
অরণ্য রাত্রি
কামিং আউট কথাটা বলতে যতটা সহজ কিন্তু ততটাই কঠিন । চাইলাম আর সবার কাছে কামিং আউট করে ফেললাম এতটা সহজ নয় ব্যাপার টা। বরং কামিং আউট করার আগে ঠান্ডা মাথায় চিন্তা করা উচিৎ। কারণ কামিং আউট করার ব্যাপারে অনেক প্রতিবন্ধকতা থাকে। কারো বেশি বা কারো কম। আমি বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে কিছু প্রতিবন্ধকতা নিয়ে আলোচনা করছি।
ধর্ম
বাংলাদেশের ৮০ ভাগ মানুষই মুসলিম। আর ইসলাম ধর্মে সমকামিতা কে খুব বড় পাপ হিসেবে ধরা হয়। বলা হয় সমকামিতার জন্য পুরো একটা সম্প্রদায়কে ধ্বংস করে দিয়েছিলেন সৃষ্টিকর্তা। এবং সমকামিদের ভয়াবহ শাস্তির কথা বলা হয়েছে। এমন কি যারা প্র্যাক্টিসিং মুসলমান না তারাও সুযোগ পেলে সমকামীদের ছেড়ে দেয় না। একটা সমকামী সিনেমার রিভিউ লেখার পর সেই রিভিউ এর নিচে যেধরনের নোংরা গালিগালাজ আর হুমকি দেয়া হয়েছে তা আর নাই বলি। আমাদের দেশের যেখানেই কামিং আউট করা হোক না কেন প্রথম প্রসঙ্গ আসবে ধর্ম। আমি ধর্মের বিরোধিতা করছি না। যার ভাল লাগবে সে ধর্ম পালন করুক। কিন্তু ধর্মান্ধ যেন না হয়। আর ধর্মের অপব্যবহার যেন না হয়।.
পরিবার
বাংলাদেশে পরিবারের কাছে কামিং আউট করবে কি করবে না তা আসলে সেই পরিবারের সমকামিতার প্রতি কি দৃষ্টি ভঙ্গী এবং নিজের আর্থিক অবস্থার কথা চিন্তা করে করা উচিৎ। এমন অনেক পরিবার আছে যাদের বাবা,মা খুব ধার্মিক হয়। যেহেতু কোন ধর্মে সমকামিতা কে ভাল বলা হয় নি সেখানে ধার্মিক পরিবারের মানুষরা কোন ভাবেই সমকামিতা কে মানতে পারে না। তাই কামিং আউটের পর এমনও হয় যে বাবা মা বা ভাই সারা দিন শুধু ধর্মের বানী শুনাতে থাকে। সমকামিতা কত বড় ধরণের অপরাধ তা বিস্তারিত বর্ণনা করে। এছাড়া নামাজ রোজা করার জন্য ও চাপ দিতে থাকে। কেউ কেউ সন্তান কে শারীরিক ভাবেও অত্যাচার করে। নিজের উপার্জন না থাকলে বাড়ি থেকে চলে যাবার অপশন থাকে না।
আবার যারা ধার্মিক না তাদের সবাই যে মেনে নেয় তা নয়। সমাজের কাছে সমকামিতা বড় অপরাধ। কেউ জেনে গেলে পরিবারের উপর কলঙ্ক পড়বে।বাবা মা কাউকে মুখ দেখাতে পারবেনা এই চিন্তা থেকেও তারা সন্তান কে সমকামিতা থেকে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করে। আবার যেই পরিবারে একটা মেয়ে সন্তান থাকে তার বিয়ে কিভাবে দিয়ে সেই চিন্তা মাথায় থাকে। কারণ আমাদের সমাজে কেউ যদি জানে পাত্রীর ভাই সমকামি তাহলে বিয়ে ভাঙ্গার যথেষ্ট সম্ভবনা থাকে।
বন্ধু
বন্ধুদের কাছে কামিং আউট করার আগে তাদের দৃষ্টিভঙ্গি কেমন তা জেনে রাখা ভাল। কারণ অল্প বয়সে কামিং আউট করলে (যেমন স্কুল বা কলেজ) বন্ধুদের বুলিং এর শিকার হতে হবে। কারণ তখনো তারা এই জিনিসটা মেনে নেয়ার মত ম্যাচুরিটি অর্জন করতে পারে নাই। এমন কি তার সাথে কেউ বন্ধুত্ব করতে চাইবে না এমন হতে পারে। স্কুলে আমার এক নাস্তিক সহপাঠী ছিল। তাকে এই সমস্যায় পড়তে দেখেছি যখন সে সবার সামনে বলল যে সে নাস্তিক। তবে একটা ম্যাচিউরড বয়সে পৌঁছে যাবার পর অনেকে মেনে নেয় এবং বন্ধুত্বে তেমন কোন ছাপ ফেলে না। আবার অনেক মেনে নিতে পারে না। তাই একটা বয়সে আসার পর যার সাথে সাচ্ছন্দে সব কথা বলা যায় তাদের সাথেই ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রাখা ভাল।
আত্মীয়স্বজন এবং প্রতিবেশী
সরাসরি কামিং আউটেরও দরকার নেই। কেউ একটু মেয়েলি হলেই তাকে নিয়ে সমালোচনার শেষ থাকে না। সেই ছেলের বাবা, মা কে বলা হয় , “ তোমার ছেলে তো মেয়েলি। নরম। সে তো একা একা জীবনে কিছুই করতে পারবে না। এই সব কথা বাবা মা কে কষ্ট দেয়ার জন্য বলে থাকে। তবে কোন আত্মীয় যদি গে ফ্রেন্ডলি হয় তার কাছে কামিং আউট করা যেতেই পারে।
আরেকটা ব্যপার আত্মীয় স্বজন করে থাকে তাহলে বিয়ের বয়স পার হয়ে যেতে থাকলে বিয়ে দিচ্ছে না কেন বা হচ্ছে না কেন তা নিয়ে গবেষণা। তখন বাবা মাও জোরাজুরি করে বিয়ের জন্য। অনেকে কামিং আউট করে। অনেকে বিয়ে করে ফেলে।
বাসস্থান
কামিং আউট করার আগে নিজের আর্থিক ক্ষমতা আর বাসস্থান নিয়ে ভাবা উচিত। একটা বিকল্প জায়গা যেখানে থাকা যাবে থাকলেই কামিং আউট করা সহজ হয়।আর ভাল হয় নিজের কর্মক্ষেত্র অন্য শহর বা দেশে হলে। আমার এক বন্ধু অস্ট্রেলিয়ায় থাকা অবস্থায় কামিং আউট করে। কিন্তু তার বাবা মা ফোনে ছেলে কে বুঝানো ছাড়া কিছুই করার ছিল না।আবার আরেক জন ঢাকায় পড়তো তাকে কামিং আউটের জন্য প্রচণ্ড মানসিক এবং শারীরিক অত্যাচার করা হয়। কিন্তু নিজের উপার্জন বা বাসস্থান থাকলে পরিবারের মানুষ জন অত্যাচার করার সুযোগ খুব একটা পায় না।
কর্মক্ষেত্র
আমি নিজেই কোন জরুরি প্রয়োজন ছাড়া কর্মক্ষেত্রে কামিং আউট করা টা বিপজ্জনক মনে করি। কারণ কলিগ দের সাথে দূরত্ব বাড়তে পারে। বস জানতে পারলে তার সাথে দুর্ব্যবহার করতে পারে। এত দিনে নিজের যে ইমেজ টা তৈরি করেছে তা আর থাকে না। প্রমশন আটকে যায়। কেউ কথা বলতে আসে না নিজের থেকে। আসলেও সমকামিতা নিয়ে নোংরা রশিকতা করে। এসবের কারণে অনেকে চাকুরীর উৎসাহ হারিয়ে ভাল।
আইন সালিস
বাংলাদেশে এখন ৩৭৭ ধারা রয়েছে। তা বলবৎ হয়নি। কবে হবে তাও জানি না। ২ জন সমলিঙ্গের মানুষ পরস্পর কে ভালবাসে। ভালবাসার মাঝে সেক্স করা অসম্ভব কিছু না। কিন্তু সেক্স প্রমাণিত হলে তাদের কে আইন অনুযায়ী শাস্তি দেয়া যায় । গ্রামে অনেক সময় পুলিশের কাছে না যেয়ে সালিস বসানো হয় । এই সালিস গুলো তে মানুষ প্রমাণের তেমন তোয়াক্কা করে না। আর ইচ্ছা মত ভয়ংকর শাস্তি দিয়ে থাকে। গ্রাম থেকে বের করে দেয়া, তাদের বাড়ি কে একঘরে করে ফেলা ইত্যদি
বিয়ে এবং ডিভোর্স
যারা প্রেশারে পরে বিয়ে করে তাদের মধ্য একটা বিরাট অংশ দ্বৈত জীবন যাপন করেন। তার উপরে সমকামীরা বিয়ের পর বিষণ্ণতায় আক্রান্ত হয়। কারণ একটা অন্য লিঙ্গের মানুষের সাথে দাম্পত্য জীবন কখনো সুখের হয় না। তার উপরে তারা নিজেদের দোষী মনে করে। এখন এই অনুভূতির জন্য কেউ যদি তার স্ত্রী বা স্বামীর কাছে কামিং আউট করে তাহলে ডিভোর্স , মামলা হবে। মানুষ জানবে। তাই বেশিরভাগ মানুষ ককক্ষনো কামিং আউট করে না বরং এই দুর্বিষহ জীবন বয়ে নিয়ে বেরায়।
চিকিৎসা
বহু আগেই আই সি ডি -১০ থেকে সমকামিতা কে অসুখের তালিকা থেকে বাদ দেয়া হয়েছে। তারপরও বাংলাদেশের কিছু কিছু চিকিৎসক সমকামিতা কে রোগ হিসেবে চিহ্নিত করে চিকিৎসা করতে চান। আর অভিভাবক রা তো অনেকেই জোর করে সন্তান কে সাইক্রিয়াটিস্ট এর কাছে নিতে চান। এবং অনেক সাইক্রিয়াট্রিস্ট এর কথা শুনেছি তারা যেখানে রোগীর সমস্ত ব্যাপার গোপন রাখার কথা তা না করে রোগীর অনুমতি ছাড়াই অভিভাবক দের বলে দেন। এবং আশ্বস্ত করেন চিকিৎসা করে ভাল করা যাবে। কিন্তু সবাই এমন নয়। গে ফ্রেন্ডলি চিকিৎসকও রয়েছেন। কিন্তু ঐসকল হোমোফোবিক চিকিৎসক দের ব্যাপারে শোনার পর অনেকেই কোন চিকিৎসকের কাছেই কামিং আউট করে না।
ব্যক্তিগত জ্ঞান
অনেকের সমকামিতা সম্পর্কে তেমন কিছু জানা নেই। কিন্তু তারা সমকামি । এবং তাদের যে বিপরীত লিঙ্গের প্রতি আকৃষ্ট না হয়ে নিজের লিঙ্গের মানুষের প্রতি আকৃষ্ট হচ্ছে এটা তাদের মাঝে ভীতি ঢুকিয়ে দেয়। তারা কাউকে শেয়ার করতে পারে না। যদি সবাই খারাপ ভাবে।
এছাড়া আরও প্রতিবন্ধকতা থাকতে পারে।আমি হয়তো মিস করে গিয়েছি। থাকলে এখানে কমেন্ট সেকশনে সেই ব্যাপার গুলো আলোচনা করা যেতেই পারে।
অরণ্য রাত্রি: নিজেকে লেখক বলবো না। এই যোগ্যতা আমার নেই। বলবো স্বপ্নচারী। আমার স্বপ্ন গুলো, কল্পনা গুলো নানা রঙে রাঙানো। কখনো নীল বেদনা আমাকে বেদনার্ত করে। কখনো লাল রঙের ভালবাসায় আবদ্ধ করে। কখনো রংধনু রঙে নিজের পরিচয় কে তুলে ধরি। আবার যখন কল্পনার জগৎ ছেড়ে এই বাস্তবতায় ফিরে আসি তখন মানুষের মন নিয়ে কাজ করি। আমি পেশায় চিকিৎসক এবং উচ্চশিক্ষা করছি মনঃচিকিৎসায়। বিচিত্র মানুষের মন।এই বৈচিত্র্য এবং কল্পনার মিশেলে তৈরি করি আমার খেরোখাতা।