পুরুষনামা

লিখেছেন সন্তু

একটি ঝড় যেমন এক, দু’মাস কিংবা একবছর ধরে চলেনা ঠিক তেমনি আমার অন্তিকের প্রতি প্রেমের যে আবেগ সেটা দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। আবেগ চিরস্থায়ী নয়। আবেগ বারবার জাগতে পারে একইজনের প্রতি বা বিভিন্ন পুরুষের প্রতি। আমি অন্তিককে এখনো ঠিক আগের মতনই ভালোবাসি। তার গায়ের গন্ধ এখনো আমাকে নাড়া দেয়। ঠিক কত সময় হবে আমাদের সম্পর্কের? একবছর? চাইলেই কী এর থেকে বেশি টিকতে পারতোনা? অবশ্যই পারতো। কিন্তু আমি সব কাঁচের চুড়ির মতন ভেঙে দিয়েছি!

অন্তিকের সাথে আমার পরিচয় গণজাগরণ মঞ্চের উত্তাল সময়ে ফেসবুকের কল্যাণে। সে ছিলো একজন খুব পরিচিত মুখ তখনকার অনলাইন এ্যাকভিস্টদের ভেতর। সে দেখতে ভারী সুদর্শন! এছাড়াও তার ঝাঁকড়া চুলে তাকে দেখতে যা লাগেনা! আর এদিকে আমি? একজন উচ্চ মাধ্যমিকের ছাত্র যার কিনা কলেজে যেতে মনই বসে না! আমার অবশ্য অন্তিকের মতন এমন পুরুষ পুরুষ চেহারা নেই। সবাই আমাকে দেখলেই বলে উঠে, আরে এর তো চেহারা দেখতে একদম বাচ্চাদের মতন। এমনকি আমার দাড়ি গোঁফও উঠেনা! তো কী ভেবে আমার মতন বাচ্চার সাথে অন্তিকের মতন যুবা পুরুষ সম্পর্কে যেতে রাজি হলো তা অদ্ভুতই বলা যায়।তবে আমাদের মনস্তাত্ত্বিক দিকটা খুবই কাছাকাছি ছিলও। তার ব্যক্তিগত দর্শন আর আমার দর্শন প্রায়ই মিলে যেতো এটা একটা কারণ হতে পারে।

আমাদের প্রতিদিন রাস্তায় রাস্তায় বেড়ানো, মিছিলে যাওয়া, একটু পরপর চুমু খাওয়া এসব অন্যান্য প্রেমিক যুগলদের ঈর্ষা জাগাতো। একবার তো সন্ধ্যায় লাকি আপার ঘর-ভর্তি চা আড্ডায় আমাকে চুমু খেয়েছিলো সে। আমি যেন লজ্জায় লাল হয়ে যাচ্ছিলাম। এরকম হুট হাট তার আবেগের জানান দেওয়া অভ্যাসে পরিণত হয়ে গিয়েছিলো। আমাকে যদি বলা হয় অন্তিককে এক বাক্যে বিশ্লেষণে করতে তাহলে আমি বলবো সে একটা বোকা প্রেমিক। হ্যাঁ বোকা প্রেমিক! সে তার সমস্ত দিয়ে তার আবেগকে প্রকাশ করতো আর তাই আমিও তার এমন হুট হাট ভালোবাসাকে পেয়ে বসলাম। আমি তার প্রতি একনিষ্ঠ থাকতে পারিনি।

অন্তিকের সাথে সম্পর্কে থাকাকালীন আমি অনেকের সাথে সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ি। এবং সেটি সম্পূর্ণ জৈবিক ছিল। এরকম একের পর এক জৈবিক সম্পর্ক আমার চলতে থাকে,যার বিন্দুমাত্র অন্তিক টের পায়নি। আমি অন্তিকের সাথে মননের দিক দিয়ে সম্পূর্ণ একনিষ্ঠ ছিলাম। কিন্তু জৈবিক দিকে দিয়ে পারিনি। জিনিসটা এমন নয় যে অন্তিকের দেহ আমাকে টানেনি। তার সুঠাম দেহ, সেক্সুয়াল পারফর্মেন্স সবই ছিলো যথেষ্ট আকর্ষণীয়। কিন্তু তবুও কেন আমি জৈবিক দিক দিয়ে একগামী হতে পারিনি তার উত্তর আমি নিজেও জানিনা।

তার আর আমার প্রেমের নিজস্ব, গভীরতা, আবেগ, তীব্রতা ও সৌন্দর্য সবই ছিলো। প্রত্যেকটা মিলনই ছিলো অসাধারণ। কিন্তু তাও আমি আমার বহিরাগত সম্পর্ক চালিয়ে যাই। আমার কখনো মনে হয়নি আমি তার সাথে প্রতারণা করছি। আমিতো তাকেই ভালোবাসি ! কই অন্য পুরুষের জন্য তো আমার মনে প্রেম জাগে না। কিন্তু আমি আমার জৈবিক ডাককেও হেয় করতে পারিনা। অন্তিক আমাকে মনেপ্রাণে ভালোবাসে এবং আমিও। কিন্তু মুল পার্থক্য সে জৈবিক দিক দিয়ে সম্পূর্ণ একগামী। কিন্তু আমি হতে পারিনি। কেন পারিনি সেটা আমারও প্রশ্ন।

জিনিসটাকে আরও বড় হিসেবে ভাববার দরকার। সভ্যতার শুরু থেকে বলা হচ্ছে পুরুষ তার নারীর প্রতি একনিষ্ঠ থাকবে এবং নারী পুরুষের প্রতি। শর্তটি পুরুষ কখনো মানেনি; কিন্তু নারীকে নানাভাবে বাধ্য করা হয়েছে মানতে। আর এখন যদি আমরা ব্যাপারটাকে সম্পূর্ণ জেন্ডারবিহীন ভাবে ভাবি তবে দেখা যাবে আমরা যে পরস্পরকে দীর্ঘকাল ভালোবাসোতে পারিনা—এটা একনিষ্ঠতার শর্তটির জন্য। এরকম সম্পর্কে থাকাকালীন বহুগামিতার ইতিহাস আছে বিভিন্ন সভ্যতায়।

আমি এসব নিয়ে অন্তিকের সাথে আলাপ করছিলাম। আমি আর ব্যাপারগুলো আমার ভেতর আর নিতে পারছিলাম না। এক বিকেলে তীব্র এক মিলনের পর আমরা লেক পাড়ে যাই হাঁটতে। আকাশে তখন মেঘেরা একত্রিত হচ্ছিল যেমন আমরা হয়েছিলাম শাহবাগের মোড়ে। শেষমেশ আমি ব্যাপারটা সম্পূর্ণ খুলে বললাম অন্তিককে। সে বেশ অবাকই হলো এবং বেশ আঘাতও পেলো মনে হয়। কিন্তু আমি ব্যাপারটা আর লুকাতে পারছিলাম না। সে বলল,

“আমি বেশ অবাকই হচ্ছি এসব শুনে! আমার বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে। তুমি প্রথম দিকেই বললেই পারতে। তাহলে আমি আজ এমন কষ্ট পেতাম না।”

“আমি মাথা এতো কিছু নিতে পারছিলনা অন্তিক্। আমি দুঃখিত।“ ভারি নিশ্বাস বের হলো অজান্তেই।

অনেকক্ষণ চুপচাপ হাঁটলাম আমরা। তারপর সে বলে উঠলো, “দেখো আমরা জানি একগামিতা একটা শর্ত স্বরূপ। চাপিয়ে দেওয়া বলা যায় আমাদের উপর। কে একগামী থাকবে কে থাকবেনা এটা সম্পূর্ণ তার পার্সপেক্টিভ এর উপর। তোমাকে কেউ জোর করেনি একগামী সম্পর্কে থাকতে। তুমি যেটাতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করবে সেটাই করবে। কিন্তু আমি হয়তো আবেগ নিয়ে একটু বেশিই ভাবি তাই আমার মনে হয়না আমি যাকে তীব্রভাবে কাছে চাই তার এসব মেনে নিবো। আমার মনে হয় আমাদের সম্পর্কে র এখানেই ইতি টানা দরকার।“

আমার মনে হয় অন্তিক আরও অনেক কিছু বলতে চাচ্ছে কিন্তু বলছেনা। আমিও একপ্রকার বাকরুদ্ধই হয়ে ছিলাম সেই মুহূর্তে। আমি কি বলবো তখন ভেবে পাচ্ছিলাম না। সবকিছু যেন ওলটপালট লাগছিলো। ভাবতেই মন ভেঙ্গে যাচ্ছে সামনের মানুষটাকে আর কাছে পাবো না। কিন্তু কি করার আমার নিয়তিই হয়তো এমন। আমি এক আদর্শ প্রেমিক হতে চেয়েও পারিনি। আমি প্রতিউত্তরে কিছুই বললাম না একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়া।

আকাশে কালো মেঘগুলো আরও কালো হচ্ছে ঠিক সেদিনের মতন যেদিন আমাদের প্রথম দেখা হয়েছিলো শিল্পকলার সামনে। আমরা সেদিন মাঠের এককোণায় দাড়িয়ে বৃষ্টি উপভোগ করেছিলাম। আজ আবার কেন ঠিক তেমন পরিবেশ তৈরি হয়েছে আমার জানা নেই। আমার একজন আদর্শ প্রেমিক না হয়ে ওঠার গল্পের সাক্ষী থাকবে হয়তো এই ভরা বর্ষা। হঠাৎ অন্তিক আমার হাত ধরল। হয়তো শেষবারের মতন ঠিক তেমন ছোঁয়ায় যেমন ধরেছিল প্রথম। আর তার একটু পরই আকাশ ভেঙে মেঘেরা কাঁদতে শুরু করে…

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.