্তু নিজের দেশ ছেড়ে চলে যাবার স্বপ্ন কক্ষনো দেখিনি, কখনও না। আমি সবসময় দেশের জন্য কিছু করতে চেয়েছি। সুবিধা-বঞ্চিতদের সাথে কাজ করবো, যৌন সংখ্যালঘুদের নিয়ে কাজ করব, দেশের অর্থনীতিতে অবদান রাখব। অনেক আশা এ নিয়ে আমার। কিন্তু আমি কেমন করে এ দেশে থাকবো যেখানে আমার বেঁচে থাকার ন্যূনতম নিশ্চয়তাটুকু নাই? আমি কেমন করে থাকবো এদেশে যেখানে আমি জানি আমি মরে যাবার পর হোমপেইজ, চায়ের-কাপ সবখানে সোল্লাসে ঝড় উঠবে বেশ হয়েছে মরে গিয়ে দেশটাকে সাফ হয়েছে! এ কেমন মাতৃভূমি? যার বুকে আমার জন্য এতো টুকু জায়গা নাই?
আমরা চাই ঘটনার সাথে জড়িত প্রতিটি অপরাধীকে ফাঁসি দেয়া হোক।
আমি যতক্ষণ পারি ততক্ষণ টিকে থাকার চেষ্টা করব।
বিক্ষিপ্ত অনুভূতি, একটি সংগৃহীত সংকলন, যা জুলহাজ-তনয় হত্যাকাণ্ডের পঞ্চম বছরে প্রকাশ করা হয়।
লেখকদের অনুভুতি, অভিজ্ঞতা এবং মতামত একান্তই তাদের নিজেদের। ‘মন্দ্র’ এর অনুমতি ছাড়া এই লেখা পুনঃপ্রকাশ করা যাবে না।