সুহৃদকথন বা প্রিয়জন বিয়োগের বেদনানামা

লিখেছেন অ্যা বয় ইন দ্যা সলিচিউড

একইসাথে এলজিবিটি কমিউনিটির হওয়ায় এবং বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে ছাত্ররাজনীতিতে সক্রিয় হওয়ার দরুণ কিংবা অধিকারসচেতনতার জায়গা থেকে- লিঙ্গবৈচিত্র্যের প্রশ্নে সচেতন ছিলাম বা কাজ করার আগ্রহ ছিলো বলে সে সময়কার এলজিবিটি এক্টিভিস্টদের সাথে আলাপ কিংবা সখ্যতা তৈরি হয়েছিলো।  জুলহাজ মান্নান ছিলেন তাদেরই একজন; রাজনীতিসচেতন একজন এলজিবিটি এক্টিভিস্ট।  দেখা হয়েছিলো দুই একবার তার সাথে- বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায়। ইনবক্সে কথা হতো; একটি পত্রিকার কথা বলতেন প্রায়ই- কমিউনিটি নিয়ে পত্রিকা করতে চান।  বয়েজ অফ বাংলাদেশ (বব) এ কাজ করতে চাই কিনা; আমি খুব বিনয়ের সাথে ব্যাখ্যা দিয়ে না করেছিলাম।  আমার সেক্সুয়াল ওরিয়েন্টেশন লুকিয়ে যাই কেন এই প্রশ্ন তিনি একাধিকবার করেছেন; আমিও তাকে আগ্রহ নিয়ে উত্তর দিয়ে প্রতিবার তবে উত্তরে তিনি সন্তুষ্ট হতেন কিনা সেটা বুঝতে পারিনি কখনো।  আমার প্রেমিক রোড অ্যাক্সিডেন্টে মারা যাওয়ার কথা তিনি জানতেন; মাঝেমাঝে আমার অস্থিরতা কিংবা বিষণ্ণতার কথা তাকে জানাতাম। সে সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করেননি কখনো; শুনে যেতেন আমার কথা। উত্তরার ফ্ল্যাটে বন্ধু রাতুলের আত্মহত্যা নিয়েও আলাপ হচ্ছিলো একদিন। 

২০১৪ এর জানুয়ারিতে একটা বিপ্লব ঘটে যায়- ‘রূপবান’ চলে আসে। ‘রূপবান’ প্রকাশ পাচ্ছে- এই খবরে প্রতিক্রিয়াশীলরা উন্মাদ হয়; তথাকথিত প্রগতিশীলরাও নাক সিটকাতে থাকে- তাদের মুখ থেকে শুনতে পাই, “তাদের অধিকারের কথা আমিও বলি; তাই বলে পত্রিকা বের করার ঝুঁকি…?” হলের টঙে সকালের নাশতা করতে করতে তাবলীগ করা একদল ছেলের পরিকল্পনার কথাও শুনতে থাকি ‘রূপবান’ এর প্রথম সংখ্যার মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠান বানচালের।  দুই সংখ্যা বের হওয়ার পর ভয়ে ছাপাখানাগুলো ছেপে দেওয়ার দায়িত্বও নিতে চায়নি। 

শাহবাগ আন্দোলনের কর্মী আমি।  দীর্ঘদিন ব্লগিং করেছি; সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতেও সক্রিয় ছিলাম বেশ।  খুব কাছের মানুষ-আপনজন- ভাই-বন্ধুদের খুন হয়ে যেতে দেখেছি। রাজীব হায়দার, ওয়াশিকুর রহমান বাবু, অনন্ত বিজয় দাস, অভিজিৎ রায়, নিলয় নীল- একে একে এদের হারিয়ে ততদিনে আমি শোকে স্তব্ধ- সবসময় মৃত্যু -আতঙ্কে থাকতাম- ঘুমের মাঝে আঁতকে উঠতাম- ততদিনে ব্লগের লেখাগুলো মুছে দিয়েছি- অন্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নিষ্ক্রিয় হয়ে গেলাম। কাছের বন্ধুদের সাথেও যোগাযোগ কমিয়ে দিলাম। এরই মাঝে ’১৬ সালের ২৫ এপ্রিল খবর পেলাম লেকসার্কাসের বাসায় জুলহাজ ভাই-তনয় স্লটারড।  বিশ্বাস করুন কিংবা নাই করুন এই খবর আমার মনে নতুন করে কোনো ভাবনা জাগায়নি। ততদিনে আমি শোকে- শঙ্কায়- অস্থিরতায় ভিতরে ভিতরে মরে শেষ হয়ে আছি। একজন মরা মানুষের আর অনুভূতি কী? ততদিনে কমিউনিটি থেকে দূরে- বেশ দূরে। আশ্রয়ের জন্য কোনো দূতাবাসে সাহায্যও চাইনি- সে ইচ্ছে ছিলো না; এখনো নেই।

বিক্ষিপ্ত অনুভূতি, একটি সংগৃহীত সংকলন, যা জুলহাজ-তনয় হত্যাকাণ্ডের পঞ্চম বছরে প্রকাশ করা হয়।

লেখকদের অনুভুতি, অভিজ্ঞতা এবং মতামত একান্তই তাদের নিজেদের। ‘মন্দ্র’ এর অনুমতি ছাড়া এই লেখা পুনঃপ্রকাশ করা যাবে না।

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.