স্মৃতিতে জুলহাজ-তনয়

লিখেছেন জয়ন্ত

ফিরে দেখা সেই ২০১১-২০১২ তখন আমি খুব লজ্জা পেতাম কারো সাথে পরিচিত হতে। আর লোকগুলোও গুটিকয়েক ছিল- বিক্ষিপ্ত ছড়িয়ে ছিটিয়ে এদিক ঐদিক। একটা ফেক একাউন্টকে কেন্দ্র করে কমিউনিটির লোকজন সম্পর্কে পরিচিত হওয়া, সেই সুবাদে জুলহাজ ও তনয় উনাদের সাথে বেশ কয়েকবার দেখা সাক্ষাৎ হয়েছে। আমি বেশ কয়েকবার জুলহাজ ভাইয়ের বাসাতেও গিয়েছি, অমায়িক ব্যবহার। খুব স্নেহ করতেন। কমিউনিটির অনেক ব্যাপারে টুকটাক দিকনির্দেশনা পেতাম। 

ঘটনাটা সেদিন শুনতে হবে কখনো আশা করি নাই। 

অফিসের কাজে উত্তরা গিয়েছিলাম, যানজট এড়াতে ট্রেনে ফিরছিলাম। হঠাৎ আমার এক পরিচিত ফোন করে বলল, “জয়ন্ত তুমি কোথায়?”

আমি বললাম, “ট্রেনে।”

আমাকে বলল, “একটা সাইডে আসো, আর্জেন্ট কথা আছে।”

মনে কেমন যেন একটা কামড় দিলো। 

বললাম, “কি?”

বলে, “তুমি কি জানো যে জুলহাজ আর তনয় খুন হইসে সন্ধ্যায়।”

আমি শোনা মাত্রই চিৎকার করে হাত থেকে ফোন ট্রেনের ফ্লোরে ফেলে দিয়েছিলাম, পরে কিছু মনে নেই।

প্রায় ৩০ মিনিট পর দেখলাম মানুষজন চোখেমুখে, মাথায় পানি দিচ্ছে। প্রচণ্ড মাথা ঘুরাচ্ছিলো, সাথে ব্যথা, হঠাৎ করেই মুখভর্তি বমি। অবস্থার অবনতি দেখে কমলাপুর এসে লোকজন লোকাল মেডিকেল শপে কিছুক্ষণ বসিয়ে রেস্ট নিতে বলে। আমি খেয়াল করতে থাকি আমার হাত পা অবশ হয়ে যাচ্ছে ক্রমশই। নড়ার শক্তি পাচ্ছিও না। কোন রকমে বাড়ি ফিরে ঘুমের ঔষধ খেয়ে ঘুম। এরপর টানা ৫ দিন জ্বর। 

ব্যক্তিগতভাবে আমি উনাদের প্রস্থানের ঘটনাটি মেনে নিতে পারিনি। কমিউনিটির অনেকেই তাদের নিরাপত্তার কথা ভেবে দেশ ছেড়ে চলে গেছে। আর আমার নিরাপত্তার দিকটা চিন্তা করে আমি আমার ফেইক একাউন্টের সব ছবি মুছে দেই তখন।  রূপবান ম্যাগাজিনটা নিয়ে বেশ আলোড়ন হচ্ছিল তখন সবার মধ্যে। সে সময়টার কথা আমি এখনো বলতে পারি। দেশে একটা মুভমেন্ট তৈরি হচ্ছিল, কিন্ত অংকুরেই সেটা বিনষ্ট হলো।

২০১৬ থেকে প্রায় দুই বছর ঝিম মারা অবস্থায় ছিল সবাই। মানুষগুলো দেখা করতে চাইতো না নিরাপত্তার ভয়ে। এর আগেই অভিজিৎ রায়-সহ রাজীব ও অন্যান্য ব্লগারও খুন হয়েছে। নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে কেউ কোন ইভেন্ট আয়োজন করতে চাইতোও না, আর কেউ আসতে চাইতোও না। তবে এই কয়েক বছরে আমার নিজেকে নিয়ে বেশ কিছু কনফিউশন দূর হয়েছে, নিজের জেন্ডার আইডিন্টি সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারনা হয়েছে। পারস্পারিক সম্পর্ক বেড়েছে, নেটওয়ার্ক বেড়েছে।

২৫শে এপ্রিল, ২০২১- জুলহাজ-তনয়ের ৫ম প্রয়াণ দিবস। আমাদের স্মৃতিতে আজো জুলহাজ-তনয় আজীবন থাকুক। ওপারে ভালো থাকুক তারা। 

বিক্ষিপ্ত অনুভূতি, একটি সংগৃহীত সংকলন, যা জুলহাজ-তনয় হত্যাকাণ্ডের পঞ্চম বছরে প্রকাশ করা হয়।

লেখকদের অনুভুতি, অভিজ্ঞতা এবং মতামত একান্তই তাদের নিজেদের। ‘মন্দ্র’ এর অনুমতি ছাড়া এই লেখা পুনঃপ্রকাশ করা যাবে না।

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.