
আজিজুল হক
“আর কত দেখতে হবে বৈষম্য? আর কত সহ্য করতে হবে অত্যাচার আর কত মেনে নিতে হবে নিন্দা? আর কত পেতে হবে অভিশাপ?” রকিবের মাথায় এই কথাগুলো বেশ কিছুদিন ধরেই ঘুরপাক খাচ্ছে। প্রায় দুই বছরের মতো হতে চলল রকিবের বাবা-মা তার যৌন অভিযোজনের ব্যাপারে জানতে পেরেছে। আর সেই সময় থেকে তার জীবন যেন পরিণত হয়েছে এক জীবন্ত নরকে। ঠিক যেদিন তার বাবা-মা তার ব্যাপারে জানতে পারে, সেদিন থেকেই তার উপর শুরু হয় অমানবিক অত্যাচার। এবং তার পরের দিনই তাকে একটি সাইকিয়াট্রিস্টের কাছে নিয়ে যাওয়া হয়। সেই সাইকিয়াট্রিস্ট বলে হরমোন টেস্ট করতে। এবং হরমোন টেস্ট এর রেজাল্টটা সম্পূর্ণ স্বাভাবিক আসে। এতে রকিবের মনে হয় তার বাবা-মার খুবই মনঃক্ষুন্ন হয়েছে; কারণ তারা চেয়েছিলেন কোন না কোন কিছু যেন অস্বাভাবিক বের হয়েই আসুক।
এই প্রথম ডাক্তার কে দেখিয়ে যখন কোনো ফায়দা হলো না রকিবের বাবা-মায়ের তখন রকিবের বাবার অধীনস্থ একজন ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেলেন(রকিবের বাবা ডাক্তার নয় তবে একই প্রতিষ্ঠানেকাজ করেন) এবং সেই ডাক্তার ইনিয়ে-বিনিয়ে অনেক উল্টাপাল্টা জিনিস বুঝালেন রকিবকে। আবার একটা ওষুধও দিলেন খাওয়ার জন্য। আর সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে যে সেই ডাক্তার যখন আবার হরমোন টেস্ট করতে দিলেন তখন রিপোর্টে ভুল থাকা সত্ত্বেও সেটাকে সত্য প্রমাণ করার চেষ্টা করলেন। রকিব এতে প্রচণ্ড কষ্ট পেয়েছিল।
এই দ্বিতীয় ডাক্তারকে দেখিয়েও যখন রকিবের বাবা-মা তাকে তথাকথিত “স্বাভাবিক” বা “নরমাল” করতে পারলেন না তখন আরও একটি ডাক্তারের শরণাপন্ন হলেন এবং সেটাও রকিবের বাবার অধীনস্থ। আর এত কিছুর মধ্যে রকিবকে সহ্য করতে হয়েছিল হাজারো নিন্দা, পড়তে হয়েছিল অনেক বিব্রতকর অবস্থায় এবং শুনতে হয়েছিল হাজারো অভিশাপ। এই ডাক্তার দেখানোর পর্ব শেষ হওয়ার বেশ কয়েক মাস পরে রকিবের বাবা আরও একবার চেষ্টা করলেন তাকে “স্বাভাবিক” করে তোলার জন্য তাই এবার তিনি শরণাপন্ন হলেন তাদের বাসার পাশের মসজিদের ইমামের কাছে। এবং সেই ইমামের অবৈজ্ঞানিক কথাবার্তা শুনে যেমন রকিবের হাসি পেয়েছিল তেমনি করে আবার ইমামের কটু কথা শুনে অনেক কষ্টও হয়েছিল। আর এই পুরো সময়ের মধ্যে রকিব বেশ কয়েকবারই নিজের প্রাণ নিজে নিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করেছিল। রকিবের মনে হয়েছিল এই জীবনটা রেখে আর কি লাভ যখন এই জীবনে তাকে কেউ ভালোবাসে না; তার নিজের বাবা-মাই যখন তার ভালোর কথা চিন্তা করে না তখন সে আর বেঁচে থেকে কি করবে? কিন্তু সত্যি কথা বলতে, আত্মহত্যা করার সাহসটা আসলে রকিবের কখনো হয়ে উঠেনি।
এখন আর রকিবের কষ্ট হয়না; কারণ লাঞ্ছনা, অপমান, নিন্দা আর অত্যাচার সহ্য করতে করতে এসবে সে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছে। তবে রকিবের কষ্ট না পাওয়ার আরও একটি কারণ হচ্ছে যে সে জেনে গিয়েছে যে এই যুদ্ধে তার বাবা-মা হেরে গিয়েছে। সমাজের নামেই হোক কিংবা ঈশ্বরের নামেই হোক বাস্তবতাটা পালটানো তার বাবা-মার পক্ষে সম্ভব ছিল না। রকিব এখন জেনে গিয়েছে যে সে কোন অপরাধী বা দোষী না তাই তার ভয়ের আর কোনো কারণ নেই। হয়তো তার বাবা-মা সহ অনেকেই তার ক্ষতি করার চেষ্টা করবে, কিন্তু রকিবকে সুঠাম ভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে হবে; যুদ্ধ করে যেতে হবে। রকিব জানে তার মতো অনেকেই এরকম সহিংসতা এবং ঘৃণ্যতম অপরাধের স্বীকার। এখনও অনেক দেশেই শোকজনকভাবে অত্যাচার প্রচলিত তার মতো মানুষের। রকিবের আশা যে একদিন আইনগতভাবে সে এবং তার মতো মানুষেরা স্বীকৃতি পাবে। যদিও আদালত কক্ষ যথেষ্ট নয় সাম্যতা নিশ্চিত করার জন্য; সাম্যতার জন্য সকল মানুষেরই সহযোগিতা প্রয়োজন। আর এই বিশ্বাস নিয়েই রকিব তার দিন-কাল পার করে চলেছে। তাও প্রতিদিনই তার মাথায় ঘুরপাক খায়ঃ “আর কত দেখতে হবে বৈষম্য? আর কত সহ্য করতে হবে অত্যাচার আর কত মেনে নিতে হবে নিন্দা? আর কত পেতে হবে অভিশাপ?”